ফিরে দেখা উত্তাল মার্চ ১৯৭১- স্বাধীন বাংলার পতাকা পেয়ে গেল জাতি

1820

Published on মার্চ 2, 2022
  • Details Image

আজিজুল পারভেজ: 

২ মার্চ, ১৯৭১। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বাতিলের প্রতিবাদে আওয়ামী লীগের আহ্বানে ঢাকায় পালিত হয় হরতাল কর্মসূচি। কেমন ছিল সেই হরতাল? সেই চিত্র উঠে এসেছে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’ গ্রন্থে। ‘হরতালের দিনে ফাঁকা রাস্তার মাঝখান দিয়ে...হাঁটতে হাঁটতে নিউ মার্কেটের দিকে চলে গেলাম। কী আশ্চর্য! আজকে কাঁচাবাজারও বসেনি। চিরকাল দেখে আসছি হরতাল হলেও কাঁচাবাজারটা অন্তত বসে। আজ তা-ও বসেনি। শেখ মুজিবসহ সবগুলো ছাত্র, শ্রমিক ও রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে যে সর্বত্র যানবাহন, হাটবাজার, অফিস-আদালত ও কলকারখানায় পূর্ণ হরতাল পালনের ডাক দেওয়া হয়েছে, সবাই সেটা মনে-প্রাণে মেনে নিয়েই আজ হারতাল করছে।’

ষাটের দশকে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা আন্দোলনের মূল লক্ষ্য যে এক দফা তথা স্বাধীনতা, তা প্রকাশ হয়ে গেল একাত্তরের এই দিনে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আগের রাতেই গঠন করা হয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। ছাত্রনেতারা বিশেষ বৈঠক করে গ্রহণ করেন পরদিনের কর্মসূচি। সেই কর্মসূচি অনুসারে ২ মার্চ সকাল ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসভা হওয়ার কথা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় নির্ধারিত সময়ের আগেই অভূতপূর্ব জনসমাগম ঘটে। ছাত্রনেতারা বাধ্য হয়ে সভামঞ্চ কলা ভবনের গাড়ি বারান্দার ওপরে নিয়ে যান। সভার সভাপতি ছাত্রলীগ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী শুরুতেই সমবেত ছাত্রদের বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও নির্দেশ অনুযায়ী স্বাধীনতার সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার শপথ গ্রহণ করান। ঐতিহাসিক ওই ছাত্রসমাবেশে সর্বপ্রথম সবুজ পটভূমিকার ওপর লাল বৃত্তের মাঝখানে সোনার বাংলার সোনালি মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। পতাকা উত্তোলন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ভিপি ছাত্রলীগ নেতা আ স ম আবদুর রব। সভায় ছাত্রলীগ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ ও ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদ্দুস মাখনও বত্তৃদ্ধতা করেন। সভা চলাকালে ডাকসুর সাবেক ভিপি ছাত্রলীগ নেতা তোফায়েল আহমেদও সভায় উপস্থিত হন। ছাত্রসমাবেশ থেকে পরদিন পল্টন ময়দানে জনসমাবেশের ঘোষণা দেওয়া হয়। সভা শেষে বিশাল এক শোভাযাত্রা স্বাধীনতার স্লোগান দিতে দিতে বায়তুল মোকাররমের দিকে যাত্রা করে। দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সচিবালয়ে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকা পতাকা ওড়ানো হয়।

পতাকা তৈরি সম্পর্কে জানা যায়, আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে ষাটের দশকে গোপনে একটি স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ গঠন করা হয় মূল নেতাদের নিয়ে, যা ‘নিউক্লিয়াস’ নামে পরিচিত ছিল। এই বিপ্লবী পরিষদের সদস্যদের ভাবনায় বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার নকশা ছিল। এ প্রসঙ্গে সিরাজুল আলম খান তাঁর স্মৃতিচারণায় বলেছেন, “ছোট পরিসরে ‘নিউক্লিয়াস’-এর বৈঠক থেকে সিদ্ধান্ত নিলাম, পরের দিন অর্থাৎ ২ মার্চের সভায় বাংলাদেশের নতুন জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। আ স ম আবদুর রবকে ডেকে এই সিদ্ধান্ত জানানো হলো। কথাটা শোনার পর তাকে খুবই উত্তেজিত দেখলাম। সে উত্তেজনা কেবল নতুন একটি পতাকা উত্তোলনের আবেগ থেকে নয়, তার চেয়েও বড় কিছু করার প্রত্যয় যেন তার চোখে-মুখে ফুটে ওঠে। যথারীতি ২ মার্চ কলা ভবনের গাড়ি বারান্দার ছাদ থেকে পতাকা উত্তোলন করা হয়।...এই পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে লক্ষাধিক ছাত্র-জনতার সমাবেশে স্বাধীনতাসংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দৃঢ় মনোভাব প্রকাশ পায়।”

তৎকালীন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হাসানুল হক ইনু কালের কণ্ঠকে জানান, পতাকা ওড়ানোর বিষয়টি পূর্বপরিকল্পিত ছিল না। এটি ছিল ২ মার্চের তাত্ক্ষণিক ঘটনা। পতাকাটি তৈরির প্রেক্ষাপট সম্পর্কে তিনি জানান, এই পতাকা তৈরি হয়েছিল ১৯৭০ সালের ৬ জুন। ছাত্রলীগের ‘নিউক্লিয়াস’-এর সিদ্ধান্ত অনুসারে গঠিত হয়েছিল ‘জয় বাংলা বাহিনী’। এই বাহিনীর দায়িত্বে ছিলেন ইনু। ‘জয় বাংলা বাহিনী’র পক্ষ থেকে ওই বছরের ছয় দফা দিবস উপলক্ষে ৭ জুন ঢাকার পল্টন ময়দানে একটি সামরিক কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠান করে বঙ্গবন্ধুকে অভিবাদন জানানোর আয়োজন করা হয়। এই বাহিনীর একটি পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ৬ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের (সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ১১৭-১১৮ নম্বর কক্ষে (তৎকালীন ১১৬) ছাত্রলীগ নেতা আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ, কাজী আরেফ আহমেদ ও উত্তরবঙ্গের ছাত্রলীগ নেতা মার্শাল মনিরুল ইসলাম পতাকা তৈরির পরিকল্পনা নিয়ে বৈঠকে বসেন। ওই বৈঠকেই তাঁরা সবুজ জমিন, লাল বৃত্ত আর হলুদ মানচিত্র দিয়ে পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত নেন। তাঁদের সিদ্ধান্ত অনুসারে মানচিত্রটি কাগজে আঁকেন ছাত্রনেতা শিব নারায়ণ দাস। সেই নকশা নিয়ে বুয়েটের হলে ফিরে ইনু সঠিক মাপ নির্ধারণ করে রাতে ছাত্রলীগ অফিসের পাশের এক দর্জির দোকানে কাপড়ের পতাকা তৈরি করেন।

তিনি আরো জানান, পতাকাটি তাঁর কাছেই রক্ষিত ছিল। ২ মার্চ এই পতাকা লম্বা বাঁশের মাথায় উড়িয়ে শেখ জাহিদ হোসেন ও তরুণ আওয়ামী লীগ নেতা ইদু বিশাল মিছিল নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাবেশে যোগ দেন। মঞ্চে তখন বত্তৃদ্ধতা করছিলেন আ স ম আবদুর রব। তাত্ক্ষণিকভাবে রব পতাকাটি নিয়ে ওড়ানো শুরু করেন। ‘ওই স্বাধীন বাংলার পতাকা’ বলে মানুষজন উচ্ছ্বাসমুখর হয়ে উঠল। পতাকা নিয়ে মিছিল শুরু হয়ে গেল। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে পটুয়া কামরুল হাসানের একটি প্রতিবেদনের ভিত্তিতে মানচিত্রটি বাদ দিয়ে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার ডিজাইন চূড়ান্ত করা হয়। সেই থেকে ২ মার্চ পতাকা উত্তোলন দিবস হিসেবে পালন করা হয়।

২ মার্চই বঙ্গবন্ধু প্রকাশ্যে স্বাধীনতা শব্দটি উচ্চারণ করেন। বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘বাংলার স্বতঃস্ফূর্ত গণজাগরণ সারা বিশ্বের সামনে প্রমাণ করবে যে বাঙালিরা আর উত্পীড়িত হতে চায় না, তারা স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে বাঁচতে চায়, বাংলা আর কারো উপনিবেশ বা বাজার হয়ে থাকবে না।’ শৃঙ্খলার সঙ্গে হরতাল পালনের জন্য বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট নির্দেশনা দেন। জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত সদস্যরা যে বিমানে করে ঢাকায় আসার কথা ছিল, সেই বিমানে সামরিক সৈন্যদের আনা হচ্ছে বলেও জানান বঙ্গবন্ধু।

রাতে হঠাৎ বেতার মারফত ঢাকা শহরে কারফিউ জারি করে পাকিস্তানের সামরিক সরকার। কারফিউ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ছাত্রাবাস ও শ্রমিক এলাকা থেকে ছাত্র-জনতা ও শ্রমিকরা কারফিউ ভঙ্গ করে মিছিল বের করে। উত্তেজিত জনতার কণ্ঠে ভায়াল গর্জন ওঠে ‘জয় বাংলা’, ‘সান্ধ্য আইন মানি না, মানব না’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ এসব স্লোগান। শহরজুড়ে কারফিউ ভঙ্গ করে ব্যারিকেড তৈরি করা হয়।

সৌজন্যেঃ কালের কন্ঠ 

 

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত