3381
Published on জুন 29, 2021মো. মোরশেদুল আলম:
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আনন্দধ্বনি জাগাও গগনে’ কবিতার কয়েকটি চরণ দিয়ে প্রবন্ধটি শুরু করতে চাই। তিনি লিখেছেন, ‘আনন্দধ্বনি জাগাও গগনে।/ কে আছ জাগিয়া পূরবে চাহিয়া,/ বলো ‘উঠ উঠ’ সঘনে গভীর নিন্দ্রাগমনে॥/ হেরো তিমিররজনী যায় ঐ, হাসে ঊষা নব জ্যোতির্ময়ী/ নব আনন্দে, নব জীবনে,/ ফুল কুসুমে, মধুর পবনে, বিহগ কলকূজনে॥/ হেরো আশার আলোকে জাগে শুকতারা উদয়-অচল-পথে,/ কিরণকিরীটে তরুণ তপন উঠিছে অরুণরথে/...ঐ দূর হয় শোক সংশয় দুঃখ স্বপনপ্রায়।/ ফেলো জীর্ণ চীর, পরো নব সাজ, আরম্ভ করো জীবনের কাজ/ সরল সবল আনন্দমনে, অমল অটল জীবনে॥’ ১৯৭১ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের উপ-প্রধান জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব ২০১০ সালে বাংলাদেশের একটি জাতীয় দৈনিকে লেখেন, ‘ভবিষ্যতের গর্ভে বাংলাদেশের জন্য কী অপেক্ষা করছে বলতে হলে আমি বিচক্ষণ নেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একটি প্রাণবন্ত জাতি ও দ্রুত বর্ধিষ্ণু অর্থনীতি দেখতে পাই। বাংলাদেশ একটি শক্তিশালী জাতি হিসেবে আবির্ভূত হয়ে ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৪৮তম অর্থনৈতিক শক্তি; অন্যদের অতিক্রম করে যেতে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে।’
বঙ্গবন্ধু সবসময় রাজনৈতিক স্বাধীনতার পাশাপাশি একটি সুখী-সমৃদ্ধ দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখতেন। তাঁর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে রাজনৈতিক মুক্তি দিয়েছেন, আর বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা দিয়েছেন অর্থনৈতিক মুক্তি। দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মানবসম্পদ উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন, শিশু ও মাতৃমৃত্যু হ্রাস, লিঙ্গবৈষম্য দূরীকরণ, গড় আয়ু বৃদ্ধিসহ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে। দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির উন্নয়ন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী ও মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদ দমনে দৃশ্যমান ভূমিকা আজ বিশ্বসমাদৃত। পরিবেশ সুরক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, বিনিয়োগ বিকাশ, শিক্ষা সহায়তা কর্মসূচি, কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্প, ডিজিটাল বাংলাদেশ, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, আশ্রয়ণ প্রকল্প, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ, একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্বপরিমণ্ডলে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণ, যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ অবকাঠামোগত উন্নয়নে এসেছে নতুন যুগ। স্বীকার করতে হবে, বর্তমান সরকারের টানা তিন মেয়াদে মুক্তিযুদ্ধের ধারায় দেশ ফিরে এসেছে। বঙ্গবন্ধুর খুনী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্ভব হয়েছে। দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় কূটনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান সুদৃঢ়। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাত মোকাবিলায় বাংলাদেশকে অনুসরণ করছে অন্যান্য দেশ। করোনা ভাইরাসের বৈশ্বিক অতিমারিতেও বাংলাদেশকে দাবায়ে রাখা যায়নি। বর্তমান সরকার এই অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছে। করোনা মোকাবিলার সক্ষমতায় বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম ও বিশ্বে বিশতম।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৮৮ ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক হলিস বি. শেনারি ১৯৭৩ সালে বলেছিলেন, বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ৯০০ ডলারে পৌঁছাতে সময় লাগবে ১২৫ বছর। কিন্তু স্বাধীনতার ৪০ বছরে ২০১১ সালে এদেশের মাথাপিছু আয় দাঁড়ায় ৯২৮ ডলারে। ২০২০ সালে তা ২০০০ ডলার ছাড়িয়েছে। করোনা মহামারির মধ্যে প্রায় সব দেশে যেখানে অর্থনীতি সংকুচিত হয়েছে, মাথাপিছু আয় কমেছে; সেখানে ২০২১ সালে বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় ২২২৭ ডলারে উন্নীত হয়েছে। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট দিয়েছে সরকার। ১৯৭৬ সালে অর্থনীতিবিদ জাস্ট ফালান্ড এবং জন রিচার্ড পারকিনসন বাংলাদেশ : দ্য টেস্ট কেস ফর ডেভেলপমেন্ট গ্রন্থে লিখেছিলেন, উন্নয়ন প্রত্যয়টি যদি বাংলাদেশে সফল হয়, তাহলে পৃথিবীর সব জায়গায় সফল হবে। উন্নয়নের ‘টেস্ট কেস’ নামে আলোচনায় আসা দেশটি সব বাধা পেরিয়ে এখন উন্নয়নের বিস্ময়কর রোলমডেল হিসেবে বিশ্বদরবারে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত। বাংলাদেশ এখন পৃথিবীর অন্যতম দ্রুততম অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দেশ। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অনন্য সব অর্জন নিয়ে ২০২১ সালে স্বাধীনতার ৫০ বছর উদ্যাপন করেছে প্রিয় বাংলাদেশ। ২০১৮ সালের আগস্টে ইমরান খান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অভিষিক্ত হওয়ার পর ঘোষণা করেছিলেন, দেশটিকে তিনি সুইডেনের মতো উন্নত দেশে পরিণত করবেন। তার সেই অতি উচ্চাভিলাষী মনোভাবের প্রতিক্রিয়ায় এক পাকিস্তানি সাংবাদিক টেলিভিশনের টকশোতে তাদের নবনিযুক্ত প্রধানমন্ত্রীকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য তিনি যাতে সুইডেনের দিকে না তাকিয়ে বাংলাদেশের উন্নয়ন মডেল অনুসরণ করেন। সেই সাংবাদিক আরও বলেছিলেন, খান সাহেব যদি দেশটির সকল সমস্যা দূর করতে আদৌ সমর্থ হন এবং প্রবৃদ্ধির হার ১০ শতাংশে উন্নীত করতেও পারেন, তাহলেও বাংলাদেশের সমকক্ষ হতে পাকিস্তানের দশ থেকে বারো বছর সময় লাগবে।
২০২১ সালের ৩ মার্চ ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল পত্রিকায় বলা হয়েছে, ‘দক্ষিণ কোরিয়া, চীন এবং ভিয়েতনামে বিভিন্ন পর্যায়ের সফল উন্নয়ন মডেলের নিকটতম প্রতিনিধি হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য একটা নাম।’ ২০২১ সালের ১০ মার্চ নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা প্রদত্ত ভাষ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাংকের হিসাবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সুষমভাবে বেড়েছে, বর্তমান অতিমারির আগে চার বছর ধরে দেশটির অর্থনীতি বৃদ্ধি পেয়েছে ৭ থেকে ৮ শতাংশ হারে, চীনের চেয়ে দ্রুতগতিতে। পত্রিকাটির মতে, বাংলাদেশের এই গোপন রহস্য হচ্ছে, শিক্ষা এবং বালিকারা। বাংলাদেশ যখন তাদের মেয়েদের শিক্ষিত ও ক্ষমতায়ন করেছে, সেই শিক্ষিত নারীরা পরিণত হয়েছে দেশের অর্থনীতির স্তম্ভে। পত্রিকাটি আরও বলছে, বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে দারিদ্র্য হ্রাস করার এক অনুপ্রেরণার কাহিনি হিসেবে অভিহিত করে। একসময় পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তাসনিম সিদ্দিকী এক নিবন্ধে লিখেছেন, বাংলাদেশের জনসংখ্যাধিক্য, দারিদ্র্য, রোগব্যাধি, ক্ষুধা এবং অবকাঠামোর অভাব যে কোনো সরকারের জন্য একটা ভীতিকর চ্যালেঞ্জ ছিল। কিন্তু বিস্ময়করভাবে দেশটির অর্থনীতি ভারত ও চীনকে পেছনে ফেলে গত বছর ৮ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি লাভ করেছে। রপ্তানি (২০১৮-১৯) চার হাজার কোটি ডলার ছুঁয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের তুলনা করে তিনি লিখেছেন, পাকিস্তান আজ কোথায় দাঁড়িয়ে? তিন-চার বছরের উচ্চ প্রবৃদ্ধির একটা আপাতদৃষ্ট চক্রের পর আমরা আবার আগের জায়গায়।...আমাদের রপ্তানি দুই হাজার ৫০০ কোটি ডলারে আটকে আছে। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক দেনা সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১৫০০ কোটি ডলারে নেমে এসেছে (সূত্র: স্টেটসম্যান, ২০ ডিসেম্বর ২০২০)।
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ, দারিদ্র্য পরিস্থিতি, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ বিভিন্ন কারণে স্বাধীনতার পরপর সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে ‘বাস্কেট কেস’ অর্থাৎ ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ আখ্যা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, দেশটি বৈদেশিক ঋণ ফেরত দিতে পারবে না। তার ধারণাও ভুল প্রমাণিত হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ পৃথিবীতে ঋণ পরিশোধে সফল দেশগুলোর অন্যতম। ২০২১ সালের ১০ মার্চ নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে নিকোলাস ক্রিস্টফ বাংলাদেশ প্রসঙ্গে লিখেছেন, ৫০ বছর আগে এই মাসে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি জন্ম নিয়েছিল জেনোসাইড, দারিদ্র্য ও ক্ষুধার মধ্যে। তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে দারিদ্র্য বিমোচনের উপায় জানতে বাংলাদেশের নিকট থেকে শিক্ষা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় জার্নাল ওয়ালস্ট্রিট লিখেছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে ‘তেজি ষাঁড়’। বিশ্বনেতাদের কারো কারো মতে, বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল; কারো মতে, অফুরন্ত সম্ভাবনার বাংলাদেশ। ওয়াশিংটন পোস্ট-এর ভাষ্যকার মাইক বার্ড লিখেছেন, একসময় দক্ষিণ কোরিয়াকে উন্নয়নের মডেল হিসেবে উদাহরণ দেওয়া হতো। এখন বাংলাদেশের উদাহরণ দেওয়া হয়।
স্বাধীনতার পূর্বের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, পঞ্চাশের দশকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গড় অর্থনেতিক প্রবৃদ্ধি ছিল ১.৯ শতাংশ। ওই সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রবৃদ্ধি ছিল ২.৭ শতাংশ। ষাটের দশকে এই ব্যবধান আরও বেড়ে যায়। স্বাধীনতার দশকে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ৩ শতাংশ। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা ৮.১৫ শতাংশে পৌঁছায়। বাংলাদেশ ছিল কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষিপ্রধান থেকে শিল্প ও সেবাপ্রধান অর্থনীতিতে উত্তরণের ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আধুনিকায়ন এসেছে। এখন জিডিপিতে কৃষির অংশ ১৩ শতাংশ। শিল্প এবং সেবার অংশ যথাক্রমে ৩৫ ও ৫২ শতাংশ। ১৯৭৫-৭৬ সালে বাংলাদেশ মাত্র ৩৮০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রপ্তানি ৪০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় প্রধান তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশের সাফল্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সবচেয়ে বেশি আলোচিত। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও উল্লেখযোগ্য হারে দারিদ্র্য হ্রাসে বাংলাদেশের অগ্রগতিকে সম্মান জানাতে ২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য বিমোচন দিবসে বাংলাদেশে এসেছিলেন বিশ্বব্যাংকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৩-৭৪ সালে বাংলাদেশে দারিদ্র্য পরিস্থিতির প্রথম হিসাব করা হয়। ওই সময় দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ৮২ শতাংশ। সর্বশেষ প্রকাশিত খানা আয় ও ব্যয় জরিপ অনুযায়ী ২০১৬ সালে দারিদ্র্যের হার দাঁড়ায় ২৪.৩ শতাংশ। ২০১৯ সালে দারিদ্র্যের প্রাক্কলিত হার ২০.৫ শতাংশ। গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুনের মতে, ‘স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের যাত্রা মসৃণ ছিল না। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ একটি দরিদ্র ও বৈচিত্র্যহীন অর্থনীতি হাতে পায়। আগে থেকেই এ অঞ্চলের অর্থনীতি ছিল কৃষিপ্রধান এবং উৎপাদনশীলতা ছিল খুব কম। শিল্প ও সেবা খাত ছিল খুব অনুন্নত। এর সঙ্গে ছিল দ্রুত বর্ধনশীল জনসংখ্যা এবং দুর্বল অবকাঠামো। এসব বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও বাংলাদেশ গত পাঁচ দশকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক অগ্রগতি অর্জন করেছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বিভিন্নভাবে জনগণের সামাজিক জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। দারিদ্র্য কমেছে উল্লেখযোগ্যহারে। মানুষের আয়ুষ্কাল অনেক বেড়েছে। আশির দশকের তুলনায় মাতৃমৃত্যুর হার কমেছে প্রায় ৪ গুণ এবং শিশুমৃত্যুর হার কমেছে প্রায় ৫ গুণ। এছাড়া আরও অনেক দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়েছে। ৫০ বছরে এসে দেশের এসব অর্জন অবশ্যই গৌরবের।’ বাংলাদেশ আজ দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিশ্বে ধান উৎপাদনে তৃতীয়, মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে চতুর্থ, সবজি উৎপাদনে চতুর্থ, আলু উৎপাদনে সপ্তম।
বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের শ্রেণীকরণে ২০১৫ সালের ১ জুলাই নিম্ন আয় থেকে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিতে ধারাবাহিক উন্নতির কারণে বাংলাদেশ এ তালিকায় আসে। ২০১৮ সালের মার্চ মাসে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি বাংলাদেশকে এলডিসি থেকে উত্তরণের যোগ্য বলে স্বীকৃতি দেয়। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ওই কমিটি বাংলাদেশকে উত্তরণের জন্য চূড়ান্ত সুপারিশ করে। মাথাপিছু আয়ের পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য সামাজিক সূচকে উন্নতি এবং অর্থনীতির সক্ষমতার বিচারে বাংলাদেশকে এলডিসি থেকে উত্তরণের যোগ্য বলে মনে করেছে জাতিসংঘ। ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে বের হয়ে ভারত, চীন, মালয়েশিয়ার মতো এলডিসি নয় এমন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যাবে বাংলাদেশ। ২০২০ সালে দ্য ইকোনোমিস্ট ৬৬টি সবল অর্থনীতির তালিকা প্রকাশ করে, যেখানে বাংলাদেশের অবস্থান নবম। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য বা এমডিজি’র অনেক সূচক অর্জন করে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি কেড়েছে বাংলাদেশ। এমডিজিতে ২০১৫ সালের মধ্যে দারিদ্র্যের হার কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি হারে কমাতে বাংলাদেশ সক্ষম হয়। এমডিজি অর্জনের জন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছে বাংলাদেশ। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অর্মত্য সেন তাঁর ভারত : উন্নয়ন ও বঞ্চনা গ্রন্থে লিখেছেন, বাংলাদেশ সামাজিক উন্নয়নের পথে দ্রুত এগিয়ে যাবে, এ কথা কেউ ভাবেনি। দেশ স্বাধীনের পর অনেকেই তখন বলেছিলেন, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। কেউ কেউ তাকে ‘বাস্কেট কেস’ বলে খরচের খাতায় ফেলে দিয়ে বলেছিলেন, এ দেশকে কোনো অর্থনৈতিক সাহায্য দেয়াই উচিত নয়। কারণ, সে জনসংখ্যা বিস্ফোরণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খাদ্য উৎপাদন করে উঠতে পারবে না। তিনি আরও বলেছেন, জীবনমানের নানা সুপ্রচলিত মাপকাঠিতে বাংলাদেশ কেবল ভারতের চেয়ে অনেক ভালো করছে না, অনেকটা এগিয়েও গেছে। অনেক সামাজিক সূচক, যেমন: গড় আয়ু, শিশুমৃত্যুর হার, টিকা দেওয়ার মাত্রা, সনাতন প্রজননের হার এবং এমনকি স্কুলশিক্ষার কিছু মাপকাঠিতে বাংলাদেশ ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। তিনি তাঁর সুযোগ্য ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যকে জয় করে দেশের জনগণকে অর্থনৈতিক মুক্তি প্রদান করার মাধ্যমে বিশ্বসভায় বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিকে উন্নয়নশীল এবং মর্যাদাবান জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সত্যিকার অর্থেই বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার সুযোগ্য, সুদক্ষ, দূরদর্শী, সাহসী এবং সৃজনশীল নেতৃত্বে অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় এগিয়ে চলছে প্রিয় বাংলাদেশ ।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।