নাজনীন বেগমঃ
মার্চ মাস আমাদের জাতীয় জীবনের এক অনন্য মাইলফলক। যার ঐতিহাসিক এবং ঐতিহ্যিক প্রত্যয় আপামর জনসাধারণের সহজাত অংশগ্রহণ ছাড়াও অবিস্মরণীয় নেতৃত্বের এক অনবদ্য যোগসাজশ। সেই মহিমান্বিত মার্চ আজ তার সুবর্ণজয়ন্তীর দোরগোড়ায়। ৭ মার্চের অভাবনীয় বক্তব্য সংগ্রামী মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের পালাক্রমের মহিমায় অভিষিক্ত, লড়াকু মনোবলে এগিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকারই শুধু নয়, বহু কাক্সিক্ষত স্বাধীনতার ঘোষণা ব্যক্ত করার মাহেন্দ্রক্ষণও বটে। আবার ২০২১ সালের মার্চ মাসের আরও এক শুভ সঙ্কেত স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল অগ্রযাত্রায় জাতিসংঘের অনুমোদন। যাকে বঙ্গবন্ধুতনয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনগণের নামে ও কল্যাণে উৎসর্গ করতে বিন্দুমাত্র ভাবেননি। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচার ও নিপীড়নে দগ্ধ মার্চ মাস আপামর বাঙালীর জীবনে যে অশনি সঙ্কেতের দাবানল ছড়ায় তা প্রতিবাদ, প্রতিরোধ আর লড়াকু অভিযাত্রায় একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়াকে সুসংহত করে তাও বিশ্ব ইতিহাসের সংগ্রামী অভিগমন। যার সূচনাই হয় একেবারে শুরুতে। ৭ মার্চের ভাষণ এখন বিশ্ব ইতিহাসের অনন্য দলিল। ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যে জাতির জনকের ঐতিহাসিক ভাষণ স্থান পেয়েছে। সেই ভাষণেরও সুবর্ণজয়ন্তী মহাসন্ধিক্ষণের একান্ত নিকটে। পুরো মার্চ মাসে যে স্বাধীনতার মহামন্ত্রে বাঙালী জাতির বিস্ময়কর জাগরণ তা একটি নতুন সার্বভৌম রাষ্ট্র তৈরির পরম গৌরবগাথার সংগ্রামী সম্পদ। বঙ্গবন্ধুর উদাত্ত আহ্বান আর অসহযোগ আন্দোলনের কঠিন বলয়ের মধ্যে স্বাধীনতার যে অভেদ্য প্রাচীর তৈরি হয় তা পাকিস্তানী সামরিক জান্তার নৃশংস ছোবলে আক্রান্ত হলেও পরিণামে মুক্তির বারতা এক সময় সমস্ত সঙ্কট কাটাতে নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে। আর এই মাসই বঙ্গবন্ধুর জন্মের মাস। ১৭ মার্চ টুঙ্গিপাড়ার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম নেয়া অসাধারণ এই ব্যক্তিত্ব অল্প বয়সেই পরাধীনতার গ্লানি নিয়ে শৈশব-কৈশোর অতিক্রান্তের সময় উত্তাল ভারতে ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রাসঙ্গিক আন্দোলন এবং সংগ্রামী ইতিহাসের একজন অংশীদার ও সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষক ছিলেন। উপলব্ধি করেছেন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিষবাষ্প। যার ফলে সম্প্রদায়িক সংঘর্ষ জাতির জনককে নানামাত্রিকে সম্প্রীতির বেড়াজালের প্রতি সচেতন দৃষ্টি নিবদ্ধ করাতেও দায়বদ্ধতা তৈরি করে। সম্প্রদায়গত বিভাজনের অংশীদারিত্ব করাও ছিল সময়ের দাবি শুধু ব্রিটিশদের এ ভূখণ্ড থেকে বিতাড়িত করার উপায় হিসেবেই। সেই মোহমুক্ত হতেও সময় লাগেনি। কিছুদিনের মধ্যেই সাংস্কৃতিক চেতনা এবং মাতৃভাষার ওপর নব্য শাসকগোষ্ঠীর যে আগ্রাসী মনোভাব দেখা যায় তাতে বঙ্গবন্ধুসহ অনেক সংগ্রামী নেতার বোধোদয় হয়। পঞ্চাশ থেকে ষাট দশকের আন্দোলন বাংলাকে অস্থির করে তোলে। তারই দুর্দান্ত পথপরিক্রমায় স্বাধীনতার মন্ত্র দুর্বার গতিতে তার অভীষ্ট গন্তব্য স্থির করে নেয়।
ভাষা সংগ্রাম, ছয় দফা আন্দোলন থেকে শুরু করে হরেকরকম বিপর্যয়ও বঙ্গবন্ধুকে দৃঢ় অঙ্গীকারে সামলাতে হয়। ’৬৮ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ছাড়াও ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান সারা বাংলাকে অভিন্ন মাত্রায় একাত্ম করে দেয়। তারই সংগ্রামী অভিঘাতে ’৭০-এর নির্বাচন তার যাত্রাপথ নিশ্চিত মুক্তির লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়ার দৃঢ় সঙ্কল্পে জোরালো হয়। সত্তরের নির্বাচন বাংলাদেশে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন শাসন ক্ষমতায় যাওয়ার পথকে অবারিত করে দেয়। আর সেখানেই তৈরি হতে থাকে জঙ্গী শাসকগোষ্ঠীর হরেকরকম ছল-চাতুরি, কূটকৌশল। সঙ্গে সশস্ত্র অভিযান বাঙালীকে হতোদ্যম, বিচলিত এবং বিক্ষুব্ধ করে তোলে। তারপর থেকেই শুরু হয়ে যায় অবিস্মরণীয় মার্চ মাসের লড়াকু অভিযাত্রা। সেই ২৫ মার্চের কালরাত্রির রক্তাক্ত প্লাবন পেরিয়ে ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণায় বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক গুরুদায়িত্ব পালন জাতির জন্য মাইলফলক। জাতির জনককে তার পরিণাম ভোগ করতে হয় নিদারুণভাবে। আটকের মাধ্যমে তাঁকে পাকিস্তানের কারাগারে শাসকগোষ্ঠী বন্দী করে রাখে। সেই উত্তাল মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত নয় মাসের রক্তস্নাত নদী পার হয়ে বাঙালী স্বাধীনতার রক্তিম সূর্যে নিজেদের রাঙিয়ে নেয়। তখন অবধি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাকক্ষে নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করেছেন। আন্তর্জাতিক চাপকে উপেক্ষা করাও এত সহজ ছিল না। ফলে নয় মাসের অন্তরীণ জীবন যতই অসহায় আর দুর্বিষহ হোক না কেন এক সময় শাসকগোষ্ঠীর বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে স্বীকৃতি জানানো ছাড়া অন্য কোন উপায়ও ছিল না। উন্নত মস্তকে, বীরদর্পে জাতির জনক স্বদেশের পলি মাটিতে পা রাখেন। তেমন স্মরণীয় ঘটনাও ঐতিহাসিক মর্যাদায় আজও সবাইকে আনন্দঘন আবেগে আপ্লুত করে। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু নিজ দেশে ফেরার পর নতুন পরিক্রমায় এক অনন্য বাংলাদেশ গড়ার উদ্দীপ্ত অঙ্গীকারে যখন আধুনিক নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন তার মধ্য থেকেই অনাকাক্সিক্ষত ষড়যন্ত্র দানা বাঁধতে অপশক্তির খুব বেশি সময়ও লাগেনি। মাত্র সাড়ে তিন বছরে স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণই শুধু নয়, তাকে অর্থবহ করে তোলার সূচনাকালেই সব শেষ হয়ে যায়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ড আজও শুধু জাতি নয়, সারা বিশ্বেরও এক কলঙ্কিত অধ্যায়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে ইতিহাস থেকে নিশ্চিহ্ন করার অশুভ পাঁয়তারা চলে সুদীর্ঘ ২১ বছর। ইতিহাসের অকৃত্রিম দায়বদ্ধতায় সৌভাগ্যক্রমে দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দেশের বাইরে থাকায় জানে বেঁচে যান। সর্বস্ব হারানো দুই সহোদরার বেঁচে থাকাও ছিল প্রতিদিনের লড়াকু অভিঘাত। অনেক বিবর্ণ এবং অন্ধকার বলয়ের হাতছানিকে উদ্দীপ্ত মনোবলে ঠেকানোর চেষ্টাও আমাদের বিভিন্নভাবে তাড়িত করে। তেমন সংগ্রামী অভিযাত্রায় ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বাংলার ইতিহাসের আর এক অমোঘ নিদর্শন বললে খুব বেশি বলাও হয় না। দেশে ফিরলেও নিশ্চয়তা ও নিরাপত্তার কোন বলয় সুরক্ষা তো দেয়ইনি, বরং বারবার প্রতিদিনের যাত্রাপথ বিপন্ন হওয়াই ছিল যাপিতজীবন। সেই বন্ধুর পরিক্রমা পাড়ি দেয়াও এত সহজ ছিল না। অনন্য দেশাত্মবোধ, জনগোষ্ঠীর প্রতি অকৃত্রিম দায়বদ্ধতা ছাড়াও বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার দৃঢ় অঙ্গীকারে প্রতিনিয়তই শুধু দলকে সংহত আর সংগঠিত করা নয়, তার চেয়েও বেশি একটি নতুন বাংলাদেশকে উপহার দেয়ার প্রত্যয়ে সমস্ত বাধা অতিক্রম করতে একেবারে দ্বিধাহীন ছিলেন। ১৯৯৬ সালে ২১ বছর পর ক্ষমতায় এসে যে অসত্য অভিশাপকে সম্মুখ সমরে অতিক্রম করতে হয়েছে তাও যেন এক প্রকার মুক্তির লড়াই। সব কিছুর ওপর স্বাধীনতাবিরোধীদের যন্ত্রণাদায়ক আগ্রাসন আর আস্ফালনকে ঠাণ্ডা মাথায় যৌক্তিক বিবেচনা ছাড়াও আইনী সমাধান দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নতুন সংগ্রামে অবতীর্ণ হলেন। পেছন ফেরে তাকাননি পর্যন্ত। দৃঢ় মনোবলে সম্মুখ সারির যোদ্ধার ভূমিকায় নিজেকে শাণিত করেছেন। প্রাণ সংশয়ের মতো অবাঞ্ছিত দুর্ঘটনাকেও তোয়াক্কা পর্যন্ত করেননি। পিতার হত্যার বিচার করতে গিয়ে তাঁকে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসতে হয়। ১৯৯৬ থেকে ২০০০ মাত্র ৫ বছরে সব ষড়যন্ত্র আর জঞ্জালকে প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে ক্ষমতায় আসতে আরও ৮ বছর অপেক্ষা করতে হয়। ততদিনে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তিই শুধু নয়, মৌলবাদী জঙ্গীগোষ্ঠীও এক ভয়াবহ অপতৎপরতায় সারাদেশকে অরাজক অবস্থায় নিয়ে যায়। পরিস্থিতির চরম অবনতি হলে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার নতুন পথপরিক্রমায় নিজেদের যে শাসনক্ষমতা তৈরি করে তার মেয়াদও ২ বছর পর্যন্ত গড়ায়। অনির্বাচিত সরকারের এভাবে ক্ষমতায় আসন গেড়ে বসা সাংবিধানিক বিধিবদ্ধ আইনের একেবারে পরিপন্থী। ফলে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচনের সময় নির্ধারণ হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হাতে নেয়ার সাংবিধানিক অধিকার পায়। ২০০৯ সাল থেকে শেখ হাসিনার শাসনকাল বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অনবদ্য যাত্রাপথ। একেবারে সমস্যাজর্জরিত এক নিম্ন আয়ের দেশ থেকে যেভাবে শেখ হাসিনা তাঁর অসাধারণ কর্মপরিকল্পনায় নতুন করে বাংলাদেশের পুরো বলয় সাজানো-গোছানোর দায়ভারে নিজেকে সমর্পণ করলেন সেই চলমান উন্নয়ন প্রক্রিয়া আজ অবধি এগিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে দেশ তার উন্নয়ন অভিযাত্রার লক্ষ্যমাত্রাকে স্পর্শ করার দুরন্ত অভিগমনে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। উন্নয়ন দশক অতিক্রমের সুবর্ণ সময়ে দ্বিতীয় মেয়াদ পার করে তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নিজেকে তুলে ধরেন আন্তর্জাতিক বলয়ে অনন্য উচ্চতায়। সঙ্গে দেশের অভাবনীয় উন্নয়নযজ্ঞে দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষুদ্র অঞ্চলটিকেও বিশ্বের মানদণ্ডে নিয়ে যেতে এই কিংবদন্তি নেতৃত্বের কোন জুড়ি নেই।
মহিমান্বিত মার্চ মাস এলে দেশের সব ধরনের অর্জন-বিসর্জন সামনে এসে যায়। বিশ্ব নেতৃত্বের যে সোপানে প্রধানমন্ত্রী তাঁর আসন মজবুত করেছেন সেখানে সারা বাংলাকেও নিয়ে গেছেন। তার যথার্থ অনুগামিতায় স্বপ্লোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল যাত্রাপথ শুরু হয়েছে আরও আগে। শুধু মাইলফলক ছুঁয়ে ফেলা বাকি ছিল। সেটাও আজ আয়ত্তের মধ্যে এসে যাচ্ছে। শুরুতেই বলা হয়েছে জাতিসংঘ বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল যাত্রাপথের অংশ হিসেবে বিবেচনায় এনে অনুমোদনও দিয়েছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্ত্রী তো বটেই, একটানা শাসনের যুগপূর্তি অতিক্রম করার মহাসন্ধিক্ষণে বাংলাদেশের এমন প্রাপ্তি সারাদেশের জন্য এক অভাবনীয় উপহার। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রায় এগিয়ে চলা বাংলাদেশ তার সফল অগ্রসরমানতায় আধুনিক ও প্রযুক্তির বাংলাদেশকে আরও সম্মানজনকভাবে সামনের সারিতে নিয়ে যাবে তেমন প্রত্যাশা এবং আকাক্সক্ষায় বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষ।