2800
Published on জুন 7, 2021বিনয় দত্তঃ
১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ৬ দফা ঘোষণা করেছেন। এই ৬ দফা সেইসময় সবার কাছে যে স্পষ্ট ছিল তা কিন্তু নয়। এইটা বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন তাই সেইসময় ‘আমাদের বাঁচার দাবি: ৬-দফা কর্মসূচী’ শীর্ষক একটি প্রচারপত্র প্রকাশ করা হয়। এটি প্রকাশিত হয় ৪ঠা চৈত্র, ১৩৭২; ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৬। এই প্রচারপত্র প্রকাশের উদ্দেশ্য হলো, যাতে সবাই ৬ দফা সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখে এবং এতে কেউ যেন বিভ্রান্ত না হয়। বঙ্গবন্ধু প্রচণ্ড দূরদর্শী ছিলেন। তাই তিনি ছয় দফার দফাওয়ারী ব্যাখ্যা, পটভূমি, যুক্তি ও এই দফা এবং তাঁকে নিয়ে সমালোচনার জবাব তুলে ধরেন। উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো, তিনি গোটা জাতিকে ৬ দফার বিষয়ে এক করতে পেরেছিলেন।
৬ দফার মূলত দুটি দিক। একটি রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাঠামো সম্পর্কিত, অন্যটি অর্থনৈতিক উন্নয়ন বা অর্থনৈতিক মুক্তি সম্পর্কিত। আমার দৃষ্টি অর্থনৈতিক উন্নয়ন বা অর্থনৈতিক মুক্তি সম্পর্কিত দিকে। একটি রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গেলে সেই রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নয়ন অবশ্যই জরুরি। বঙ্গবন্ধু যে সময়ে বাংলাদেশ নামক স্বপ্নের রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করছেন তখন দেশের অর্থনীতি ছিল কৃষি নির্ভর। বলতে গেলে ফলজ উৎপাদন বাদ দিয়ে বাকি সবকিছু বাইরে থেকে আমদানি করতে হতো। এতে করে পশ্চিম পাকিস্তান, পূর্ব পাকিস্তান থেকে সবকিছু নিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেত বা পাচ্ছিল। এইটা বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন তাই তিনি মোট ৬টি দফার মধ্যে ১, ২ এবং ৬ বাদ দিয়ে ৩ থেকে ৫ পর্যন্ত সবগুলো অর্থনৈতিক উন্নয়ন বা অর্থনৈতিক মুক্তি সম্পর্কিত বিষয়ে জোর দিয়েছিলেন।
৩, ৪, ৫ দফাগুলোর সংক্ষেপিত রূপ হলো‐
দফা ৩: প্রতিটি প্রদেশের জন্য পৃথক, তবে অবাধে রূপান্তরযোগ্য মুদ্রা থাকবে। অথবা, যদি একক মুদ্রা ব্যবহার করা হয়, সেক্ষেত্রে এক প্রদেশ থেকে অন্য প্রদেশে মুদ্রা হস্তান্তর রোধ করার উপায় থাকতে হবে।
দফা ৪: রাজস্বের দায়িত্ব প্রদেশের হাতে থাকবে।
দফা ৫: প্রতিটি প্রদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের জন্য পৃথক অ্যাকাউন্ট থাকতে হবে।
১৯৬৬ সালে প্রকাশিত ‘আমাদের বাঁচার দাবি: ৬-দফা কর্মসূচী’ প্রচারপত্রে তৃতীয় দফার বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর ব্যাখ্যা: যদি আমার দ্বিতীয় অল্টারনেটিভ গৃহীত হয়, তবে মুদ্রা কেন্দ্রের হাতেই থাকিয়া যাইবে। যদি পশ্চিম পাকিস্তানী ভাইরা আমার এই প্রস্তাবে রাজী না হন, তবেই শুধু প্রথম বিকল্প অর্থ্যাৎ কেন্দ্রের হাত হইতে মুদ্রাকে প্রদেশের হাতে আনিতে হইবে।
আমার প্রস্তাবের মর্ম এই যে, উপরোক্ত দুই বিকল্পের দ্বিতীয়টি গৃহীত হইলে মুদ্রা কেন্দ্রের তত্ত্বাবধানে থাকিবে। সে অবস্থায় উভয় অঞ্চলের একই নকশার মুদ্রা বর্তমানে যেমন আছে তেমনি থাকিবে। পার্থক্য শুধু এই হইবে যে, পূর্ব পাকিস্তানের প্রয়োজনীয় মুদ্রা পূর্ব পাকিস্তানের রিজার্ভ ব্যাংক হইতে ইস্যু হইবে এবং তাতে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ বা সংক্ষেপে ‘ঢাকা’ লেখা থাকিবে। পশ্চিম পাকিস্তানের প্রয়োজনীয় মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানের রিজার্ভ ব্যাংক হইতে ইস্যু হইবে এবং তাতে ‘পশ্চিম পাকিস্তান’ বা সংক্ষেপে ‘লাহোর’ লেখা থাকিবে। পক্ষান্তরে, আমার প্রস্তাবের দ্বিতীয় বিকল্প না হইয়া যদি প্রথম বিকল্পও গৃহীত হয়, সে অবস্থাতেও উভয় অঞ্চলের মুদ্রা সহজে বিনিময়যোগ্য থাকিবে এবং পাকিস্তানের ঐক্যের প্রতীক ও নিদর্শন স্বরূপ উভয় আঞ্চলিক সরকারের সহযোগিতায় একই নকশার মুদ্রা প্রচলন করা যাইবে। [প্রচারপত্রে প্রকাশিত ভাষারীতি অনুযায়ী]
বঙ্গবন্ধু আকারে ইঙ্গিতে পূর্ব পাকিস্তানের আলাদা মূদ্রানীতির বিষয়টি বা অর্থ রিজার্ভের বিষয়টি বলেছিলেন। প্রতিটি দেশ অর্থনৈতিভাবে সমৃদ্ধ হয় তখন, যখন তার রিজার্ভ সমৃদ্ধ থাকে বা আলাদা মুদ্রানীতি থাকে। আজকে আমরা যে উন্নয়নশীল বাংলাদেশ দেখছি বা অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল ভোগ করছি, এইটা বঙ্গবন্ধুর সেইসময়ে তৃতীয় দফায় প্রস্তাব করেছিলেন। যা ১৯৬৬ সালে প্রস্তাবিত।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হয়। তার বহমান ধারায় আজকে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে স্বীকৃত। এর নির্দেশনা আমরা পাই ১৯৬৬ সালে।
প্রচারপত্রে চতুর্থ দফার বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর ব্যাখ্যা: আমার এই প্রস্তাবে কেন্দ্রকে ট্যাক্স ধায্যের্র দায়িত্ব দেয়া না হইলেও কেন্দ্রীয় সরকার নির্বিঘ্নে চলার মত যথেষ্ট অর্থের ব্যবস্থা করা হইয়াছে। সে ব্যবস্থা নিখুঁত করিবার শাসনতান্ত্রিক বিধান রচনার সুপারিশ করা হইয়াছে। এটাই সরকারী তহবিলের সবচেয়ে অমোঘ, অব্যর্থ ও সর্বাপেক্ষা নিরাপদ উপায়। তারা এটাও জানেন যে, কেন্দ্রকে ট্যাক্স ধার্য্যের ক্ষমতা না দিয়াও ফেডারেশন চলার বিধান রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্বীকৃত।
৩ নং দফার ব্যাখ্যায় আমি দেখাইয়াছি যে, অর্থমন্ত্রী ও অর্থদফতর ছাড়াও দুনিয়ার অনেক ফেডারেশন চলিতেছে। আমার প্রস্তাব কার্যকরী হইলেও তেমনি পাকিস্তানের দেশরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হইবে না। কারণ আমার প্রস্তাবে কেন্দ্রীয় তহবিলের নিরাপত্তার জন্য শাসনতান্ত্রিক বিধানের সুপারিশ করা হইয়াছে। সে অবস্থায় শাসনতন্ত্রেও এমন বিধান থাকিবে যে, আঞ্চলিক সরকার যেখানে যখন যে খাতেই যে টাকা ট্যাক্স ধার্য্য ও আয় করুন না কেন, শাসনতন্ত্রে নির্ধারিত সে টাকায় হারের অংশ রিজার্ভ ব্যাংকে কেন্দ্রীয় তহবিলে জমা হইয়া যাইবে। সে টাকার আঞ্চলিক সরকারের কোন হাত থাকিবে না। [প্রচারপত্রে প্রকাশিত ভাষারীতি অনুযায়ী]
১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু রাজস্বের বিষয়ের জোর দেওয়া এবং রিজার্ভ ব্যাংকে রাজস্ব জমার করার বিষয়টি গুরুত্বারোপ করেছেন যা এখন খুবই উল্লেখযোগ্য বিষয়। তারচেয়েও উল্লেখযোগ্য হলো, রাজস্ব আদায় হওয়ার পর সেই রাজস্ব খরচের এখতিয়ার কার? এই বিষয়েও তিনি সঠিক নির্দেশনা বা প্রস্তাব দিয়েছেন। বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন অবকাঠামো নির্ধাতিত হয় জনগণের কাছ থেকে কী পরিমাণ রাজস্ব আদায় হবে বা কী পরিমাণ রাজস্ব আদায় করতে হবে বা রাজস্ব আদায়ে জনগণের উৎসাহিত করার বিষয়ে।
৬ দফা আমার পূর্বেই পড়া। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে ৬ দফাকে আমি নতুনভাবে আবিষ্কার করি প্রতিনিয়ত। আমার মনে হয় একজন নেতা কতটা দূরদর্শী হলে এই প্রস্তাব তিনি তখন করেন। আজকে বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপিত হচ্ছে। বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হিসেবে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধি লাভ করেছে। অথচ এই অর্থনৈতিক মুক্তি বা সমৃদ্ধির পথ বঙ্গবন্ধু দেখিয়েছেন দেশটির স্বাধীনেরও আগে। এই বিস্ময় আমার কখনোই কাটে না।
প্রচারপত্রে পঞ্চম দফার বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর ব্যাখ্যা: পূর্ব পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক নিশ্চিত মৃত্যু হইতে রক্ষা করিবার জন্য এই ব্যবস্থা ৩ নং দফার মতই অত্যাবশ্যক। পাকিস্তানের আঠার বছরের আর্থিক ইতিহাসের দিকে একটু নজর বুলাইলেই দেখা যাইবে যে-
ক) পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বিদেশী মুদ্রা দিয়া পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্প গড়িয়া তোলা হইয়াছে এবং হইতেছে। সেই সকল শিল্পজাত দ্রব্যের অর্জিত বিদেশী মুদ্রাকে পশ্চিম পাকিস্তানের অর্জিত বিদেশী মুদ্রা বলা হইতেছে।
খ) পূর্ব পাকিস্তানে মূলধন গড়িয়া না উঠায় পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বিদেশী মুদ্রা ব্যবহারের ক্ষমতা পূর্ব পাকিস্তানের নাই এই অজুহাতে পূর্ব পাকিস্তানের বিদেশী আয় পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় করা হইতেছে। এইভাবে পূর্ব পাকিস্তান শিল্পায়িত হইতে পারিতেছে না।
গ) পূর্ব পাকিস্তান যে পরিমাণে আয় করে সেই পরিমাণ ব্যয় করিতে পারে না। সকলেই জানেন, পূর্ব পাকিস্তানে যে পরিমাণ রফতানী করে আমদানী করে সাধারণত তার অর্ধেকের কম। ফলে অর্থনীতির অমোঘ নিয়ম অনুসারেই পূর্ব পাকিস্তানে ইনফ্লেশন বা মুদ্রাস্ফীতি ম্যালেরিয়া জ্বরের মত লাগিয়াই আছে। তার ফলে আমাদের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দাম এত বেশী। বিদেশ হইতে আমদানী করা একই জিনিসের পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান দামের তুলনা করিলেই এটা বুঝা যাইবে। বিদেশী মুদ্রা বণ্টনের দায়িত্ব এবং অর্থনৈতিক অন্যান্য সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের এখতিয়ারে থাকার ফলেই আমাদের এই দুর্দশা।
ঘ) পাকিস্তানের বিদেশী মুদ্রার তিন ভাগের দুই ভাগই অর্জিত হয় পাট হইতে। অথচ পাটচাষীকে পাটের ন্যায্য মূল্য তো দূরের কথা আবাদী খরচাটাও দেয়া হয় না। ফলে পাটচাষীদের ভাগ্য আজ শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের খেলার জিনিসে পরিণত হইয়াছে। পূর্ব পাকিস্তান সরকার পাটের চাষ নিয়ন্ত্রণ করেন কিন্তু চাষীকে পাটের ন্যায্য দাম দিতে পারেন না। [প্রচারপত্রে প্রকাশিত ভাষারীতি অনুযায়ী]
পঞ্চম দফা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ বলে আমার মনে হয়। এই এক দফার মধ্যে তিনি অর্থ পাচার, বৈদেশিক বাণিজ্য নীতি, বাণিজ্যিক চুক্তি, বৈদেশিক কূটনীতি, দেশীয় চাষীর অধিকার, চাষীদের শোষণ-বঞ্চনার বিষয়সহ অনেক কিছু উল্লেখ করেছেন।
দেশের অর্থনীতি সচল এবং জোরদার রাখতে এই বিষয়গুলো কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা নতুন করে বলার নেই। দেশ থেকে অর্থ পাচার রোধে সব দেশ কাজ করছে। বাংলাদেশও কাজ করছে। এই বিষয়ে বঙ্গবন্ধু সেইসময় ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। দেশের অর্থ যদি দেশেই না থাকে তবে সেই দেশ কোনোভাবেই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি দেখতে পাই না।
বৈদেশিক বাণিজ্য নীতি, বাণিজ্যিক চুক্তি, বৈদেশিক কূটনীতি এই তিনটি বিষয়েও তিনি পঞ্চম দফায় সঠিক নির্দেশনা দিয়েছেন। তখন পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক আয় নিজের মতো করে ব্যয় করতো যা ছিল ভয়ানক অন্যায়। বঙ্গবন্ধু বিষয়টি বুঝতে পেরে তাদের প্রতি ক্ষুব্ধ না হয়ে খুব সূক্ষ্মভাবে তাদের সামলে নিয়েছেন, নিজের দূরদর্শিতার প্রমাণ দিয়েছেন। সেই পথেই বঙ্গবন্ধু পরবর্তীতে ‘সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়’ এই ভাবনায় পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়ন করেন। যা এখনো চলমান।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, দেশীয় প্রতিষ্ঠান বা দেশীয় চাষীদের অগ্রাধিকার। ১৯৬৬ সালের প্রস্তাবিত ৬ দফায় তিনি যেভাবে অধিকারের কথা বলেছেন তা এখনো পর্যন্ত জনগুরূত্বপূর্ণ নির্দেশনা। এই পথ ধরে এখনকার বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে।
বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা আসলে ১৯৬৬ সালের ৬ দফা বা পাকিস্তানিদের হাত থেকে মুক্ত হওয়ার ৬ দফা নয়। এর সর্বজনীনতা এখনো উজ্জ্বল। আমার বিশ্বাস, আরো পঞ্চাশ বছর পরেও যদি ৬ দফা নিয়ে আলোচনা করা হয় বা বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে তা তখনো বর্তমান থাকবে। যা বাংলাদেশকে পথ দেখাবে, পথ দেখাবে বাংলার মানুষকে।
লেখকঃ কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক