বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা ও আমাদের মুক্তির সংগ্রাম

1861

Published on জুন 5, 2021
  • Details Image

মাহমুদুল হাসান (ইমন): 

১৯৪৭ সালে স্যার রেডক্লিফের আঁকা মানচিত্রের মাধ্যমে পৃথক দুটো রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল- ভারত ও পাকিস্তান। ভারতকে একটি খণ্ডে ভাগ করা হলেও, পাকিস্তানকে ভাগ করা হয়েছিলো দুটো খণ্ডে। একটি পশ্চিম পাকিস্তান, আরেকটি হলো পূর্ব পাকিস্তান। এই পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন দেখেছিলেন টুঙ্গিপাড়ার খোকা বাবু। তাই তো একটা জাতিকে স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে নিজের জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন বন্দি কারাগারে। পরিবারকে সময় না দিয়ে স্লোগান দিয়েছেন মিটিংয়ে-মিছিলে। নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করেছিলেন সকল যন্ত্রণা সহ্য করে নেওয়ার জন্য। পূর্ব বাংলার এই বাঙালি জাতিকেই তিনি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত করেছিলেন। সেই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর প্রস্তাবে দেওয়া ছয় দফা দাবিই রচিত করেছিলো 'আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, বাংলার মানুষের মুক্তির সংগ্রাম'।

৬ দফা দাবির আত্মপ্রকাশ:

১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি, পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোরে চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর বাসভবনে কাউন্সিল মুসলিম লীগের সভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ আফজালের সভাপতিত্বে বিরোধীদলের সম্মেলন শুরু হয়। সাবজেক্ট কমিটির এই সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের পক্ষ হয়ে ছয় দফা দাবি পেশ করেন। তবে সেই প্রস্তাব গৃহীত হয় না।

এই খবর শুধু সেই অধিবেশনে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং ৬ ফেব্রুয়ারি পশ্চিম পাকিস্তানের কয়েকটি পত্রিকা বঙ্গবন্ধু ও তার উপস্থাপিত ছয় দফা নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে। সেখানে এই দাবি সম্পর্কে উল্লেখ করে তারা বলে যে, 'পাকিস্তানের দুটি অংশ বিচ্ছিন্ন করার জন্যই চয়দফা দাবি আনা হয়েছে'। জেনারেল আইয়ুব ছয় দফাকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’, ‘বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী’, ‘ধ্বংসাত্মক’, ‘বৃহত্তর বাংলা প্রতিষ্ঠা’র কর্মসূচি বলে আখ্যায়িত করেন এবং এই কর্মসূচির প্রবক্তা বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের ‘এক নম্বর দুশমন’ হিসেবে চিহ্নিত করে, ছয় দফাপন্থীদের দমনে ‘অস্ত্রের ভাষা’ প্রয়োগের হুমকি দেন।

বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে আসার আগে, ১০ ফেব্রুয়ারি, সাংবাদিক সম্মেলন করে এসবের জবাব দেন। ১১ই ফেব্রুয়ারি তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন। দেশে এসে বিমানবন্দরেই তিনি সাংবাদিকদের সামনে ৬ দফা পুনরায় সংক্ষিপ্তাকারে তুলে ধরেন এবং এর ব্যাখ্যা করেন।

বঙ্গবন্ধু যখন ছয় দফা দাবি পেশ করেন, তখন সেখানে শুধু পূর্ব পাকিস্তানের কথা ছিলো তা কিন্তু না, বরং ছয় দফার এই দাবিতে পাকিস্তানের প্রত্যেক প্রদেশকে স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার প্রস্তাব ছিল। কিন্তু পাকিস্তানের কোনো রাজনৈতিক দল এই দাবি গ্রহণ বা আলোচনা করতেও রাজি হয়নি।

পরে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটিতে ছয় দফা দাবি পেশ করলে, আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন এই দাবি গ্রহণ করে। অতঃপর এই দাবিসমূহ ব্যাপকভাবে প্রচারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই দাবি জনগণের সামনে তুলে ধরতে সারাদেশব্যপী সফরের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেসময় ছয় দফা দাবির উপর বঙ্গবন্ধুর লেখা একটি পুস্তিকা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের নামে প্রকাশ করা হয়। শুধু পুস্তিকা কিংবা সম্মেলন করে নয় বরং লিফলেট, প্যাম্ফলেট, পোস্টার ইত্যাদির মাধ্যমেও এই দাবি জনগণের কাছে তুলে ধরার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল।

আইয়ুবের জবাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বক্তব্য:

আমরা পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশ, সংখ্যাগুরু। আমরা বিচ্ছিন্ন হব কেন? আমরা আমাদের ন্যায্য অধিকার চাই, স্বাধীনভাবে বাঁচতে চাই। যারা সংখ্যালগিষ্ঠ, তারা বিচ্ছিন্ন হতে পারে, সংখ্যাগরিষ্ঠরা নয়।

কেন ৬ দফা দাবি?

আমরা যদি ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ নিয়ে চিন্তা করি। তাহলে দেখতে পারি যে, সেসময় এই পূর্ব বাংলা পুরোটাই ছিলো অনিরাপদ ও অরক্ষিত। তাছাড়াও সেনাবাহিনীর উচ্চপদে পূর্ব বাংলার কেউ নেই ছিল না বললেই চলে। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যাকার যুদ্ধের সময় পূর্ববঙ্গের জনগণ ছিল সম্পূর্ণ অরক্ষিত ও অনিরাপদ। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে এই অঞ্চলের সুরক্ষার কোনো মাথাব্যথা ছিল না। সম্পূর্ণভাবে ভারতের দয়ার উপর পূর্ব বাংলাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। ভারত সে সময় যদি পূর্ববঙ্গে আক্রমণ চালাতো, তাহলে প্রতিরোধ করার মতো কোনো শক্তি এই পূর্ববঙ্গে ছিল না। বঙ্গবন্ধু এই পূর্ববঙ্গকে নিরাপদ ও সুরক্ষিত রাখতে এই দাবিগুলো পেশ করেছিলেন।

এছাড়া, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পরে, ১৯৫৪ সালে যখন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে অন্যান্য সকল দল ঐক্যবদ্ধ হয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে এবং নির্বাচনে জয়লাভ করে, তখন মুসলীম লীগ শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। কিন্তু তখন ১৪৪ ধারা জারি করে নির্বাচিত সরকারকে বাতিল করে দেওয়া হয়। পূর্ববঙ্গে চালু করা হয়েছিল কেন্দ্রীয় শাসন। স্বাধীনতার পক্ষ নিয়ে কাজ করা আওয়ামী লীগ যখন অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে, তখন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা ষড়যন্ত্র করেই কী থেমে ছিল? ষড়যন্ত্রে যখন আওয়ামী লীগকে থামাতে পারেনি, তখন ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান 'মার্শাল ল' জারি করে। এভাবে বাঙালিদের উপর আঘাত করে রুখে দিতে চেয়েছিলো পশ্চিম পাকিস্তান।

৬ দফার প্রতি জনসমর্থন

১১ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু ঢাকায় ফিরে আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটিতে ছয় দফা পেশ করার পর, দেশব্যাপী জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে সফর শুরু করেন। ফলে অতি দ্রুত ছয় দফার প্রতি বাংলার মানুষের সমর্থন বেড়ে যায়।

প্রবাদ বাক্যে প্রচলিত আছে যে- কথায় নয়,কাজেই পরিচয়। বঙ্গবন্ধু এই ছয় দফা দাবি নিয়ে সমগ্র পূর্ব বাংলা সফর শুরু করেন। তিনি যে জেলায় জনসভা করতেন, সেখানেই তার বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হতো, গ্রেফতার করা হতো। জামিন পেয়ে আবার অন্য জেলায় সভা করতেন। মাত্র দুই মাসের মধ্যে পরপর ৮ বার গ্রেফতার হন।

কিন্তু ১৯৬৬ সালের ৮ মে নারায়ণগঞ্জের জনসভা শেষ করে ঢাকায় ফিরে আসার পর ধানমন্ডির বাসা থেকে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়। বঙ্গবন্ধুকে জিম্মি করতে একের পর এক বানোয়াট ভিত্তিহীন মামলা দেওয়া শুরু করে পশ্চিম পাকিস্তান সরকার। দলের নেতাকর্মীদের মনোবল কমাতে একইসঙ্গে দলের নেতাকর্মীদেরও গ্রেফতার করা হয়।

ছয় দফা দিবস কীভাবে এলো:

বঙ্গবন্ধু ও দলের নেতাকর্মীদের গ্রেফতারের প্রতিবাদে সারাদেশে ৭ জুন হরতাল ডাকা হয়। হরতালে পূর্ব বাংলার সকল স্তরের মানুষ-রিকশাওয়ালা, স্কুটারওয়ালা, কলকারখানার শ্রমিক, বাস-ট্রাক-বেবি টেক্সিচালক, ভ্যানচালক, দোকানদার, মুটে-মজুরসহ- সকলে এই হরতালে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তৎকালীন পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি জেনারেল আইয়ুব খান এই হরতাল ও আন্দোলন দমন করার জন্য নির্দেশ দেয় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খানকে।

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান বাংলার মানুষ শান্তভাবে হরতাল পালন করলেও কোন উসকানি ছাড়া উপর মহলের নির্দেশে জনতার উপর পুলিশ গুলি চালাতে নির্দেশ দেয়। সেদিন শ্রমিক নেতা মনু মিয়াসহ ১১ জন নিহত হন। পরবর্তীতে এই দিনটিকে দয় দফা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

বঙ্গবন্ধুর ছয়দফা ছিলো বাংলার মানুষের মুক্তির সনদ। ছয় দফাকে 'ম্যাগনাকার্টা' বলেও অভিহিত করা হয়। জাতিসংঘ বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ছয় দফার একটি স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করেছে। যে নেতার নিজস্ব চিন্তায় এসেছে বাংলার স্বাধীনতা, সেই নেতা সম্পর্কে ফিদেল কাস্ত্রোর কথাই যথার্থ, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসিকতায় তিনি হিমালয়ের মতো’।

লেখক: শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজ,ঢাকা।

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত