1832
Published on মে 17, 2021এম. নজরুল ইসলামঃ
১৯৮১ সালের আগে নিতান্তই আটপৌরে জীবন ছিল তাঁর। দিন কাটছিল আর দশটা বাঙালি নারীর মতই ঘরকন্না করে। কিন্তু রাজনীতি ছিল তাঁর রক্তকণায়। রাজনীতিবিদ বাবার আদর্শের পতাকা হাতে ১৯৮১ সালের ১৭ মে থেকে শুরু হলো তাঁর নতুন পথচলা। দেশের প্রাচীন ও প্রধান রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব নিয়েই দেশে ফিরেছিলেন তিনি। সেদিন তিনি এসেছিলেন একা। কিন্তু তাঁর এই নিঃসঙ্গ একাকীত্ব কাটিয়ে উঠতে একটুও অপেক্ষা করতে হয়নি তাঁকে।
১৭ মে, ১৯৮১। সেদিন ঢাকার সব পথ মিশে গিয়েছিল বিমানবন্দর ও মানিক মিয়া এভিনিউতে। আসলে অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্তি চাইছিল যে মানুষ, তারা বুঝেছিল, তাদের ত্রাতা আসছেন। আসছেন সেই দিকনির্দেশক, যিনি মুক্তির অগ্রযাত্রায় আসন্ন বিপ্লবের নেতৃত্ব দেবেন। মানুষের অধিকার ফিরে পাবার আন্দোলনে নতুন গতি যে তাঁরই যোগ্য নেতৃত্বে নতুন করে সূচিত হবে, তা বুঝতে এ দেশের মানুষের একটুও সময় লাগেনি। বঙ্গবন্ধুর মতো উদারপ্রাণ, মহৎ মানুষকে হারিয়ে এদেশের মানুষ তখন এমন কাউকে খুঁজছে, যাঁর ওপর শতভাগ নির্ভর করা যায়। মানুষের আস্থার প্রতীক হিসেবেই তাঁর ফিরে আসা এই মাটিতে। জনক্যলাণের ব্রত সাধনার মন্ত্রে নতুন দীক্ষা নিয়ে আজকের এই দিনে এক নিঃস্ব নারী পিতৃভূমিতে পা রেখেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, তিনি একেবারেই একা নন। বাংলার মানুষ রয়েছে তাঁর পাশে। এরাই তাঁর আত্মার আত্মীয়। হার্দিক উষ্ণতায় এদেশের মানুষ তাঁকে বরণ করে নিয়েছিল। নিজেকে উজাড় করে একরাশ বৃষ্টির মধ্যে তিনিও ভেসে গিয়েছিলেন আবেগের অশ্রুতে। আজ তিনি মানুষের মুক্তির প্রতীক। টানা তৃতীয়বারের মতো সরকারের প্রধান তিনি। সব অপশাসনের মূলোৎপাটন করে বাংলাদেশকে আজ নিয়ে গেছেন এক অনন্য উচ্চতায়।
তার পর এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় বারবার শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে পড়তে হয়েছে তাঁকে। অন্তরীণ করা হয়েছে। হত্যার উদ্দেশে কমপক্ষে ১৯ বার সশস্ত্র হামলা হয়েছে তাঁর ওপর। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়লাভ করে এবং তাঁর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হলো জনগণের সরকার। ক্ষমতায় এসে তিনি জনগণের ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য, দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, শিক্ষার মানোন্নয়ন, পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন, কৃষিব্যবস্থা আধুনিকীকরণ, বহির্বিশ্বে দেশের মর্যাদা পুনরুদ্ধার করার পাশাপাশি জাতির জনকের হত্যাকারীদের রক্ষাকবচ কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে হত্যাকারীদের বিচারের প্রক্রিয়া শুরু করলেন। ১৯৯৭ সালের ২৩ জুন যমুনা নদীর ওপর নির্মিত দেশের সর্ববৃহৎ বঙ্গবন্ধু সেতু উদ্বোধন করেন। ১৯৯৭ সালের ২২ ডিসেম্বর পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে যে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করেন তার সাফল্যের জন্য ১৯৯৯ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর তাঁকে ইউনেসকোর শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। মহান ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক দিবস একুশে ফেব্রুয়ারি তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের গৌরবজনক মর্যাদা পায়। আবার ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাঁকে গ্রেপ্তার করে সংসদ ভবন চত্বরে সাবজেলে পাঠায়।
সব চক্রান্তের জাল একে একে ছিন্ন করে তিনি বাঙালিকে অভীষ্ঠ লক্ষ্যে পৌঁছে দেওয়ার ব্রত সাধনা থেকে একটুও বিচ্যুত হননি। বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের বিচার হয়েছে এই দেশে। কার্যকর হয়েছে দণ্ড। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার হচ্ছে। ভারতের সঙ্গে অমীমাংসিত ইস্যুগুলো যৌক্তিক পর্যায়ে সমাধান হয়েছে। বাস্তবায়িত হয়েছে সীমানা চুক্তি। বিনিময় হয়েছে ছিটমহল। দেশের সমুদ্রসীমা নিয়ে যে বিরোধ ছিল, আন্তর্জাতিক আদালতে তার সমাধান হয়েছে। বাংলাদেশ যে আজ বিশ্বের কাছে রোল মডেল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে, তার শতভাগ কৃতিত্ব শেখ হাসিনার। তাঁর যোগ্য নেতৃত্ব আজ বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে নতুন পরিচয়ে পরিচিত করেছে।
স্বাধীনতা-পরবর্তী ৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্জন তো কম নয়। মধ্যম আয়ের দেশটি পোশাকশিল্পে বিপ্লব ঘটিয়েছে। শিক্ষা, জন্ম নিয়ন্ত্রণ ও শিশু-মাতৃ মৃত্যুর হার নিয়ন্ত্রণ, নারীর ক্ষমতায়ন, চিকিৎসা, খেলা, তথ্য-প্রযুক্তি, পাটের জিনতত্ত্ব আবিষ্কার ও কৃষি-মৎস্য উৎপাদনে পেয়েছে অনন্য সাফল্য। জন্মের ৫০ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে দ্রুতগতিসম্পন্ন বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের সফলতা দেখিয়েছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ এখন নিতে পারে মেগা প্রকল্পের দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা। অর্জন করেছে এমডিজি। এসডিজি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, লিঙ্গ সমতা, কৃষি, দারিদ্র্যসীমা হ্রাস-ইত্যাদি বিষয়ে কাজ হচ্ছে। বৃদ্ধি পেয়েছে আয়ু। রপ্তানীমূখী শিল্পায়ন বেড়েছে। ১০০ টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল উন্নয়নে কাজ হচ্ছে। পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর, ঢাকা মেট্রোরেলসহ দেশের মেগা প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়িত হলে বদলে যাবে দেশের চেহারা।
ক্ষুদ্র আয়তনের একটি উন্নয়নশীল দেশ হয়েও বাংলাদেশ এরই মধ্যে সারা বিশ্বের কাছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের নিবিড় সমন্বিত ব্যবস্থাপনা, ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবহার এবং দারিদ্র দূরীকরণে তার ভূমিকা, জনবহুল দেশে নির্বাচন পরিচালনায় স্বচ্ছ ও সুষ্ঠুতা আনয়ন, বৃক্ষরোপণ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সূচকের ইতিবাচক পরিবর্তন প্রভৃতি ক্ষেত্রে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জনক্যলাণের ব্রত সাধনার মন্ত্রে নতুন দীক্ষা নিয়ে আজকের এই দিনে পিতৃভূমিতে পা রেখেছিলেন যিনি, আজও তিনি মানুষের মুক্তির প্রতীক। মানুষের কল্যাণ সাধনার ব্রত নিয়ে নতুন মন্ত্রে দীক্ষা নিয়েছিলেন বলেই নতুন করে জেগে ওঠা বাংলাদেশের প্রতীক শেখ হাসিনা। বাংলাদেশ আজকের রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় শেখ হাসিনার অবদান অনস্বীকার্য। এই অর্জন ধরে রাখতে ও উন্নত দেশ হিসেবে নিজেদের তুল ধরতে তাঁর গতিশীল নেতৃত্বের কোনো বিকল্প নেই। এদেশের মানুষের আস্থার প্রতীক তিনি। আজকের এই দিনটিকে তাই বিশেষভাবে স্মরণ করি। স্মরণ করি সেই বর্ষণমুখর দিন, যেদিন তিনি ফিরেছিলেন বাংলাদেশে, মানুষের কল্যাণব্রত সাধনার নতুন মন্ত্রে দীক্ষা নিয়ে। নতুন করে জেগে ওঠা বাংলাদেশের প্রতীক শেখ হাসিনা।
১৯৮১ সালের এই দিনে তিনি ফিরে এসেছিলেন প্রিয় পিতৃভূমিতে। আর সেই থেকে তিনি অসহায় মানুষের ত্রাতা। তিনিই দিকনির্দেশক, অর্থনৈতিক মুক্তির অগ্রযাত্রায় বিপ¬বের নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। ভয়কে জয় করে সেদিন তিনি ফিরে এসেছিলেন বলেই বাংলাদেশ আজ এই করোনা সংকটেও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বাংলাদেশের ইতিবাচক পরিবর্তনের অগ্রনায়ক তিনি। তাঁকে ঘিরেই সুন্দর আগামীর স্বপ্ন দেখে বাংলাদেশ। তাঁর জয় হোক। জয় হোক বাংলার মানুষের। তাঁর নেতৃত্বে করে শুরু হওয়া গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় আরো এগিয়ে যাক বাংলাদেশ।
আপনার জয় হোক মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। জয় হোক বাংলার মানুষের। জয় বাংলা।
লেখক: সর্ব ইউরোপীয় আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং অস্ট্রিয়া প্রবাসী লেখক, মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিক