1036
Published on আগস্ট 5, 2021তোফায়েল আহমেদ:
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দের ৫ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। আজ তার ৭৪তম জন্মদিন। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে শেখ কামাল দ্বিতীয় ছিলেন। তিনি শাহীন স্কুল থেকে ম্যাট্রিক, ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
ছাত্রলীগের একনিষ্ঠ কর্মী ও সংগঠক হিসেবে ৬ দফা ও ১১ দফা আন্দোলন এবং '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে শেখ কামাল সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। আমার স্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠে '৬৯-এর অগ্নিঝরা গণআন্দোলনের স্মৃতি। যে আন্দোলনে শেখ কামালের প্রতিদিনের উপস্থিতি ছিল সবার জন্য তুমুল উৎসাহব্যঞ্জক। ওই আন্দোলনে ঢাকা কলেজের ছাত্রদের সংগঠিত করে মিছিলসহ বটতলায় সমবেত হতেন। আমার পরম স্নেহভাজন ছিলেন শেখ কামাল। মনে পড়ে, '৬৯-এ পাকিস্তান সামরিক জান্তা সরকার ধর্মীয় উগ্রতার পরিচয় দিয়ে রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করে। শেখ কামাল তখন রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীদের সংগঠিত করেন এবং রবীন্দ্রনাথের 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি' গানটি খ্যাতিমান শিল্পী জাহিদুর রহিমকে দিয়ে বিভিন্ন সভা ও অনুষ্ঠানে গাওয়ানোর উদ্যোগ নেন। সংস্কৃতিবান শেখ কামালের প্রতিবাদের ভাষা ছিল রবীন্দ্রসংগীত। মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক হিসেবে ছাত্রসমাজকে সংগঠিত করে হাতিয়ার তুলে নিয়ে দেশমাতৃকার মুক্তির যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানীর এডিসি ছিলেন শেখ কামাল। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলকে সংগঠিত করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তার আশাবাদ ছিল, দেশ স্বাধীন হলে বাংলাদেশের ক্রীড়াক্ষেত্রের ছবিটাই পাল্টে দেবেন এবং দেশকে অনন্য উচ্চতায় আসীন করবেন। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া দেশ পুনর্গঠনে নিজের অসামান্য মেধা ও অক্লান্ত কর্মক্ষমতা নিয়ে জাতির পিতার আদর্শ বুকে ধারণ করে ঝাঁপিয়ে পড়েন শেখ কামাল।
স্বাধীন বাংলাদেশের ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে শেখ কামালের অবদান অনস্বীকার্য। তিনি ছায়ানট থেকে সেতার শিক্ষার তালিম নেন। পড়াশোনা, সংগীতচর্চা, অভিনয়, বিতর্ক, উপস্থিত বক্তৃতা থেকে শুরু করে বাংলা ও বাঙালির সংস্কৃতিকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরার চেষ্টায় সদাসর্বদা নিয়োজিত ছিলেন শেখ কামাল। স্বাধীনতার পর শেখ কামাল তার বন্ধুদের সহযোগে প্রতিষ্ঠা করেন নাট্যদল 'ঢাকা থিয়েটার' এবং আধুনিক সংগীত সংগঠন 'স্পন্দন শিল্পীগোষ্ঠী'। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যাঙ্গনে তিনি ছিলেন সুপরিচিত সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়াসংগঠক এবং অভিনেতা। আবাহনী ক্রীড়াচক্র প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি দেশের ক্রীড়াজগতে স্মরণীয় হয়ে আছেন। 'স্পন্দন শিল্পীগোষ্ঠী'র প্রতিষ্ঠাও তাকে অমরত্ব দান করেছে। প্রকৃতপক্ষে শেখ কামাল ছিলেন একজন ক্রীড়া ও সংস্কৃতিমনা সুকুমার মনোবৃত্তির মানুষ। তিনি কখনও ব্যবসায়িক কার্যকলাপে জড়িত হননি, অনর্থক ছোটেননি অর্থের পেছনে। ক্রিকেট ছিল তার প্রিয়। তৎকালের অন্যতম উদীয়মান পেসার ছিলেন তিনি। 'আজাদ বয়েজ ক্লাব' তখন কামালদের মতো উঠতি প্রতিভাদের আশ্রয়স্থল। দেশ স্বাধীনের পর '৭২-এ 'আবাহনী সমাজকল্যাণ সংস্থা' প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংস্থার নামে সংগঠিত করেন ফুটবল দল 'ইকবাল স্পোর্টিং', আর ক্রিকেট, হকির দল 'ইস্পাহানী স্পোর্টিং'। পরে এসব দলের সমবায়ে নবোদ্যমে যাত্রা শুরু করে 'আবাহনী ক্রীড়া চক্র'। ফুটবল, ক্রিকেট, হকি এই খেলাগুলোতে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন ছিল কামালের। তার স্বপ্ন ছিল একদিন আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে বাংলাদেশ হবে অপরাজেয় অপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্রীড়াশক্তি।
শেখ কামালের নবপরিণীতা সুলতানা খুকু ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। দেশজোড়া খ্যাতি ছিল তার। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তার পরিচিতি ছিল এক প্রতিভাবান অ্যাথলেট হিসেবে। '৭৫-এর ১৪ জুলাই যেদিন গণভবনে শেখ কামাল ও শেখ জামাল দুই ভাইয়ের বিয়ে হয়, সেদিন আমি সেই বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারিনি। কেননা ওই বছরের ১১ জুলাই আমার বড় ভাই পিজি হাসপাতালে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) মৃত্যুবরণ করেন। আমি তখন ভোলায়। বিয়ের দিন ভোলার পুলিশ স্টেশনে ফোন করে বঙ্গবন্ধু আমার খবর নিয়েছিলেন। বলেছিলেন, 'জামাল-কামালের বিয়ের আসরে সবাই আছে। শুধু তুই নাই।' কত বড় মহান নেতা যে, আমার মতো ক্ষুদ্র কর্মীর কথাও সেদিন তিনি ভোলেননি। বিয়ের অল্প কিছুদিন পর ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫-এ সেনাবাহিনীর কতিপয় বিশ্বাসঘাতক উচ্ছৃঙ্খল সেনাসদস্যের হাতে পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মাতা বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ও দুই নববধূ, দুই ভাই শেখ জামাল, শেখ রাসেলসহ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নির্মম মৃত্যুকে বরণ করতে হয়।
শেখ কামালের আচার-আচরণ কেমন ছিল সে সম্পর্কে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য আবুল ফজল রচিত 'শেখ মুজিব : তাঁকে যেমন দেখেছি' নাতিদীর্ঘ এই গ্রন্থটির ৪৭-৪৮ এই দুই পৃষ্ঠাজুড়ে আছে একটি স্মৃতিচারণমূলক লেখা। তিনি লিখেছেন, '১৭ই মার্চ শেখ সাহেবের জন্মদিন। স্বাধীনতার পর ছাত্রলীগ প্রতিবছর এ দিনটি পালন করে থাকে। ১৯৭৪-এর অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হওয়ার জন্য ঢাকার ছাত্রলীগ আমাকে অনুরোধ জানায়। আমি রাজি হলাম, তবে দিনে দিনে ফিরে আসতে চাই এ শর্তে। তারা সেভাবে বিমানের টিকিট পাঠিয়ে দিয়েছিল। ... নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্য জিজ্ঞাসা করলাম : "তুমি ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে এসেছ? 'জি হ্যাঁ।' নম্রকণ্ঠে জবাব দিল ছেলেটি। ... হঠাৎ কৌতূহল হলো, জিজ্ঞাসা করলাম : তুমি কি করো? বললে : 'অনার্স পরীক্ষা দিয়েছি সোশিওলজিতে'। ঢাকা থেকে? 'জি হ্যাঁ।' শেখ সাহেবের সঙ্গে ছেলেটির দৈহিক সাদৃশ্য আমার মনে ধীরে ধীরে স্পষ্টতর হয়ে উঠেছিল। জিজ্ঞাসা করলাম : তোমার নাম। 'শেখ কামাল।' ও তুমি আমাদের শেখ সাহেবের ছেলে।" এই ছিলেন শেখ কামাল।
ঘাতকের বুলেট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করার মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল। ঘাতকেরা চেয়েছিল বাংলাদেশকে নেতৃত্বশূন্য করতে। তারা জানত জাতির পিতার সন্তানেরা মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের ধারক-বাহক। সে জন্য তারা শেখ কামাল, শেখ জামাল, শিশু শেখ রাসেল কাউকেই রেহাই দেয়নি। সেদিন জাতির পিতার দুই কন্যা বিদেশে থাকায় ঘাতকের বুলেট তাদের স্পর্শ করতে পারেনি। ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের পর '৮১তে আমরা দলীয় ও জাতীয় ঐক্যের প্রতীক জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনার হাতে শহীদের রক্তে ভেজা দলীয় পতাকা তুলে দিই। সেই পতাকা যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে হাতে তুলে নিয়ে জাতির পিতার আদর্শ সমুন্নত রেখে তিনি আজ দেশকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনকে বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে আসীন করার যে স্বপ্ন শেখ কামাল দেখতেন, সেই অসমাপ্ত কাজটিও সাফল্যের সঙ্গে করে চলেছেন।
লেখকঃ আওয়ামী লীগ নেতা; সংসদ সদস্য; সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।
সৌজন্যেঃ দৈনিক সমকাল