2832
Published on মার্চ 21, 2021সজল চৌধুরীঃ
সম্প্রতি একটি খবর দেখে অনুপ্রাণিত হলাম। সুখী দেশের তালিকায় নয় ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। ২০১৮-২০২০ সাল পর্যন্ত বিশ্বের প্রায় ১৪৯টি দেশের মধ্যে জরিপ চালিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি হয়েছে। যেখানে মানুষ তার ব্যক্তিগত জীবনে কতটা সুখী তার নম্বর ভিত্তিক মূল্যায়ন থেকে এই তালিকাটি তৈরি করা হয়। যেখানে বাংলাদেশ তার তার প্রাপ্ত নম্বর অনুযায়ী তালিকার ৬৮ নম্বরে স্থান পেয়েছে। আবার ইউএন হ্যাবিটাট তাদের ২০২০ সালের রিপোর্টে বাংলাদেশকে অত্যন্ত আশাবাদী একটি দেশ হিসেবে চিহ্নিত করছে অবকাঠামো থেকে শুরু করে সামগ্রিক টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে। অন্যদিকে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে ভিডিও বার্তার মাধ্যমে মুসলিম দেশগুলোর ওআইসির মহাসচিব ইউসুফ বিন আহমেদ আল ওথাইমিন ৫০ বছরের এই দীর্ঘ পথ চলায় বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়ন এবং অর্জনের ভূয়শী প্রশংসা করে বলেছেন বাংলাদেশ বর্তমানে ধর্মীয় শান্তির এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। আজ বিভিন্ন দেশ থেকে বিশ্বের নেতৃবৃন্দ তাদের বার্তা পাঠাচ্ছে আমাদের কাছে, আমাদের দেশের মানুষের কাছে বঙ্গবন্ধু ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অব্যক্ত ভালোবাসা প্রদান করেন। দেশের উন্নয়নের কথা বলে।
আমরা যদি শিক্ষা উন্নয়নের কথাও বলি সেখানেও দেখা যাবে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষার সমূহ সম্ভাবনা বর্তমানে দেশে বিরাজ করছে তা সত্যি অকল্পনীয় এবং অনুকরণীয়। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধুমাত্র স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেননি। তিনি একটি উন্নত সমৃদ্ধ সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। সোনার বাংলা গড়তে তিনি বলতেন ‘সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ চাই’। তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন সে মানুষগুলো হবে অসাম্প্রদায়িক, শিক্ষিত, আধুনিক এবং স্বাবলম্বী। তাই তিনি বাংলাদেশের আধুনিক শিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। তিনি গণমুখী এবং সর্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের সকল স্তরের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। আজ বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা তার সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়নের জন্য ‘সোনার বাংলা’ গঠনকল্পে অবিরাম ছুটে চলেছেন। তিনি স্বপ্ন দেখছেন ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ যেখানে শিক্ষা থেকে শুরু করে সব বিষয়ের আধুনিক পরিবর্তন বাংলাদেশকে ‘সোনার বাংলা’ করে গড়ে তুলতে সক্ষম হবে অচিরেই। সংবিধানে স্পষ্টত উল্লেখ আছে সমাজের প্রয়োজনের সাথে শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ করার কথা এবং সেই প্রয়োজন পূরণ করবার উদ্দেশ্যে যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছাপ্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টির কথা - যা অনুপ্রাণিত করে উচ্চ শিক্ষা পদ্ধতি নিয়ে কিছু ভাবনার প্রয়াস। যেখানে জড়িত রয়েছে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন।
আর এই প্রত্যেকটি উন্নয়নের সাথে যিনি জড়িত আছেন, যার চিন্তা চেতনা এবং সামগ্রিকতা জড়িয়ে রয়েছে রন্ধে রন্ধে, আমাদের ধমনীতে তিনি হচ্ছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আজ তিনি মহান থেকে মহিমান্বিত।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চের বিকেলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উত্তাল জনসমুদ্রে ভাষণ দিয়েছিলেন বাংলার আকাশ, বাতাস আর মাটি একাকার করে লক্ষ লক্ষ মানুষের জনসমুদ্রে। তিনি বলেছিলেন উদাত্ত কণ্ঠে আমাদেরকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না। তিনি উচ্চারিত করেছিলেন সেই মোহনীয় ধ্বনি “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম”। প্রায় ১১০৮ টি শব্দের সেই মোহনীয় অনুরণন আজও বাঙ্গালীদের মধ্যে বেঁচে আছে সর্বক্ষণ। সেই ভাষণে তিনি আঠারো বার বাংলা, বাঙালি ও বাংলাদেশের তিনটি শব্দ উচ্চারিত করেছিলেন। আর সেই থেকে “স্বাধীনতা” শব্দটি একান্তই আমাদের নিজস্ব।
আর সেই মুক্তি মন্ত্রোচ্চারণের আজ ৫০ বছর পূর্তি। বাংলাদেশ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন এর মাহেন্দ্রক্ষণে। ১৯৭১ সালের এপ্রিলের ৫ তারিখে সেসময়ের যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বহুল প্রচারিত এবং প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম নিউজউইক এই ভাষণকে উপলক্ষ করে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছিল। যার নাম দিয়েছিল “পয়েট অব পলিটিক্স”। সেই ভাষণ এর প্রত্যেকটি শব্দ আমাদের হৃদয়কে আন্দোলিত করে। অনুরণিত করে। প্রত্যেকটি শব্দ যেন হয়ে ওঠে এক একটি কবিতা। আর এই শব্দগুলি পরবর্তীতে হয়ে যায় নতুন দেশ গঠনের কোটি মানুষের স্বপ্নের আলোকবর্তিকা। বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি এখন শুধুমাত্র আমাদের বাংলাদেশের নয় সমস্ত বিশ্বের সম্পদ। ২০১৭ সালের ৩০ শে অক্টোবর জাতিসংঘের বিশ্ব ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও শিক্ষা বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো বঙ্গবন্ধুর সেই মহান ৭ ই মার্চের ভাষণকে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য বলে স্বীকৃতি প্রদান করে। ৭ ই মার্চের ভাষণটি শুধুমাত্র ভাষণ ছিল না সেটি ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল দলিল।
বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণকে নিয়ে বিশ্ব নেতারা তাদের অনেক বিশ্লেষণধর্মী বক্তব্য দিয়েছেন। তারা বিস্ময় প্রকাশ করেছেন একটি ভাষণ কিভাবে একটি জাতিসত্তা গঠনে, একটি নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনে সর্বাঙ্গীণ ভূমিকা রাখতে পারে। বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো বলেছেন ৭ই মার্চের ভাষণ শেখ মুজিবুর রহমানের শুধুমাত্র একটি ভাষণ নয় এটি একটি অনন্য রণকৌশল এর দলিল। আবার যুগোস্লাভিয়ার কিংবদন্তী নেতা মার্শাল টিটো বলেছেন ৭ ই মার্চের ভাষণের মূল তাৎপর্য হচ্ছে এই ভাষণের মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমান প্রমাণ করেছেন পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানের কোনরকম বৈধতা নেই। পূর্ব পাকিস্তান আসলে বাংলাদেশ। ১৯৭৪ সালে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী শন ম্যাকব্রাইড-তার মতে শেখ মুজিবুর রহমান বুঝতে পেরেছিলেন কেবল ভৌগোলিক স্বাধীনতাই যথেষ্ট নয়। সে জন্য প্রয়োজন মানুষের মুক্তি। বেঁচে থাকার স্বাধীনতা, সাম্য ও সম্পদের বৈষম্য দূর করাই হচ্ছে স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য এবং সার্থকতা। আর এই মহান শক্তির প্রকাশ ঘটেছে বঙ্গবন্ধুর ৭ ই মার্চের ভাষণে।
বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার এক নিবন্ধে বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু কিভাবে চোখের চশমাটা খুলে টেবিলের উপর রাখলেন এবং তিনি ভাষণ দিলেন। ঠিক সেই কথাগুলো যেন বললেন যা তার মনে এসেছিল বাংলার মাটি আর মানুষকে ভালোবেসে। সেদিনের তার সেই কথাগুলোর মধ্যে বাংলার মানুষের মনের প্রতিটি কথা গেঁথে গিয়েছিলো। স্বাধীনতা শব্দটিকে তিনি বুকে লালন পালন করেছিলেন। ধারণ করেছিলেন। তিনি দিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন। আর পরবর্তীতে দেশের মুক্তিকামী মানুষ অক্ষরে অক্ষরে তার সেই কথা পালন করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলেন। শোষণ নিপীড়ন আর বঞ্চনার হাত থেকে মুক্ত করে ছিনিয়ে এনেছিল লাল-সবুজের এই বাংলাদেশ।
আজ তাই বর্তমান বাংলাদেশকে নিয়ে বলতে চাই। এখন আমাদের খুঁজে বের করতে হবে আমাদের স্বাধীনতার সত্তা গুলোকে। বঙ্গবন্ধু যেমন বলেছিলেন আমাদের যার যা কিছু আছে তা নিয়েই স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা, আজকের এই বাংলাদেশকে উন্নত করতে গেলে আসলে আমাদের সামগ্রিক প্রচেষ্টা দরকার। বিশেষ করে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব কিংবা ডিজিটাল বাংলাদেশের যে বিপ্লব আজ হচ্ছে সেটি কিন্তু শুধুমাত্র আমাদের এই দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এই বিষয়গুলো আজ বিশ্বদরবারে সমানতালে ছড়িয়ে গেছে। সমানভাবে সমাদৃত। আমাদের উচিত হবে আমরা যে যার অবস্থান থেকে, কর্মক্ষেত্র থেকে লেখালিখি, গবেষণা কিংবা জীবিকা নির্বাহ করছি-প্রত্যেকে প্রত্যেকের অবস্থান থেকে যার যা কিছু আছে তা নিয়েই বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে সাহায্যের হাত বাড়াতে হবে। একে একে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন গুলোকে সোনার বাংলা গঠনে বাস্তবায়িত করতে হবে। কারণ আমাদের সামগ্রিক উন্নয়নের সার্থকতা-সামগ্রিক সহযোগিতা এর উপর নির্ভর করে। বঙ্গবন্ধুর প্রত্যেকটি বক্তব্যের মধ্যে ছিল ভবিষ্যতের পরিকল্পনা। একটি দেশের বিজয় ছিনিয়ে আনা থেকে শুরু করে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, স্থাপত্য, পরিবেশ, শিল্পায়ন কিংবা নগরায়ন যেকোন বিষয়ের কথাই বলি না কেন ৭ই মার্চের ভাষণ থেকে শুরু করে তার প্রত্যেকটি বক্তব্য এবং শব্দের মধ্যে ছিল বহুমুখী সম্ভাবনার প্রকাশ যাকে বিশ্লেষণ করতে হবে সঠিকভাবে। পর্যাপ্ত গবেষণা করতে হবে। সেখান থেকে খুঁজে বের করতে হবে আগামীর বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নে পন্থাগুলোকে। কারণ তিনি’ই বাংলাদেশ।
লেখকঃ শিক্ষক, স্থপতি ও গবেষক (বর্তমানে মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য ও পরিবেশ বিষয়ক পিএইচডি গবেষক)