৭২ বছরের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি

1082

Published on জুন 23, 2021
  • Details Image

ড. মুনাজ আহমেদ নূরঃ

তথাকথিত তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে বাংলাদেশ আজ আঞ্চলিক শক্তি এবং মানবিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়েছে। নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে আমরা এখন বিভিন্ন দেশকেও সহায়তা করতে পারছি। সম্প্রতি ঋণগ্রস্ত শ্রীলঙ্কাকে উদ্ধারে ২০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ সহায়তা দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। দারিদ্র্য মোকাবেলায় সুদানকে ৬৫ কোটি টাকা ঋণ সহায়তা এবং রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। পাকিস্তান এবং ভারতকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় এখন ২২২৭ ডলার। এই রূপান্তর সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু এবং শেখ হাসিনার অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে। এ কারণেই আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা ছিল বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি আমরা ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশে পৌঁছাতে চাই তাহলে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরের বছরই ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের এ্যাসেম্বলি হলে ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা করেন। ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার পরের বছর ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেন।

স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে একটি ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলায় রূপান্তরের স্বপ্ন দেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তান কারাগার থেকে দেশে ফিরেই বঙ্গবন্ধু দ্রæত যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠন শুরু করেন এবং সফলভাবে অর্থনৈতিক ও অর্থনীতির বাইরের উভয় খাতের গভীরে প্রথিত বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের মাধ্যমে এদেশের প্রত্যেক মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে বিদ্যুত, কৃষি ও সমবায়, শিল্প ও বিজ্ঞান, গৃহনির্মাণ, অর্থনীতি ও বাণিজ্য ব্যবস্থাপনা, শিল্প ব্যবস্থাপনা জাতীয়করণ, শিক্ষা ও সংস্কৃতি, প্রযুক্তি, ভ‚মি ব্যবস্থাপনাসহ নানা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করেছিলেন। ১৯৬৯ সালে ইন্টারনেটের আবিষ্কার বিশ্বে ডিজিটাল বিপ্লবে এক নতুন মাত্রা যোগ করে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি হয়ে ওঠে উন্নয়নের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি। বঙ্গবন্ধু তাই ডিজিটাল বিপ্লবে শামিল হওয়ার দূরদর্শী চিন্তা থেকে সদ্য স্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সম্প্রসারণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এজন্য প্রথমেই তিনি ১৯৭৩ সালের ৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশকে আইটিইউর সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেন। স্যাটেলাইট স্থাপন করার লক্ষ্যে ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন রাঙ্গামাটির বেতবুনিয়ায় তিনি দেশের প্রথম উপগ্রহ ভ‚-কেন্দ্রের উদ্বোধন করেন। বঙ্গবন্ধু গৃহীত ও বাস্তবায়িত উদ্যোগগুলোই ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের মূল প্রেরণা। প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার আধুনিক রূপ আজকের এই ডিজিটাল বাংলাদেশ।

স্বাধীনতাবিরোধীদের হাতে পুরো পরিবারকে হারিয়ে ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ এই ছয় বছর প্রবাসে নির্বাসিত ও কষ্টের জীবন কাটাতে হয় বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যার দেশে ফেরা ছিল নিষিদ্ধ। ১৯৮১ সালে ফেব্রæয়ারির ১৪, ১৫ ও ১৬ তারিখে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। একই বছরের ১৭ মে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে দেশে ফেরেন শেখ হাসিনা। দেশে ফেরার পর থেকেই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে সঙ্গে নিয়ে নিরলসভাবে দেশের মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। দীর্ঘ একুশ বছর পর ১৯৯৬ সালে দলকে সরকারে আনেন তিনি। দেশে গণতন্ত্র পুনর্প্রতিষ্ঠিত করেন।

২০০৯ থেকে বর্তমান পর্যন্ত টানা এক যুগ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সুযোগ্য পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রবেশ করেছে ইতিহাসের এক স্বর্ণযুগে। ২০০৯ থেকে ২০২১ এই একযুগে বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে বিশ্বের বিস্ময়, উন্নয়নের রোল মডেলে। ডিজিটাল বাংলাদেশের চার স্তম্ভ কানেক্টিভিটি ও ইনফ্রাস্ট্রাকচার, দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়ন, ই-গবর্নমেন্ট এবং আইসিটি ইন্ডাস্ট্রি প্রমোশন ঘিরে নেয়া অধিকাংশ উদ্যোগের বাস্তবায়ন করা হয়েছে। যার ফলে দেশে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির অভ‚তপূর্ব সম্প্রসারণ ঘটেছে। দেশের প্রায় সকল ইউনিয়নকে এখন ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট কানেক্টিভিটির আওতায় আনা হয়েছে। ২০১৮ সালের ১২ মে মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ করা হয়েছে। যার মাধ্যমে বাংলাদেশ স্যাটেলাইটের এলিট ক্লাবের সদস্য হয়। এর মাধ্যমে দুর্গম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেট সেবা দেয়া হচ্ছে। বিশ্বে ৫জি নেটওয়ার্ক চালুর প্রথম দিকে বাংলাদেশেও তা চালু করার ঘোষণা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়। ইতোমধ্যে দেশে হুয়ায়ে এবং টেলিটকের সহায়তায় ৫জি মোবাইল ডাটার টেস্ট রান চলছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের এমন অনেক অর্জন রয়েছে যা উল্লেখ করে শেষ করা যাবে না।

বাংলাদেশকে উন্নত বিশ্বে পৌঁছানোর জন্য কয়েকটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্ববপূর্ণ। তার মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে রাষ্ট্রের জনগণকে মানুষ হিসেবে সম্মান দেয়া, দ্বিতীয়ত কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করা, তৃতীয়ত একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজব্যবস্থা তৈরি করা এবং সর্বক্ষেত্রে আইনের শাসনের প্রসার ঘটানো। এই বিষয়গুলো যদি বাস্তবায়ন করা যায় তাহলে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠন করা সহজ হবে। শিক্ষায় বর্তমানে যে বাজেট তা দিয়ে জ্ঞানভিত্তিক সমাজব্যবস্থার দিকে যাওয়া সহজ হবে না। জ্ঞানভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থায় যদি যেতে হয় তাহলে শিক্ষা খাতে মোট বাজেটের ২০ শতাংশ অথবা ডিজিপির ০৪ শতাংশ ব্যয় করতে হবে, যা বঙ্গবন্ধু ৭০-এর নির্বাচন পূর্ববর্তী ভাষণে বলেছিলেন। তাই আজকের এই প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নিকট আমাদের প্রত্যাশা সেই জ্ঞানভিত্তিক সমাজব্যবস্থার জন্য শিক্ষা খাতে মোট বাজেটের ২০ শতাংশ অথবা ডিজিপির ০৪ শতাংশ যেন ব্যয় এবং প্রযুক্তি শিক্ষাকে উৎসাহিত করা হয়। কারণ প্রযুক্তি শিক্ষা এবং প্রযুক্তি পেশায় মানুষ ততদিন যাবে না যতদিন সমাজে সে মানুষ হিসেবে সম্মানিত না হবে।

লেখক : উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি

সৌজন্যেঃ দৈনিক জনকণ্ঠ

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত