BNP-50

2619

Published on মার্চ 3, 2021
  • Details Image

অজয় দাশগুপ্তঃ

প্রায় ত্রিশ বছর তো আপনারাই ক্ষমতায়। ত্রিশ লাখ শহীদের মহান আত্মদানে অর্জিত বাংলাদেশের ৫০ বছরের ইতিহাসে প্রায় তিন দশক ক্ষমতায় ছিল এমন শক্তি, যারা স্বাধীনতা চায়নি। অর্থনৈতিক মুক্তি চায়নি। উন্নয়ন চায়নি। স্বয়ংসম্পূর্ণতা চায়নি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সম্মান ও মর্যাদার বাংলাদেশ চায়নি। এখন তারা বলছেন ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়েছে’। [মির্জা ফকরুল ইসলাম, ১ মার্চ বিএনপির স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তি কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভাষণ]

যদি এটা ধরেই নিই যে বাংলাদেশ দরিদ্র দেশ রয়ে গেছে, লুটপাটের অর্থনীতি চলছে তাঁর দায় কার? বাংলাদেশের ৫০ বছরের প্রায় ৩০ বছর বা তিন দশক তো ক্ষমতায় ছিল বিএনপি-জাতীয় পার্টি-জামায়াতে ইসলামী যারা স্বাধীনতার ঘোষণা মানে না, ৭ মার্চ মানে না, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অস্বীকার করে। বিচারপতি আবুসাদাত মোহাম্মদ সায়েম ও মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৭৬ সালের ৪ আগস্ট সামরিক বিধি জারি করে বলেছিলেন ‘কোনো রাজনৈতিক দল বা অন্য কেউ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রশংসা করতে পারবে না এমনকি নামও নিতে পারবে না।’ এরপর প্রায় পাঁচ দশক চলে গেছে। বিএনপি এবং তাদের মিত্রদের মনোভাবে একটুও পরিবর্তন ঘটেনি। ১ মার্চ (২০২১) বিএনপির পল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যে আলোকসজ্জা করা হয়েছে তাতে ফুটিয়ে তোলা একটি বাক্য আমাদের নজর এড়ায় না ‘জিয়ার ঘোষণা স্বাধীনতার সূচনা’।

বিএনপির মহাসচিব ১ মার্চ বলেছেন ‘ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ভ্রান্ত ইতিহাস জানিয়ে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগ সরকার স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃত করছে।’ বিএনপির আরেক নেতা বলেছেন ‘জিয়াউর রহমান মানেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। বাংলাদেশ মানেই জিয়াউর রহমান।’

বিএনপি নেতারা ইতিহাস শুধু বিকৃত করছেন না, নির্লজ্জ মিথ্যাচার করছেন। আমাদের সংবাদপত্র, টেলিভিশন, বেতার ও সামাজিক গণমাধ্যম তার প্রচার দিচ্ছে কোনো এডিট করা ছাড়াই। তারপরও বলা হচ্ছে  দেশে কথা বলার স্বাধীনতা নেই, লেখার স্বাধীনতা নেই।

স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপনের প্রাক্কালে বিশ্বসম্প্রদায় একটি স্বীকৃতি দিয়েছে ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তে অর্জিত দেশটি আর আর স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় নেই। আন্তর্জাতিক বাস্কেট কেস নেই। সবার পিছে, সবার শেষে থাকাদের দলে নেই।

এ স্বীকৃতি তাদের খুশি করে না কেন? এর প্রধান কারণ বোধগম্য। গত একযুগে বাংলাদেশ অর্থনীতি অনেকটা নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাচ্ছে প্রায় ৫ কোটি ছাত্রছাত্রী। ডিজিটাল বাংলাদেশ আর স্লোগান নেই, বরং অনেকটাই বাস্তব। প্রচণ্ড গরমের সময়েও লোডশেডিং হয় না। পদ্মা সেতুর মতো বড় অর্থনৈতিক বিকল্প নিজের অর্থে বাস্তবায়ন করতে পারছি। অনেক উন্নত দেশও যখন করোনার ভেকসিন সংগ্রহ নিয়ে সমস্যায়, বাংলাদেশ রয়েছে নির্ভাবনায়।

একবার ভেবে দেখুন তো বাংলাদেশের ৫০ বছরের ইতিহাসের প্রায়  পাঁচভাগের তিনভাগ সময় বিএনপি-জাতীয় পার্টি-জামায়াতে  ইসলামীর মতো শক্তি ক্ষমতায় না থাকত, আমাদের অর্জন কত বড় হতে পারত?        

বাংলাদেশ এ বছর স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করছে। বিএনপি এ স্মরণীয় বার্ষিকী উপলক্ষে কর্মসূচি গ্রহণ করবে কীনা, এমন প্রশ্নই যে অনেকের মনে ছিল। এখন এ দলটির নেতৃত্বে যারা রয়েছেন, তাদের নিশ্চয়ই ১৯৯৬ সালের ২৬ মার্চের কথা মনে আছে। ওই দিনটিতে পূর্ণ হয়েছিল স্বাধীনতার রজত জয়ন্তী। বিএনপির কোনো কর্মসূচি এ দিনে তো নয়ই, গোটা বছরেও ছিল না। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পর রজন্তী উপলক্ষে বাংলাদেশ ব্যাপক কর্মসূচি নেয়। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী সংগ্রামের মহান নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা, ফিলিস্তিন মুক্তি সংগ্রামের নেতা ইয়াসির আরাফাত এবং তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী সুলেমান ডেমিরেল এ কর্মসূচির অংশ হিসেবে ১৯৯৭ সালের মহান স্বাধীনতা দিবসে বাংলাদেশ সফরে আসেন। তারা সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে বড় ধরনের সমাবেশে বক্তব্য রাখেন, যেখানে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।... সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না।

বিএনপি স্বাধীনতার ৫০ বছর পালনের সিদ্ধান্ত এবং কেবল মার্চ মাস জুড়ে নয়, বরং কর্মসূচি গ্রহ করবে। এ কারণে কেউ কেউ ধারণা করেছিলেন অবশেষে তাদের সুমতি হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে সেটা ঘটেনি। স্মরণীয় মাসটিকে তারা সেই পুরানো রেকর্ড বাজানোর জন্যই ব্যবহার করছে। বছরের বাকি সময় কী করবে, বুঝতে সমস্যা হয় না।

পাকিস্তানের ‘ডন’ পত্রিকায় ২০১৯ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি পারভেজ হুদবয় নামের এক কলামিস্ট লিখেছিলেন পাকিস্তানের অনেকেরই ধারণা ছিল ১৯৭১ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে টিকবে না। বাঙালিরা শেষ পর্যন্ত আমাদের কাছে হাতে-পায়ে ধরে পড়বে, কাকুতি-মিনতি করে বলবে ভুল করেছি হুজুর, মাফ করে দেন। অনুগ্রহ করে আবার আমাদের পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করে নিন।

আমরা স্মরণ করতে পারি যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর যুক্তরাষ্ট্র্রের প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা উপদেষ্টা (পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী) হেনরি কিসিঞ্জার এবং বিশ্বব্যাংকের দু’জন অর্থনীতিবিদ ফালান্ড ও পারকিনসন বলেছিলেন বাংলাদেশ একটি ইন্টারন্যাশনাল বাস্কেট কেস। তাদের টিকে থাকা নির্ভর করবে উন্নত বিশ্বের দয়ার ওপর। কেউ কেউ তো বাংলাদেশকে বটমলেস বাস্কেট বা তলাবিহীন ঝুঁড়ি বলেও উপহাস করেছিলেন। বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের সুবর্ণ জয়ন্তীর প্রান্তে দাঁড়িয়ে আমরা শুনছি তার স্বীকৃতি।  ‘

‘Miraculous’ Bangladesh outshines India, Pakistan on development indicators ভারতের বিখ্যাত টাইমস অব ইন্ডিয়া ২০২০ সালের ১৮ আগস্ট এ শিরোনামের এক প্রতিবেদনে আরও লিখেছে Bangladesh is a 'South Asian miracle'

বিএনপি ও তার মিত্ররা স্বাধীনতার মাস হিসেবে পরিচিত মার্চ মাসটিকে যেভাবে ব্যবহার করছে, তাতে কিন্তু আমাদের এ ধারণাই বদ্ধমূল থাকবে দলটি আদৌ বদলাতে চায় না। আমাদের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তরুণ প্রজন্ম জানুক, সে জন্য তাদের বিন্দুমাত্র ইচ্ছা-আগ্রহ নেই। বরং তারা চাইছে যেখানে যতটা সুযোগ পাওয়া যায় চলুক না বিভ্রান্তি সৃষ্টি! একইসঙ্গে তারা চাইছে ‘দৃষ্টি অন্য পথে ঘুরে যাক’।

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছলটি জুড়ে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাঁথা এবং আমাদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অর্জন নিয়ে আলোচনা হবে, এটাই স্বাভাবিক প্রত্যাশা। আমাদের কোথায় কোথায় ঘাটতি আছে এবং কীভাবে সে সব দূর করা যাবে সেটা নিয়েও আলোচনা কাম্য। অর্থনীতিতে যে ইতিবাচক রূপান্তর ঘটছে, তার গতি বাড়াবে। শিক্ষার মান উন্নত করতে হবে। শহর ও গ্রামের সুযোগ-সুবিধায় সামঞ্জস্য আনতে হবে। ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য কমাতে হবে। আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির সুবিধা ধনবানরা যতটা ভোগ করছে, মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তরা সেটা পারছে না। এ ক্ষেত্রে পদক্ষেপ নিতে হবে। দুর্নীতি-অনিয়মের প্রতি কঠোরহস্ত হতে হবে।

এ সব ক্ষেত্রে ক্ষমতায় যারা রয়েছে, তাদের দায় বড়। কিন্তু ক্ষমতার বাইরে থাকা সকল রাজনৈতিক ও সামাজিক  শক্তিরও সক্রিয় অংশগ্রহণ চাই। সরকারের বাইরে যারা, ক্ষমতায়  যেতে প্রবল আকাঙ্খা তাদের থাকবেই। তাদের সব পদক্ষেপ-বক্তব্য সব সময় যুক্তিপূর্ণ হবে, এমন আশা করাও ঠিক নয়। ক্ষমতায় না থাকার যে অনেক জ্বালা! তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে আওয়ামী লীগ টানা ২১ বছর ক্ষমতার বাইরে ছিল। কিন্তু রাজনীতিতে তারা  প্রাসঙ্গিতা হারায়নি। তারা নির্দিষ্ট কিছু এজেন্ডায় অবিচল ছিল মুক্তিযুদ্ধের ধারায় বাংলাদেশকে ফিরিয়ে আনতে হবে। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী এবং বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিচার করতে হবে। পরনির্ভরতা কমিয়ে বাংলাদেশকে উন্নত দেশে পরিণত করতে হবে। ১৯৯৬ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ যে লক্ষ অর্জনে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিতে পেরেছে তার মূলে কিন্তু এটাই। এটাও আমাদের ভুললে চলবে না যে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার জন্য যে দীর্ঘ আন্দোলন করেছে তাতে প্রধান মনোযোগ ছিল জনগণকে সম্পৃক্ত করার ওপর। তারা বিএনপি নেতাদের মতো বলেনি ‘লাঠি লাগে, অস্ত্র লাগে যা কিছু লাগে আমরা প্রস্তুত। সাত দিনের মধ্যে সরকারকে ফেলে দেব!’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শক্তির উৎসও ছিল এই জনগণ, যাদের সংগঠিত ও সচেতন করার জন্য দুই দশকেরও বেশি সময় ঘুরেছেন বাংলার পথে প্রান্তরে। এ জনগণের শক্তিতেই তিনি পাকিস্তানের নিষ্ঠুর সামরিক শাসকদের চ্যালেঞ্জ করতে এবং তাদের পরাভূত করতে পেরেছিলেন। তাঁর নাম উচ্চারণ পর্যন্ত নিষিদ্ধ করার পরও যে জনগণ তাকে সর্বোচ্চ সম্মানের আসনে রেখেছে, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির আসনে ঠাঁই দিয়েছে তার কারণ বুঝতে তাই কারও সমস্যা হয় না।

 

লেখকঃ সাংবাদিক ও গবেষক

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত