1036
Published on জুন 6, 2021মনিরুল ইসলামঃ
১৮৮৫ সালে সর্বভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ভারত উপমহাদেশের জনগণের প্রাতিষ্ঠানিক রাজনৈতিক চর্চার শুরু। এরপর বহু নেতা, বহু দল জনগণের পক্ষ থেকে অনেক দাবীদাওয়া উত্থাপন করেছেন। কিন্তু কোনটাই এত অল্প সময়ে এত বিপুল সাড়া জাগাতে পারেনি, ব্যাপক জনসমর্থন পায়নি এবং অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেনি, যা বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার ক্ষেত্রে ঘটেছে। কিন্তু কেন?
এমন নয় যে, কোন এক শুভ সকাল বা স্নিগ্ধ বিকেলে কয়েকজন নেতা, বুদ্ধিজীবী বা থিংকট্যাংক বিলাসবহুল প্রাসাদের কক্ষে
বসে কতকগুলো দাবী লিপিবদ্ধ করলেন এবং ছয় দফা আখ্যা দিয়ে পেশ বা প্রচার শুরু করলেন। আর মানুষ তা মেনে নিল। ছয় দফা আদৌ এধরনের কিছু নয়। এটি ছিল বঙ্গবন্ধুর পাকিস্তানের ১৯ বছরের রাজনীতির প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ফসল। এই সময় দলের নেতা হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত রাজনৈতিক সফরের মাধ্যমে তৃণমূল মানুষের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছাড়াও তিনি ছিলেন প্রাদেশিক মন্ত্রী, প্রায় তিন বছর পাকিস্তানের দ্বিতীয় গণপরিষদ সদস্য এবং প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বিশেষ দূত। সুতরাং তৃণমূল মানুষের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগের ফলে তাদের সমস্যা, অভাব, অভিযোগ সম্বন্ধে যেমন জেনেছেন, তেমনি সরকারের কেন্দ্রবিন্দুতে কী ঘটে তাও দেখেছেন। দেখেছেন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ কীভাবে শোষিত হচ্ছে। এই শোষণ বন্ধ করার পথই ছিল ছয় দফা। মানুষ যখন দেখল তাদের যেসব সমস্যা নিয়ে নেতা শেখ মুজিবের সঙ্গে তাদের দীর্ঘদিনের মতবিনিময় সেসব সমস্যার সমাধানেরই সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে ছয় দফায়, তখনই তারা এই কর্মসূচিকে লুফে নেয়।
অনেকের কাছে নতুন কর্মসূচি মনে হলেও বঙ্গবন্ধুর কাছে ছয় দফা কর্মসূচি মোটেই নতুন কিছু ছিলনা। ছয় দফায় বিধৃত কথাগুলোর বেশীরভাগই তিনি দীর্ঘ ১৯ বছর ধরে অন্যভাবে বলে আসছিলেন খোদ পাকিস্তানের পার্লামেন্টের ভেতরে বাইরে, রাজপথে জনসভায়। কেউ যদি ছয় দফার প্রতিটি দফা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিশ্লেষণ করেন তাহলে তাঁর এর আগের ১৯ বছরের বক্তৃতা বিবৃতির মধ্যে এগুলোর অত্যন্ত পরিস্কার এবং জোরালো উপস্থিতি খুঁজে পাবেন। ছয় দফা, আমাদের বাঁচার দাবী, বাঙালির মুক্তিসনদ এসব শিরোনামে একত্রে সন্নিবেশিত করে অতি সহজ ভাষায় সংক্ষেপে নতুনভাবে উপস্থাপন করেছেন মাত্র। গোপনীয়তার রাজনীতি বঙ্গবন্ধু চিরদিনই অপছন্দ করতেন। তাই এই কর্মসূচিকে গোপন না রেখে প্রকাশ্যে ঘোষণার সিদ্ধান্ত নিলেন। আর এ জন্য বেছে নিলেন পাকিস্তানের বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহের ঐতিহাসিক লাহোর শহরের আসন্ন সম্মেলনকে। উক্ত সম্মেলনকে বেছে নেয়ার অন্য পরিকল্পনা এবং উদ্দেশ্যও তাঁর ছিল।
লাহোরে বিরোধী দলসমূহের সম্মেলনে যোগদানের উদ্দেশ্যে যাত্রার আগে বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানের সমমনা কয়েকজন নেতার সঙ্গে এক একান্ত বৈঠকে মিলিত হন। ছয় দফা কর্মসূচীটি তাঁদের দেখিয়ে বললেন, আমি এটা নিয়ে সংগ্রাম শুরু করতে যাচ্ছি। তোমাদের সমর্থন এবং সহযোগিতা চাই। দেখে সবাই আঁতকে উঠলেন এবং বললেন, মুজিব ভাই, আইয়ুব খান এখনতো কড়াকড়ি কিছুটা শিথিল করেছে। আমরা সীমিত মাত্রায় হলেও কিছুটা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাতে পারছি। কিন্তু আপনার এই কর্মসূচী দেখলে আপনাকে নিশ্চিত ফাঁসিতে ঝুলাবে এবং আমাদেরও জেলে পুরবে।
গর্জে উঠে বঙ্গবন্ধু বললেন, আমি আইয়ুব খানের কলিজায় হাত দিয়েছি। ওটা ছিঁড়ে আনবোই। তোমরা আমার সঙ্গে আস আর নাইবা আস। উল্লেখ্য, নিজ দলের একেবারেই ঘনিষ্ঠ কয়েকজন ছাড়া এই প্রথম বঙ্গবন্ধু অন্য কারো সঙ্গে ছয় দফা নিয়ে কথা বললেন।
১৯৬৬ সালের ৫--৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধী দলসমূহের সম্মেলন। ৫ ফেব্রুয়ারির সভায় বঙ্গবন্ধু তাঁর ছয় দফা কর্মসূচী উত্থাপন করে ৬ ফেব্রুয়ারির সাব্জেক্ট কমিটির মূল এজেন্ডায় তা অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করেন। কিন্তু অন্যান্য দলের কোন নেতাই তাতে রাজি নন। পশ্চিম পাকিস্তানের অন্য কোন দলের কোন নেতাতো নয়ই, এমনকি নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান এবং পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য দলের নেতৃবৃন্দও এটাকে সমর্থন করা দূরে থাক, আলোচ্যসূচীভুক্ত করতেও সম্মত হলেননা। তারা সবাই এর মধ্যে পাকিস্তানকে দুর্বল , এমনকি পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনা আবিস্কার করলেন।
উল্লেখ্য, এসময় বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাত্র, সভাপতিও নন। সুতরাং ছয় দফা তিনি সম্পূর্ণ একক সিদ্ধান্তেই প্রণয়ন এবং পেশ করেছিলেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং তাজউদ্দিন আহমদসহ ঘনিষ্ঠ কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ করে থাকবেন হয়ত।
বঙ্গবন্ধু সম্মেলন বর্জন করেন। ৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পত্রপত্রিকায় ছয় দফার সংক্ষিপ্ত খবর ছাপা হয়। ১০ ফেব্রুয়ারি লাহোরেই এক তাৎক্ষণিক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ছয় দফার যৌক্তিকতা তুলে ধরে বঙ্গবন্ধু বলেন, যেখানে আমার জনগণের স্বার্থ নিয়ে কথা বলতে পারবোনা সেখানে আমি থাকতে পারিনা। তাই আমি এই সম্মেলনের সঙ্গে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করলাম। ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ফিরে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ জনগণকে দেয়া ওয়াদা রক্ষা করেননি। তিনি ছয় দফার বিস্তারিত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ তুলে ধরেন এবং ১২ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানের পত্রিকাসমূহে এই প্রথম গুরুত্বসহকারে ছয় দফার খবর প্রকাশিত হয়।
লাহোরের এই সম্মেলনেই বঙ্গবন্ধু প্রথমবারের মত তাঁর ছয় দফা কর্মসূচী জনসমক্ষে প্রকাশ করেন। উপস্থিত নেতৃবৃন্দ কর্তৃক তাঁর প্রস্তাব সমর্থন বা আলোচনার জন্য গৃহীত না হলেও অন্যদিক দিয়ে বঙ্গবন্ধু সফল হন। এতে ঐ সম্মেলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় এবং দেশ-বিদেশের গণমাধ্যমে খবরের শিরোনাম হয়: শেখ মুজিব উত্থাপিত ছয় দফার কারণে লাহোর সম্মেলন ব্যর্থ হয়। ছয় দফা রাতারাতি ব্যাপক প্রচার পায় এবং মানুষের মধ্যে এ সম্পর্কে জানার আগ্রহ সৃষ্টি হয়।
লাহোর শহরে ছয় দফা পেশ করার আরেকটি ঐতিহাসিক তাৎপর্য রয়েছে। এ শহরেই ঠিক ২৬ বছর আগে ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ বাংলার আরেক অবিসংবাদিত নেতা শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক তাঁর ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন যার ভিত্তিতে পরবর্তীকালে পাকিস্তান গঠিত হয়। উক্ত প্রস্তাবের কোথাও পাকিস্তান শব্দটি না থাকলেও এরপর থেকে এই দিনটি পাকিস্তান দিবস হিসেবে পালিত হয়। আর ২৬ বছর পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সামরিক শাসক আইয়ুবের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তাদের মুখের উপরে এই লাহোর শহরেই তাঁর "আমাদের বাঁচার দাবী" শিরোনামে ছয় দফা উত্থাপন করেন। এতে অনেকেই এটাকে পাকিস্তানের অস্তিত্ব ও সংহতির প্রতি হুমকি হিসেবে আখ্যায়িত করেন। আইয়ুব খান ঘোষণা করলেন, অস্ত্রের ভাষায় ছয় দফার জবাব দেয়া হবে। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান ঘোষণা করলেন, আমি যতদিন আছি শেখ মুজিবকে জেলেই পঁচে মরতে হবে। ছয় দফার প্রতি ভুট্টোর চ্যালেঞ্জের জবাবে বঙ্গবন্ধু তাকে যেকোন জায়গায় বিতর্কে অবতীর্ণ হবার পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলে ভুট্টো পিছিয়ে যান। এতে ছয় দফার নৈতিক বিজয় হয়েছে বলে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন।
১৯৬৬ সালের ১৮ - ২০ মার্চ ঢাকার আরামবাগস্থ ইডেন হোটেলে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু কাউন্সিল অধিবেশনের জন্য ইডেন হোটেল চত্তরে স্থাপিত মঞ্চটির নাম দিয়েছিলেন "৬ - দফা মঞ্চ"। এই মঞ্চে দাঁড়িয়েই তিনি ছয় দফা ঘোষণা করেন এবং কাউন্সিলর-ডেলিগেটদের অনুমোদন নেন।মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশসহ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা ছয় দফার বিরোধিতা করেন এবং এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে আলাদা দল গঠন করেন। পত্রপত্রিকা কিছুদিন আওয়ামী লীগ (৬ দফা) এধরনের শিরোনামেও খবর ছাপে। অল্প সময়ের মধ্যেই অবশ্য এর অবসান ঘটে, কারণ যারা বেরিয়ে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর দৃঢ়তা ও ছয় দফার প্রতি মানুষের বিপুল সমর্থনের ফলে তারা বেশীদিন টিকতে পারেননি। আসলে কেবল ছয় দফা নয়, জনগণের কল্যাণে যেকোন সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু আগা গোড়াই - যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলোরে -- নীতি অবলম্বন করতেন।
ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দকে ডেকে ছয় দফার কিছু পুস্তিকা দিয়ে বঙ্গবন্ধু বললেন, এটা বাংলার মানুষের মুক্তিসনদ। তোমাদের কাজ হবে বাংলার ঘরে ঘরে এটা পৌঁছে দেয়া। ছাত্রলীগ সেই দায়িত্ব অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিল।
ছয় দফার প্রতি জনসমর্থন সৃষ্টির লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু সমগ্র বাংলাদেশ সফরের কর্মসূচি নিলেন। প্রথমেই চট্টগ্রামে জনসভা। উল্লেখ্য, এর মাধ্যমেই জনসভায় ছয় দফার প্রচার শুরু। ঢাকা থেকে বিমানে চট্টগ্রাম গেলেন বঙ্গবন্ধু। বিমানবন্দর এবং আশপাশের এলাকা জনসমুদ্র। চট্টগ্রামে এর আগে এত বড় জনসমাবেশ কেউ দেখেনি। যে সিঁড়ি দিয়ে বিমান থেকে অবতরণ করবেন বঙ্গবন্ধু সেই সিঁড়ি পর্যন্ত মানুষের ভিড়। নামতে পারছিলেননা তিনি। নিরাপত্তা রক্ষী এবং সিনিয়র নেতৃবৃন্দ অপারগ হয়ে বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ করেন তিনি যেন একটু বলেন মানুষকে। বঙ্গবন্ধু সিঁড়ি দিয়ে দু'এক ধাপ নেমে থেমে বললেন, আমি কি নামবো, নাকি এই বিমানেই ঢাকা ফিরে যাবো? মুহুর্তের মধ্যে মানুষ নিজেরাই দুভাগ হয়ে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর জন্য করিডোরের মত একটা পথ করে দিলেন। বঙ্গবন্ধু নামছেন। হেটে যাচ্ছেন। দু'হাত উপরে উঠানো। ডান হাতের পাঁচ আঙ্গুল আর বাম হাতের তর্জনীটি খোলা। মুখে কিছু বলছেননা। কিন্তু মানুষের মুখে গগণবিদারি শ্লোগান -- ছয় দফা, ছয় দফা। শুধু চট্টগ্রামে নয়, এটা পরবর্তীতে অন্যান্য অনেক স্থানেও দেখা গেছে। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু দু'হাতের ঠিক ছটি আঙ্গুল খুলে চলেছেন বা মঞ্চে দাঁড়িয়েছেন, আর উপস্থিত জনতা উচ্চৈ:স্বরে শ্লোগান দিচ্ছেন - ছয় দফা, ছয় দফা।
বঙ্গবন্ধুর এধরনের কৌশলের ব্যাপারে বয়োজ্যেষ্ঠদের জিজ্ঞাসা করে তখন একাধিক রকমের ব্যাখ্যা পেয়েছিলাম যার প্রতিটিই আসলে সত্য ছিল। কেউ বললেন এটা ছিলো বঙ্গবন্ধুর নিজের উদ্ভাবিত স্টাইল - সাধারণ মানুষের স্বার্থসংক্রান্ত যেকোন কর্মসূচী বা দাবী তাদের মুখে তুলে দেয়া, তাদের দিয়ে বলানো। কেউ বললেন বিরামহীন সফর আর বক্তৃতায় ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়েই তিনি এটা করতেন। আবার কেউ বললেন এবডো'র কথা। ইংরেজি EBDO (পূর্ণরূপ Elective Bodies Disqualification Order) অর্থাৎ কোন ব্যক্তির নির্বাচনে অযোগ্যতা সংক্রান্ত সামরিক আদেশ। আইয়ুব খান ক্ষমতা নিয়েই সোহরাওয়ার্দী এবং বঙ্গবন্ধুসহ পূর্ব পাকিস্তানের ৭৫ জন নেতার উপর এ সামরিক আদেশ জারি করে যাদের বেশির ভাগই ছিলেন আওয়ামী লীগের। মূল আদেশে নির্বাচনের কথা বলা হলেও বাস্তবে সামগ্রিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ব্যাপারেই, এমনকি বক্তব্য বিবৃতির বেলায়ও তা প্রয়োগ করা হতো। এক পর্যায়ে ছয় দফার উপরও এবডো জারি করা হয় অর্থাৎ ছয় দফা কথাটা কেউ মুখেও আনতে বা উচ্চারণ করতে পারবেনা। প্রথম দিকে সামরিক আদেশকে সরাসরি চ্যালেঞ্জের মাধ্যমে উস্কানি না দিয়ে বরং এড়িয়ে চলার কৌশল হিসেবেই বঙ্গবন্ধু এমনটা করতেন। আবার সময়মত প্রয়োজনে আদেশ সরাসরি অমান্যও করতেন। ঐ সময় এবডো কথাটা গ্রামের মানুষের মুখে মুখে ছিল। রাগ বা বিরক্ত হয়ে কেউ কাউকে কথা বলতে বারণ করলে সে ব্যক্তি জবাব দিত, কেন কথা বলবোনা? আমার উপর এবডো নাকি?
দেশব্যাপী সফর কর্মসূচির এক পর্যায়ে সামরিক জান্তা ক্ষিপ্ত হয়ে বঙ্গবন্ধুকে রাজনৈতিকভাবে চাপে রাখার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলাসহ অনেক নতুন মামলা রুজু করে এবং পুরনো মামলা সচল ও ত্বরান্বিত করে। এক পর্যায়ে দেখা যায় এমন কোন জেলা নাই যেখানে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়নি। এখানে শুধু একটি উদাহরণ দেব। ২১ এপ্রিল ১৯৬৬ ছয় দফার সমর্থনে সিলেটের জনসভায় বক্তৃতা করার অপরাধে তাঁকে ধানমণ্ডির বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা জেলে পাঠানো হয়। ঢাকার আদালত জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে তাঁকে সিলেট পাঠিয়ে দিলে সেখানকার আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পান। জেলগেইটে এসে দেখেন অন্য একটি মামলায় তাঁকে পুনরায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। কিন্তু এবার আর তাঁকে সিলেট কারাগারে রাখা হয়নি, এই আশঙ্কায় যে, যদি পরদিন আবার জামিনে মুক্তি পেয়ে যান। তাই গ্রেপ্তার অবস্থায়ই তৎক্ষনাৎ তাঁকে পাঠানো হয় ময়মনসিংহে। ময়মনসিংহ গিয়ে দেখেন ওখানে ইতোমধ্যে তাঁর বিরুদ্ধে আরো দুটি মামলা প্রস্তুত।
এভাবে একের পর এক মামলা চলতেই থাকে। কিন্তু এতদসত্ত্বেও বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক কর্মসূচী অব্যাহত রাখেন এবং যখনই ছাড়া পান, যেটুকু সময় পান ছয় দফা নিয়ে বাংলার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে তৃণমূল মানুষের কাছে ছুটে যান। অবশেষে ৮ মে ১৯৬৬ নারায়ণগঞ্জ জনসভায় ছয় দফার পক্ষে বক্তৃতাশেষে মধ্যরাতে ধানমণ্ডির বাসা থেকে গ্রেপ্তার হয়ে কারাবন্দী থাকেন ১৯৬৯ এর ২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।
এর মধ্যেই আরো কিছু দু:খজনক ঘটনা ঘটে। জ্যেষ্ঠকন্যা শেখ হাসিনার বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য বঙ্গবন্ধুর প্যারোলের আবেদন নামঞ্জুর হওয়ায় ১৭ নভেম্বর ১৯৬৭ প্রথম সন্তানের বিয়ের অনুষ্ঠানে তিনি উপস্থিত থাকতে পারেননি। আরেকদিন কারাবন্দী বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরিবারের সদস্যদের সাক্ষাতের নির্ধারিত দিন এবং সময়ে কারাগারের নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে সন্ধ্যার পর পর্যন্ত অপেক্ষা করেও দেখা বা কোন সদুত্তর না পেয়ে সন্দেহ এবং শঙ্কিত মনে বেগম মুজিব সন্তানদের নিয়ে বাসায় ফিরে যান। তিনি কোন নতুন ষড়যন্ত্র, এমনকি তাঁকেও গ্রেপ্তারের আভাস পান।
এভাবে বঙ্গবন্ধুর কোনরকম খবর ছাড়া বেশ কদিন দুশ্চিন্তায় কাটানোর পর তিনি জানতে পারেন কারাবন্দী থাকা অবস্থায়ই ৩ জানুয়ারি ১৯৬৮ পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে প্রধান আসামি করে 'রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য' শিরোনামে একটি মামলা দায়ের করেছে। ১৮ জানুয়ারি তাঁকে মুক্তির কথা বলে জেলগেইট থেকে পুনরায় গ্রেপ্তার করে ঢাকা সেনানিবাসের নির্জন সেলে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯ জুন ১৯৬৮ ঢাকা সেনানিবাসের অভ্যন্তরে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে সামরিক আদালতে এই মামলার বিচার কাজ শুরু হয়।
লেখকঃ সাবেক অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ,তেজগাঁও কলেজ