1732
Published on মার্চ 2, 2022সৈয়দ মনজুরুল ইসলামঃ
এক বিদেশি সাংবাদিক ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ সকাল থেকেই একজন দোভাষী খুঁজছিলেন, সেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ভাষণ দেবেন তা তাৎক্ষণিক ইংরেজি করে তাকে শোনাবে, সেজন্য। দুপুরের আগে আমার সঙ্গে তার যোগাযোগ হলো, বললাম ভাষণ শুরুর আগে টিএসসিতে এসে তার সঙ্গে রেসকোর্স মাঠে যাব।
মাঠে সেদিন কত মানুষ ছিল, কেউ বলতে পারবে না। হয়তো ১০ লাখ। হয়তো আট লাখ। কিন্তু মনে আছে ভাষণ শুরুর আধঘণ্টা আগে যখন বিদেশি সাংবাদিককে সঙ্গে নিয়ে বেরোই, মনে হলো সারা দেশ ভেঙে পড়েছে রেসকোর্স মাঠে। সাংবাদিকদের জন্য মঞ্চের সামনে জায়গা ছিল। সাংবাদিক হাত ধরে আমাকে টেনে সেখানে নিয়ে গেলেন। আমি আমার কপালকে ধন্যবাদ দিলাম। এত সামনে থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে পাব, ভাবতেও পারিনি।
বঙ্গবন্ধুকে বেশ চিন্তিত মনে হচ্ছিল। বক্তৃতা শুরুর আগে দু’একবার হাত দিয়ে মাথার চুল সমান করলেন; আকাশে একটা হেলিকপ্টার উড়ছিল। সেদিকে একবার তাকালেন। তারপর সামনের মানুষের দিকে গভীর দৃষ্টি ফেললেন। মনে হলো তার চিন্তা সরে গিয়ে মুখে একটা প্রসন্ন ভাব যেন এলো। তিনি লেকটার্নের সামনে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা শুরু করলেন। পুরো বক্তৃতাই এখন ডিভিডিতে পাওয়া যায়; কিন্তু যা পাওয়া যায় না তা হচ্ছে ওই কুড়ি-বাইশ মিনিটের জাদু।
সেই জাদুর স্পর্শ অনুভব করেছিল তারাই, যারা সেদিন রেসকোর্সে ছিল। বঙ্গবন্ধু কথা বলছিলেন না, তিনি যেন বাঙালি জাতির সংগ্রামী ইতিহাসের একটা মুখবন্ধ লিখছিলেন। যাতে প্রতিফলিত হচ্ছিল বাঙালি চরিত্রের শ্রেষ্ঠ প্রকাশগুলো তার সাহস আর সংকল্প, তার আত্মদৃপ্ত এবং বলিষ্ঠ প্রত্যয়, তার সততা আর সৌজন্য, তার ভেতরের আগুন এবং বারুদ। সারা মাঠের মানুষ নিঃশব্দে শুনছিল সেই জাদুময় ভাষণ, যা তাদের সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে এক একজন যোদ্ধায় পরিণত করছিল।
এরকম গভীর আর জলদ কণ্ঠের ভাষণ বঙ্গবন্ধুও হয়তো আর দেননি এবং বক্তৃতাটি শেষ হলে কারও মনে কোনো সন্দেহ ছিল না তিনি কী চাইছেন : তিনি যা চাইছিলেন, আমরাও তা চাইছিলাম বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং তার ভাষণে তিনি মানুষকে প্রস্তুত হতে বলেছিলেন। তার ভাষণটি পাকিস্তানিরাও সঠিক পড়তে পেরেছিল; কিন্তু পাকিস্তানিরা কাপুরুষ ছিল এবং কাপুরুষরা যা করে তারাও তা করেছিল। ঘুমন্ত মানুষ, নারী ও পুরুষের ওপর রাতের অন্ধকারে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি ছিল একটি সাহসী জাতির প্রত্যয়ী কিছু উচ্চারণ। বঙ্গবন্ধু নিজেও হয়তো পাকিস্তানিদের কাপুরুষতার ব্যাপকতাটা বুঝতে পারেননি, যদিও তাদের কপটতা ও মিথ্যাবাদিতার বিষয়টি তিনি তার ভাষণে তুলে ধরেন।
২. একটা দুঃখবোধ থেকে ভাষণটা তিনি শুরু করেছিলেন। ‘আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি।’ এভাবেই তার ভাষণ শুরু। ‘দুঃখ’, ‘দুঃখের বিষয়’, ‘দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়’ এবং ‘করুণ ইতিহাস’ শুরুর কয়েক মিনিটেই এ রকম বর্ণনা তিনি কয়েকবার দিলেন। আমি প্রথম তিন-চার লাইন দ্রুত অনুবাদ করলাম, কিন্তু সাংবাদিক আমাকে থামিয়ে দিলেন। ‘আমি বরং ভাষণটা শুনি, তুমি যদি পার, মনে রাখার চেষ্টা কর, পরে আমাকে অনুবাদে শুনিও’ সাংবাদিক বললেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পুরোটা সময় সেই সাংবাদিক একাগ্রতা নিয়ে ঠাঁয় বসেছিলেন। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছিল, তিনি প্রতিটি বাক্য বুঝছেন, যেন বঙ্গবন্ধু বাংলাতে নয়, ইংরেজিতে ভাষণটা দিচ্ছেন। এবং আশ্চর্য, শুনতে শুনতে ভাষণটা আমার মাথায় একটা জায়গা করে নিল। বিকালে চারুকলায় সাংবাদিককে যখন মূল বিষয়গুলো অনুবাদ করে দিচ্ছিলাম, দেখতে পেলাম, আমার গলাতেও যেন আলাদা একটা জোর এসেছে, যেন ভাষণটা আমাকে আলাদা শক্তি জোগাচ্ছে। সাংবাদিক বললেন, কী ছিল শেখ সাহেবের ভাষণে? আমি কিছু বলার আগে তিনি নিজেই বললেন, ‘নিশ্চয়ই জাদু। ইট ওয়াজ সিম্পলি ম্যাজিক্যাল।’
৩. জাদু তো বটেই। ইতিহাসের কিছু কিছু সময় থাকে, যখন জাদুর প্রয়োজন হয়; যখন বাস্তব এমন কঠিন হয়ে পড়ে, পরিস্থিতি এমন প্রতিকূলে চলে যায় মানুষের যে একটা জাদুর ঘটনা না ঘটলে কিছুতেই মানুষ পথ খুঁজে পায় না, পায়ের ওপর শক্ত হয়ে দাঁড়াতে পারে না। শিরদাঁড়াটা তাদের প্রয়োজনীয় দার্ত্য পায় না। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ছিল সেই জাদুর ঘটনা। একাত্তরের মার্চের দিকে তাকান। ৭ মার্চের আগের ও পরের দিনগুলোর কথা ভাবুন। ৭ মার্চের পর বাংলাদেশের ইতিহাস বদলে গেল। আমরা বুঝে নিলাম, পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের উদ্ভট গৃহস্থালির দিন শেষ।
কী ছিল সেই ভাষণে? আজকালকার রাজনীতিবিদদের বক্তৃতা শুনলে দুঃখ হয়, খুব কমই কাউকে তার মনের ভাষা পরিষ্কারভাবে বলতে শুনি। বেশির ভাগ রাজনীতিক বাক্য সমাপ্ত করেন না, অশুদ্ধ বাংলা ব্যবহার করেন। বঙ্গবন্ধুর অনেক গুণগ্রাহী এবং অনুসারীকেও দেখি, তার মতো গুছিয়ে বলতে একেবারেই অপারগ। বঙ্গবন্ধুর ভাষণগুলোতে তিনি প্রতিটি বাক্য শেষ করতেন। একটি বাক্য থেকে অন্য বাক্যে তার যাত্রা হতো অবধারিত এবং যৌক্তিক। তিনি বুঝতেন কখন, কোথায়, কতটা আবেগ মাখাতে হবে কথায়; কোথায় দিতে হবে প্রেরণার বাণী অথবা কাজের উপদেশ।
৭ মার্চের ভাষণে তিনি আঞ্চলিক অনেক শব্দ ব্যবহার করেছেন ‘শাসনতন্ত্র তৈয়ার’ করা, ‘বলে দেবার চাই যে’, ‘হুকুম দেবার না পারি’, ‘মায়নাপত্র নেবার পারে’ এরকম বলেছেন। এক সময় যখন তিনি বললেন, ‘সাত কোটি মানুষকে দাবায়া রাখতে পারবা না’ মনে হলো, এখানে ‘দাবিয়ে রাখতে পারবে না’ বললে যেন তার গলার আগুনটা ঠিকমতো উত্তাপ ছড়াতে পারত না। যে মুহূর্তে কথাগুলো তিনি বলছিলেন, সেটি একটি আরোহণের মুহূর্ত। যুক্তি দিয়ে, উদাহরণ দিয়ে তিনি যুক্তির অংশটি প্রতিষ্ঠা করে ‘দাবায়া রাখার’ মুহূর্তে উঠে গেলেন আবেগ ও প্রত্যয়ের একটি চূড়ায়। ঠিক ওই সময়ে তার আঞ্চলিক ভাষা থেকে কয়েকটি শব্দ ধার নেওয়াটা যেন বাংলাদেশের প্রাণের উচ্চারণটি তীব্র স্বতঃস্ফূর্ততায় প্রকাশ করার জন্য জরুরি হয়ে পড়ল। অথচ তার ভাষণের অনেক জায়গায় বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষাকে খুব সাজিয়ে ব্যবহার করেছেন। ‘২৩ বছরের ইতিহাস, মুমূর্ষু নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস’, অথবা ‘বাংলার ইতিহাস এ দেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস।’ অথবা ‘তারা শান্তিপূর্ণভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য স্থির প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো।’
বঙ্গবন্ধুর ভাষণটির মুদ্রিত রূপটি আমাদের এরকম একটা ভাবনার কাছে নিয়ে যায়। তিনি কি আগে লিখেছিলেন ভাষণটির একটি খসড়া? তা না হলে এত সুন্দর কী করে হয় তার বাংলা? এত সুঠাম বাক্যে কীভাবে তিনি সাজান তার কথাগুলো? বঙ্গবন্ধুর কয়েকটি ভাষণ শুনেছি বলে আমি বলতে পারি, ওইদিন ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর থেকে রেসকোর্স পর্যন্ত যাত্রায় ভাষণটি তিনি তার মাথায় লিখে নিয়েছিলেন। মাত্র কুড়ি-বাইশ মিনিটের ভাষণ, কিন্তু কী বাক্সময়। বাঙালির সংগ্রামের ইতিহাস থেকে নিয়ে সংগ্রামের রূপরেখা, মানুষের করণীয় এবং স্বাধীনতার একটা ঘোষণা। সবই তিনি ওই সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় বলে দিলেন। বঙ্গবন্ধু ইংরেজি ভালোই জানতেন।
স্বাধীনতার পর ডেভিড ফ্রস্টকে দেওয়া তার সাক্ষাৎকারটি শুনলে বোঝা যাবে, ইংরেজিতে তার দখল মন্দ ছিল না। কিন্তু ৭ মার্চের ভাষণে তিনি অকারণ কোনো ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেননি। ‘প্রেসিডেন্ট’, ‘ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি’ অথবা ‘সেক্রেটারিয়েট’, ‘সুপ্রিম কোর্ট’। এসব শব্দ বা বর্ণনা ব্যবহার করেছেন; কিন্তু এগুলো তো ভাষার প্রতিদিনের ব্যবহারেই আমরা বলি। কিন্তু তিনি অর্থনৈতিককে ইকোনমিক বলেননি, সাংস্কৃতিককে কালচারাল বলেননি। মুক্তিকে ইন্ডিপেন্ডেন্স বলেননি, নেতৃবৃন্দ না বলে লিডার্স বলেননি। পুরো ভাষাটা বাংলার প্রাণবন্ত ব্যবহারের একটি দলিল, যা একই সঙ্গে শিক্ষাহীন গ্রামের মানুষ এবং শিক্ষিত শহুরে মানুষ বুঝতে পারবে। একাত্তরের ৭ মার্চ যারা রেসকোর্সে এসেছিল, তারা সবাই বুঝেছে, পরের দিন যখন রেডিওতে সেটি প্রচারিত হয়, সবাই বুঝেছে। আজও যখন ভাষণটি কেউ শোনেন, সমাজ বা বিত্তের যে প্রান্তেই তার অবস্থান, তিনি সেটি বোঝেন।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে কেউ কেউ একটি কবিতার সঙ্গে তুলনা করেছেন। কবিতাই বটে। কবিরা যদি যথাস্থানে যথাশব্দ ব্যবহারে পারদর্শী হন, তাহলে বঙ্গবন্ধুও তো কবি। এ ভাষণটিতে ব্যবহৃত প্রতিটি শব্দই নির্বিকল্প, প্রতিটি শব্দই তাৎপর্যমণ্ডিত। বক্তৃতার শেষে উচ্চারিত ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ একটি দু’পঙ্ক্তির কবিতাই বটে। এখানে মুক্তি ও স্বাধীনতার দুটি ব্যাখ্যা দেওয়া আমাদের জন্য জরুরি হয়ে পড়ে। স্বাধীনতা যতটা রাজনৈতিক-ভৌগোলিক, মুক্তি ততটাই অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক। একটি জাতি স্বাধীন হলেই সে মুক্ত হয় না। একটি দেশ অন্য কোনো দেশের আদর্শ ধারণ করে তার মুক্তিকে বিলিয়ে দিতে পারে। বঙ্গবন্ধু মুক্তির তাৎপর্য কী, তা জানতেন। তার কথা প্রথমেই উল্লেখ করেছেন। স্বাধীনতার বিষয়টি নিয়ে তার দ্বিধা ছিল না। স্পষ্ট কণ্ঠে স্বাধীনতার কথা বলেছেন। সেদিন তার শ্রোতারা দুটিই চেয়েছিল; কিন্তু মাত্র সাড়ে চার বছর পর তার যে ঘাতকরা পাকিস্তানি কাপুরুষতার পুনরাবৃত্তি ঘটাল, তারা স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়েও মুক্তি পায়নি। তারা পাকিস্তানের কাছে আত্মা বিক্রি করে দিয়েছিল। যুদ্ধাপরাধী, উগ্রবাদীরাও মুক্ত নয়। তাদের নিয়ন্ত্রণ করছে পাকিস্তানি ভাবাদর্শ এবং অনেক ক্ষেত্রে অর্থ। বঙ্গবন্ধু সেই মুক্তি চেয়েছিলেন, যা স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে।
বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে শুনতে আমার মনে হচ্ছিল, তিনি শুধু প্রত্যয় নয়, সৌজন্যে সততায় সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন। তিনি ‘এহিয়া সাহেব’, ‘ভুট্টো সাহেব’ বলেছেন একাধিকবার। তার কণ্ঠে হয়তো কিছুটা শ্লেষ ছিল। কিন্তু সৌজন্যও ছিল। একবার বলেছেন, ‘আমরা ভাতে মারব, আমরা পানিতে মারব’, কিন্তু ঠিক তারপর বলেছেন, ‘তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাক, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না।’ এই সৌজন্য পাকিস্তানি কোনো নেতা কোনো দিন দেখাতে পারেননি। এজন্যই কি-না, ভুট্টো এত বিরাট জমিদার আর প্রতিপত্তিশালী রাজনীতিবিদ হয়েও বঙ্গবন্ধুর সামনে এলে বাহাদুরিটা মুলতবি রাখতেন। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ৬ দফা দাবি তুললে ভুট্টো হইচই শুরু করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন, তার সঙ্গে তর্কে নামতে। ভুট্টো সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেননি। অথচ জাতিসংঘে পাকিস্তানের সামরিক অভিযানের পক্ষে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তিনি বক্তৃতা দিতেন। বঙ্গবন্ধুর কাছে ছিল যুক্তি এবং সততা, ভুট্টোর ছিল কপটতা আর অযুক্তি। বঙ্গবন্ধুর সামনে তার নিজেকে অরক্ষিত মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক।
৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু ধাপে ধাপে মানুষকে একটা সংকল্পের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। শুরুতে সেই দুঃখবোধ, তারপর পাকিস্তানিদের শঠতার ইতিহাস। শুরুতে মানুষের বোধের কাছে তার প্রশ্ন ‘কী অন্যায় করেছিলাম?’ এবং একটু পরই ঠিক যখন মানুষ পাকিস্তানিদের শঠতার বিষয়টিকে ঘৃণা জানাতে শুরু করেছে, বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় একটি প্রশ্ন, ‘কী পেলাম আমরা?’ এই প্রশ্নে যখন মানুষ একটা হিসাবের দিকে তাকাতে শুরু করেছে নিজেদের মতো করে, বঙ্গবন্ধু জানিয়ে দিলেন, আমরা পয়সা দিয়ে যে অস্ত্র কিনেছি বহিঃশত্রু থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য, আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে দেশের গরিব-দুঃখী-আর্ত মানুষের মধ্যে। কী সুন্দর, ঝরঝরে তার বাংলা। অথচ এই মুহূর্তটি মানুষের ঘৃণার একটা চরম বহিঃপ্রকাশের সময়ও। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বাঙালির গুলি খাওয়ার প্রসঙ্গ থেকে আবার চলে গেলেন এহিয়া খানের প্রসঙ্গে এবং এ প্রসঙ্গের একপর্যায়ে যখন বললেন, পাঁচ ঘণ্টা গোপন বৈঠক করে এহিয়া খান বক্তৃতা দিলেন আর সব দোষ দিলেন বঙ্গবন্ধু ও বাংলার মানুষকে, রেসকোর্সের জনতার কাছে পক্ষ-প্রতিপক্ষের বিষয়টি স্থির নিশ্চিত হয়ে গেল। তারপরই দ্বিতীয়বারের মতো ‘ভাইয়েরা আমার’ বলে জানিয়ে দিলেন, ‘ওই শহীদের রক্তের ওপর দিয়ে’ তিনি অ্যাসেম্বলিতে যোগ দিতে পারবেন না। তার পরই শুরু হলো তার ভাষণের সবচেয়ে কেজো অংশটা, যেখানে তিনি হরতালের ঘোষণা দিয়েছেন, হরতালে গরিব মানুষের যাতে কষ্ট না হয়, সেজন্য দিকনির্দেশনা দিয়েছেন এবং অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল বলে তিনি যখন আহ্বান জানালেন এবং ‘যা কিছু আছে’ তা নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোল, তখন মানুষের সামনে একটা পথ খুলে গেল। সে পথটি আমাদের নিয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধে।
৪. একজন মানুষ এত সহজ ভাষায় মানুষের মনের ভেতরে, মাথার ভেতরে, রক্তের ভেতরে কীভাবে ঢুকে যেতে পারেন, তার প্রমাণ একাত্তরের ৭ মার্চে আমি পেয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি কথা দূরবিস্তারি অনুরণন তুলছিল রেসকোর্সের মাঠে। মানুষ আন্দোলিত হচ্ছিল, উদ্বেলিত হচ্ছিল ভাষণটির প্রতিটি বাক্য শুনে। আঞ্চলিক শব্দ মিশিয়ে যে বাংলা তিনি সেদিন ব্যবহার করেছিলেন তাতে ইতিহাসের, লোকসংস্কৃতি আর জনজীবনের গভীরের দোলা অনুভব করা যাচ্ছিল। আজও যখন ভাষণটি শুনি, চোখ বন্ধ করলে বঙ্গবন্ধুর তেজোদীপ্ত চেহারাটা মনে ভেসে আসে। তার কথাগুলো পরিষ্কার শুনতে পাই আর অনেক দিন আগের সেই অপরাহ্নে ফিরে যাই।
লেখক : কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