2049
Published on এপ্রিল 17, 2021ডা. সৈয়দা জাকিয়া নূর লিপিঃ
১৭ই এপ্রিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় দিন। এই দিনে বর্তমান মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলায় (পরবর্তী সময়ে যার নামকরণ হয় মুজিবনগর) বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথগ্রহণ করে। সংক্ষিপ্ত এই অনুষ্ঠানে দেশি-বিদেশি অর্ধশতাধিক সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবর্তমানে যুদ্ধকালীন এই সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্বে থাকা আমার পিতা, জাতীয় চার নেতার অন্যতম সৈয়দ নজরুল ইসলাম গার্ড অব অনার গ্রহণ করেন। স্যালুট নিতে থাকা তাঁর সেই মুহূর্তের ছবিটির সঙ্গে আমরা অনেকেই পরিচিত। ৫০ বছর আগের সেই সাদাকালো ছবিটি একটি বিরল ঐতিহাসিক দলিল এবং ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে অমূল্য। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর প্রেক্ষাপটে আমি নতুন করে সেই বিশেষ ক্ষণের কুশীলবদের কথা স্মরণ করছি এবং তাঁদের প্রতি আমাদের যে অপূরণীয় ঋণ রয়েছে সে কথা ভেবে কিছুটা আবেগতাড়িত হয়ে উঠছি।
১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর সহযোদ্ধাদের বেশির ভাগই তখনো চল্লিশের কোঠায়, তাঁদের ছিল পরিবার-পরিজন, আদরের শিশুসন্তান। সব কিছু ফেলে ২৫শে মার্চের পর তাঁরা সীমান্ত অতিক্রম করে আশ্রয় নেন প্রতিবেশী দেশ ভারতে। এক অনিশ্চিত গুরুদায়িত্ব মাথায় তুলে নেন, কারণ তাঁদের ছিল অপরিসীম সাহস, দেশের জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা আর প্রাণপ্রিয় নেতার প্রতি অবিচল আস্থা। দু-একজন ব্যতিক্রম ছাড়া কেউই মন্ত্রিসভার পদ-পদবি নিয়ে ব্যস্ত হননি। তাঁরা জানতেন, তাঁরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত। সুতরাং সরকার গঠন করার সম্পূর্ণ এখতিয়ার তাঁদের রয়েছে। শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বক্তব্যে ফুটে ওঠে তাঁদের প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা এবং সাধারণ মানুষের জন্য ভালোবাসা। মঞ্চে ইচ্ছাকৃতভাবেই রাষ্ট্রপতির জন্য নির্ধারিত চেয়ারটি খালি রাখা হয়েছিল বিশ্ববাসীকে জানাবার জন্য যে বাংলার অবিসংবাদিত নেতা, স্বাধীনতার রূপকার বঙ্গবন্ধুর জন্য সবাই অপেক্ষমাণ।
ষাটের দশক থেকেই এই নিবেদিতপ্রাণ সহযোদ্ধারা দেশের মানুষের মুক্তির আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু জেলে ছিলেন অনেক দিন, কিন্তু এতে সংগ্রাম কিংবা স্বাধিকার আন্দোলন থেমে থাকেনি। ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে থেকে তাঁরা একে অপরের পরিপূরক হিসেবে—দেশের জন্য, জনগণের জন্য একনিষ্ঠভাবে কাজ করে গেছেন। কী দুঃসাহসী তাঁরা ছিলেন—ভাবলে অবাক হতে হয়। ১৭ই এপ্রিল বাংলাদেশের যে নতুন সরকারের শপথ অনুষ্ঠান হবে এটি পাকিস্তানি বাহিনী জেনে গিয়েছিল এবং সে জন্যই পূর্বনির্ধারিত স্থান চুয়াডাঙ্গায় পাকিস্তানি বিমানবাহিনী তুমুল বোমাবর্ষণ করে। তা সত্ত্বেও তড়িঘড়ি করে অতিগোপনে মেহেরপুরের আম্রকাননে শপথগ্রহণের ব্যবস্থা করা হয়। এই স্থানটির সঙ্গে ভারতীয় সীমান্তের যোগাযোগ ছিল ভালো, অথচ মেহেরপুরের সঙ্গে কোনো ভালো সড়কপথ তখন ছিল না। প্রচুর আমগাছ থাকায় বিমান থেকে খুব সহজে বোঝাও যাবে না; কিন্তু শপথ মঞ্চ থেকে মাত্র ২০ মাইল দূরেই তখন অবস্থান করছিল আধুনিক মারণাস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনী। গা শিউরে ওঠার মতো ব্যাপার বৈকি! এই অসম সাহসী কাজটি করতে পারার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সরকার বৈধতা পায় এবং যাত্রা শুরু করে।
যুদ্ধকালে এই সরকারের প্রধান দায়িত্ব ছিল মুক্তিযুদ্ধকে পরিচালনা করা, যেন গেরিলা যোদ্ধারা মনোবল না হারায়। পরাক্রমশালী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে অপরিকল্পিত ও বিক্ষিপ্তভাবে আক্রমণ করে পরাভূত করা সম্ভব ছিল না। প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানী এর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আরেকটি বিশেষ দায়িত্ব ছিল বিশ্বকে জানানো—বাংলাদেশের নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্যরা স্বাধীন সরকার গঠন করেছে এবং অন্য দেশ যেন একে স্বীকৃতি দেয়। শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানেই এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট আহ্বান জানানো হয় উপস্থিত দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের মাধ্যমে। বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের ওপর কি পৈশাচিক বর্বরতা পাকিস্তান সেনাবাহিনী চালিয়ে যাচ্ছে সে সম্পর্কেও সভ্য ও গণতান্ত্রিক দেশের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। আরেকটি প্রধান দায়িত্ব ছিল বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারে ভারত সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা। পৃথিবীতে অনেক দেশই আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে; কিন্তু একটি প্রবাসী সরকারের এমন সাফল্য বিশ্ব ইতিহাসে সত্যিই বিরল।
১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে বাংলার তথা ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল, আর আমরা ২০০ বছরের ঔপনিবেশিক শাসনের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হই। কি এক অদ্ভুত যোগাযোগ যে, সেই স্থান থেকে অল্প দূরে আরেকটি আম্রকাননেই বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে; জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা নিয়মতান্ত্রিকভাবে নতুন সরকারের শপথগ্রহণ করেন। যতবারই আমি আমার পিতার স্যালুট গ্রহণের ছবিটির দিকে তাকাই, ততবারই একটা দুঃখ মেশানো অব্যক্ত আনন্দ আমাকে অভিভূত করে। অল্প বয়সে বাবাকে হারানোর কষ্টটা ছাপিয়ে একটা কথাই শুধু মনে অনুরণিত হতে থাকে। যে ত্যাগ, তিতিক্ষা ও দেশপ্রেমের উদাহরণ আপনারা রেখে গেছেন সেটিই হোক আমাদের পাথেয়, আমাদের সামনে চলার শক্তি। বাংলাদেশ আজ বীরদর্পে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে, জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে আমি সেই সব সূর্যসন্তানের কথা আবারও সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করছি। বীরের মৃত্যুর চেয়ে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে?
লেখক : সংসদ সদস্য, কিশোরগঞ্জ-১; সদস্য, স্বাস্থ্যবিষয়ক সংসদীয় কমিটি