প্রতি বছর জানুয়ারি মাস ফিরে এলে ১৯৬৯-এর অগ্নিঝরা দিনগুলাে স্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠে। প্রত্যেক মানুষের জীবনে উজ্জ্বলতম দিন আছে। আমি দুর্লভ সৌভাগ্যের অধিকারী। আমার জীবনেও কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা আছে। ৬৯ আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ কালপর্ব। সেই কালপর্বে আইয়ুবের লৌহ শাসনের ভিত কাঁপিয়ে বাংলার ছাত্রসমাজ ৬৯-এর ২৪ জানুয়ারি সর্বব্যাপী গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত করে ইতিহাস সৃষ্টি করে। এবার ৬৯-এর সেই স্মৃতিময় দিনগুলাের কথা কেন যেন বেশি মনে পড়ছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের মতাে এত বড় আন্দোলন হয়েছে বলে আমার মনে পড়ে না। ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন এক ভিন্ন প্রেক্ষাপট। কিন্তু ৬ দফা দেয়ার পর বঙ্গবন্ধুকে যখন ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলাবার সব পরিকল্পনা আইয়ুব খান গ্রহণ করেছিল, তখনই এ আন্দোলন আমরা করেছিলাম। যে আন্দোলনের ফলে আসাদ, মতিউর, মকবুল, রুস্তম, আলমগীরসহ অনেক শহীদের রক্তের বিনিময়ে গণঅভ্যুত্থান হয়েছিল। এ আন্দোলন বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল। কেন জানি না প্রতি বছরই এই দিনগুলাে আমাদের জাতীয় জীবনে ফিরে আসে ঠিকই; কিন্তু যেভাবে এ দিনগুলাে স্মরণ করার কথা সেভাবে আমরা পালন করি না। এটি খুব পীড়াদায়ক এবং কষ্টকর। এই তাে সেদিন আমি জাতীয় জাদুঘরে গিয়েছিলাম। দেখলাম, সেখানে '৬৯-এর শহীদ আসাদ, মতিউর, মকবুল, রুস্তম, আলমগীর, এমনকি ১৫ ফেব্রুয়ারি ক্যান্টনমেন্টে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক, ড. শামসুজ্জোহার ছবি নেই। খুব কষ্ট পেয়েছি। যে কারণে বন্ধুবান্ধবের সহযােগিতায় আমার জন্মস্থান ভােলার বাংলাবাজারে স্ব-উদ্যোগে স্বাধীনতা জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করেছি, যেখানে ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলন, বঙ্গভঙ্গ থেকে শুরু করে ভাষা আন্দোলন, '৫৪-এর যুক্তফ্রন্টের আন্দোলন, '৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, '৬৬-এর ৬ দফা আন্দোলন, '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং ফাঁসির মঞ্চ থেকে জাতির পিতাকে মুক্তকরে ২৩ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে ১০ লক্ষাধিক লােকের সামনে বঙ্গবন্ধুকে কৃতজ্ঞ জাতির পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞচিত্তে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেয়া হয়েছিল, সেসব স্মৃতি সেই জাদুঘরে স্থান পেয়েছে। আমরা একদিন চলে যাব। কিন্তু স্বাধীনতার পূর্বলগ্নে যে আন্দোলন হয়েছিল, যা ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের ড্রেস রিহার্সেল-সেই আন্দোলনটি আমাদের স্মৃতির পাতা থেকে মুছে যাবে, এটি হতে পারে না। সেই কারণেই ‘স্বাধীনতা জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করেছি। কেউ যদি পরিদর্শনে আসে, স্বাধীনতার পরিপূর্ণ ইতিহাস এখানে পাবে। এ ডিজিটাল জাদুঘরটি ২০১৮-এর ২৫ জানুয়ারি মহামান্য রাষ্ট্রপতি মাে. আবদুল হামিদ উদ্বোধন করেন।
'৬৯-এর এর সােনালি দিনগুলাের প্রতিটি মুহূর্তের কথা মনে পড়ে। অনেক সময় ভাবি, কী করে এটা সম্ভবপর হয়েছিল । বঙ্গবন্ধু যখন ৬ দফা দেন, আমি তখন ইকবাল হলের ভিপি। ইকবাল হলে বসেই ৬ দফার পক্ষে আমরা আন্দোলনের পরিকল্পনা গ্রহণ করি। আমার কক্ষ নম্বর ছিল ৩১৩। এ কক্ষে প্রায়ই থাকতেন শ্রদ্ধেয় নেতা শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান ও আবদুর রাজ্জাক। ৬ দফা দিয়ে বঙ্গবন্ধু আমাদের বলেছিলেন, 'সাঁকো দিলাম স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার উন্নীত হওয়ার জন্য।' অর্থাৎ এ ৬ দফার সিড়ি বেয়ে তিনি স্বাধীনতায় পৌছবেন। ৬ দফা দেয়ার পর বঙ্গবন্ধু দেশব্যাপী ঝটিকা সফর করে ৩২টি জনসভা করেন এবং বিভিন্ন জেলায় বারবার গ্রেফতার হন। শেষবার নারায়ণগঞ্জ থেকে সভা করে ঢাকা আসার পর তাকে গ্রেফতার করা হয়। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের পর ৬৬-এর ৭ জুন আমরা সর্বাত্মক হরতাল পালন করেছিলাম। ৬৮-এর ১৭ জানুয়ারি শেষ এবং ১৮ জানুয়ারির প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুকে কারামুক্তি দিয়ে জেলগেটেই আবার গ্রেফতার করা হয়। জেলগেট থেকে গ্রেফতার করে প্রিজনভ্যানে তােলার প্রাক্কালে এক টুকরাে মাটি কপালে ছুইয়ে বলেছিলেন, হে মাটি, আমি তােমাকে ভালােবাসি। ওরা যদি আমাকে ফাঁসি দেয়, আমি যেন মৃত্যুর পর তােমার বুকে চিরনিদ্রায় শায়িত থাকতে পারি। প্রথমে আমরা জানতাম না প্রিয়নেতা কোথায় কীভাবে আছেন। আমরা জাগ্রত ছাত্রসমাজ এ গ্রেফতারের বিরুদ্ধে মিছিল করি। আমার সৌভাগ্য ওইদিনই ডাকসুর ভিপি হয়েছিলাম। কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বসে বঙ্গবন্ধু চিঠি লিখে বিশ্বস্ত এক কারারক্ষীর মাধ্যমে পাঠিয়েছিলেন, চিঠিতে লিখেছিলেন, 'স্নেহের তােফায়েল, তুই ডাকসুর ভিপি হয়েছিস, এ কথা শুনে খুব ভালাে লেগেছে। বিম্বাস করি এবারের এ ডাকসু বাংলার মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করবে।'
৬৯-এর ১৯ জুন আগরতলা মামলার বিচার যেদিন শুরু হয়, সেদিন থেকে আমরা জানতাম আইয়ুব খান বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসিকাষ্ঠে মৃত্যুদণ্ড দেবে। কারণ, স্বৈরশাসক আইয়ুব কান উপলব্ধি করেছিল, সবাইকে বশে আনা যায়; কিন্তু শেখ মুজিবকে বশে আনা যায় না। তাই আইয়ুব খান সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, এই একটি কণ্ঠকে চিরদিনের জন্য স্তব্ধ করে দিতে হবে। কেননা, একটি কণ্ঠে কোটি কোটি কণ্ঠ উচ্চারিত হয়। আইয়ুব খান প্রদত্ত মামলার নামই ছিল রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য মামলা। আইয়ুব খান শিরােনামে একটি বই লিখেছেন আলতাফ গওহর। সেই বইতে উল্লেখ আছে, বঙ্গবন্ধুকে কীভাবে ফাঁসি দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। ৬৯-এর ১৭ জানুয়ারি যে আন্দোলন আমরা শুরু করেছিলাম, যে আন্দোলনের ফলে বঙ্গবন্ধু ফাঁসিকাষ্ঠ থেকে মুক্তি লাভ করেন। সেদিন যদি এই আন্দোলন না হতাে, সেদিনের শহীদরা যদি জীবন বিলিয়ে না দিত, তাহলে তো আমরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করতে পারতাম না। বঙ্গবন্ধুর ফাসি হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতাে না। যে আন্দোলন জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে এত বড় ভূমিকা পালন করেছে, সে আন্দোলন যখন কম আলােচিত হয়, তখন তা মনােকষ্টের কারণ হয় বৈকি! কিন্তু আমরা জাতির জনকের কাছে কৃতজ্ঞ। যখনই প্রসঙ্গ উঠত তখনই, এমনকি ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের বক্তৃতায় তিনি ১৯৬৯-এর আইয়ুববিরােধী আন্দোলনের কথা উল্লেখ করেছেন।
