“কতো নেছো, কতো দেবা, কবে যাবা?”

1669

Published on জুন 7, 2021
  • Details Image

জয়ন্ত বসাকঃ

‘‘আপন ধন পরকে দিয়ে / দৈবজ্ঞ মরে কাঁথা বয়ে“
(পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ, ১৯৫৭)।

পশ্চিম পাকিস্তানী আধিপত্যবিহীন একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র অর্জন ও অর্থনীতিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি সমাজ প্রতিষ্ঠাই ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমগ্র জীবনের সাধনা। ১৯৬৬ সালে সেই স্বাধীনতারই রূপরেখা প্রণয়ন করেন বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার ফসল, বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ৬ দফা দাবি উত্থাপনের মধ্য দিয়ে। কারণ বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন যে স্বায়ত্তশাসনের দাবি বেশিদিন স্থায়ী হবে না। তাই তিনি রাজনৈতিক মুক্তি অর্জন করতে ব্যবহার করলেন অর্থনৈতিক বৈষম্য নির্মূলের ছদ্মাবরণ। রাজনীতির সাথে ইতিহাসে এই প্রথমবারের মত একই মোহনায় এসে মিললো অর্থনীতির চোরাস্রোত। দ্বিজাতি তত্ত্বকে ঘায়েল করার জন্য বঙ্গবন্ধু বেছে নিলেন দ্বি-অর্থনীতির কৌশল। বঙ্গবন্ধু ছয় দফা সম্পর্কে বলতে গিয়ে সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হককে বলেছিলেন, “আমার দফা আসলে তিনটা। কতো নেছো (নিয়েছ), কতো দেবা (দিবে), কবে যাবা?” এই প্রবন্ধের আলোচনাও এগিয়ে চলবে বঙ্গবন্ধুর এই উক্তিকে পাথেয় করে।

কতো নেছো?

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, সামরিক ও সাংস্কৃতিক সকল ক্ষেত্রে আমাদের ন্যায্য অধিকার কেঁড়ে নিয়েছে পশ্চিম পাকিস্তান। প্রথম গণ-পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানের সদস্য সংখ্যা ছিল ৪৪; আর পশ্চিম পাকিস্তানের ছিল ২৮। বাঙালিরা চাইলেই গণতান্ত্রিক শক্তিতে ভোটের জোরে রাজধানী পূর্ব পাকিস্তানে স্থাপন করতে পারত, কারণ পাকিস্তানে বাঙালিরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। ভোটের জোরে বাঙালিরা শুধু বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে পারতো, কারণ পাকিস্তানে ৫৬% মানুষের মাতৃভাষা ছিল বাংলা। কিন্তু তা না করে বাঙালিরা বাংলার সাথে উর্দুকেও রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তান ইচ্ছা করলে ভোটের জোরে নিজেদের ইচ্ছামত শাসনতন্ত্র রচনা করতে পারতো। কিন্তু কোনো ক্ষেত্রেই পূর্ব পাকিস্তান সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগ নেয় নি। বরং সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভয় দূর করার জন্য, পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে সৌভ্রাতৃত্ব ও সমতা বিধানের জন্য বাঙালিরা সংখ্যাগুরু নীতি ত্যাগ করে সংখ্যাসাম্য নীতি গ্রহণ করেছিল। বাঙালিরা মুখ বুজে সব সৈহ্য করেছে। বঙ্গবন্ধু ৬ দফার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে লিখেছেন, “যেখানে যেখানে আমাদের দান করিবার আওকাৎ ছিল, আমরা দান করিয়াছি। আর কিছুই নাই দান করিবার। থাকিলে নিশ্চয় দিতাম।” বাঙালি তার উদারতা অপাত্রে দান করেছিল। তাই তাদের উপর জুলুম-অত্যাচার বন্ধ হয় নি। নিজেদের অধিকার লড়াই করে আদায় করতে হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানীরা শাসনের নামে আমাদের থেকে যা কিছু কেঁড়ে নিয়েছে তার সংক্ষিপ্ত খতিয়ান তুলে ধরা হলো।

স্বায়ত্তশাসনের অধিকারঃ ভারত বিভক্তি ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে। ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হয়। এই প্রস্তাবে বলা হয়, ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে যেসব স্থানে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেখানে “স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ” প্রতিষ্ঠা করা হবে। এ সকল স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্যগুলো হবে স্বায়ত্তশাসিত। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানকে কখনোই স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দেয়া হয় নি। প্রায় এক দশক কেটে যায় পাকিস্তানের প্রথম সরকার গঠন ও একটি কার্যকর সংবিধান প্রণয়ন করতে করতে।

যুক্তফ্রন্ট সরকার অকার্যকরঃ ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়ী হয়ে জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকার গঠন করলেও আদমজী পাটকলে বাঙালি-বিহারী সংঘর্ষ এবং আরো দু'একটি ঘটনার দোহাই দিয়ে ১৯৫৪ সালের ৩০ মে কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা বাতিল করে। মাত্র ৫৬ দিনের মাথায় যুক্তফ্রন্ট সরকারের পতন ঘটে।

গণতান্ত্রিক অধিকার হরণঃ ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি করা হয় যা জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার ক্ষুন্ন করে।মৌলিক গণতন্ত্রের নামে আইয়ুব খান জনগণের ভোটাধিকার ছিনিয়ে নেয়।১৯৪৭ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানে কোন জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি।এভাবে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী ১৯৬৬ সাল তথা স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে তাদের ন্যায়সঙ্গত রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে।

অর্থনৈতিক প্রবঞ্চনাঃ ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের সৃষ্টিলগ্ন থেকেই পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য বিরাজ করছিল, আইয়ুব খানের শাসনামলে এ বৈষম্য চরম আকার ধারণ করে। পাকিস্তানের প্রায় সকল ব্যাংক, বীমা ও অন্যান্য অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের হেড অফিস ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। সকল প্রকার আর্থিক লেনদেনের টাকা বালুচরে ঢালা পানির মত একটানে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যেত। বঙ্গবন্ধু তাঁর লেখায় এই অর্থনৈতিক বৈষম্য রূপকের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে, “বালুচরে পানির দরকার হইলে টিউবওয়েল খুদিয়া তলদেশ হইতে পানি তুলিতে হয়। অবশিষ্ট পানি তলদেশে জমা থাকে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রয়োজনীয় অর্থও তেমনি চেকের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তান হইতে আনিতে হয়। উদ্বৃত্ত অর্থ পশ্চিম পাকিস্তানে জমা থাকে। একারণেই পূর্ব পাকিস্তানের ক্যাপিটাল ফর্মেশন হইতে পারে নাই। ক্যাপিটাল ফর্মেশন পশ্চিমে হইয়াছে।” এই মুদ্রাপাচার ছাড়াও মুদ্রাস্ফীতির কারণে পূর্ববাংলায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম সাধারণের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছিল। পাট চাষিরা পাটের ন্যায্য দাম না পেয়ে হয়ে যাচ্ছিল সর্বহারা; অথচ তখন পূর্ব পাকিস্তানের রপ্তানি আয়ের সিংহভাগ আসতো সোনালী আঁশ পাট রপ্তানি করে।

রপ্তানি বাণিজ্যে শঠতাঃ পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বিদেশি মুদ্রায় পশ্চিম পাকিস্তানের বড় বড় শিল্প গড়ে উঠত এবং সেই শিল্পজাত দ্রব্য রপ্তানি করে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রাকে পশ্চিম পাকিস্তানের অর্জিত বিদেশি মুদ্রা বলা হত। ১৯৬০ পর্যন্ত রপ্তানি বাণিজ্যের মোট ৬০% আসতো পূর্ব পাকিস্তান থেকে, এই মুদ্রা ব্যয় করা হতো পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নের কাজে। বিদেশ থেকে আমদানিকৃত একই পণ্যের দামে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ছিল বিরাট ফারাক। পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বিদেশি মুদ্রার জোরে যে প্রচুর বিদেশী সাহায্য আসতো তাও পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় করা হতো। কিন্তু ঋণের সুদ বহন করতে হতো পূর্ব পাকিস্তানকে। কেন্দ্রীয় কোষাগারে পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় ২০০ কোটি টাকার বেশি বৈদেশিক মুদ্রা জমা দেয় অথচ কেন্দ্রীয় সরকার এ সময় প্রতিবছর প্রায় ৪০ কোটি টাকার বিদেশি দ্রব্য আমদানির ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানকে বঞ্চিত করতো।

অসামঞ্জস্যপূর্ণ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাঃ পাকিস্তানের সামরিক নৌ এবং বিমান বাহিনীর সদর দপ্তর ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। জাতীয় নিরাপত্তা বাহিনীতে পূর্ব বাংলার অধিবাসীদের অংশগ্রহণ ছিল নগণ্য। বিশেষত, ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তান সামরিকভাবে অরক্ষিত ছিল। শত্রুর উপর শত্রুর দয়া ও মর্জির ওপর বেঁচে থাকা যেন ছিল পূর্ববাংলার নিয়তি। পাকিস্তানের দুই অংশের প্রতিরক্ষা ব্যয়ে ছিল ব্যাপক বৈষম্য।

এছাড়া সরকারি চাকরিতে বৈষম্য এবং সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মত কারণগুলো তো ছিলই। জন্ম লগ্ন থেকেই পশ্চিম পাকিস্তান তার ভ্রাতৃপ্রতিম পূর্ব পাকিস্তান থেকে ছলে-বলে-কৌশলে বাঙালির সম্পদ, বাঙালির টাকা, বাঙালির রাজস্ব, বাঙালির স্বায়ত্তশাসনের অধিকার, বাঙালির ভোটাধিকার, বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার কেঁড়ে নিয়ে নিজেদের পাল্লা ভারী করেছে। এবার পশ্চিম পাকিস্তানের সময় এসেছে পূর্ব পাকিস্তানকে বিনিময়ে কিছু দেবার। যে অধিকার না চাইতেই পাওয়ার কথা ছিল, সেই অধিকার আদায় করতে বাঙালির অবিসংবাদিত মুখপাত্র হয়ে এগিয়ে এলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

কতো দেবা?

বহুকাল ধরে চলা অন্যায়, অবিচার ও বৈষম্যের শিকার বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত “ছয় দফা দাবি”” প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে নতুন দিক নির্দেশনা পেয়েছিল। আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী দলের সম্মেলন চলাকালে ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণা করতে গিয়ে ব্যর্থ হন। তাই তিনি এক সংবাদ সম্মেলন ডেকে ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন।১৯৬৬ সালের ২০ ফেব্রুয়ারী আওয়ামীলীগের ওয়াকিং কমিটির সভায় ছয় দফা প্রস্তাব এবং দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলনের কর্মসূচী গৃহীত হয়। ছয় দফা কর্মসূচির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সামনে তুলে ধরেন আমাদের এতদিনের পাওনা-গন্ডার হিসাব।

প্রথম দফাঃ ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করে পাকিস্তানকে একটি সত্যিকারের যুক্তরাষ্ট্র হিসেবে গঠন করতে হবে। এই যুক্তরাষ্ট্রের সরকার হবে পার্লামেন্টারি পদ্ধতির। প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচিত প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইনসভা হবে সার্বভৌম।

দ্বিতীয় দফাঃ কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকবে দেশ রক্ষা ও পররাষ্ট্র নীতি। অবশিষ্ট সকল বিষয় অঙ্গরাজ্য সমূহের ক্ষমতাধীন থাকবে। দেশের দুই অঞ্চলের জন্য সহজে বিনিময়যোগ্য দুটি মুদ্রা থাকবে। এ ব্যবস্থায় মুদ্রা লেনদেনের জন্য দুই অঞ্চলে দুটি স্বতন্ত্র স্টেট ব্যাংক থাকবে এবং মুদ্রা ও ব্যাংক পরিচালনার ক্ষমতা থাকবে আঞ্চলিক সরকারের হাতে। অথবা, দুই অঞ্চলের জন্য একই মুদ্রা থাকবে, তবে শাসনতন্ত্রে এমন ব্যবস্থা রাখতে হবে যাতে এক অঞ্চল থেকে মুদ্রা ও মূলধন অন্য অঞ্চলে পাচার হতে না পারে। এ ব্যবস্থায় পাকিস্তানি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে এবং দুই অঞ্চলের জন্য দুটি পৃথক রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে।

চতুর্থ দফাঃ সকল প্রকার ট্যাক্স, খাজনা ও কর আদায়ের ক্ষমতা থাকবে আঞ্চলিক সরকারের হাতে । আদায়কৃত করের একটি নির্দিষ্ট অংশ সঙ্গে সঙ্গে ফেডারেল তহবিলে জমা হবে। শাসনতন্ত্রের রিজার্ভ ব্যাংকসমূহের উপর এরূপ বিধান থাকবে।

পঞ্চম দফাঃ বৈদেশিক মুদ্রা ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রদেশগুলোর হাতে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা থাকবে। বৈদেশিক বাণিজ্য ও সাহায্যের ব্যাপারে প্রদেশগুলো যুক্তিযুক্ত হারে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা মেটাবে।

ষষ্ঠ দফাঃ আঞ্চলিক সংহতি ও জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার কার্যকর ব্যবস্থা হিসেবে প্রদেশগুলোকে নিজস্ব কর্তৃত্বাধীনে আধাসামরিক বাহিনী বা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠন ও পরিচালনা করার ক্ষমতা দেয়া হবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ‘৬ দফা কর্মসূচী’ পূর্ব পাকিস্তানের জেলায় জেলায় প্রচার করেন। আইয়ুবী সরকার মসনদ হারানোর ভয়ে ভীত হয়ে ছয় দফা প্রচার কালে ১৯৬৬ সালের ৮ মে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে। কিন্তু প্রাণপ্রিয় নেতার কারাবরণ বীর বাঙালিকে দামাতে পারেননি। ৬ দফা বাস্তবায়ন ও বঙ্গবন্ধুসহ আওয়ামী লীগের বন্দি নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবিতে আওয়ামী লীগ নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চালিয়ে যায়। ১৯৬৬ সালের ৭ই জুন আওয়ামী লীগের ডাকে ছয় দফা বাস্তবায়নের দাবিতে সারা দেশে হরতাল পালিত হয়। পুলিশ ও ইপিআর হরতালে নির্বিচারে গুলি চালায় ও লাঠিপেটা করে। টঙ্গী, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জে মনু মিয়া, শফিক, শামসুল হকসহ ১১ জন বাঙালি শহীদ হন। প্রায় আটশ আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ কর্মী এবং হাজারো নিরীহ মানুষকে গ্রেফতার করা হয়। এর পর থেকেই ৭ জুন ‘ছয় দফা দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।

কবে যাবা?

ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপ-এর পূর্ব পাকিস্তান প্রধান অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ শেখ মুজিবুর রহমানকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, "আপনি এই যে ৬ দফা দিলেন তার মূল কথাটি কী?" আঞ্চলিক ভাষায় এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন শেখ মুজিব: "আরে মিয়া বুঝলা না, দফা তো একটাই। একটু ঘুরাইয়া কইলাম।" এই ঘুরিয়ে বলা একটি দফাই হলো স্বাধীনতা। বহুকাল ধরে শোষিত, বঞ্চিত ও নির্যাতিত বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনের ইতিহাসে ছয় দফা ছিল একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। তাই একে ম্যাগনাকার্টার সাথে তুলনা করা হয়। ছয় দফা ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম বলিষ্ঠ প্রতিবাদ। পূর্ববাংলার হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান আপামর বাঙালি স্বতঃস্ফূর্তভাবে ছয় দফাকে সমর্থন জানায়। আমাদের প্রাণের দাবিকে দমিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে কঠোর দমননীতির প্রয়োগ করে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান সরকার। স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে কেন্দ্র করে নবজাগ্রত চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয় বাঙালি জাতি। মুদ্রা ব্যবস্থা, আঞ্চলিক মিলিশিয়া বাহিনী গঠন ভবিষ্যতে স্বাবলম্বী হওয়ার আকাঙ্ক্ষার পরিচয় বহন করে। ছয় দফা আন্দোলনে প্রথমবারের মতো ছাত্রদের পাশাপাশি বাংলার কৃষক ও শ্রমিকরা সাংগঠনিকভাবে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। ছয় দফা আন্দোলন ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের সম্ভাবনাকে ত্বরান্বিত করে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ছয় দফাকে সন্নিবেশ করা হয়। জনগণ তাই আওয়ামী লীগের পক্ষে ব্যালট বিপ্লব ঘটায়।

‘ছয় দফা’ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলতেন, “সাঁকো দিলাম, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতায় উন্নীত হওয়ার জন্য।” ছয় দফা দাবিতে পাকিস্তান হতে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার কোনো দাবি উল্লেখ ছিল না। শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির ন্যায্য অধিকার আদায়ের চেষ্টা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারী পাকিস্তান সরকার ছয় দফা দাবির অপব্যাখ্যা করে এবং বাঙ্গালিদের বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে আখ্যা দেয়। বাঙালির স্বায়ত্তশাসনের দাবি নস্যাৎ করে শাসকগোষ্ঠী আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের উপর জেল জুলুম সহ সকল প্রকার উৎপীড়নের পথ অবলম্বন করে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুকে এক নম্বর আসামী করে আন্দোলন দমনের চেষ্টা করে। এতে পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য হিতে বিপরীত হয়। ১৯৬৯ সালে আন্দোলন গণ অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে। সত্তরের নির্বাচনে জয়ী হয়ে বাঙালির স্বাধিকারের স্বপ্ন চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। কিন্তু নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পরও বাঙালির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় শুরু হয় পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলন, যা পরবর্তীতে সশস্ত্র আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে। ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু দিলেন স্বাধীনতার ঘোষনা। বাঙালির যা কিছু আছে তাই নিয়ে তারা ঝাঁপিয়ে পড়লো মুক্তির সংগ্রামে। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর বাঙালি লাভ করে তার বহুল কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। এভাবে ৬ দফা আন্দোলন স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে উপনীত করে বাঙালিকে।

ছয় দফা কর্মসূচি ছিল বঙ্গবন্ধুর ব্রেইনচাইল্ড। মূল দাবি গুলি বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার ফসল। বঙ্গবন্ধু দাবি আদায়ের শেষ দিন পর্যন্ত ছয় দফার সাথে কোন আপোষ করেননি। ছয় দফা উপস্থাপনের সময় বঙ্গবন্ধু বলেন, “ ছয় দফা হলো নিম্নতম কর্মসূচি। কোন আপোষ নাই।” স্বাধীনতা অর্জন রাতারাতি হয়ে যায় নি। সময়োপযোগী রাজনৈতিক কৌশল রচনা ও অবলম্বন এবং তার যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ধাপে ধাপে বাঙালি জাতিকে পৌঁছে দেন স্বাধীনতার সূর্যসোপানে। ঐতিহাসিক ছয় দফা তেমনি এক কৌশল। ছয় দফার প্রধান দুইটি দিক, একটি রাজনৈতিক, অপরটি অর্থনৈতিক। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন অর্থনৈতিক মুক্তিকে সামনে রেখে পরোক্ষ ভাবে চূড়ান্ত রাজনৈতিক মুক্তি আদায় করে নিতে। বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শিতা এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞার কাছে হার মেনেছে সকল ষড়যন্ত্র। ছেষট্টির ছয় দফায় বপিত স্বায়ত্তশাসনের আকাঙ্ক্ষার বীজ অঙ্কুরিত হয়েছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে।

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত