দফা তো একটাই, একটু ঘুরাইয়া কইলাম...

1090

Published on জুন 7, 2021
  • Details Image

অধ্যাপক ড. সৈয়দ সামসুদ্দিন আহমেদ

ছেষট্টির আগে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে আরো ‘অ্যাজেন্ডা’ ছিল। কিন্তু ৬ দফা ঘোষণা দেওয়ার পর ‘জাতীয়তাবাদে’র বিষয়টি একমাত্র অ্যাজেন্ডায় পরিণত হয়। এই এক ‘অ্যাজেন্ডা’ দিয়েই আন্দোলন-সংগ্রাম করে একাত্তরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতা অর্জন করে বাংলাদেশ।ো

১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর পূর্ববঙ্গের ওপর পশ্চিম পাকিস্তনের শাসন ও শোষণ নিরঙ্কুশ হয়ে ওঠে। শুরু হয় নিরাপত্তাহীনতা ও মানুষের রাজনৈতিক অধিকার হরণ করার মচ্ছব। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে দিনে দিনে বৈষম্য এবং বিরোধ ক্রমান্বয়ে বাড়ার কারণে জনগণও এই ক’বছরের রাজনৈতিক ঘটনাবলীর মধ্য দিয়ে সচেতন হয়ে ওঠে। তাদের মধ্যে তৈরি হয় অধিকার ফিরে পাওয়ার বোধ। আর এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করেন তরুণ নেতা শেখ মুজিব।

তিনি নির্যাতিত-নিপীড়িত বাঙালির মুক্তির জন্য কর্মসূচি প্রণয়ন করেন, এই কর্মসূচি—ই হচ্ছে ছয় দফা। যা বাঙালির মুক্তির সনদ হিসেবে ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে।

১৯৬৬ সালের ১০ জানুয়ারি উজবেকিস্তানের রাজধানী তাশখন্দে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে চুক্তি হয়। তাশখন্দ চুক্তির ফলে ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সমাধান হয়। এই চুক্তিকে অভিনন্দন জানান শেখ মুজিব।

এর মধ্য দিয়ে প্রতিবেশী দুই দেশের মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার বিষয়ে পূর্ববঙ্গের জনগণের সমর্থন বেড়ে যায়। এ অবস্থার মাঝে ছৈষট্টি সালের ১৩ জানুয়ারি পূর্ববঙ্গের তৎকালীন গভর্নর মোনায়েম খান হিন্দুদের সম্পত্তি নিয়ে শত্রু সম্পত্তি সংক্রান্ত এক আদেশনামা জারি করেন।

এই আদেশের ফলে হিন্দুদের সহায়-সম্পত্তি নিয়ে সরকার সমর্থিত সন্ত্রাসীদের উৎপাত বেড়ে যায়। পূর্ববঙ্গে নিজেদের অনিরাপদ ভাবতে শুরু করে হিন্দু জনগোষ্ঠী। পাশাপাশি শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে একের পর এক হয়রানিমূলক মামলা অব্যাহত রাখে সরকার।

পাকিস্তানি গোষ্ঠী বুঝে গিয়েছিল-শেখ মুজিবের যে জনসমর্থন তা আর থামানো সম্ভব নয় । তাই তাঁকে জেলে রাখার ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠেন তৎকালীন গভর্নর মোনায়েম খান। প্রকাশ্যে তিনি ঘোষণা করেন, যতদিন পূর্ববঙ্গের গভর্নর থাকবেন, ততদিন মুজিবকে জেলে থাকতে হবে। (সূত্র: সিরাজ উদ্দীন আহমেদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ভাস্কর প্রকাশনী, ঢাকা, ২০০১)।

মোনায়েম খানের এই নিপীড়নমূলক দম্ভোক্তির পর ফুঁসে ওঠে পূর্ববঙ্গের রাজনীতি সচেতন মধ্যবিত্ত শ্রেণী। বঙ্গবন্ধু যেমন জনগণের সঙ্গে ছিলেন, জনগণও তাঁকে ছেড়ে যায়নি। তাই জনগণই বারবার তাঁকে নিয়ে এসেছে মানুষের মাঝে।

১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পাকিস্তানের লাহোরে চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর বাসভবনে আহুত এক জাতীয় সম্মেলনে যোগ দেন শেখ মুজিবসহ আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দল। সম্মেলনের সাবজেক্ট কমিটির সভায় ১০ ফেব্রুয়ারি তিনি ঘোষণা করেন ছয় দফা; এতে বাংলার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃকৃতিক স্বার্থ সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়।

তবে সেখানে নেতৃবৃন্দ ছয় দফা প্রশ্নে কোনো আলোচনা করতে সম্মত হননি। এ অবস্থায় সম্মেলন ত্যাগ করে ১১ ফেব্রুয়ারি প্রতিনিধি দলকে নিয়ে ঢাকায় ফেরেন শেখ মুজিব। ছয় দফা নিয়ে পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানে দ্বিধা-বিভক্তি দেখা দেয়। বিরুদ্ধ মত আসে আওয়ামী লীগ থেকেও।

তবে চট্টগ্রামের এমএ আজিজ, এমএ হান্নান, আবদুল্লাহ আল হারুণসহ কয়েকজন নেতা ১৩ ফেব্রুয়ারি ছয় দফার সমর্থনে বিবৃতি দেন, ছয় দফা সমর্থন দিয়ে বিবৃতি দেয় ছাত্রলীগও। (সূত্র: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: জীবন ও রাজনীতি, বাংলা একাডেমি, ২০০৮, পৃষ্ঠা-৩২৩)

তবে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ছয় দফার বিপক্ষে বক্তব্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে পুরো দেশে। এ সময় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (মস্কোপন্থী) পূর্ব পাকিস্তান প্রধান অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ছয় দফা প্রসঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনি এই যে ছয় দফা দিলেন, তার মূল কথাটি কী?’

আঞ্চলিক ভাষায় শেখ মুজিব ওই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন এভাবে, ‘আরে মিয়া বুঝলা না, দফা তো একটাই। একটু ঘুরাইয়া কইলাম।’ (সূত্র:স্বাধীনতা যেভাবে আমাদের হলো, অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, কালের কণ্ঠ উপসম্পাদকীয়, ২৬ মার্চ ২০২০)

এ অঞ্চলের মানুষ ১৯৪৯ সাল থেকে স্বায়ত্তশাসন শাসন দাবি করে আসছে। কিন্তু ছয় দফা দাবির মধ্য দিয়ে এটি একক অ্যাজেন্ডায় রূপ পেল। এই অ্যাজেন্ডার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু খুব দ্রুত জনগণকে জাতীয়তাবাদী মন্ত্রে দীক্ষিত করে তোলেন এবং ৭০-এর নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে দেশকে নিয়ে যান স্বাধীনতার পথে। যার চূড়ান্ত পরিণতি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ।

এরই মাঝে ১৭ ফেব্রুয়ারি (১৯৬৬) পুরানা পল্টনের আওয়ামী লীগ অফিসে ছয় দফার বিষয়বস্তুর উপর বিষদ ব্যাখ্যা দেন শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর ব্যাখায় স্পষ্ট হয়ে উঠলো, আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলার জনগণের মুক্তি, স্বাধীনতা, স্বায়ত্তশাসন অধিকার প্রতিষ্ঠা নিয়ে সংগঠনের জন্মলগ্ন থেকে যে চিন্তা-ভাবনা ও আন্দোলনের সূচনা করেছিল, শেখ মুজিবের ঐতিহাসিক ছয় দফায় তা মূর্ত হয়ে উঠলো। আর শেখ মুজিব আবির্ভূত হলেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতায়।

২১ শে ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬, মহান শহীদ দিবসে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় ছয় দফা আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন লাভ করে। মূলত ছয় দফা ছিল শেখ মুজিবের চিন্তার ফসল। যা ২১ শে ফেব্রুয়ারির পর দলীয় ইশতেহারে পরিণত হয়। পুরো দেশের মানুষের একক ‘অ্যাজেন্ডা’য় রূপ লাভ করে।

ছয় দফা পেশ করে বঙ্গবন্ধু ঘরে বসে ছিলেন না। তাঁর এই দাবির মর্মার্থ মানুষকে বোঝাতে দেশজুড়ে চষে বেড়ান তিনি, অসংখ্য সভা–সমাবেশ করেন। এই কাজটি শুরু হয় ২৩ শে ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক লালদীঘি ময়দানে সমাবেশের মাধ্যমে। কিন্তু বাঙালিবিদ্বেষী ও প্রতিহিংসাপরায়ণ সরকারও বসে নেই।

জননন্দিত এই নেতার বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা করে। তিনি গ্রেপ্তার হন, জামিন পান, আবার আরেক মামলায় গ্রেপ্তার হন।

ষাটের দশকে অর্থাৎ ছয় দফার সময়ের দেশে সামরিক শাসন ছিল না। কিন্তু ‘মৌলিক গণতন্ত্রে’র মাধ্যমে শাসনক্ষমতার কেন্দ্রে ছিলেন স্বৈরাচার আইয়ুব খান। ওইসময় ছয় দফার বিরুদ্ধে আইয়ুব-মোনায়েমের বিষোদগার চলতেই থাকে।

তবে মুজিব দেশজুড়ে তাঁর গণতান্ত্রিক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া বন্ধ করেননি। আজ যশোর তো কাল খুলনা, পাবনা, পরশু রাজশাহী- এভাবে উল্কার মতো দেশের এ প্রান্ত থেকে ওই প্রান্তে কর্মসূচি নিয়ে ছুটে চলেছেন তিনি।

১৮ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু খুলনা সমাবেশ করে যশোরে ফিরছিলেন। ওইদিন রাতে তাঁকে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা আইনের ৪৭(৫) ধারায় গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ২০ মার্চ ঢাকার পল্টন ময়দানে রাষ্ট্রবিরোধী ভাষণ দেওয়ার অভিযোগে হয়রানিমূলক মামলায় তাঁকে যশোরে গ্রেপ্তার করা হয়।

যশোরে জামিন পেয়ে প্লেনযোগে ঢাকায় ফেরেন শেখ মুজিব, সঙ্গে তাজউদ্দিন আহমেদ। ঢাকা বিমানবন্দরে তাঁকে জনগণের পক্ষে বিশাল সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এ সময় সবার মুখে স্লোগান ছিল একটাই- ‘ছয় দফা মানতে হবে’।

এদিকে পূর্বপাকিস্তানে স্বায়ত্তশাসনের দাবি ক্রমেই জোরালো হতে শুরু করে। এর মাঝে ২১ এপ্রিল সিলেটে গ্রেপ্তার হন শেখ মুজিব। ২৫ এপ্রিল ময়মনসিংহ জেলা জজ আদালতে তিনি মুক্ত হন। এর মাঝে কর্মসূচি চলছে-ই। শাসকগোষ্ঠীর তীক্ষ্ম ষড়যন্ত্রও থেমে নেই, বরং প্রতিনিয়ত বিস্তার ঘটছে এর জাল।

১৯৬৬ সালের ৮ মে নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ায় পাটকল শ্রমিকদের এক সমাবেশে ভাষণ দেওয়ার পর ৯ মে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে নেওয়া হয়। তাঁর সঙ্গে গ্রেপ্তার হন তাজউদ্দিন আহমেদসহ আরও কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা। তাঁদের বন্দি করা হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে।

এর মাঝে আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পড়ে সৈয়দ নজরুল ইসলামের উপর। অন্যান্য নেতৃবৃন্দকে নিয়ে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে যান তিনি। (সূত্র: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: জীবন ও রাজনীতি, বাংলা একাডেমি, ২০০৮, পৃষ্ঠা-৩৩৫)।

বঙ্গবন্ধু ছিলেন জনগণ অন্তঃপ্রাণ। জনগণও তাঁকে প্রচণ্ড ভালোবেসেছে এবং ভালোবাসে। তাঁকে এ ধরনের হয়রানিতে জনগণের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। এর মাঝে দলের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত হয়, ছয় দফার বায়স্তবায়ন নীতি অব্যাহত রাখা এবং ৭ জুন প্রদেশব্যাপী হরতাল পালন করার।

এ কর্মসূচি ঘোষণার পর শাসকগোষ্ঠী প্রচার কাজে ব্যাপক বাধা সৃষ্টি ও আওয়ামী লীগের কর্মীদের বেআইনিভাবে আটকে রাখার কৌশল নেয়। কিন্তু দমে যায়নি বাঙালি।

আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এসব ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হয়। উল্টো মোনায়েম খান কঠোর হস্তে এসব দমন করার হুমকি দেন। হরতালকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী ব্যাপক ধর-পাকড় শুরু হয়। অঘোষিত নিয়ন্ত্রণ আলোপ করা হয় পত্র-পত্রিকার ওপর।

পত্র-পত্রিকার ওপর নিয়ন্ত্রণের মধ্যেও দেশব্যাপী ৭ জুন হরতালের খবর ছড়িয়ে পড়ে। জনগণ স্বতস্ফূর্তভাবে হরতাল পাল করে। হরতাল-কর্মসূচি চলাকালে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও টঙ্গীতে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ১১ জনকে হত্যা করে পুলিশ। আহত ও গ্রেপ্তার হন অনেক। সরকারের এ রকম বিরূপ প্রচারণা ও অত্যাচারে ছয় দফা আরও বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

দেশের এই দমন-পীড়নের মাঝেই খবর আসে গোপালগঞ্জে শেখ মুজিবের মা অসুস্থ। কিন্তু তিনি প্যারোলে মুক্তি নিতে আগ্রহী নন, কারণ তাঁর মা চান না, ছেলে প্যারোলে মুক্তি নিন, নিঃশর্ত মুক্তি চান। (সূত্র: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: জীবন ও রাজনীতি, বাংলা একাডেমি, ২০০৮; পৃষ্ঠা- ৩৩৫)।

এদিকে হরতালে গুলি করে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জাতীয় পরিষদে ও প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশনে প্রতিবাদ জানান আওয়ামী লীগের সদস্যবৃন্দ। আওয়ামী লীগের আরও কয়েকজন শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে আটক করা হয়।

শেখ মুজিব ও তাজউদ্দিন জেলে থাকায় সৈয়দ নজরুল অন্যদের নিয়ে দলীয় কর্মসূচি পরিচালনা করছিলেন, স্বৈরাচার আইয়ুব সরকার ভেবেছিল তাঁদের গ্রেপ্তার করলেই আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার কেউ থাকবে না।

কিন্তু মানুষের ওপর নির্যাতন যত বাড়ছে, ততই ছয় দফার বাণী পৌঁছে যাচ্ছে গ্রামে-গঞ্জে। জনগণ সচেতন হয়ে নিজেরাই এর পক্ষে প্রচারণা চালানো শুরু করে। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের পক্ষেও কর্মসূচি অব্যাহত থাকে। দাবি উঠে শেখ মুজিবসহ সকল রাজবন্দীর মুক্তির।

কিন্তু আইয়ুব-মোনায়েম ব্যস্ত ষড়যন্ত্রে। তাই ছয় দফা যখন জনগণের ব্যাপক সমর্থন পায়, ঠিক সেই সময় অর্থাৎ ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ফাঁসানো হয় শেখ মুজিবকে। তাঁর সঙ্গে আসামি করা হয় ২৮ জন আমলা, সেনা ও রাজনীতিককে।

বন্দী করা হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। ১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি গভীর রাতে সেখানে উপস্থিত হন ডেপুটি জেলার তোজাম্মেল। দরজা খুলে দেন জেলে থাকা শেখ মুজিবের সঙ্গী আওয়ামী লীগের নেতা মোহনগঞ্জের আব্দুল মোমেন। দরজা খুলতেই শেখ মুজিবকে একটি কাগজ দেখিয়ে তোজাম্মেলন বললেন, ‘স্যার, আপনাকে বেকসুর দেওয়া হয়েছে।’

এর আগে কারাগারে বসে শেখ মুজিব শুনেছেন, তাঁকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জড়ানো হয়েছে। তোজাম্মেলকে তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘আমাকে খালাস দেওয়া হলো কী নতুন কোনো ফাঁদে নেবার জন্যে?

তোজাম্মেল কোনো কথা বলেননি। নিজের অজান্তেই তখন শেখ মুজিব বলে উঠলেন, ‘বুঝলাম, সংগ্রাম ঘনিয়ে আসছে, মুক্তি এগিয়ে আসছে, বাংলার মুক্তি।’

অশ্রুসিক্ত নয়নে মোমেনকে বুকে জড়িয়ে বাঙালির প্রিয় নেতা মুজিব বললেন, ‘বন্ধু, বাংলাদেশকে আপনাদের হাতে রেখে গেলাম। জানি না, কোথায় এরা আমাকে নিয়ে যাবে-হয়তো বাংলার মাটি থেকে এ আমার শেষ যাত্রা। যাবার সময় আপনাকে শুধু একটি কথা বলে গেলাম- বাংলাদেশের সাথে আমি কোনোদিন বিশ্বাসঘাতকতা করিনি, কোনোদিন করবো না। আপনারা রইলেন বাংলাদেশ রইলো, এই দেশকে স্বাধীনতার পথে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। সার্বভৌম স্বাধীনতাই আমার স্বপ্ন, আমার লক্ষ্য।’

জেলখানা থেকে বের হলেন, মুজিবের সেই আশঙ্কাই যেন সত্য হলো। আবারও নতুন ফাঁদে ফেলা হলো তাঁকে। জেলগেটে বিজাতীয় ভাষায় ঊর্দি পড়া অফিসার বললো, তুমি আবারও বন্দি!

জেলগেটেই ফের গ্রেপ্তার হলেন শেখ মুজিব, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। মিলিটারি ভ্যানে উঠার আগে কারাগারের সামনে একমুটো মাটি কপালে ঘঁষে বললেন, ‘এই দেশেতে জন্ম আমার, যেন এই দেশেতেই মরি...।’

বঙ্গবন্ধুকে হত্যায় ষড়যন্ত্র করেছিল পাকিস্তান সরকার, কিন্তু জনগণের মুজিব জনগণের মাঝেই ফিরে এলেন। দেখা দেয় ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, এর ফলে তাঁকে মুক্ত দিতে বাধ্য হয় আইয়ুব সরকার।

আজ আমাদের দুর্ভাগ্য যে, বঙ্গবন্ধুকে ধরে রাখতে পারিনি। কিন্তু তাঁরই দেখানো পথে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে অপ্রতিরোধ্য গতিতে সোনার বাংলার দিকে ধাবিত হচ্ছে বাংলাদেশ।

বঙ্গবন্ধু ঘুমিয়ে রয়েছেন, টুঙ্গীপাড়ায়। নিজের জন্মভূমিতে। যেখান থেকেই বাংলার স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলেন। আমরা তাঁর আদর্শে গড়ে তুলবো 'সোনার বাংলা'। এভাবেই তিনি বেঁচে থাকবেন বাঙালির ভালোবাসায়, শ্রদ্ধায়— হৃদয়ের মণিকোঠায়।

লেখক: উপাচার্য, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়; জামালপুর

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত