সেই একুশ আর এই একুশ

1744

Published on ফেব্রুয়ারি 21, 2021
  • Details Image

অধ্যাপক ডাঃ মামুন আল মাহতাবঃ

করোনাকালে ফেসবুক লাইভ আর ভার্চুয়াল টিভি টকশোগুলোর কল্যাণে বলার আর তার চেয়ে বেশি জানার সুযোগ হয় অনেক। এমনি এক টকশোর কদিন আগের শিরোনাম ‘ভাষার মাসে ষড়যন্ত্র’। একুশ নিয়ে লিখতে বসে হঠাৎই মাথায় খেলল টকশোর শিরোনামটি। এই একুশেই আমার আরেকটি লেখায় আমি লিখেছি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের এই যে পথ চলা এর সূচনাটা একুশে। একুশ শুধু ভাষার দাবিতে বাঙালীর রক্ত ঝড়ানোর অনন্য গৌরবগাথাই নয়, একুশ থেকেই শুরু বাঙালীর বাঙালীয়ানা আর বাংলাদেশ চর্চারও। আমাদের দেশের নাম বাংলাদেশ, আমাদের জাতীয় স্লোগান ‘জয় বাংলা’ আর আমাদের জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা’। এর প্রত্যেকটি নির্ধারণ করেছিলেন জাতির জনক আর এর প্রত্যেকটিতেই আছে ‘বাংলা’। দ্বিজাতিতত্ত্বের অসাধারণতা বঙ্গবন্ধু অনুধাবন করেছিলেন পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের একেবারে সূচনালগ্নে। পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ, আওয়ামী মুসলিম লীগ এবং সব শেষ আওয়ামী লীগের মাধ্যমে বাঙালীকে চব্বিশ বছরে স্বাধীনতার জন্য ধীরে ধীরে পরিপক্ব করে তোলায় বঙ্গবন্ধুর কঠিন পথ চলার শুরুটা ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই। আর এই পথ চলায় একদিকে বঙ্গবন্ধু আর বাংলাদেশের সামনে যেমন ছিল নানা প্রতিকূলতণ্ড ছিল তেমনি ষড়যন্ত্রও। এই সত্যকে বুঝতে পাকিস্তান আমলে ফিরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। বাংলাদেশেই আছে এর ভূরি ভূরি উদাহরণ।

পঁচাত্তরের পনেরো আগস্টের প্রেক্ষাপট রচনায় ষড়যন্ত্রের ছড়াছড়ি। কোথাকার কোন্ বাসন্তি, যার শাড়ি কেনার পয়সা জোটে না, সে কোত্থেকে শরীরে জড়ানোর জন্য জাল কেনার পয়সা পেল, এ নিয়ে সেদিন প্রশ্ন উঠেনি। যেমন চেষ্টা করা হয়নি বহু প্রতিভাধর, সব্যসাচি ব্যক্তিত্ব, মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামালের চরিত্রহননের নানা প্রচারণার পেছনের কার্যকরণ খুঁজে দেখারও। বলা হয়েছে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের সব কল-কারখানার মেশিনপত্র খুলে নিয়ে চলে গেছে ভারতীয় সেনাবাহিনী। একাত্তরের নয় মাসে পাকিস্তানীরা যেখানে বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে পুড়িয়ে-ধ্বসিয়ে দিয়েছে একের পর এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অবকাঠামো, সেখানে ভারতীয়দের নিয়ে যাওয়ার জন্য অবশিষ্টইবা ছিল কি তাও খতিয়ে দেখার তাগিদ অনুভূত হয়নি। বলা হয়েছে বাংলাদেশ-ভারতের পঁচিশ বছরের মৈত্রী চুক্তি নাকি দাসত্বের চুক্তির নামান্তর মাত্র। অথচ একবারও আমাদের মাথায় আসল না, তাহলে কি তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে একই চুক্তি করে ভারত সরকার সোভিয়েতদের কাছে দাসখত লিখে দিয়েছিল? এমনি সব দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রের সফল মঞ্চায়ন ছিল পঁচাত্তরের পনেরো আগস্ট।

ষড়যন্ত্রের এই ধারা অব্যাহত থেকেছে বঙ্গবন্ধু-উত্তর বাংলাদেশেও। এই ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতায়ই একাত্তরের যুদ্ধপরাধীর গাড়িতে উঠেছে জাতির পতাকা। জয় বাংলার ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদে’ রূপান্তর কিংবা পাকিস্তানের নাম রাতারাতি ‘হানাদার’ দিয়ে প্রতিস্থাপন- এসব কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। যেমন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় কোটালীপাড়া, বঙ্গবন্ধু এভিনিউ কিংবা চট্টগ্রাম। একইভাবে ভাষার মাসে হালের যে ষড়যন্ত্র বিচ্ছিন্ন কোন কিছু নয় সেটাও। যে প্রতিবেদনের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ন্যূনতম যোগসূত্রও নেই সেই প্রতিবেদনে প্রধানমন্ত্রীর নাম জুড়ে দেয়া যেমন ইঙ্গিতবহ, ইঙ্গিতবহ তেমনি আরও অনেক কিছুই। আলোচিত প্রতিবেদনটির প্রচারকাল এমন এক সময়ে যখন প্রতিবেদনের মূল টার্গেট যিনি তিনি সরকারী সফরে দেশের বাইরে। করোনাকালে নাকে তেল দিয়ে ঘুমানোয় ব্যস্ত যে কুম্ভকর্ণের দল, হঠাৎই তাদের যত বাকোয়াস করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে। মুরগির টিকা থেকে বুড়িগঙ্গার পানি, বাদ গেল না কোনকিছুই। অথচ প্রত্যাখ্যাত যখন নাটুকে প্রতিবেদন, আবারও ফিরতি ঘুমে কুম্ভকর্ণের পাল। শুধু ঘুমাতে যাওয়ার আগে করোনা ভ্যাকসিন নিতে ভুল করলেন না তাদের কেউই। আবারও আরেকটি অঘটনের প্রেক্ষাপট রচনা আর ষড়যন্ত্রের সব উপাদানের কি চমৎকার ‘কাকতালীয়’ উপস্থিতি।

আবারও যখন ব্যাকফুটে ষড়যন্ত্রীর দল তখনও কিন্তু স্বস্তির সুযোগ নেই এতটুকু। বায়ান্নর একুশ যদি একদিন বাঙালীকে একাত্তরের পথ চিনিয়ে থাকে তাহলে আজকের একুশ পথ দেখাচ্ছে একচল্লিশের, যেদিন বাংলাদেশ হবে উন্নত আর পাশাপাশি পৃথিবীর অন্যতম অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল অর্থনৈতিক শক্তি। সেদিন নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু আর আজ নেতৃত্বে তাঁর সুযোগ্য কন্যা। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরে অখুশি ছিলেন অনেকেই। পাশ্চাত্যের শ্বেতাঙ্গ, দূরপ্রাচ্যের পীতাঙ্গ কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের আরব শেখ- অখুশির দীর্ঘ লাইনে শামিল ছিলেন এরা সবাই। একাত্তরের পর সময় পার হয়েছে পাঁচ দশক, কিন্তু সময় বদলেছে সামান্যই। আজ বাংলাদেশে এই শনৈ শনৈ উন্নতিতে অখুশি মানুষের সংখ্যা বেড়েছে বৈ কমেনি। অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার’স মেন-এ তাই শ্বেতাঙ্গ থেকে আরব, সবারই সরব উপস্থিতি।

সেই একুশে আমরা শত্রু-মিত্র চিনে নিয়েছিলাম ঠিকঠাকমতই। আমাদের পূর্বসূরিরা তেল আর জলে মিশতে দেননি। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙতে আমাদের তাই দু’যুগের বেশি সময় লাগেনি, আর দ্বিজাতিতত্ত্বের অসারতা তো বঙ্গবন্ধু আমাদের চিনিয়ে দিয়েছিলেন বছরখানেকের মধ্যেই। পঞ্চাশ বছরের স্বাধীন পথ চলায় আমরা অভিজ্ঞতায় আজ অনেক বেশি পুষ্ট। তার ওপর গত একটি যুগ ধরে আমরা অনেক বেশি সুস্থ পরিবেশে আমাদের চিন্তা-চেতনাগুলোকে লালন করতে শিখেছি। কাজেই এই একুশে আমরা অনেক বেশি পরিপক্ব। ওরা ওদের হিসেবে বড় বেশি ভুল করে ফেলেছে। শুধু ঐ গুটি কজনা নয়, গোটা জাতিই আজ ‘শেখ হাসিনাজ মেন’। কারণ পুরো জাতিই কোন না কোনভাবে আর কোন না কোন কারণে শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ। আমরা যেন শুধু কোন ধরনের নির্লিপ্ততায় না ভুগি আর কোন নিস্পৃহতা যেন কোনভাবেই আমাদের পেয়ে না বসে এই একুশে এটুকু মনে রাখা জরুরী।

লেখক : চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ

সৌজন্যেঃ দৈনিক জনকণ্ঠ

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত