ছয় দফাঃ বাঙ্গালির ম্যাগনাকার্টা

2216

Published on জুন 6, 2021
  • Details Image

ফারহান সাদিকঃ

১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর শুরু হয় অমানবিক শোষণ, বঞ্চনা, নির্যাতন এবং ক্রমবর্ধমান হারে বেড়ে ছিল বৈষম্য। এদেশের মাটি উর্বর হওয়ায় পূর্ব পাকিস্তান পরিণত হয় পশ্চিম পাকিস্তানী শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের কাঁচামালের যোগানদাতা হিসেবে। গুটিকয়েক শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠিত হলেও সেগুলোর নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা পর্ষদ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে। পূর্ব পাকিস্তানিদের মৌলিক অধিকারকে উপেক্ষিত রেখে এসব শিল্পকারখানার লভ্যাংশ পাচার হত ১২০০ মাইলের অধিক দূরে পশ্চিম পাকিস্তানে। পরবর্তীতে ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধ হলে বাঙালিরা আরও অরক্ষিত হয়ে পড়ে। অর্থনৈতিক,সামরিক, শিক্ষা,সামাজিক সবদিক থেকে আমরা যখন পিছিয়ে তখন মুক্তির প্রদীপ হয়ে ১৯৬৬ সালের ৫-৬ ফেব্রুয়ারী লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী দলগুলোর সম্মেলনে শেখ মুজিব "ঐতিহাসিক ছয় দফা" কর্মসূচি পেশ করেন এবং দেশবাসীর সামনে তুলে ধরে জনমত সৃষ্টি করতে প্রয়াসী হন। এ কর্মসূচিকে তিনি "পূর্ব পাকিস্তানের বাঁচার দাবি বলে অভিহিত করেন এবং বাংলার জনগণের মাঝে তা খুব দ্রুত সমাদৃত হয়।

ছয় দফা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এর ১ম দফা ছিল প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা, অগণতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাড়িয়ে লাহোর প্রস্তাব ভিত্তিক সংসদীয় ও যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার ব্যবস্থা। ২য় দফায়,কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের ওপর দায়িত্ব বন্টনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। অর্থনৈতিক শোষণ ও মুদ্রা পাচার রোধের জন্য বিনিময়যোগ্য দুইটি মুদ্রার কথা কিংবা একই মুদ্রাসহ কার্যকর সাংবিধানিক বিধিনিষেধ আরোপের কথা বলা হয়েছিল ৩য় দফায়। ৪র্থ ও ৫ম দফায় পাকিস্তান সকল প্রদেশের বাণিজ্যিক অধিকার, রীতিনীতি ও দায়িত্ব বন্টনের সাংবিধানিক কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের ওপর দাবি করা হয়। ষষ্ঠ দাবি ছিল, জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠনের। পাকিস্তানের তিন বাহিনীর কোয়ার্টার ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে কিন্তু বাংলার জনগণ এই নিয়ে উচ্চবাচ্য করেনি অথচ নৌবাহিনীর সদরদপ্তর ও মিলিশিয়া বাহিনী গঠনের সাথে সাথেই শেখ মুজিবকে ঘোষণা করা হয় বিশ্বাসঘাতক হিসেবে। স্বৈরাচারী আইয়ুব-মোনায়েম গং দের কাছে ছয় দফা আন্দোলনকে রাষ্ট্রবিরোধী আন্দোলন বলে অভিহিত করে শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামীলীগ এর নেতাদেরকে আপত্তিকর বক্তব্যের কুৎসা রটিয়ে বিভিন্ন জেলার আদালতে আনীত মিথ্যা ফৌজদারি মামলায় আটক করতে থাকে, কিন্তু প্রতিটি মামলায় শেখ মুজিব ও অন্যান্য নেতাগণ মুক্তি লাভ করেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে আইয়ুব সরকার নিত্যনতুন মিথ্যা মামলা রুজু করে শেখ মুজিব ও আওয়ামীলীগ নেতাদের কারাগারে অন্তরীণ করতে বদ্ধপরিকর হন।

শেখ মুজিব পূর্ব বাংলার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ছয় দফার ম্যান্ডেট জনগণের কাছে তুলে ধরে ব্যাপক জনসমর্থন অর্জন করেন যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। তিনি যে জেলায় জনসভা করতেন, সেখানেই তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হত। এভাবে ২ মাসের ব্যবধানে ৮ বার গ্রেপ্তার হন শেখ মুজিব। এভাবে শেখ মুজিবসহ, ছাত্রনেতা, শ্রমিক নেতাদের তৎকালীন সরকারের মামলা হয়রানির প্রতিবাদে ৭ই জুন সারাদেশব্যপী হরতাল পালিত হয়। স্বৈরশাসক আইয়ুব সরকার ১৪৪ ধারা জারি করলেও দেশের আপামর জনতা তা অমান্য করে ছয় দফার পক্ষে রাজপথে সভা ও শোভাযাত্রা বের করে। কিন্তু দুঃখের বিষয়,তীব্র জনরোষের মুখে পুলিশি হামলার নির্দেশ দেন আইয়ুব-মোনায়েম সরকার। এতে শ্রমিকনেতা মনুমিয়া সহ প্রায় ১২ জন নিহত হন, আহত হন শত শত লোক এবং হাজার হাজার নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হন। এতে বারুদের মতন ফুঁসে উঠে দেশের আপামর জনতা এবং ছয় দফা হয়ে উঠে পূর্ব বাংলার জনগণের আপোষহীন ম্যান্ডেট এবং ক্রমাগত পূর্ব বাংলার জনগণের কাছে শেখ মুজিব হয়ে উঠেন নির্ভীক ও আপোষহীন নেতৃত্ব।

ভাষা আন্দোলনের চেতনায় বাঙ্গালির জাতীয়তাবাদের মূলে সেদিন বারি সিঞ্চন করেছিল এই ছয় দফা কর্মসূচি। নিরাশার অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত বাঙ্গালির জাতির আশার প্রদীপ হয়ে শক্তি যুগিয়েছিল। প্রেরণা যুগিয়েছিল স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে। সরকার যতই নিষ্ঠুর হয়েছিল আন্দোলন ততই দানা বাঁধা শুরু করে এবং সংহত হতে থাকে বাঙ্গালির জাতীয়তাবাদ। বাংলার জনগণ এই স্বাধিকার আন্দোলনের সিঁড়ি বেয়ে পরবর্তীতে ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়ে এবং চুড়ান্ত পর্যায়ে সশস্ত্র আন্দোলনে উদ্ধার করে পরাধীনতার গ্লানি।বাংলাদেশ নামক ভূখন্ডের ইতিহাসে ছয় দফা একটি অন্যতম মাইলফলক এবং সুচিন্তিত কর্মসূচি। এটি বাঙ্গালির মুক্তির সনদ,বাঙ্গালির ম্যাগনাকার্টা....

লেখকঃ শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত