3064
Published on জুন 7, 2021মোঃ মোয়াজ্জেম হোসেন সম্রাটঃ
একটি গাভী সতেজ সবুজ ঘাস খাচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানে, আর সেই গাভীটির দুধ দোহন হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানে। পাকিস্তানে পূর্ব বাংলার মানুষ কীভাবে শোষিত-বঞ্চিত হচ্ছে, ছয় দফার প্রচারকালে এমন এক পোস্টারে তা প্রতীকী অর্থে দেখানো হয়েছিল।
ছয় দফা হলো নিষ্পেষিত ও নিপীড়িত বাঙালির পাকিস্তানি দুঃশাসন থেকে মুক্তিচেতনার বহিঃপ্রকাশ।সরাসরি যদিও স্বাধীনতার কথা বলা নেই, তবে ছয় দফা বাঙালিদের স্বাধীনতার স্বপ্নে উজ্জীবিত করে। কারণ ছয়দফার ভেতরে বাঙালির জাতীয় মুক্তির বীজ নিহিত ছিল।কালক্রমে ছয় দফাই হয়ে ওঠে বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ, বাঙালির ম্যাগনাকার্টা।
আজ ৭ জুন, ঐতিহাসিক ছয় দফা দিবস। ১৯৬৬ সালে আজকের দিনটা কেমন ছিল, দেখে আসি, বঙ্গবন্ধুর বয়ানে।
"সকালে ঘুম থেকে উঠলাম। কি হয় আজ? আবদুল মোলায়েম খান যেভাবে কথা বলছেন তাতে মনে হয় কিছু একটা ঘটবে আজ। কারাগারের দুর্ভেদ্য প্রাচীর ভেদ করে খবর আসলো দোকান-পাট, গাড়ি, বাস, রিকশা সব বন্ধ। শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল চলছে।............. জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালন করেছে। তারা ছয়দফা সমর্থন করে আর মুক্তি চায়, বাঁচতে চায়, খেতে চায়, বাকস্বাধীনতা চায়।শ্রমিকের ন্যায্য দাবি, কৃষকের বাঁচবার দাবি তারা চায়- এর প্রমাণ এই হরতালের মধ্যেই হয়ে গেল।"
(সূত্রঃকারাগারের রোজনামচা/ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান/ পৃষ্ঠা-৬৯)
ছয় দফার আত্মপ্রকাশ কেন অনিবার্য ছিলোঃ
১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রতারণায় সৃষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রে শুরু থেকেই অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা, প্রশাসনিক ও প্রতিরক্ষা খাতে বাঙ্গালিদেরকে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়।
সে সময় পূর্ব পাকিস্তান শতকরা ৬০-৭০ ভাগ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতো, যার মাত্র ২৫ ভাগ খরচ হতো পূর্ববাংলায়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে মাত্র ৬ ভাগ, নৌবাহিনীতে মাত্র ৮ ভাগ এবং বিমানবাহিনীতে মাত্র ১৬ ভাগ ছিল বাঙালি। উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তা ১০-১২ জনের বেশি ছিল না। আর পাকিস্তানের ১২৩ জন জয়েন্ট সেক্রেটারীর মধ্যে মাত্র ০৮ জন ছিল বাঙালি, কোন সচিব ছিল না। উন্নয়ন খাতে ১৯৬০ সাল থেকে ১৯৬৫-৬৬ সাল পর্যন্ত যেখানে তিন হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানে সেখানে পূর্ববাংলার জন্য খরচ করা হয়েছিল মাত্র ৯০০ কোটি টাকা।
পাকিস্তান রাষ্ট্র কর্তৃক পূর্ব বাংলার মানুষের উপর চরম বৈষম্যমূলক আচরণ ও ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ হিসাবে এবং ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত ১৭ দিনের যুদ্ধে পূর্ব বাংলার মানুষকে অরক্ষিত রেখেই পাকিস্তানের আত্মরক্ষার বৈমাত্রেয়সুলভ মনোবৃত্তি বাঙালির নিজের অস্তিস্ত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য ছয় দফার উন্মেষ অনিবার্য হয়ে ওঠে।
এরূপ পরিস্থিতিতে, ৫-৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৬ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লাহোরে ৬ দফা দাবি ঘোষণা করেন। ১১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৬ সালে লাহোর বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন," ছয় দফা বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ।" ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৬ বঙ্গবন্ধুর নামে "আমাদের বাঁচার দাবি - ছয় দফা" শীর্ষক একটি পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়।
কী ছিল ছয় দফায়ঃ
সহজ ভাষায় একবার ছয় দফা বুঝাতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর হাতের তিনটে আঙ্গুল দেখিয়ে বলেছিলেন, আমার আসলে তিন দফা। কত নিছো? কবে দিবা? আর, কবে যাবা?
১৯৬৬ সালের ৫–৬ ফেব্রুয়ারি পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোরে চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর বাসভবনে তাসখন্দ চুক্তির বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলোর এক কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়। ওই কনভেনশনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ঐতিহাসিক ছয় দফা কর্মসূচি উত্থাপন করেন:
দফা ১: লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তান হবে একটি ফেডারেশন বা যুক্তরাষ্ট্র। সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত আইন পরিষদের প্রাধান্যসহ সংসদীয় পদ্ধতির সরকার গঠনের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
দফা ২: বৈদেশিক সম্পর্ক ও প্রতিরক্ষা ছাড়া সকল বিষয় অঙ্গরাষ্ট্র বা প্রদেশের হাতে ন্যস্ত থাকবে। উল্লিখিত দুটি বিষয় ন্যস্ত থাকবে কেন্দ্রীয় বা যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের হাতে।
দফা ৩: পাকিস্তানের দুটি অঞ্চলের জন্য পৃথক অথচ অবাধে বিনিময়যোগ্য মুদ্রাব্যবস্থার প্রবর্তন করতে হবে। অথবা সমগ্র দেশে একটি মুদ্রাব্যবস্থা থাকবে, তবে সে ক্ষেত্র পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধন পাচার রোধের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ জন্য একটি ফেডারেল ব্যাংকের অধীনে কার্যকরী ব্যবস্থা থাকতে হবে।
দফা ৪: অঙ্গরাষ্ট্র বা প্রদেশগুলোর কর বা শুল্ক ধার্য করার ক্ষমতা থাকবে। তবে ব্যয় নির্বাহের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার এর একটি অংশ পাবে।
দফা ৫: পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পৃথক হিসাব রাখা হবে। অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা স্ব স্ব অঞ্চলের বা অঙ্গরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় সরকারের বৈদেশিক নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আঞ্চলিক সরকার বিদেশে বাণিজ্য প্রতিনিধি প্রেরণ এবং যেকোনো চুক্তি সম্পাদন করতে পারবে।
দফা ৬: নিজস্ব নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য অঙ্গরাষ্ট্রসমূহ প্যারামিলিশিয়া বা আধা সামরিক বাহিনী গড়ে তুলতে পারবে।
১৩ মার্চ, ১৯৬৬ আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটিতে 'ছয় দফা' অনুমোদিত হয় এবং ২৩ মার্চ, ১৯৬৬ বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিকভাবে ছয় দফা ঘোষণা করেন।
বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ও স্বাধীন বাংলাদেশের উন্মেষে ছয় দফাঃ
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতীয়তাবাদের সূচনা হলেও এর বিকাশ লাভ করে ছয় দফা দাবির আত্মপ্রকাশ ও পরবর্তীতে একে কেন্দ্র করে বাঙালির জাতীয় জীবনের নানা ঘটনাপ্রবাহ। মূলত ৬৬ থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত পাকিস্তানের রাজনীতির মূল নিয়ামক হয়ে উঠেছিল বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা এবং এর মাধ্যমেই বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশ ও পরিপূর্ণতা লাভ করে।
পাকিস্তানি সামরিক শাসন ছয় দফাকে 'বিচ্ছিন্নতাবাদী' বলে আখ্যায়িত করে এবং বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের 'এক নম্বর দুশমন' হিসেবে চিহ্নিত করে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাতে দমে না গিয়ে ছয় দফা কর্মসূচি নিয়ে পূর্ব বাংলার মানুষের কাছে হাজির হন। তিনি ঘোষণা করেন, "ছয় দফা আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্ন। ছয় দফা প্রশ্নে কোনো আপস নাই"।
১৯৬৬ সালের ২০ মার্চ থেকে ৮ মে পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু ৩২টি জনসভা করেন। সারাদেশে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী গ্রেফতার, অত্যাচারের প্রতিবাদ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্য নেতাদের মুক্তির দাবিতে ১৯৬৬ সালের ৭ই জুন হরতাল আহ্বান করা হয়। কর্মসূচির ধারবাহিকতায় আহূত হরতালের দিনেই শ্রমিক মনু মিয়া, শফিক, শামসুল হকসহ ঢাকা, টঙ্গী ও নারায়নগঞ্জে পুলিশের গুলিতে ১১ জন শহীদ হয়। সেই থেকে "৭ই জুন ছয় দফা দিবস" হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে সরকার ১৯৬৮ সালে 'রাষ্ট্রদ্রোহিতার' অভিযোগে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে। তাকে প্রধান আসামী করে মোট ৩৫ জনের বিরুদ্ধে মিথ্যা "আগরতলা মামলা" দায়ের করে। বিশেষ ট্রাইব্যুনালে ১৯৬৮ সালের ১৯ শে জুন কুর্মিটোলা সেনানিবাসে কড়া প্রহরায় "রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব এবং অন্যান্যদের মামলা" শুরু হয়। তখন গোটা দেশে আগুনের ফুলকি হয়ে জ্বলতে থাকে মানুষের বিক্ষোভ। মিছিলে মিছিলে প্রকম্পিত হতে থাকে রাজপথ। "তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা", " পিণ্ডি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা", "জেলের তালা ভাঙবো, শেখ মুজিবকে আনবো" স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হয় ঐক্যবদ্ধ বাঙালি জাতি।
বাধ্য হয়েই ২২শে ফেব্রুয়ারি আইয়ুব- মোনায়েম সরকার মামলা প্রত্যাহারসহ সকল রাজবন্দীদের নিঃশর্ত মুক্তি দেয়। ২৩শে ফেব্রুয়ারি 'ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ' রেসকোর্স ময়দানে সংবর্ধনা সভায় শেখ মুজিবকে "বঙ্গবন্ধু" উপাধিতে ভূষিত করেন। পরিস্থিতি শান্ত না হওয়ায় ২৫ মার্চ আইয়ুব খান সামরিক আইন জারি করে আগা মোঃ ইয়াহিয়া খানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।
১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানের প্রথম ও শেষ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ছয় দফার ভিত্তিতে সমগ্র পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানে বরাদ্দকৃত ১৬৯ টি আসনের মধ্যে ১৬৭ টি আসন এবং প্রাদেশিক পরিষদে বরাদ্দকৃত ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮ টি আসন লাভ করে। পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের প্রদত্ত ভোটের ৭৫.১১% ভোট লাভ করে।
কিন্তু বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক ঘোষণা দেন 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম'।
বঙ্গবন্ধুর ডাকা অসহযোগ আন্দোলনে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন। অসহযোগ আন্দোলন থেকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সামরিক জান্তা গণহত্যা শুরু করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। ৯ মাসের যুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে। বাঙালিরা একটি জাতি হিসেবে বিশ্বে মর্যাদা পায়, পায় স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ।
ছয় দফা প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর আত্মত্যাগ ও সংগ্রামঃ
ছয় দফার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, "এটা ক্ষমতা দখলের সংগ্রাম নয়, জনগণকে শোষণের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য সংগ্রাম।"
জনগণের অধিকার রক্ষায় আপসহীন বঙ্গবন্ধু জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ১২ টি বছর জেলে কাটিয়েছেন। ছয় দফা দেওয়ার পর বঙ্গবন্ধু যেখানে সমাবেশ করতে গেছেন, সেখানেই গ্রেপ্তার হয়েছেন। ওই সময়ে তিনি ৩২টি জনসভা করে বিভিন্ন মেয়াদে ৯০ দিন কারাভোগ করেন। এরপর ৬৬ সালের ৮ মে আবারও গ্রেপ্তার হয়ে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মুক্তি পান। এ সময় তিনি ১ হাজার ২১ দিন কারাগারে ছিলেন।
মিথ্যা আগরতলা মামলার পর তাঁর উপর কী পরিমাণে মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে, তার কিছুটা বিবরণ পাওয়া যায় বঙ্গবন্ধুর লেখা 'কারাগারের রোজনামচা' গ্রন্থে। ১৯৬৮ সালের জানুয়ারি মাসের ১৮ তারিখ বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টে বন্দি করে নিয়ে যাওয়া হয়।একাকী একটা ঘরে দীর্ঘদিন বন্দি থাকেন।একটা ঘর গাঢ় লাল রঙের মোটা পর্দা, কাচে লাল রং করা, উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন লাইট চব্বিশ ঘণ্টা জ্বালানো অবস্থায় দীর্ঘদিন বন্দি থাকতে হয়েছে।এই চরম অত্যাচার দিনের পর দিন তাঁর উপর করা হয়েছিল। পাঁচ মাস পর একখানা খাতা পান লেখার জন্য।তিনি সেখানে উল্লেখ করেছেন যে তাকে এমনভাবে একটি ঘরে বন্দি করে রেখেছিল যে রাত কি দিন তাও বুঝতে পারতেন না, দিন তারিখ ঠিক করতে পারতেন না।
ছয় দফার পাঁচ দশক ও বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশঃ
এ বছর ছয় দফার ৫৫ বছর পূর্ণ হলো আর বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী।
ব্রিটিশ উপনিবেশ ও পাকিস্তানি দুঃশাসন থেকে মুক্ত হওয়ার পর বিশ্ব মোড়লদের কেউ কেউ সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলে উপহাস করেছিল।
বঙ্গবন্ধু একসময় ক্ষুধামুক্ত দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন। বলেছিলেন, "এই স্বাধীনতা আমার ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি বাংলার মানুষ পেট ভরে খেতে না পায়। এই স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি বাংলার মা বোনেরা কাপড় না যায়।"
যে সোনার বাংলার স্বপ্ন বাস্তবায়নে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন, ছয় দফা ও স্বাধীনতার পাঁচ দশকে সেই স্বপ্ন অনেকখানিই পূর্ণ হয়েছে। সেদিনের বিদ্রুপ করা বিশ্ব মোড়লরাও আজ বাংলাদেশের উচ্চকিত প্রশংসায় মুখর।
স্বাধীনতার কাছাকাছি সময়ে বাংলাদেশের শিশু মৃত্যু (প্রতি হাজারে) ছিল ১৪১ জন, এখন শিশু মৃত্যু কমে ২১ জন। গড় আয়ু ছিল ৪৬.৫১ বছর, এখন ৭২.৬ বছর। মাথাপিছু আয় তখন ছিল ৭০ মার্কিন ডলার, এখন ২০৬৪ মার্কিন ডলার।( সূত্রঃ অর্থনৈতিক সমীক্ষা- ২০২০)
বিভিন্ন দারিদ্র বিমোচন কর্মসূচির সফলতায় প্রতি বছর কমছে দরিদ্রের সংখ্যা। দারিদ্রের হার ও চরম দারিদ্রের হার যথাক্রমে ২১.৮% ও ১১.৩% (সূত্রঃ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০২০)।
সফলভাবে এমডিজি বাস্তবায়ন করে বাংলাদেশ এখন এসডিজি বাস্তবায়নের পথে। নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ রোলমডেল।জাতিসংঘ কর্তৃক এলডিসিমুক্ত ঘোষিত হয়ে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা লাভ করেছে।
বৈশ্বিক মহামারিতেও অর্থনৈতিক উত্তরণ ও সমৃদ্ধির পথে অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সহচর ও ষাটের দশকের তুখোড় ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ বলেন, "বঙ্গবন্ধু তো বাংলাদেশের স্বাধীনতা চেয়েছিলেন। তিনি ছয় দফা না দিলে আগরতলা মামলা হতো না, এই মামলা না হলে গণঅভ্যুত্থান হতো না, এই গণ অভ্যত্থান না হলে বঙ্গবন্ধুকে কারাগার থেকে মুক্ত করতে পারতাম না। আর তিনি মুক্ত না হলে সত্তরের নির্বাচনে বিজয়ী হতাম না।"
তাই স্পষ্টতই বলা যায়, ছয় দফা হলো সেই মুক্তি সনদ যা সংগ্রামের পথ বেয়ে এক দফায় পরিণত হয়েছিল,সেই এক দফা হলো স্বাধীনতা। স্বাধিকার ও স্বাধীনতার পথে সেতুবন্ধ রচনা করে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা।
লেখকঃ সাবেক শিক্ষার্থী, লোকপ্রশাসন বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়।