ভাষা আন্দোলনের প্রথম সংগ্রাম শুরু হওয়ার পূর্বে ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে শেখ মুজিবুর রহমান বরিশালে এসে বিএম কলেজ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সভা করে ছাত্রদের সংগঠিত করেছেন। ভাষা আন্দোলনের প্রস্তুতি নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের এ সভাই ছিল বরিশালের প্রথম সভা। পরবর্তীতে শেখ মুজিবুর রহমান বরিশালে সভা করে ঢাকায় যাওয়ার পর বাংলা ভাষার দাবিতে প্রদেশব্যাপী ধর্মঘট করে সেক্রেটারিয়েট ঘেরাও করা হয়। ওইদিন শেখ মুজিবুর রহমানসহ বরিশালের গৌরনদী থানার কাজী গোলাম মাহবুব ও সরদার ফজলুল কবির গ্রেফতার হন। জীবিত থাকাকালীন বরিশালের কয়েকজন ভাষা সৈনিকের স্মৃতিচারণ ও বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘ভাষা আন্দোলনের আঞ্চলিক ইতিহাস’ গ্রন্থ সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। সূত্রমতে, পরবর্তী সময়ে ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ঢাকার এক জনসভায় উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করার পরপরই এর প্রতিবাদে বিভিন্ন দলসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত হয় ‘রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ’।
২৮ সদস্য বিশিষ্ট ওই কর্মপরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন বরিশালের গৌরনদী থানার কৃতী সন্তান কাজী গোলাম মাহবুব। এছাড়া ওই কমিটিতে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন বরিশালের আরও পাঁচজন। ফলে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের ঘোষণার উত্তাপ বরিশালেও ছড়িয়ে পরে। কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের আহ্বানে বরিশালে ‘২১ ফেব্রুয়ারি’ পালনের প্রস্তুতি চলে।
আওয়ামী মুসলিম লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের উদ্যোগে ১১ ফেব্রুয়ারি থেকে অর্থ সংগ্রহের জন্য ‘পতাকা দিবস’ পালন শুরু হয়। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ এ নামে পতাকা ও ব্যাজ বিতরণ এবং পোস্টারিং চলতে থাকে। কর্মীরা টিনের চোঙা নিয়ে রাস্তায় প্রচার কাজ চালায়। ওই চোঙা ফুকানোর অন্যতম নায়ক ছিলেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নিখিল সেন।
১৪ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি আব্দুল মালেক খানকে সভাপতি এবং যুবলীগের সম্পাদক আবুল হাশেমকে আহ্বায়ক করে ২৫ সদস্যবিশিষ্ট ‘বরিশাল রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হয়। বরিশাল যুবলীগের সভাপতি আলী আশরাফ ছিলেন সংগ্রাম পরিষদের অবিসংবাদিত নেতা।
বরিশালে ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে বিএম কলেজের ছাত্ররা ছিলেন মূল চালিকাশক্তি। তারা পৃথক ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করেন। এর আহ্বায়ক ছিলেন ছাত্রলীগ সভাপতি এবং বিএম কলেজ ছাত্র সংসদের ভাইস প্রেসিডেন্ট গৌরনদীর সৈয়দ গোলাম কিবরিয়া।
২১ ফেব্রুয়ারি বৃহত্তর বরিশালের সব বিদ্যালয় ও শহরে হরতাল পালিত হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্র হত্যার সংবাদ বরিশালে পৌঁছে। একজন পুলিশ সদস্য রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দকে তা জানিয়েছিলেন। ফলে পরিষদের উদ্যোগে রাত ৯টার দিকে শহরে মিছিল বের করা হয়। ওই রাতেই সার্কিট হাউসের কাছে অবস্থিত বরিশাল মুসলিম ইনস্টিটিউটে সংগ্রাম পরিষদের জরুরী সভা বসে পরবর্তী কর্মসূচি প্রণয়ন করা হয়। সভায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য সংখ্যা ২৫ থেকে ৮১ জনে উন্নীত করা হয়।
২১ ফেব্রুয়ারি সারারাতই ছাত্রদের প্রচারকাজ চলে। ঢাকায় ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে ২২ ফেব্রুয়ারি বরিশালে হরতাল ও মিছিল হয়। অন্যস্থানের মতো বরিশালেও আন্দোলনকে সংগঠিত করার পেছনের চালিকাশক্তি ছিল ছাত্রসমাজ। ওইদিন বরিশাল নগরীর অশ্বিনী কুমার টাউন হলের সামনে ভোর থেকেই ছাত্র ও জনতার স্রোত নামে। গ্রাম থেকে আসা জনতা ছাড়াও শহরের শত শত নারীদের নেতৃত্বে প্রথম শোভাযাত্রা বের করা হয়। মিছিলের অগ্রভাগে ছিলেন মেয়েরা, তার পরে সংগ্রাম পরিষদের নেতারা।
স্মরণকালের বৃহত্তম মৌন মিছিল অশ্বিনী কুমার টাউন হল থেকে বের হয়ে শহরের বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করে সার্কিট হাউস ময়দানে গিয়ে শেষ হয়। অবিভক্ত বাংলার মন্ত্রী খান বাহাদুর হাশেম আলী, এ্যাডভোকেট শামসের আলী নগ্নপদে মৌন মিছিলে অংশগ্রহণ করেন। ওইদিন অনেক মুসলিম লীগ নেতাকর্মী দল ত্যাগ করেন। সংগ্রামী জনতার এক জনসভা ওইদিন বিকেল ৩টায় অশ্বিনী কুমার টাউন হলে অনুষ্ঠিত হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টায় এ কে স্কুল মাঠে শহীদ ছাত্রদের গায়েবানা জানাজা শেষে ছাত্র ও জনতা শোকর্যালি বের করে শহর প্রদক্ষিণ করে অশ্বিনী কুমার টাউন হল চত্বরে সমবেত হন। সেখানে একেএম আজহার উদ্দিনের সভাপতিত্বে এক শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়।
২৪ ফেব্রুয়ারি অশ্বিনী কুমার টাউন হলের সামনে প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। ওইদিন শহীদ মিনারে শোকের প্রতীক কালো পতাকা এবং সংগ্রামের প্রতীক লাল পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল। পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্যদিয়ে বরিশালের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক আবুল হাশেম শহীদ মিনারের উদ্বোধন করেন। পরবর্তীতে ২৭ ফেব্রুয়ারি রাতে সরকারী নির্দেশে পুলিশ ওই শহীদ মিনারটি ভেঙ্গে ফেলেছিল।
বরিশালের গৌরব শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ১৯৫৪ সালে পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হয়ে একুশে ফেব্রুয়ারিকে সরকারী ছুটির দিন ঘোষণা করেন এবং শহীদ মিনার নির্মাণ ও বাংলা ভাষাকে ‘রাষ্ট্রভাষা’ করার প্রস্তাব অনুমোদন করেন। বরিশালের সৈয়দ আজিজুল হক নান্না মিয়া শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে এসব গৃহীত প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
লেখক : সাংবাদিক
সৌজন্যেঃ দৈনিক জনকণ্ঠ