৬৯-এর ৪ জানুয়ারি ডাকসুসহ ৪টি ছাত্র সংগঠনের সমস্বয়ে ঐতিহাসিক ১১ দফার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয় 'সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। ডাকসু ভিপির কক্ষে বসেই আমরা ১১ দফার ভিত্তিতে গণআন্দোলনের পরিকল্পনা গ্রহণ করি। আজ যখন স্মৃতিকথা লিখছি, বারবার মনে পড়ছে ৬৯-এর ১১ দফা আন্দোলনের প্রণেতাদের-ছাত্রলীগ সভাপতি প্রয়াত আবদুর রউফ ও সাধারণ সম্পাদক খালেদ মােহাম্মদ আলী; ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপ) সভাপতি প্রয়াত সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক ও সাধারণ সম্পাদক সামসুদ্দোহা; ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ) সভাপতি মােস্তফা জামাল হায়দার ও সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল্লাহ এবং এনএসএফের একাংশের সভাপতি প্রয়াত ইব্রাহিম খলিল ও সাধারণ সম্পাদক ফকরুল ইসলাম মুন্সীর কথা। এ ছাত্রনেতাদের প্রত্যেকেই ছিলেন খ্যাতিমান ও বড় নেতা। আমি ডাকসুর ভিপি হিসেবে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সমন্বয়ক ও মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করি; সঙ্গে ছিলেন ডাকসুর জিএস নাজিম কামরান চৌধুরী। '৬৯-এর ১৭ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবনের বটতলায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের প্রথম সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। আমার সভাপতিত্বে সভা শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে গভর্নর মােনাযেম খান ১৪৪ ধারা জারি করেছে। সভাপতি হিসেবে আমার দীয়ত্ব ছিল সিদ্ধান্ত দেয়ার যে আমরা ১১ ধারা ভাঙব কি ভাব না। ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত জানিয়ে মিছিল নিয়ে রাজপথে এলাম। পুলিশ বাহিনী ক্ষিপ্রগতিতে আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে শুরু করে বেপরােয়া লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস আর ফায়ারিং। ছাত্রলীগের সভাপতি আবদুর রউফ ঘটনাস্থলে আহত হন। পরদিন ১৮ জানুয়ারি, পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল ও ঢাকা শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলােয় ধর্মঘট পালনের কর্মসূচি দিই। ১৮ জানুয়ারি, বটতলায় জমায়েত। যথারীতি আমি সভাপতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সফল ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। সকালে বটতলায় ছাত্র জমায়েতের পর খণ্ড খণ্ড মিছিল এবং সহস্র কণ্ঠের উচ্চারণ শেখ মুজিবের মুক্তি চাই, আইয়ুব খানের পতন চাই।' সেদিনও ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত এবং মিছিল নিয়ে রাজপথে এলাম। দাঙ্গা পুলিশ বেধড়ক লাঠিচার্জ আর টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করল। পরদিন ১৯ জানুয়ারি ছিল রােববার। সেসময় রােববার বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকত। কিন্তু প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় খােলা ছিল। কর্মসূচি নেয়া হল আমরা আমরা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিছিল শুরু করব এবং ১৪৪ ধারা ভাঙব। গত দু'দিনের চেয়ে মিছিল আরও বড়। পুলিশ গুলি চালাল। একজন ছাত্র গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়ল রাজপথে।
ছাত্রলীগের এই কর্মীর নাম আসাদুল হক। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বাড়ি দিনাজপুর। '৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি শহীদ হন। পুলিশের বর্বরতা ও গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে তাৎক্ষণিকভাবে ২০ জানুয়ারি আবারও বটতলায় সমাবেশের কর্মসূচি দিলাম। ২০ জানুয়ারি ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের ইতিহাসে মাইলফলক। আমরা ছিলাম মিছিলের মাঝে। মিছিল যখন আগের কলাভবনের (বর্তমান মেডিকেল কলেজ) সামনে তখনই গুলিবর্ষণ শুরু হয়। খালেদ মােহাম্মদ আলী, আসাদুজ্জামান ও আমি-আমরা তিনজন একসঙ্গে ছিলাম। আমাদের লক্ষ্য করেই এক পুলিশ ইন্সপেক্টর গুলি ছােড়ে। গুলি আসাদুজ্জামানের বুকে বিদ্ধ হয়। আমি আর খালেদ আসাদকে মেডিকেল কলেজে নেয়ার পথে আমাদের হাতের ওপরই তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। একজন শহীদের শেষ নিঃশ্বাসটি আমি স্পষ্ট শুনতে পাই। মেডিকেলের সিঁড়িতে আসাদের লাশ রাখা হয়। তার গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত শার্টটি সংগ্রামের পতাকা করে আকাশে উড়িয়ে, আসাদের রক্ত ছুঁয়ে শপথ গ্রহণ করে সমস্বলে বলি, 'আসাদ তুমি চলে গেছাে। তুমি আর ফিরবে না আমাদের কাছে। তােমার রক্ত ছুঁয়ে শপথ করছি, আমাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা মায়ের কোলে ফিরে যাবাে না। এরপর শহীদ মিনার চত্বর থেকে শহীদ আসাদের মৃত্যুর খবর ঘােষনা করি বিক্ষুবদ্ধ শােকার্ত জনতার মাঝে। আসাদের রক্তাক্ত শার্ট সামনে রেখে সমাবেশের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা বলি, আসাদের এই রক্ত আমরা বৃথা যেতে দেবাে না।
২১ জানুয়ারি অর্ধদিবস হরতাল এবং হরতালের পর পল্টনে সমাবেশের কর্মসূচি ঘােষণা করি। ২১ জানুয়ারি পূর্বঘোষিত হরতালের কর্মসূচি পালনকালে চারদিক থেকে স্রোতের মতাে মানুষের ঢল নামে পল্টন ময়দানে। এদিনও মাইক, মঞ্চ কিছুই ছিল না। ২২ জানুয়ারি শােক মিছিল, কালােব্যাজ ধারণ, কালাে পতাকা উত্তোলন। ২৩ জানুয়ারি সন্ধ্যায় মশাল মিছিল, পরে কালাে পতাকাসহ শােক মিছিল। ২৪ জানুয়ারি দুপুর ২টা পর্যন্ত হরতাল। ২৩ জানুয়ারি, শহরের সব অলিগলি থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বের হয় মশাল মিছিল। ঢাকা পরিণত হয় মশালের নগরীতে। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। ২৪ জানুয়ারি, সর্বাত্মক অর্ধদিবস হরতাল পালিত হয়। সবার তখন একই প্রশ্ন, শেখ মুজিব কবে মুক্তি পাবে (তখনও তিনি বঙ্গবন্ধু উপাধি পাননি)? কবে আগরতলা মামলা তুলে নেয়া হবে? যদি সরকার না মানে তাহলে? 'এখনই আমাদের তুমুল সংগ্রাম শুরু করা উচিত যেন আইয়ুবের পতন ঘটে। আইয়ুব-মােনায়েমের পতন না হলে শেখ মুজিব মুক্তি পাবে না। ঢাকা শহরের সর্বত্র এ ধরনের আলােচনাই চলছিল। সে গুলিতেই নিহত হয়ে শহীদদের তালিকায় যুক্ত হয় মতিউর, মকবুল, আনােয়ার, রুস্তম, মিলন, আলমগীরসহ আরও অনেক নাম। ঢাকার নবকুমার ইন্সটিটিউটের দশম শ্রেণির ছাত্র মতিউর রহমানের লাশ নিয়ে আমরা পল্টনে যাই। তখনই শুনতে পাই মােনায়েম খান শহরের নিয়ন্ত্রণ ভার ছেড়ে দেবে সেনাবাহিনীর হাতে এবং অচিরেই কারফিউ জারি হবে। উনসত্তরের ২৪ জানুয়ারি প্রবল গণআন্দোলন-গণবিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে ঢাকা নগরীর মানুষ রাজপথে নেমে এসে গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত করল। বাংলাদেশে বহু আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু ১৭ থেকে ২৪ জানুয়ারি মাত্র ৭ দিনের মধ্যে নিরস্ত্র বাঙালি জাতি এক কাতারে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঐতিহাসিক যে গণঅভ্যুতখান সৃষ্টি করেছিল তা আজও স্মৃতির পাতায় অম্লান। ২৪ জানুয়ারি গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা ১১ দফার প্রতি ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, পেশাজীবী ও বুদ্ধিজীবীসহ বাংলার সর্বস্তরের মানুষের সমর্থন আদায় করতে পেরেছিলাম।
৯ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানে শপথ দিবসে স্লোগান দিয়েছিলাম শপথ নিলাম শপথ নিলাম মুজিব তােমায় মুক্ত করবাে; শপথ নিলাম শপথ নিলাম মা-গাে তােমায় মুক্ত করবাে।' ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবসে পল্টনের মহাসমুদ্রে প্রিয়নেতা শেখ মুজিবসহ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আটক সবার নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে ২৪ ঘন্টার আলটিমেটাম প্রদান করি। সমগ্র দেশ গণবিস্ফোরণে প্রকম্পিত হয়। জনরােষের ভয়ে ২২ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান সব রাজবন্দিকে বিনা শর্তে মুক্তি দিলেন দেশজুড়ে আনন্দের বন্যা বয়ে যায় । ২৩ ফেব্রুয়ারি ১০ লক্ষাধিক লােকের বিশাল জনসমুদ্রে গণসংবর্ধনা দিয়ে কৃতজ্ঞ বাঙালি জাতি কৃতচিত্তে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করেছিল ।সেই সভায় দাঁড়িয়ে জনসমুদ্রের উদ্দেশ্যে স্বভাবসুলভ কণ্ঠে কৃতজ্ঞচিত্তে তিনি বলেছিলেন, ভাইয়েরা আমার, তােমরা যারা রক্ত দিয়ে জীবন দিয়ে আমাকে কারাগার থেকে মুক্ত করেছে, যদি কোনােদিন পারি নিজের রক্ত দিয়ে আমি সেই রক্তের ঋণ শােধ করে যাবাে। তিনি একা রক্ত দেননি, '৭৫- এর ১৫ আগস্ট স্বপরিবারে রক্ত দিয়ে বাঙালি জাতির রক্তের ঋণ তিনি শােধ করে গেছেন।
২০২০ সাল জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী। ১০ জানুয়ারি থেকে ক্ষণগণনা শুরু হয়েছে । মুজিববর্ষ পালন উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর জীবনে প্রতিটি অধ্যায় যথাযথ মর্যাদায় ঐতিহাসিকভাবে তুলে ধরা জরুরি। আমরা ইতিহাস বিকৃতির কথা বলি, কারণ, একদা ইতিহাস বিকৃত করার অপচেষ্টা হয়েছিল । আগামীতে কেউ যাতে ইতিহাস বিকৃতির প্রশ্ন তুলতে না পারে, সেই কারণেই '৪৮ ও ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৫৪-এর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, '৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, '৬৬-এর ৬ দফা আন্দোলন, '৬৯-এর ১১ দফা আন্দোলন, '৭০-এর নির্বাচন এবং '৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জন করলেও ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা যেভাবে পরিপূর্ণতা লাভ করেছে, সেগুলাে আমাদের জাতীয় মুক্তির ইতিহাসের পাতায় পাতায় যথাযথ গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ থাকা প্রয়ােজন বলে আমি মনে করি ।