স্বাধীন বাংলাদেশকে নির্বাচিত নেতার হাতে রেখে চলে গেলো ভারতীয় সেনারা

1711

Published on ডিসেম্বর 2, 2021
  • Details Image

১৯৭১ সালে পাকিস্তানি জান্তারা যখন বাংলার আপামর জনতার ওপর গণহত্যা ও ধর্ষণের বর্বরতা চালাতে শুরু করে, প্রাণ বাঁচাতে প্রায় এক কোটি মানুষ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আশ্রয় নেয় ভারতে। আওয়ামী লীগ সরকার যেমন মিয়ানমারের সৈন্যদের হাতে নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক কারণে সীমান্ত খুলে দিয়েছিল, ঠিক তেমনি সেসময় আমাদের পূর্ব পুরুষদের প্রতি আরো অনেক বেশি মানবিকতা দেখিয়েছে ভারত সরকার। শুধু তাই নয়, অবশেষে ত্রিশ লাখ মানুষের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা অর্জনের পর, বাঙালি জাতির নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা নিশ্চিত করে, এই দেশ থেকে নিজেদের সৈন্য প্রত্যাহার করে নিয়েছে তারা। যুদ্ধজয়ের পর এতদ্রুত মিত্রবাহিনীর সৈন্যদের চলে যাওয়ার ঘটনা ইতিহাসে অদ্বিতীয়।     

এটি শুধু সম্ভব হয়েছে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের প্রতি ভারতবাসীর মনে পর্বতসম শ্রদ্ধা থাকার কারণে। মুক্তিযুদ্ধকালে বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে স্পষ্টভাবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে বিভিন্ন মন্তব্য করেছেন তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। ১৯৭১ এর নভেম্বর মাসে পাকিস্তানি জান্তারা ইন্দিরা গান্ধীকে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু তা প্রত্যাখান করে পাকিস্তানের জেলে বন্দি বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, 'ইয়াহিয়ার সঙ্গে আমার আলোচনার কিছু নেই। শেখ মুজিবের সঙ্গে আলোচনাই কার্যকর সমাধান হতে পারে। কারণ তিনিই বাঙালি জনগণের নির্বাচিত নেতা।'

এর আগে, ১৯৭১ সালের ১৩ মে, বিশ্বশান্তি সংঘের সম্মেলনে পাঠানো ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বার্তায় তিনি বলেন, 'বাংলাদেশের জনসাধারণের ন্যায্য দাবি, তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা তাদের দেশ শাসন করবেন। আশা করি, বিশ্বের মানুষ এই দাবি সমর্থন করবেন এবং তাদের অধিকার পুনরুদ্ধারের জন্য সচেষ্ট হবেন।'

বাংলার রণাঙ্গণে পাকিস্তানি সৈন্যরা যেমন গণহত্যা ও ধর্ষণ চালাচ্ছিল, তেমনি জেলের মধ্যে বঙ্গবন্ধুকেও হত্যার ষড়যন্ত্র করছিল তারা। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে, ২১ অক্টোবর এক যুক্ত বিবৃতিতে পাকিস্তানকে সাবধান করে দেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি গান্ধী ও যুগোশ্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট জোসেফ টিটো।

মুক্তিযোদ্ধা ও অসহায় বাঙালি জাতির পাশে দাঁড়ানোর কারণে ৩ ডিসেম্বর ভারতেও বোমা হামলা চালায় পাকিস্তানি জান্তারা। এরপর ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ভারত এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থনে নিজেদের সৈন্যদের যুদ্ধে নামায়।  

১০ ডিসেম্বর দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে শ্রীমতি গান্ধী বলেন, 'ভারত তখনই পুরোপুরি বিজয়ী হবে, যখন বাংলাদেশ ও তার নেতারা মুক্ত হবে। মাতৃভূমি বাংলাদেশে ফিরে গিয়ে সরকার গঠন করবে। এককোটি শরণার্থী ভারত থেকে স্বাধীন সার্বভৌম স্বদেশে ফিরে যাবে।'

১৬ ডিসেম্বর বিকালে, মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সেনাদের নিয়ে গঠিত মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। সেদিনই বিকাল সাড়ে ৫টায় ভারতের লোকসভা ও রাজ্যসভায় শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বলেন, 'আমরা বাংলাদেশের জনগণকে তাদের এই বিজয়লগ্নে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। আমরা বিশ্বাস করি, এই নতুন দেশের জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান তার জনগণের মধ্যে যথাযোগ্য স্থান গ্রহণ করে বাংলাদেশকে শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যাবেন।'

ভারতের জনগণ ও সরকার তাদের কথা রেখেছিল। পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্র ছিন্ন করে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফেরেন বঙ্গবন্ধু। এরপর মাত্র তিন মাসেরও কম সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ ত্যাগ করে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সেনারা। পৃথিবীর ইতিহাসে এরকম ঘটনা বিরল।

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত