1368
Published on মার্চ 24, 2021মুহাম্মদ শামসুল হক:
১৯৭১ সালের ছাব্বিশে মার্চ প্রথম প্রহরে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের প্রত্যক্ষ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে ৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে দেশব্যাপী যে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয় তাতে চট্টগ্রামের বীর জনতা অনন্য ভূমিকা পালন করেন। বিশেষ করে উল্লেখ করতে হয়, পাকিস্তান থেকে অস্ত্র বোঝাই ‘সোয়াত’ জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাসে বাধা দিতে গিয়ে কয়েকশত শ্রমিক-জনতা ও বাঙালি সৈন্যের মরণপণ সংগ্রামের কথা।
সাতই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সমগ্র চট্টগ্রামবাসীকে দারুণভাবে সংগ্রামে উদ্দীপ্ত করে। ওই ভাষণের পর থেকেই চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে ছোট-বড় আকৃতির বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা তৈরি ও বেচাকেনা হতে দেখা যায় চার আনা থেকে এক টাকা দামে। প্রায় প্রতিদিন কোনো না কোনো স্থানে সংস্কৃতিকর্মীসহ জনতার মিছিল-সমাবেশ চলতে থাকে। নেতা-কর্মীরা স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা এবং পাকিস্তানি সামরিক-জান্তার ষড়যন্ত্র সম্পর্কে জনগণকে সতর্ক ও সংগঠিত করার কাজে নিয়োজিত থাকেন। সব মানুষই মানসিকভাবে ধরে নেন যে, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’–এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু পরোক্ষভাবে স্বাধীনতার ঘোষণাই করেছেন। কাজেই যেকোনো সময় পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ শুরু হতে পারে। বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর মধ্যে পরস্পর আলোচনা ও সংগ্রাম পরিষদ গঠনের মাধ্যমে চলে বেসামরিক প্রতিরোধ প্রস্তুতি। এলাকায় এলাকায় শুরু হয় বন্দুক-বল্লম ও দেশি অস্ত্র সংগ্রহের প্রক্রিয়া।
এদিকে, সাতই মার্চের পর থেকে সাধারণ মানুষের মুখে মুখে বলাবলি হচ্ছিল, ‘সোয়াত’ নামক একটি জাহাজ আরব সাগর পেরিয়ে বাংলাদেশে তথা চট্টগ্রাম বন্দরে এসেছে। বন্দরে অবস্থিত পাকিস্তানি নৌ-সেনারা এ সম্পর্কে ওয়্যারলেসে যেসব কথাবার্তা বলাবলি করেন, বাঙালি কর্মচারীদের কেউ কেউ তা বুঝে ফেলেন। তারা অস্ত্রের চালান আসার খবরটি বাইরে আওয়ামী লীগ নেতাদের জানিয়ে দেন। বিষয়টি দ্রুত পুরো শহর ছড়িয়ে পড়লে সর্বস্তরের জনতার মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এ সময় আওয়ামী লীগ নেতারা পরস্পর যোগাযোগের মাধ্যমে করণীয় ঠিক করেন। তারা সিদ্ধান্ত নেন, যেকোনো উপায়ে অস্ত্র খালাস প্রচেষ্টা ঠেকাতে হবে। চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের প্রথম সারির নেতাদের মধ্যে তখন এ নিয়ে তৎপরতা চালান জহুর আহমদ চৌধুরী, এম আর সিদ্দিকী, এম এ হান্নান, এম সিদ্দিক, আবদুল্লাহ আল হারুন চৌধুরী, সিরাজুল হক মিয়া, এম এ মান্নান, আতাউর রহমান খান প্রমুখ।
পরে জানা গেছে, পাকিস্তানি পতাকাবাহী ৯ হাজার ২২৩ টন ক্ষমতাসম্পন্ন ৪৭০ ফুট দৈর্ঘ্যের ‘সোয়াত’ জাহাজটি করাচি বন্দর থেকে এসে ২৮ ফেব্রুয়ারি বেলা প্রায় আড়াইটায় (১৪.৩০টা) চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে অবস্থান নেয়। জাহাজটির ক্যাপ্টেন ছিলেন জনৈক এস (শামসুল) আলম চৌধুরী। এজেন্ট ছিল ন্যাশনাল শিপিং করপোরেশন।
জাহাজটি ১৭ মার্চ সাড়ে চারটা থেকে সাড়ে পাঁচটার মধ্যে ১৭ নম্বর জেটিতে ভেড়ানো হয়। তখন পোর্ট পাইলট ছিলেন একজন অবাঙালি মি. মোকাদ্দাম। ১৮ মার্চ থেকে জাহাজের অস্ত্র খালাসের চেষ্টা চালানো হলে বন্দরের বাঙালি শ্রমিক-কর্মচারী-কর্মকর্তারা এতে সহযোগিতা করতে অস্বীকার করেন।
অবসরপ্রাপ্ত মেজর রফিকুল ইসলাম বীর উত্তমের (পরবর্তী সময়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী) মতে, “২৮ ফেব্রুয়ারি সোয়াত জাহাজ ভিড়েছে ১০ হাজার টন অস্ত্র-গোলাবারুদ নিয়ে। একই দিন পাকিস্তান থেকে একটি বিমানে করে বেলুচ রেজিমেন্টের কন্টিনজেন্ট ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণ করে। তার অর্থ দাঁড়ায় ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি কোনো একসময় পাকিস্তানি বাহিনী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বাঙালিদের কাছে তারা ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না এবং আমাদের ওপর গণহত্যা অভিযান চালানো হবে।”
এদিকে বন্দরে সোয়াত ভেড়ার খবর পাওয়ার পর থেকে চট্টগ্রামের সংস্কৃতিকর্মীসহ সর্বস্তরের জনতা সোয়াত থেকে অস্ত্র খালাস ও তা অন্যত্র সরবরাহে বাধা দিতে বদ্ধপরিকর হন। এ ব্যাপারে পারস্পরিক যোগাযোগ ও সমন্বয়ের জন্য বেশ কিছু ইউনিট করে দেওয়া হয়। জেটির অভ্যন্তরে কর্তব্যরত বাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর দায়িত্ব ছিল বাক্সভর্তি অস্ত্রের চালান জেটিতে কখন নামছে এবং কোথায় নেওয়ার চেষ্টা চলছে–এসব তথ্য জানানোর। বন্দরের ভেতর বলাবলি হয়, ২০ মার্চের মধ্যেই সোয়াত জেটিতে ভিড়বে। জেটিতে কর্মরত শ্রমিকনেতারা এক গোপন বৈঠকে কোনো বাঙালি শ্রমিক ‘সোয়াত’ থেকে কোনো মাল খালাস হতে দেবে না বলে সিদ্ধান্ত নেন। পরিবহন কাজেও বাঙালি চালকেরা জড়িত না থাকার অঙ্গীকার করেন। অন্য দিকে দেশি কিছু অনুচরের মাধ্যমে এসব সিদ্ধান্তের কথা পাকিস্তানি বাহিনীর সংশ্লিষ্ট মহল জেনে যায়। তারাও যেকোনো উপায়ে অস্ত্র খালাসের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। তারা বুঝতে পারেন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি ব্রিগেডিয়ার মজুমদার অস্ত্র খালাসে দেরি করছেন। এতদিন চট্টগ্রামে জেটিতে নোঙর করা সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাসে শ্রমিকেরা অস্বীকৃতি জাানিয়ে আসছিলেন। বাঙালি ব্রিগ্রেডিয়ার এম আর মজুমদারের পরোক্ষ সায় ছিল এতে।
অস্ত্র খালাস নিশ্চিত করার জন্য ২৪ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের জিওসি মেজর জেনারেল খাদেম হোসেন রাজা হেলিকপ্টারে চট্টগ্রাম আসেন। ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। চট্টগ্রামের দায়িত্ব দেওয়া হয় অবাঙালি ব্রিগেডিয়ার আনসারীকে। তিনি ঘোষণা দেন, ‘যেকোনো মূল্যে গোলাবারুদ-অস্ত্র নামাতে হবে।’
আওয়ামী লীগের তৎকালীন সম্পাদক এম এ হান্নান এম আর সিদ্দিকীর সঙ্গে আলোচনা করে অস্ত্র খালাস প্রতিরোধ করার সিদ্ধান্ত নেন। এম এ হান্নান এ ব্যাপারে ব্রিগেডিয়ার আনসারীর সাথে আলাপ করলে তিনি অস্ত্র খালাসের ব্যাপারে অটল থাকেন। এ অবস্থায় জনতা বন্দর থেকে সেনানিবাস এলাকা পর্যন্ত সড়কের বিভিন্ন স্থানে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে। রহমত উল্লাহ চৌধুরী, আবুল বাশার, আহসান উল্লাহ চৌধুরী, আবুল কালাম, মান্নান সিকদার, নজরুল ইসলাম, ওমর ফারুকসহ অনেক শ্রমিক নেতা সোয়াত জাহাজের অস্ত্র খালাস করতে না দেওয়ার ব্যাপারে সাহসী ভূমিকা রাখেন।
২৪ মার্চ নিউমুরিং এলাকায় আওয়ামী লীগের এক জনসভায় জাহাজ থেকে অস্ত্র সরবরাহ প্রতিরোধ করার জন্য ছাত্র-জনতার প্রতি আহ্বান জানানো হয়। স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ, ছাত্রলীগ কর্মী ও শ্রমিক-জনতা জঙ্গি স্লোগান দিয়ে বন্দর এলাকায় মিছিল বের করেন। ওদিকে বন্দরের ভেতর ‘সোয়াত’ জাহাজ ঘেরাও করে ডক শ্রমিক লীগ সদস্যরা।
২৪ মার্চ সোয়াত জাহাজ প্রতিরোধ সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করে এই প্রতিরোধ সংগ্রামে যুক্ত মুক্তিযোদ্ধা-সাংবাদিক রইসুল হক বাহার বলেন, ‘যুদ্ধ শুরুর আগে আমার কাছে সবচেয়ে স্মরণীয় দিন হচ্ছে ২৪ মার্চ। ওইদিন আমাদের কলোনির মাঠে একটি জনসভার আয়োজন করা হয়। সকাল বেলা শামসুদ্দিন ভাই কলোনির মাঠে আমাদের ডেকে বললেন, “এ মাঠে আজ বিকেলে জনসভা হবে। আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান এতে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেবেন। তোমাদের এই সভার দায়িত্ব নিতে হবে।” আমাদের কাজ ছিল সকাল থেকে মাইকে নিউমুরিং, হালিশহর, পতেঙ্গা ইত্যাদি এলাকায় জনসভার কথা প্রচার করা। আমরা মধ্যম হালিশহরের মালুমদের বাড়ির সংগ্রামী রাজনৈতিক কর্মী এজাহার মিয়ার কাছ থেকে মাইক ভাড়া নিয়ে প্রচার ও সভার আয়োজন করি। এজাহার মিয়া স্থানীয়ভাবে ‘মাইক এজাহার’ নামে পরিচিত। সভা শুরুর আগেই কলোনির মাঠ পূর্ণ হয়ে আশপাশের এলাকা লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। বাসার ছাদ, গাছের ডাল, সবজায়গায় মানুষ আর মানুষ। বাদশা মিয়ার সভাপতিত্বে সভায় এম এ মজিদ, এম এ হান্নান বক্তব্য দেন। এম এ মজিদের বক্তৃতার পর এম এ হান্নান দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বক্তৃতা করছিলেন, এমন সময় দেখা গেল স্টিল মিল এলাকা থেকে প্রায় পাঁচ হাজার লোকের একটি মিছিল আমাদের জনসভার দিকে ছুটে আসছে। মিছিলের প্রত্যেকের হাতে ছিল লোহার লাঠি। স্টিল মিল থেকে রড কেটে এসব লাঠি তৈরি করেছিলেন তারা। মিছিলটি সভাস্থলে ঢোকার সাথে সাথে হান্নান সাহেব বললেন, “আমাদের জনসভা স্থলের পাশে বন্দরের ১৭ নং জেটিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জাহাজ সোয়াত অবস্থান করছে। সেই জাহাজে করে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অস্ত্র আনা হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত অবাঙালি সৈন্যদের অতিরিক্তভাবে সুসজ্জিত করে বাঙালিদের মারার জন্য। আমরা কোনোভাবে এসব অস্ত্র জাহাজ থেকে নামাতে না দিয়ে প্রতিরোধ করবো।” তার এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে জনতা উত্তেজনায় গগণবিদারী স্লোগানে ফেটে পড়ে। তারা সোয়াত অবরোধ বা ঘেরাও করে অস্ত্র নামাতে না দেওয়ার অঙ্গীকার করে। হান্নান সাহেব সভা থেকে সুশৃঙ্খলভাবে মিছিল নিয়ে বারিক মিয়া স্কুলের পাশে ৩ নং জেটির আর্মির নিয়ন্ত্রণ কক্ষে গিয়ে প্রতিবাদ জানানো এবং অস্ত্র নামাতে বাধা দেওয়ার আহ্বান জানান। সভা ভেঙে তৎক্ষণাৎ মিছিলের পুরোভাগে নেতারা অবস্থান নেন। মিছিল সল্ট গোলা হয়ে নিয়ন্ত্রণ কক্ষের দিকে যতই এগোচ্ছিল ততই চারদিক থেকে মানুষের স্রোত এসে মিশে একাকার হচ্ছিল মিছিলে। বন্দর ভবনের সামনে এতে পোর্ট কলোনি থেকে আরও একটি মিছিল যুক্ত হয়। বিকেল সাড়ে ৫টা-পৌনে ৬টার সময় তিন নম্বর জেটি গেইটের সামনে পৌঁছানোর সাথে সাথেই নেভি ফ্লিট ক্লাবের দিক থেকে পাকিস্তানি সেনারা মিছিলের ওপর আচমকা প্রচণ্ড গুলিবর্ষণ শুরু করলে অনেকে হতাহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এমন বর্বরতার জন্য অপ্রস্তুত মিছিলের লোকজন আতঙ্কে কান্নাকাটি এবং যে যেভাবে পারে ছুটোছুটি করে আত্মরক্ষার চেষ্টা করে। আমি নিমতলা, পোর্ট কলোনি হয়ে উত্তর হালিশহরের ভেতর দিয়ে ঘুরপথে নিজ এলাকায় পৌঁছি। পরদিন জানতে পারি ওই গুলিবর্ষণের ঘটনায় ১৭ জন নিহত ও অনেক লোক আহত হয়েছেন। আজাদী ও পিপলস ভিউতে এ সংক্রান্ত বিস্তারিত খবর ছাপা হয়। আওয়ামী লীগ নেতা এম আর সিদ্দিকী, জহুর আহমদ চৌধুরী প্রমুখ ঘটনাস্থলে গিয়ে খোঁজ খবর নেন এবং আহতদের দেখতে হাসপাতালে যান। বঙ্গবন্ধু এই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে দোষীদের শাস্তি দাবি করেন। তাজউদ্দিন আহমদও বিবৃতিতে প্রতিবাদ জানান।
ক্যাপ্টেন রফিক বলেন, “চট্টগ্রাম বন্দরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সে সৈন্যরা ছিল, নেভির যারা ছিল তারা নির্বিচারে গুলি করে বাঙালি শ্রমিকদের হত্যা করে সে দিন রাতে। এই বাঙালিদের লাশ তারা গান বোটে করে গভীর সমুদ্রে নিয়ে ফেলে দেয়, অনেকে সে ঘটনাটা জানেন না। এই লাশগুলো কয়েকদিন পরে কালুরঘাট এলাকা পর্যন্ত ভেসে উঠেছিল।”
২৪ মার্চ চকবাজার প্যারেড ময়দানে অনুষ্ঠিত সংস্কৃতিকর্মীদের এক বিশাল সমাবেশ থেকে অস্ত্র খালাস প্রচেষ্টার প্রতিবাদ জানানো হয়। সভা শেষে হাজার হাজার মানুষ মিছিল নিয়ে বন্দরের দিকে ছুটে যান। সেই সময় সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সক্রিয় ব্যক্তিত্ব মাহবুব হাসান, সুলতান উল আলম প্রমুখ জানান, ২৪ মার্চ চকবাজার প্যারেড ময়দানে অধ্যাপক মমতাজউদ্দিন আহমদের নাটক স্বাধীনতার সংগ্রাম মঞ্চায়ন করা হয়। এতে প্রায় ৮০ হাজার লোকসমাগম হয়। নাটক চলাকালে খবর পাওয়া যায়, সোয়াত থেকে অস্ত্র খালাসে বাধাদানকারী বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানিরা নির্বিচারে গুলি চালাচ্ছে। এতে দর্শক-শ্রোতাদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। প্রায় ১০ হাজার মানুষ মিছিল নিয়ে প্রতিরোধে অংশ নেওয়ার জন্য বন্দরের দিকে ছুটে যান। প্রসঙ্গত, মাহবুব হাসান ও সুলতান উল আলম এবং নাটকের রচয়িতা মমতাজউদ্দিন আহমদ ওই নাটকে অভিনয় করেন। ২৫ মার্চ লালদিঘির মাঠের সমাবেশ থেকেও সোয়াত প্রতিরোধে জনগণ ছুটে যান। জহুর আহমদ চৌধুরী, এম আর সিদ্দিকী, এম এ হান্নান প্রমুখ অস্ত্র খালাস প্রতিরোধে সম্ভাব্য উপায় নিয়ে আলোচনা করেন। ২৪ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু ঢাকা থেকে নঈম গওহর এবং মোশাররফ হোসেনের মাধ্যমে (সাবেক জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী) চট্টগ্রামে নির্দেশ দেন যাতে অস্ত্র খালাস করতে দেওয়া না হয়। (মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে সাক্ষাৎকার)
জহুর আহমদ চৌধুরী ব্রিগেডিয়ার আনসারীকে টেলিফোনে অস্ত্র খালাসে বাধাদানকারী শ্রমিক-জনতার ওপর গুলি না ছোড়ার অনুরোধ জানান। কিন্তু আনসারী সেই অনুরোধ এই বলে প্রত্যাখ্যান করেন যে, ‘আগর মেরা গাড়িকা সামনে কোঈ শে’র ঝুকা দে তো ম্যায় কেয়া করো।’ এ ব্যাপারে এম এ হান্নানের অনুরোধও আনসারী প্রত্যাখ্যান করেন।
এদিকে, হাজার হাজার শ্রমিক-জনতা রাস্তায় নেমে প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। তারা বন্দর থেকে সেনানিবাস এলাকা পর্যন্ত রাস্তায় রাস্তায় পুরোনো ট্রাকের ভাঙা চেসিস, গাছের গুঁড়ি, বিদ্যুতের খুঁটি ও পাথরসহ যেখানে যা পাওয়া গেছে তাই দিয়ে প্রতিবন্ধক তৈরি করেন। রাত প্রায় সোয়া ১১টার দিকে এক অবাক কাণ্ড লক্ষ করেন অনেকে। বর্তমান আগ্রাবাদ বিদ্যুৎ ভবনের কাছে, (কিছুটা উত্তর দিকে) একটি পানের দোকান যেন আপনা-আপনি হেঁটে আসছে, রাস্তার ওপর। কেউ কেউ মনে করলেন খান সেনারা হয়তো অস্ত্রসহ পজিশন নিতে যাচ্ছে ওইভাবে দোকান বানিয়ে। পরে জানা গেছে, সূর্যমল্লিক নামে এক দোকানি তার কর্মচারীদের সহায়তায় আস্ত পানের দোকানটি তুলে নিয়ে রাস্তার ওপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন প্রতিবন্ধক হিসেবে।
মধ্যরাতের পর থেকে ‘সোয়াত’ থেকে থেমে থেমে গোলাগুলির আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। সশস্ত্র পাঞ্জাবি নৌসেনাদের একটি দল আসে দেওয়ানহাটের কাছে অবস্থিত নৌঘাঁটি ‘বখতিয়ার’ থেকে। নতুনপাড়া সেনানিবাস থেকেও ট্যাংক নিয়ে বেরিয়ে আসে খান সেনারা।
সামরিক কর্তৃপক্ষ ২০ নম্বর বালুচ রেজিমেন্টের একটা কোম্পানির সাথে পঞ্চাশ জন বাঙালি সৈন্যকে বন্দরে পাঠায় মাল খালাসের জন্য। শ্রমিকেরা বাধা দিলে সৈন্যরা গুলি চালায়। এতে প্রথমে আট জন হতাহত হন। এক পর্যায়ে শ্রমিক জনতা লাঠি, বর্শা আর অল্পসংখ্যক বন্দুক নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। সারারাত সংঘর্ষে ২০ জন নিহত ও শতাধিক আহত হন। রাতে আড়াইটার সময় প্রবল প্রতিরোধের মুখে অস্ত্র নামানোর কাজ স্থগিত করা হয়। বাঙালি শ্রমিকদের লাশ গানবোটের মাধ্যমে নিয়ে ফেলে দেওয়া হয় সমুদ্রে।
এদিকে, পরদিন বেলা একটার দিকে প্রতিবন্ধক সরিয়ে সরিয়ে ২৭ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের প্রহরায় দুই প্লাটুন বাঙালি সৈন্য বন্দরে আনা হয় অস্ত্র খালাসের জন্য। ২৫ মার্চ রাত ১১টার দিকে তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে একটি দলও প্রতিবন্ধক সরিয়ে যেতে থাকেন বন্দরের দিকে। আগ্রাবাদ এলাকায় ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামানের কাছে শোনেন, বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানিদের আক্রমণের কথা। এসময় বন্দর এলাকায় গিয়ে নিজেরও বিপদের কথা ভেবে তিনিও (জিয়া) ফিরে আসেন ষোলশহরের দিকে। সোয়াত জাহাজের অস্ত্র খালাস প্রতিরোধ আন্দোলনের অন্যতম সহযোগী, শ্রমিকনেতা আহসান উল্লাহ চৌধুরী সেই দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, “সোয়াত প্রতিরোধ আন্দোলন চট্টগ্রামবাসীর জন্য একটি বীরত্বপূর্ণ ঘটনা। সোয়াত প্রতিরোধ করতে গিয়ে যাতে হতাহত না হয় এবং শান্তি রক্ষা করা যায় সে চেষ্টায় একটি সমন্বয় প্রক্রিয়ায় আমি যুক্ত ছিলাম। জহুর আহমদ চৌধুরী, পূর্ণেন্দু দস্তিদার, নাসির উদ্দিন নামে এক অবাঙালি এবং রাউজান ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অবাঙালি শিক্ষক হাসনাতসহ আমরা শান্তির পক্ষে কাজ করছিলাম। আমার জানা মতে, জিয়াউর রহমান ১৭ মার্চ থেকে নগর ছেড়ে যাওয়ার আগের রাত পর্যন্ত অস্ত্র খালাসের জন্য সৈন্য নিয়ে বন্দরের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু বার বার জনতার বাধা পেয়ে ফিরে গেছেন। ছাব্বিশে মার্চ সকাল ১০টা পর্যন্ত কিছু সৈন্যকে দিয়ে জোরপূর্বক প্রতিবন্ধক সরানোর কাজ করানো হয়। কাজ শেষে তাদের ব্যারাকে ফিরে যেতে না দিয়ে নিরস্ত্র করে সোয়াতের ভেতরই আটকে রাখা হয়। সবচেয়ে বড় নিষ্ঠুর ঘটনা হলো সেই সব হতভাগ্য বাঙালি সেনাদের কিছু খেতে তো দেওয়া হয়নি বরং ২৭ মার্চ বিকেল চারটার দিকে তাদের জেটির ফ্লাটফরমে দাঁড় করিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। গুলিতে আহতদের হত্যা করা হয় বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে।”
এভাবে সাধারণ শ্রমিক-জনতা ও বাঙালি সেনাদের হত্যার একপর্যায়ে নিরস্ত্র জনতা হানাদার বাহিনীর আধুনিক অস্ত্রের মুখে টিকতে না পেরে মূল সড়ক থেকে আশপাশের নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান। ছাব্বিশে মার্চ বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাঞ্জাবিরা ট্যাংকসহ অন্যান্য অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে এসে রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সরাতে থাকে এবং সোয়াতের অস্ত্র খালাস করতে সক্ষম হয়। এত অস্ত্রশস্ত্রের বহর দেখে সেদিন বন্দরের কর্মকর্তা কর্মচারীসহ সাধারণ মানুষ স্বভাবতই ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। তবে চট্টগ্রামের বীর জনতা বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে পাকিস্তান সামরিক জান্তার নির্দেশের প্রতি বৃদ্ধাঙুলি দেখিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যেভাবে অসহযোগিতা প্রদর্শন করেছেন, জীবনদান করেছেন তা অতুলনীয়।
ওই সময় শ্রমিক-জনতাকে সংগঠিত করার কাজে যেসব শ্রমিকনেতা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তাদের মধ্যে রহমত উল্লাহ চৌধুরী, আবুল বাশার, আহসান উল্লাহ চৌধুরী, এস এম জামাল উদ্দিন, আবুল কালাম, মান্নান সিকদার, নুরুল ইসলাম, আবদুস ছাত্তার, ওমর ফারুক, আবদুল নবী চৌধুরী (নবী মিস্ত্রি), শুক্কুর সওদাগর, নূর মোহাম্মদ, মজিদ মিয়া, এনামুল হক প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ২৫ মার্চ আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ শুরুর আগে সোয়াত জাহাজকে ঘিরে এই ঘটনা চট্টগ্রামের মানুষকে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে আরও ক্ষুব্ধ ও উজ্জীবিত করে।
সৌজন্যেঃ bdnews24.com