স্বপ্নের বিজয় যেভাবে এলাে

2118

Published on ফেব্রুয়ারি 25, 2021
  • Details Image

শামসুজ্জামান খানঃ

বাঙালির হাজার বছরের স্বপ্ন ও আশা-আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন ঘটেছে ঐতিহাসিক অবিস্মরণীয় ১৯৭১ সালে। ইতিহাসে লেখা আছে বাঙালির স্বাধীনতা কামনার, স্বপ্ন কুঁড়ির মতাে বা অস্পষ্ট আকাঙ্ক্ষার ও ইচ্ছার মতাে বীজাকারের, অঙ্কুর উদগমের অবয়বের মতাে কিছু দিকচিহ্নের কথা। লেখা আছে সেই স্বাধীনতা-স্বপ্নের আগুনে প্রবেশ করে ওই স্পর্ধার জন্য পুড়ে মরার কথা। লেখা আছে অগণন ত্যাগ-তিতিক্ষা আর আত্মত্যাগের কথা। স্বাধীনতা বড় কঠিন সাধনায় অর্জনের এক মণিরত্ন। দু- একদিনের বা দু-এক প্রজন্মে এই মহারত্ন অর্জনের বহু বছর আর বহু পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়নের জন্য বহু মানুষকে ধীরে ধীরে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করে দাপে ধাপে একপর্যায়ে বিজয় এবং পরের পর্যায়ে পিছু হঠা- এমনি করেই শেষ পর্যন্ত আসে সেই কাক্ষিত, বহু সাধনার ধন মহামূল্য স্বাধীনতা।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন ইতিহাসের সেই চেনাপথেই এসেছে। হঠাৎ করে একদিনে কোনাে মেজর সাহেবের ডাকে আসেনি। তা আসা সম্ভব না বলেই আসেনি-যেভাবে আসার নিয়ম, সেভাবেই এসেছে। সেই ইতিহাসই আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস-অন্য ইতিহাস কেউ বলতে চাইলে তা ভুয়া, বিকৃত, স্বকল্পিত। বাংলাদেশের ভণ্ড নতজানু ও স্বার্থসিদ্ধিপ্রবণ ঐতিহাসিক, তথাকথিত অনুগ্রহপ্রত্যাশী বুদ্ধিজীবী ও আমলা আর ক্ষমতালিপসু রাজনীতিক বাংলাদেশের স্বাধীনতার এই স্বকপােলকল্পিত বা মনগড়া ইতিহাস তৈরির নানা কুমতলবকে নানা পরিকল্পনা, মহাপরিকল্পনা এবং পূর্বের লেখা ইতিহাস সংশােধনের সিদেল চোরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।

আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস কবে থেকে শুরু, তা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল চর্যাপদের কবি ভুসুক যেদিন দুঃখ-বেদনা ও বঞ্চনার আত্মপ্রশ্নে বিদ্ধ হয়ে বললেন 'আজি ভুসুক বাঙালি ভইলি' (আজ ভুসুক বাঙালি হলাে)- বৌদ্ধ বাঙালি সিদ্ধাচার্যের সেই উচ্চারণ বাংলার জাগরণ আর বাঙালির জাতিসত্তা অর্থাৎ দূরদৃষ্টিতে স্বাধীনতার পথরেখা (এখনকার পরিভাষায় রােডম্যাপ) তৈরিতে কোনােই অবদান রাখেনি এমন তাে নয়! বাঙালি যখন তার সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার নির্মাণে চর্যাপদ কে সামনে রাখে, তখন কবি ভুসুকের ওই বাণী বাঙালিত্বের জন্মচিত্কারের মতাে অনন্য ব্যঞ্জনা লাভ করেছে। মহামতি বুদ্ধের অনুসারী বাঙালি কবিই তখন বাঙালিত্বের তথা বাঙালি জাতির বিজয়ের নকিব হয়ে উঠেছেন। এর কয়েকশ বছর পর ইংরেজ শাসনামলে শেরপুর-জামালপুরে পাই বাঙালি মুসলমান কৃষক টিপু পাগলা, উত্তরবঙ্গে হিন্দু ও মুসলমান ফকির এবং সন্ন্যাসী বিদ্রোহীদের, পশ্চিম বাংলার নারকেলবেড়িয়ার তিতুমীরকে (মীর নিসার আলী)। আর ১৯২০-৩০-এর দশকে স্বদেশী আন্দোলনের নায়ক মাস্টারদা সূর্য সেন ও প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদাদেরকে দেখি ইংরেজের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াইয়ে জীবনদান করে আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে এবং পরে স্বাধীনতার সশস্ত্র লড়াইয়ে কৃষক বিদ্রোহের অনন্য বীরগাথাও আমরা বাংলার ইতিহাসে খুঁজে পাই।

কিন্তু এর বাইরে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি ও বিপ্লবী রাজনীতি এবং সাহিত্য ও সংস্কৃতির অবদানও আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও বাঙালির জাতিসত্তা নির্মাণে অসামান্য। নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে শ্রী চিত্তরঞ্জন দাশ, বিপিণ চন্দ্র পাল, শরৎচন্দ্র বসু, এ কে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী, হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী, মানিক মিয়া প্রমুখের অবদান বিরাট। আর নিয়মতান্ত্রিক ও সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামে সুভাষ চন্দ্র বসু, শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ প্রমুখের নাম স্মরণীয়। আর এদের সংগ্রামী জীবন ও রাজনীতির সার-সংস্কৃতি ও লােকজ-সংস্কৃতির সাধকের অবদানও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মাইকেল, বিদ্যাসাগর, মীর মশাররফ হােসেন, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কবি-বিদ্রোহী কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, লালন ফকির, হাসন রাজা, অবন-জয়নুল-কামরুল- সত্যজিৎ রায়সহ অসংখ্য কবি শিল্পী-সাহিত্যিক-আলােকচিত্রীর বাঙালির জাতীয় সংস্কৃতি নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। আর এই সংস্কৃতির ভিত্তির ওপর নির্মিত হয়েছে বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্র। সে জন্য এ রাষ্ট্রের স্রষ্টা শেখ মুজিব হাসিমুখে বলতে পারেন; ফাসির মঞ্চে যাওয়ার সময়ও বলবাে আমি বাঙালি, বাংলা আমার ভাষা।

আসলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি সৃষ্টি হয়েছে মূলত বাঙালি সংস্কৃতির ভিত্তির ওপর। তাই আমরা শুধু রাজনৈতিক বিদ্রোহীদের এই রাষ্ট্র সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি না, একই সঙ্গে ভুসুক থেকে সপ্তদশ শতকের আবুল হাকিম উনিশ-বিশ শতকের মুকুন্দ দাস, রমেশ শীল, দুদুশাহ, জালাল খাঁ, মাইজভাণ্ডারী তরিকার সৈয়দ আহমদউল্লা ও সুকান্ত থেকে শামসুর রাহমানকে বাঙালির রাষ্ট্র সৃষ্টির অন্যতম রূপকার বলে মনে করতে পারি। এঁদের সবার চিন্তার সমন্বয় সাধন করেই শেখ মুজিব বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক, মানবিক, ধর্মনিরপেক্ষ বা অসাম্প্রদায়িক চরিত্র নির্ধারণ করেন। সামান্য কোনাে পেশাজীবীর পক্ষে ইতিহাসের এত বড় ক্যানভাসকে চিন্তা ও কর্মপদ্ধতিতে ধারণ করে রাষ্ট্র গঠন করা একেবারেই অসম্ভব। এখানেই শেখ মুজিবের অনন্যতা- তিনি ভিন্নধর্মী বা স্বকীয় রাষ্ট্র স্থপতি বাঙালির শত-সহস্র বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি এবং দুঃখ-বঞ্চনাকে ধারণ করেই সৃষ্টি করেন এই অন্যন্য জাতি-রাষ্ট্র বাংলাদেশ।

দুই, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস সুদীর্ঘকালের, সে কথা আমরা আগেই বলেছি। ১৯৭১-এর ৭ মার্চের ভাষণে মহানায়ক বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘােষণা করেন এবং ১০ মার্চ স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশর আত্মপ্রকাশ ঘোষণা করেন। ১৯৭১-এর মার্চের প্রথম দিনেই সংসদ অধিবেশন বন্ধ ঘােষণা পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে গােটা বাংলাদেশে। পূর্ববাংলার মানুষের মন থেকে মুছে যায় পাকিস্তান রাষ্ট্রের বাস্তব-অস্তিত্ব এবং বাংলার মানুষকে এই মানসিক স্তরে আনেন মূলত বাংলার জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি একদিনের কোনাে ঘােষণা বা ১৯৭১-এর মার্চের অসহযােগ আন্দোলনেই বিপুল মানুষকে এই গুরুতর সিদ্ধান্তের স্তরে আনতে পারেননি। বাংলার মানুষকে এই স্তরে আনতে তার সময় লেগেছে প্রায় সিকি শতাব্দী ।

১৯৪৭-৪৮-এ তিনি শামসুল হকের নেতৃত্বে, মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে আতাউর রহমান খানের সহায়তায় মুসলিম লীগ বিরােধী এবং আধুনিক জনগণের স্বার্থভিত্তিক আওয়ামী মুসলিম লীগের রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু করেন। তা ধীরে ধীরে শত নির্যাতন-অত্যাচার, জোরজুলুম সহ্য করে বাংলার মানুষের মনে সুদৃঢ় প্রভাব ফেলতে থাকে। এই ধারার প্রথম বিজয় সুচিত হয় ১৯৫৪-এর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভূমিধস পরাজয়ে। এ পর্যায়ে সােহরাওয়ার্দী, ভাসানী, এ কে ফজলুল হকের অবদান মুখ্য হলেও জনপ্রিয় তরুণ নেতা শেখ মুজিবের অবদান কিছুমাত্র কম নয়। শেখ মুজিবুর পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা ও বাঙালির সপক্ষে জাতিতাত্ত্বিক অবস্থান-প্রসূত যে ভূমিকা পালন করেন, তা বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বাঙালির রাষ্ট্র নির্মাণের উপাদান প্রস্তুত করে। তিনি পাকিস্তানের গণপরিষদে পশ্চিম পাকিস্তানি শােষকদের উদ্দেশ্যে বলেন, ক. Zulum mat karo bhai (জুলুম করাে না ভাই)। যদি করাে, তাহলে নিয়মতান্ত্রিক পথ ছেড়ে আমরা অসাংবিধানিক পন্থায় চলে যেতে বাধ্য হবাে। খ. The word Bengal' has a history has a tradition of its own (বাংলা' শব্দটির এক নিজস্ব ইতিহাস ও ঐতিহ্য আছে)। তাই বাংলা' নাম পরিবর্তন করে পূর্ব পাকিস্তান' রাখতে চাইলে আমাদের পূর্ববাংলায় যেয়ে জনগণের মত নিতে হবে। তারা রাজি হলে তবেই এটা সম্ভব । গ. বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা এবং যুক্তনির্বাচনের কী হলাে? (speeches of Sheikh Mujibur Rahman in Pakistan Parliament, P. 12) এ দুটি বিষয়ই বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের অন্যতম মূল উপাদান। ঘ. করাচিকে এক ইউনিটভুক্ত করে পশ্চিম পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করলে (করাচি বাংলার পাটের টাকায় গড়ে উঠেছে বলে) পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তর করতে হবে । ঘ. বাংলার মানুষ না খেয়ে আছে এবং তারা মারা যাচ্ছে (কিছু আগে খুলনায় দুর্ভিক্ষ হয়ে গেছে), পাকিস্তান দাবিকে বিপুলভাবে সমর্থন করার এই ফল? পশ্চিম পাকিস্তানিরা। পাকিস্তানের জন্য এতটা ত্যাগ স্বীকার করেনি। তারা আমাদের দুঃখ বুঝবে না। ঙ. আমরা পাকিস্তানি না, 'বাঙালি নামে পরিচিত হতে চাই । চ. I will here and now speak in Bangali and nobdoy can pruvent me from doing that (1127 এখানে এই মুহূর্তে বাংলায় বক্তৃতা করব। আমাকে কেউ বাধা দিতে পারবেন না)।

১৯৬২ সালে বাংলার স্বাধীনতা প্রস্তুতির জন্য তিনি গঠন করেন ছাত্রনেতাদের নেতৃত্বে এক নিউক্লিয়াস। এর সদস্য করা হয় সিরাজুল আলম খান, ফজলুল হক মণি, আবদুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমদকে। এরা বঙ্গবন্ধুর অনুমােদনে স্বাধীনতার নানা সুস্পষ্ট কর্মসূচি তৈরি করেন। যেমন- ক, তােমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা যমুনা; 'জাগ জাগ বাঙালি জাগ'; 'পিন্ডি না ঢাকা?- ঢাকা, ঢাকা স্লোগান এবং বাঙালির স্বাধীনতার বীজমন্ত্র জয় বাংলা'। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা বাংলাদেশের স্বাধীনতার মােক্ষম অস্ত্র হয়ে ওঠে। এই মারণাস্ত্রপ্রতিম ৬ দফা বঙ্গবন্ধু পেশ করেন পাকিস্তানের রাজনৈতিক শক্তির মূল কেন্দ্র লাহােরে।

সাহসী, লড়াকু মুজিব তখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। শেখ মুজিব ৬ দফা নামে এক দফায় আসছেন এটা বুঝতে পেরেই আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে অস্ত্রের ভাষা প্রয়ােগ করার হুমকি দেন। ১৯৭১-এ পাকিস্তানি দখলদাররা অস্ত্রের ভাষাই প্রয়ােগ করে বাঙালিদের বিরুদ্ধে। এই ভয়াবহ অস্ত্রের ভাষা সত্ত্বেও ১৯৭১-এর বঙ্গবন্ধু অসহযােগ আন্দোলন কর্মসূচির মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা শুধু নয়, দেশকে মার্চেই যেন স্বাধীন করে ফেলেন। ১৯৭১-এ জুলাই মাসের South Asian Review-এ লেখা প্রসঙ্গে বলেন, When the police and servants joined the judges in pleding support for Mujib a defacto transfer of power had taken place inside Bangladesh and it had happend within a week of Yahiya's decision. During next three weeks Mujibs house became in effect this secretariat of Bangladesh (বিচারকদের অনুসরণ করে পুলিশ এবং সিভিল প্রশাসনের কর্মচারীরা যখন মুজিবের প্রতি সমর্থন জানায়, তখনই বাংলাদেশের ভেতরে ক্ষমতার কার্যত হস্তান্তর হয়ে যায় এবং ইয়াহিয়ার সিদ্ধান্তের এক সপ্তাহের মধ্যেই তা ঘটে। পরের তিন সপ্তাহে মুজিবের বাড়ি কার্যত বাংলাদেশ সেক্রেটারিয়েটে পরিণত হয়)।

এভাবে উত্তাল মার্চের পথ বেয়ে ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনন্য নেতৃত্বে রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয় অর্জিত হয় । বিশ্বের বুকে আবির্ভাব ঘটে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের।

সূত্রঃ বঙ্গবন্ধু- স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা, ড. আনু মাহমুদ

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত