ঢাকায় গেরিলা অপারেশন

1542

Published on ডিসেম্বর 9, 2021
  • Details Image

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান মিলিটারির নাকের ডগায় ঢাকা শহরে দুঃসাহসিক গেরিলা অপারেশন করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল ‘ক্র্যাক প্লাটুন’ নামে দুঃসাহসী তরুণ গেরিলাযোদ্ধার একটি দল। ১৭ তরুণের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে এই দলটি। স্বাধীনতাকামী বাঙালী জাতির মুক্তি এবং পশ্চিম পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে ঢাকায় চালিয়েছিলেন প্রথম গেরিলা যুদ্ধ ‘অপারেশন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল-হিট এ্যান্ড রান’। সম্বল মাত্র ১২টি হ্যান্ড গ্রেনেড। লক্ষ্য একটাই-ঢাকায় ত্রাস সৃষ্টি করা। বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিনিধিরা উঠবেন হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিরা যাতে বুঝতে পারেন যে, ঢাকা এখন আর পশ্চিম পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে নেই এবং বাংলার প্রতিটি মানুষ পাকিস্তানীদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে।

৯ জুন ১৯৭১, সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা। অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে ধীরে ধীরে। নীরবতা ভেদ করে পুলিশের গাড়ির সাইরেন বেজে উঠল। ময়মনসিংহ রোড ধরে পুলিশের গাড়ির পেছনে আসছে আরও তিনটি গাড়ি। মুক্তিযোদ্ধাদের ছোড়া গ্রেনেডে প্রকম্পিত হলো পুরো এলাকা। এক এক করে ফাটতে থাকল গ্রেনেড। বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিনিধিদের বহনকারী গাড়িটি লাফিয়ে উঠল শূন্যে। একদিকে আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য, অন্যদিকে দেশের অত্যাচারিত নিপীড়িত জনগোষ্ঠী। পাকিস্তানীদের সশস্ত্র পাহারা ডিঙিয়ে শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে আক্রমণ চালিয়ে অক্ষত অবস্থায় ফিরে যাওয়াটা সত্যিই অকল্পনীয়। অপারেশন শেষে মিন্টো রোড ধরে ফেরার পথে সুগন্ধার পাশ দিয়ে বেইলী রোডে ঘুরিয়ে ডানদিকে জান্তা সরকারের অন্যতম দৈনিক পত্রিকা মর্নিং নিউজ অফিসের সীমানা দেওয়ালের ওপর দুটো গ্রেনেড চার্জ করে। প্রচ- বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে আশপাশ। এরপর দ্রুত সেখান থেকে গাড়ি ঘুরিয়ে রমনা থানার পাশ দিয়ে মগবাজারের কাজী অফিসের পাশে জামায়াতের আমির গোলাম আযমের বাসভবনের ওপর দুটো গ্রেনেড চার্জ করে। গ্রেনেড দুটো গিয়ে বাড়ির ভেতরে আঘাত হানে। দ্রুতগতিতে সেখান থেকে গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে প্ল্যানমতো যে যার বাসায় চলে যান। মেলাঘরে ফেরার পর তারা এই অপারেশনের সাফল্য সম্পর্কে জানতে পারেন। বিবিসি এবং অল ইন্ডিয়া রেডিও এই অপারেশনের খবর প্রচার করে। হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে আক্রমণ বিশ্ববাসীকে স্তম্ভিত করে দেয়। এই অপারেশনের উপরেই নির্ভর করছে ঢাকায় গেরিলা ওয়ারের ভবিষ্যত।

১৬ জুলাই রাত ৯টায় ক্র্যাকপ্লাটুনের ৬ জন গেরিলা রামপুরায় অবস্থিত শহরের সবচেয়ে বড় পাওয়ার স্টেশন উড়িয়ে দেয়ার কাজ শুরু করে। তারা সঙ্গে করে নিয়েছিলেন ২০ পাউ- প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ, ডেটোনেটর এবং ফিউজ। অল্প কয়েকজন গেরিলা যোদ্ধা খুব ভালভাবে অপারেশনটি সম্পন্ন করে। পাওয়ার স্টেশনের গেটে পৌঁছে তারা বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে পুলিশ এবং গার্ডদের রাইফেল ফাঁকি দেয়। একই সময় একজন কমান্ডো টেলিফোন লাইন বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ১৭ জন পুলিশকে বন্দী করে এবং অপারেটরকে বাধ্য করে তাদেরকে ট্রান্সফর্মার রুমে নিয়ে যেতে। ট্রান্সফরমার রুমে গেরিলারা এক্সপ্লোসিভ বসিয়ে ট্রান্সফরমার উড়িয়ে দেয়।

পাকিস্তানীদের গণহত্যা শুরুর পর ঢাকা ফার্মগেটে একটি চেকপোস্ট স্থাপন করেছিল সেনাবাহিনী। সে সময় নির্মাণাধীন আনন্দ সিনেমা হলের উপরে ছিল মেশিনগান। সেখান থেকে সোজা বরাবর সামনে ট্রাফিক আইল্যান্ডে তাঁবু খাটানো ফার্মগেট চেকপোস্ট। ৮ আগস্ট, সন্ধ্যা ৭.১৫ গেরিলারা ১৯৬৫ মডেলের একটি ‘মেটালিক গ্রিন’ টয়োটা সেডান গাড়িতে করে অভিযানে বের হয়। গাড়ি তেজকুনিপাড়ার বেশ কিছু রাস্তা ঘুরে হলিক্রস স্কুল পেরিয়ে ফার্মগেটের মুখে থামল। ড্রাইভিং করছিলেন সামাদ। পাশে জুয়েল, পেছনে বদিউল আলম, হাবিবুল আলম, পুলু, আর স্বপন। বদিউল আলম ক্ষিপ্র গতিতে গাড়ি থেকে নেমে এলেন। একই সঙ্গে বাকিরাও। চোখের পলকে অবস্থান নিতেই গর্জে উঠল পাঁচটি স্টেনগান ও এলএমজি। প্রায় সোয়া মিনিট স্থায়ী এ অভিযানে, গেরিলাদের ব্রাশফায়ারে মুহূর্তের মধ্যে পাঁচ পাকিস্তানী সেনাসদস্য মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। নিহত হয় ছয় দেশীয় বেঈমান রাজাকার। ক্যান্টনমেন্টের এত নিকটে এমন দুর্ধর্ষ গেরিলা অভিযান খোদ পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর কাছেই ছিল অবিশ্বাস্য। এই অপারেশন ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল পুরো ঢাকায়। নতুন উদ্যম যোগ করেছিল গোটা দেশের মুক্তিকামী মানুষের মনে।

১১ আগস্ট মুক্তিবাহিনীর দুঃসাহসী গেরিলা যোদ্ধারা ঢাকার বিলাসবহুল হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে টাইম বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে আমেরিকার টাইমস পত্রিকার সংবাদদাতাসহ ২০ জন পাকসেনা গুরুতর আহত হয়। ঢাকা ইন্টার কন্টিনেটালে দ্বিতীয় দফার মারাত্মক বিস্ফোরণ ঘটানোর নেপথ্যে মূল নায়ক ছিল ১৮ বছর বয়সী এক তরুণ, ক্র্যাক প্লাটুনের সর্বকনিষ্ঠ গেরিলা মোহাম্মদ আবু বকর। ঢাকা ইন্টার কন্টিনেন্টালে তার সেই দুঃসাহসিক এ্যাকশনের খবর বিশ্ব গণমাধ্যমে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানী মিলিটারিদের দাম্ভিকতার। ঢাকাকে তারা সবচেয়ে বেশি সুরক্ষিত করে রেখেছিল। ১৮ বছর বয়সী এক বাঙালী তরুণ সেই দাম্ভিকতাকে গুঁড়িয়ে দিয়ে ওদের সবচেয়ে নিরাপত্তাবেষ্টিত জায়গায় হামলা চালিয়ে স্বগৌরবে বের হয়ে এসেছিলেন। এর মাধ্যমে সারা বিশ্ব জেনে যায় গেরিলারা এখন ঢাকা শহরের ভিতর তৎপর।

৩০ আগস্ট ভোর ৫-৬টায় ৮ জনের পাকবাহিনীর একটি দল আকস্মিভাবে এলিফ্যান্ট রোডের ৩৫৫ নম্বর বাড়ি ‘কনিকা’ ঘিরে ফেলে। তারা সামাদ ও আলতাফকে নিয়ে বাড়ির পিছনে টিউবওয়েলের পাশে খোঁড়াখুঁড়ি করে বড় এক ট্রাঙ্ক অস্ত্র পায়। পরে রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে পাকসেনারা বদিউল আলম বদি, তপন, শাফী ইমাম রুমি, আলতাফ মাহমুদ, হাফিজুর রহমান হাফিজ, মাগফার চৌধুরী আজাদ, মোহাম্মদ আবু বকরসহ ১১ জনকে ধরে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়। তারা কর্নেল বশীর এর নিয়ন্ত্রণে উপসামরিক আইন প্রশাসকের হেফাজতে ছিলেন। নাখালপাড়া ড্রাম ফ্যাক্টরিসংলগ্ন এমপি হোস্টেলের বদ্ধ কামরায় অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে ৮ জনকে হত্যা করা হয়। আটককৃতদের ১১ জনের মধ্যে তিনজন জীবিত ফিরে আসতে সক্ষম হন। নাসের বখতিয়ার নামে আলতাফ মাহমুদের এক প্রতিবেশীও তাদের সঙ্গে আটক হয়েছিলেন। আরও দুয়েকজন আটক হয়েছিলেন। এদের মধ্যে আলতাফ মাহমুদের এক ভগ্নিপতি ছিল। গাড়িতে জায়গা না হওয়ায় ভগ্নিপতি ও অপর দু’জনকে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল।

৩৭০ নম্বর আউটার সার্কুলার রোডের বাসায় থাকতেন আলতাফ মাহমুদ। গেরিলাদের দুর্গ হিসেবে পরিচিত ছিল তার বাড়িটি। ঢাকা শহরের অপারেশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তিনি। আলতাফ মাহমুদ নিজ দায়িত্বে সব গোলাবারুদ তার বাসভবনের আঙ্গিনায় কাঁঠালগাছের নিচে পুঁতে রাখেন। দিন কয়েক আগে ক্র্যাক প্লাটুনের সামাদ নামে একজন গেরিলা ধরা পড়েছিলেন। পাঞ্জাবি পুলিশ ও সেনাবাহিনীর হাতে অমানুষিক নির্যাতন সইতে না পেরে তিনি আলতাফ মাহমুদের বাসার কাঁঠাল গাছের নিচে লুকিয়ে রাখা গোলাবারুদের কথা বলে দিয়েছিলেন। ভোরে আর্মিরা প্রথমে আলতাফ মাহমুদকে ওই ট্রাংকভর্তি অস্ত্রসহ ধরে নিয়ে যায়।

ঢাকা শহরে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেবেশ ও গেরিলা আক্রমণ ঠেকানোর জন্য পাকসেনারা শহরের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য ক্যাম্প ও চেকপোস্ট বসিয়েছিল। বাসাবো এলাকায় এইরূপ একটি ক্যাম্পে একদল পাঞ্জাবি পুলিশ ও রাজাকার পাহারায় ছিল। ৯ সেপ্টেম্বর গেরিলাদের কয়েকজন সাধারণ বেশে ‘ভাল মানুষের মতো’ প্রতিদিন তাদের সঙ্গে আলাপ করতে করতে ভাব জমায়। ওইরূপ ৫ জন আলাপী গেরিলা বেলা ২টায় পুলিশ ও রাজাকারদের সঙ্গে দ্বিপ্রহরিক বিশ্রাম আলাপ জুড়িয়ে দেয় এবং সুযোগ বুঝে হঠাৎ এক সময় শত্রুদের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে গুলি চালাতে শুরু করে। আশপাশে লুকিয়ে থাকা গেরিলারাও শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই সংঘর্ষে ১১ জন পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ ও কয়েকজন রাজাকার নিহত হয়।

৪ অক্টোবর ঢাকায় বনানীস্থ নৌ-বাহিনীর সদর দফতরের কাছে গলফ স্কোয়ারে মুক্তিবাহিনীর গেরিলাযোদ্ধারা পাকবাহিনীর সহযোগী রাজাকারদের একটি দলকে অতর্কিত আক্রমণ করে। ৯ অক্টোবর মুক্তিফৌজ হেডকোয়ার্টার থেকে দুটি ৮১ এম-এম মর্টারসহ একটি ডিটাচমেন্ট টিম ঢাকায় পাঠানো হয়। মুক্তিফৌজের একটি দল হেডকোয়ার্টার থেকে ঢাকায় তাদের বেস স্থাপন করে। মুক্তিফৌজের রেকি দল বিমান বন্দর ও ক্যান্টনমেন্টের চতুর্দিকে অনুসন্ধান চালাবার পর বাড্ডার নিকট থেকে রাত ১টা ৪০মিনিটে মর্টারের গোলা নিক্ষেপ শুরু করে। ৬টি গোলা ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের একটি লাইনের মধ্যে পড়ে। এতে ১৪ জন পাকসেনা নিহত হয়। কয়েকটি গোলা বিমানবন্দরের নিকটে পড়ে কিন্তু কোন এয়ারক্রাফটের ক্ষতি সাধিত হয়নি। আরও কয়েকটি গোলা পাক টোব্যাকো কোম্পানির ফ্যাক্টরিতে পড়ে। এতে ফ্যাক্টরির বেশ ক্ষতি হয়। কয়েকটি গোলা মহাখালী হাসপাতালের নিকটে রাস্তায় পড়ে। এই অতর্কিত মর্টার আক্রমণের ফলে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। সেদিন পাকিস্তানীরা ভেবেছিল মুক্তিবাহিনী ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করেছে। সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানরত পাকসেনারা চতুর্দিকে দ্রুত বেরিয়ে পড়ে-স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র এবং ট্যাংকসহ গুলশান এবং ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় সারা রাত পাগলের মতো ছুটোছুটি করতে থাকে এবং গুলি চালায়। এভাবেই দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করে ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে বিজয়ের বন্দরে নোঙর করে বাংলাদেশ।

লেখক : গবেষক

সৌজন্যেঃ দৈনিক জনকণ্ঠ

(মতামত লেখকের নিজস্ব। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ-এর অফিসিয়াল ওয়েবসাইটের সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত