ছয় দফা ঘোষণার পর শঙ্কিত হয় পাকিস্তানিরা, গ্রেফতার করে বঙ্গবন্ধুকে

2621

Published on জুন 5, 2021
  • Details Image

মো. আসাদ উল্লাহ তুষারঃ

বাঙালির মুক্তির সনদ 'ছয় দফা' যে 'ছয় দফা' ছিল না, 'ছয় দফা'র চূড়ান্ত লক্ষ যে 'এক দফা' ছিল, তা পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ঠিকই বুঝতে পেরেছিল। যে কারণে ছয় দফা ঘোষণার কিছুদিনের মধ্যেই গ্রেফতার করা হয় বঙ্গবন্ধুকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার মন্ত্রে এক সুতায় গাঁথতে ধীরে ধীরে তৈরি করছিলেন। তা করতে গিয়ে যে আন্দোলন সংগ্রাম করতে হয়েছিল, সেজন্য বঙ্গবন্ধুকে বছরের পর বছর কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে থাকতে হয়েছে। ফাঁসির মঞ্চেও যেতে হয়েছে।

এই আন্দোলনটা শুরু হয়েছিল মূলত পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর, সেই ১৯৪৮ সাল থেকেই। যার নেতৃত্বে ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৫২ ভাষা আন্দোলন, '৫৪ এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, '৫৮ এর আইয়ুবের সামরিক শাসন ও তার বিরুদ্ধে আন্দোলন এবং এরই ধারাবাহিকতায় '৬৬ এর ছয় দফা আন্দোলন ও '৬৯ এর গণ অভ্যুত্থান, সর্বশেষ '৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর বিচক্ষণতা ও আন্দোলনের কারণে সেই সময়ের দোর্দান্ত প্রতাপশালী সামরিক একনায়ক ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব শাহীর গদি কেঁপে উঠতো। সেই সমস্ত আন্দোলন বাংলাদেশের স্বাধীনতার একেকটা মাইলফলক।

তেমনই ছয় দফা আন্দোলন বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য একটি ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা। ছয় দফার আন্দোলনই শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতার চূড়ান্ত আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে রূপ নেয়। বরাবরের মতোই এদেশের কিছু গাদ্দার রাজনৈতিক নেতাদের অপপ্রচার ও বিরোধিতার মধ্যেই, ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এক সম্মেলনে, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষে 'ছয় দফা দাবি' পেশ করেন।

১৯৬৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের লাহোরে পৌঁছান এবং তার পরদিন অর্থাৎ ৫ ফেব্রুয়ারি তিনি ৬ দফা দাবি পেশ করেন। ৬ ফেব্রুয়ারি পত্রিকায় শেখ মুজিবকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসাবে চিত্রিত করা হয়। ফলে বঙ্গবন্ধু নিজেই ৬ ফেব্রুয়ারি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ওই সম্মেলন বর্জন করেন। ১৯৬৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি, আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় ছয় দফা প্রস্তাব এবং দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলনের কর্মসূচি গৃহীত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দিন আহমদের ভূমিকা সংবলিত ছয় দফা কর্মসূচির একটি পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়। যার নাম ছিল 'ছয় দফাঃ আমাদের বাঁচার দাবি'।

২৩ শে ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অধিকার আদায়ের ধারাবাহিক সংগ্রামের অংশ হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিরোধী দলীয় সম্মেলনে ৬ দফা পেশ করেন। এরপর ১৮ মার্চ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে দলের সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে ‘আমাদের বাঁচার দাবি: ৬-দফা কর্মসূচি’ শীর্ষক একটি পুস্তিকা প্রচার করা হয়। এরপর, ২৩ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে ছয় দফা উত্থাপন করা হয়।

ছয় দফা দাবির মূল উদ্দেশ্য- পাকিস্তান হবে একটি ফেডারেল রাষ্ট্র, ছয় দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে এই ফেডারেল রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গরাজ্যকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। পরবর্তীকালে এই ছয় দফা দাবিকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতির স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন জোরদার হয়। বাংলাদেশের জন্য এই আন্দোলন এতোই গুরুত্বপূর্ণ যে একে 'ম্যাগনাকার্টা' বা বাঙালি জাতির মুক্তির সনদও বলা হয়। পরবর্তীতে এই ছয় দফা আর ছয় দফা না থেকে এক দফায় পরিণত হয়, যে দফার নাম স্বাধীনতা। যার নেতা ও স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

ছয় দফার দফাভিত্তিক শিরোনামগুলো ছিলো নিম্নরূপ; এরপর প্রত্যেক দফার ব্যাপারে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া ছিল। সেই শিরোনামগুলো হলো:

১.শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ও রাষ্ট্রের প্রকৃতি
২.কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা
৩.মুদ্রা বা অর্থ-সম্বন্ধীয় ক্ষমতা
৪.রাজস্ব, কর, বা শুল্ক সম্বন্ধীয় ক্ষমতা
৫.বৈদেশিক বাণিজ্য বিষয়ক ক্ষমতা
৬.আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠনের ক্ষমতা

ছয় দফা ঘোষণার পর বঙ্গবন্ধু এর পক্ষে প্রচারণা করতে সারাদেশে জনসভা করেন। এক পর্যায়ে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে যান। বঙ্গবন্ধু কারাগারে থাকলেও তার পরোক্ষ নির্দেশনায় আন্দোলন চলতে থাকে এবং দিন দিন তা তীব্রতর হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৬ সালের ৭ জুন, ৬ দফা দাবির পক্ষে দেশব্যাপী তীব্র গণ-আন্দোলনের সূচনা হয়। এই দিনে আওয়ামী লীগের ডাকা হরতালে টঙ্গী, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জে পুলিশ ও ইপিআরের গুলিতে মনু মিয়া, শফিক, শামসুল হক, মুজিবুল হকসহ অনেক বাঙালি শহিদ হন।

১৯৬৬ সালের ৭ জুন বঙ্গবন্ধু কারাগারে ছিলেন। ছয় দফা দাবি পেশ করার কিছুদিন পরেই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা দাবি বাস্তবায়নে সেদিনের হরতাল ও আন্দোলন করতে গিয়ে যেসব নেতাকর্মী শহীদ হয়েছিলেন, তা জেনে জেলখানায় বঙ্গবন্ধুর কী অনুভূতি বা কষ্ট হয়েছিল তার বর্ণনা পাওয়া যায় তার লেখা 'কারাগারের রোজনামচা' বইতে।

বঙ্গবন্ধুর ভাষ্য অনুসারে:

''৭ জুন ১৯৬৬, সকালে ঘুম থেকে উঠলাম। কী হয় আজ? আব্দুল মোনায়েম খান যেভাবে কথা বলছেন, তাতে মনে হয় কিছু একটা ঘটবে আজ। কারাগারের দুর্ভেদ্য প্রাচীর ভেদ করে খবর আসলো দোকান- পাট, গাড়ি, বাস, রিকশা সব বন্ধ। শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল চলছে। এই সংগ্রাম একলা আওয়ামী লীগই চালাইতেছে। আবার সংবাদ পাইলাম পুলিশ আনছার দিয়ে ঢাকা শহর ভরে দিয়েছে । আমার বিশ্বাস, নিশ্চয়ই জনগণ বে-আইনি কিছুই করবে না। শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করার অধিকার প্রত্যেকটি গণতান্ত্রিক দেশের মানুষের রয়েছে। কিন্তু এরা শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করতে দেবে না।

আবার খবর এলো টিয়ার গ্যাস ছেড়েছে। লাঠি চার্জ হতেছে সমস্ত ঢাকায়। আমি তো কিছুই বুঝতে পারি না। কয়েদিরা কয়েদিদের বলে সিপাইরা সিপাইদের বলে। এই বলাবলির ভিতর থেকে কিছু খবর বের করে নিতে কষ্ট হয় না। তবে জেলের মধ্যে মাঝে মাঝে প্রবল গুজবও রটে।

অনেক সময় এসব গুজব সত্যই হয়, আবার অনেক সময় দেখা যায় একদম মিথ্যা গুজব। কিছু লোক গ্রেফতার হয়ে জেল অফিসে এসেছে। তার মধ্যে ছোট ছোট বাচ্চাই বেশি। রাস্তা থেকে ধরে এনেছে। ১২টার পর খবর পাকাপাকি পাওয়া গেল যে- হরতাল হয়েছে, জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালন করেছে। তারা ছয় দফার সমর্থন করে আর মুক্তি চায়, বাঁচতে চায়, খেতে চায়, ব্যক্তি স্বাধীনতা চায় ।শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি,কৃষকের বাঁচবার দাবি তারা চায় - এর প্রমাণ এই হরতালের মধ্যেই হয়ে গেল ।

এ খবর শুনলেও আমার মনকে বুঝাতে পারছি না। একবার বাইরে একবার ভিতরে খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে আছি । বন্দি আমি, জনগণের মঙ্গল কামনা ছাড়া আর কী করতে পারি ! বিকেলে আবার গুজব শুনলাম গুলি হয়েছে, কিছু লোক মারা গেছে। অনেক লোক জখম হয়েছে । মেডিকেল হাসপাতালেও একজন মারা গেছে । একবার আমার মন বলে হতেও পারে, আবার ভাবি সরকার কী এত বোকামি করবে? ১৪৪ ধারা দেওয়া হয় নাই । গুলি চলবে কেন ? একটু পরে খবর এলো- ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। মিটিং হতে পারবে না, কিছু জায়গা টিয়ার গ্যাস মারছে, সে খবর পাওয়া গেল।

বিকালে আরও বহুলোক গ্রেফতার হয়ে এলো। কোর্ট বসিয়ে প্রত্যেককে সাজা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। কাহাকেও একমাস, কাহাকে দুই মাস। বেশির ভাগ লোককেই রাস্তা থেকে ধরে এনেছে শুনলাম। অনেকে নাকি বলে- রাস্তা দিয়া যাইতেছিলাম, ধরে নিয়ে এলো, আবার জেল দিয়ে দিলো। সমস্ত দিনটা পাগলের মতোই কাটলো আমার। তালাবদ্ধ হওয়ার পূর্বে খবর পেলাম নারায়ণগঞ্জ, তেজগাঁ, কার্জন হল ও পুরান ঢাকার কোথাও কোথাও গুলি হয়েছে, তাতে অনেক লোক মারা গেছে। বুঝতে পারিনা সত্য কী মিথ্যা! কাউকে জিজ্ঞাসা করতে পারি না। সেপাইরা আলোচনা করে তার থেকে কয়দিরা শুনে আমাকে কিছু কিছু বলে।

তবে হরতাল সাফল্যজনকভাবে পালন করা হয়েছে সেকথা সকলেই বলেছে। এমন হরতাল নাকি কোনোদিন হয় নাই, এমনকি ২৯শে সেপ্টেম্বরও না। তবে আমার মনে হয় ২৯শে সেপ্টেম্বরের মতোই হয়েছে হরতাল।

গুলি ও মৃত্যুর খবর পেয়ে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেছে। শুধু পাইপই টানছি- যে এক টিন তামাক বাইরে আমি ছয় দিনে খাইতাম, সেই টিন এখন চার দিনে খেয়ে ফেলি। কী হবে? কী হতেছে? দেশকে এরা কোথায় নিয়ে যাবে, নানা ভাবনায় মনটা আমার অস্থির হয়ে রয়েছে। এমনিভাবে দিন শেষ হয়ে এল। মাঝে মাঝে মনে হয় আমরা জেলে আছি। তবুও কর্মীরা, ছাত্ররা ও শ্রমিকরা যে আন্দোলন চালইয়া যাইতেছে, তাদের জন্য ভালোবাসা দেওয়া ছাড়া আমার আর কিছুই নাই।

মনে শক্তি ফিরে এল এবং আমি দিব্যচোখে দেখতে পেলাম 'জয় আমাদের অবধারিত'। কোনো শক্তি আর দমাতে পারবে না।

অনেক রাত হয়ে গেল, ঘুম তো আসে না। নানা চিন্তা এসে পড়ে। এ এক মহা বিপদ। বই পড়ি, কাগজ উল্টাই - কিন্তু তাতে মন বসে না।

ভুলে গেছি, বিকেলে কয়েক মিনিটের জন্য জেলার সাহেব আমাকে দেখতে এসেছিলেন। তার শরীর ভালো না দেখলাম। আজ অসুখ থেকে উঠে এসেছেন। আমার মন ভালো না তাই বললাম, কিছু কথা আছে দুই একদিন পরে আসবেন। তিনি বললেন 'আসবো'। বিদায় নিলেন।

দৈনিক আজাদ পত্রিকার সংবাদ পরিবেশন ভালই করেছে, 'আওয়ামীলীগের উদ্যোগে আজ প্রদেশে হরতাল'। হরতালকে সাফল্যমণ্ডিত করার জন্য আওয়ামী লীগের একক প্রচেষ্টা।' প্রোগ্রামটাও দিয়েছে ভালো করে ।

পাকিস্তান অবজারভার হেডলাইন করেছে 'হরতাল' বলে। খবর মন্দ দেয় নাই ।

মিজানের বিবৃতিটি চমৎকার হয়েছে, হলে কী হবে 'চোরা নাহি শোনে ধর্মের কাহিনী।'...…....''

বঙ্গবন্ধু জেলখানায় বসে তার কর্মীদের জন্য, দেশের জন্য, দেশের মানুষের মুক্তির জন্য, যে কী পরিমাণ মর্মপীড়ায় ভোগেন, তা তার কারাগারের দিনলিপি পড়লেই বোঝা যায়। বঙ্গবন্ধুকে কারাগারে রেখে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বাংলাদেশের অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে স্তিমিত করতে চেয়েছে। কিন্তু হয়েছে তার উল্টো। বঙ্গবন্ধুর মুক্তির আন্দোলন ও বাঙালির অধিকার আদায়ের আন্দোলন আরো তীব্রতর হয়েছে। বঙ্গবন্ধু বাইরে থাকলে আন্দোলন তীব্র হবে- এই ভয়ে মিথ্যা মামলায় তাকে বার বার গ্রেফতার করতেন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। বঙ্গবন্ধু কারাগারকে ভয় পেতেন না কোনোদিন। কারাগারে তিনি অমানুষিক কষ্ট ভোগ করেছেন আর পরিবার পরিজন নিয়ে তার প্রিয়তমা স্ত্রী মহিয়সী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব কারাগারের বাইরে নিদারুণ দুঃখ কষ্ট সহ্য করেও নেতাকর্মীদের সাহস যোগাতেন, সহযোগিতা করতেন, পাশে থাকতেন।

বঙ্গবন্ধুর প্রধান শক্তি ছিল ছাত্রলীগ ও শ্রমিকরা। দেশের সাধারণ মানুষ তো ছিলই। যে কোনো আন্দোলন ছাত্রলীগের নেত কর্মীরা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সর্বশক্তি নিয়োগ করতো। ছয় দফা আন্দোলনেও ছাত্রলীগের ঐতিহাসিক ভূমিকা ছিল।সাথে ছিলেন টঙ্গী, ঢাকার তেজগাঁও ও নারায়ণগঞ্জের শ্রমিকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সেক্ষেত্রে কী কারাগারে, কী কারাগারের বাইরে, বঙ্গবন্ধুই ছিলেন সমস্ত আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু। তাকে কেন্দ্র করেই এগিয়ে যেত আন্দোলন, সংগ্রাম। ১৯৫২র ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ এর ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ এর গণ অভ্যুত্থান, ১৯৭১ এর সুমহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু একসূত্রে গাঁথা, এক ও অভিন্ন।

বিচক্ষণ বঙ্গবন্ধু জানতেন- পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর নাগপাশ থেকে বের হয়ে আসতে এবং স্বাধীনতার মন্ত্রে দেশের মানুষকে উজ্জীবিত করতে ধাপে ধাপে এগিয়ে যেতে হবে। বিচ্ছিন্নতাবাদের তকমা গায়ে লাগিয়ে দিয়ে বাঙালির হাজার বছরের স্বপ্নসাধ যাতে কোনোভাবেই পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী পদদলিত করতে না পারে, সে ব্যাপারে খুবই সচেতন ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। যে কারণে তৎকালীন পাকিস্তানি স্বৈরাচারী সামরিক সরকার বঙ্গবন্ধুর আসল উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে, তাকেই প্ৰধান শত্রু গণ্য করে, তার উপরই বেশি নিপীড়ন ও কারাবরণের স্ট্রিমরোলার চালান। তৎকালীন পাকিস্তানে আরো অনেক বড় বড় নেতা থাকলেও বঙ্গবন্ধুর উপর যে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন গেছে তা আর কাউকেই স্পর্শ করতে পারেনি। ছয় দফা তেমনই ছিল পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর জন্য চূড়ান্ত ওয়ার্নিং। যার ফলে ১৯৬৬ সালের ৭ জুন হরতাল পালনকালে ছাত্র জনতা ও শ্রমিকের উপর গুলি চালিয়ে, বাঙালিকে নির্বিচারে হত্যা করে, হিংস্র ও বর্বর মানসিকতার পরিচয় দেয় পাকিস্তানিরা। বাঙালিও রাজপথে তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে, অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে অভীষ্ট লক্ষে পৌঁছাতে, সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন।

তৎকালীন শাসক গোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা না মানলেও, বাঙালি জাতি সেই ছয় দফার আড়ালে থাকা এক দফা অর্থাৎ স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনে। দীর্ঘদিনের অনাচার অবিচার শেষে, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে, বীর বাঙালির কাছে পরাজিত হয়ে আত্মসমর্পণ করে, মাথা নিচু করে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় বাংলার স্বাধীনতা। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে প্রিয় স্বাধীন দেশে পদার্পণ করেন স্বাধীনতার মহানায়ক ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শুরু হয় দেশ গড়ার নতুন অধ্যায়।

লেখক: কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত