2984
Published on জানুয়ারি 29, 2021১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়। নয় মাসের যুদ্ধের কথা বলা হলেও বাঙালি ইতিহাসের পাতায় আবহমানকাল ধরেই পরাধীন জাতি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আসছে। পাকিস্তানের দীর্ঘ চব্বিশ বছরের শাসন ও শোষণের বেড়াজাল ছিন্ন করে বাঙালি স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে আনে।
স্বাধীনতার এই সূর্যকে ছিনিয়ে আনতে বাঙালিকে হাজার বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। ইতিহাসের নানা বাকে নানা ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটলেও কেউই বাঙালিকে চূড়ান্ত মুক্তির বারতা এনে দিতে পারেননি। উপরন্ত বাংলা বারবার বিভিন্ন বিদেশি শক্তির করতলগত থেকেছে।
অনার্যদের আবাস ভূমি বাংলায় আগমন ঘটেছে আর্যের। এরপর ইতিহাসের পথ পরিক্রমায় বিভিন্ন জাতি এসেছে। শাসন করেছে পাল, সেন, মুসলমান, ইংরেজ, পাকিস্তানিসহ বিভিন্ন শাসকগোষ্ঠী । কিন্তু এদের কোনটিই এদেশের ছিল না। তারা বিভিন্ন দেশ থেকে এদেশে এসে শাসনক্ষমতা দখল করেছে। তারপরও আমাদের সংস্কৃতি একেবারে বিলীন হয়নি। উপরন্তু তারা আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে।
ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী ছাড়া প্রায় সকলেই এদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করে এদেশের আলো বাতাসকে আপন করে নিয়েছে। আর বাঙালিরা তাদেরকে সাদরে গ্রহণ করেছে।
ইংরেজ সরকারের আগমন বাঙালিদের চোখ খুলে দিয়েছে। পাশ্চাত্য জান-বিজ্ঞানের চর্চা তাদেরকে এতদিনের পরাধীনতা সম্পর্কে নানা প্রশ্নের মুখোমুখী করেছে। ফলে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলার রাজনৈতিক পরিবেশও ইংরেজ সরকারের শেষ দিকে সরগরম থেকেছে। এই সরগরম রাজনৈতিক অবস্থার মধ্যে ইংরেজরা তাদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য কৌশলে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ঢেলে দিয়েছে। তারপরও তারা সফল হয়নি। দুই সম্প্রদায়ের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে তারা এদেশ ছেড়েছে। কিন্তু যে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প তারা এদেশবাসীর মনে ঢেলে দিয়েছে তা থেকে বের হওয়া সম্ভব হয়নি। ইংরেজরা যাওয়ার পর ধর্মীয় জাতীয়তার নামে দেশের যে শাসনযন্ত্র পরিচালিত হয়েছে তাতেও শুরুতেই ভাষার প্রশ্নে গলদ দেখা দিয়েছে। ধর্মীয় জাতীয়তার স্থান ভাষা দখল করেছে।
বাঙালি জাতীয়তাবাদ নতুন করে বাঙালিকে পথ দেখিয়েছে। এই বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবাদপুরুষ হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু, শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি ব্রিটিশ আমল থেকে রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকলেও পাকিস্তান আমলেই বৃহত্তর পরিসরে বাঙালি জাতীয়তাবাদ নিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হন। পাকিস্তানের দীর্ঘ চব্বিশ বছরের শাসন ও শোষণের বেড়াজাল ছিন্ন করতে তিনি জীবনের অধিকাংশ সময়ই কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে কাটান। তারপরও তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে বিন্দুমাত্র ছাড় দেননি।
১৯৩৮ সালে তার প্রথম রাজনৈতিক জীবনের যাত্রা থেকে শুরু করে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত জীবনের আদর্শকে ধরে রেখেছিলেন। তিনি একে একে ব্রিটিশ, পাকিস্তান আমলের রাজনৈতিক চর্চাকে খুব কাছ থেকে দেখে মানুষের সমস্যা সমাধানের জন্য যে আদর্শকে সামনে এনেছিলেন তা হলো অসাম্প্রদায়িক চেতনা। আমাদের রক্তের মধ্যেই মিশে আছে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বীজ। এই চেতনা আবহমানকাল ধরেই চলে আসছে। ইংরেজ সরকার এসে এই চেতনায় ভাঙ্গন ধরালেও আমাদের মুক্তির একমাত্র রাস্তা এই চেতনাকে বাস্তবায়ন করার মধ্যেই রয়েছে। কীভাবে এই চেতনা জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া যায় এই ব্রত নিয়েই তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন। এই সংগ্রাম করতে গিয়ে তাকে দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় কারাগারে কাটিয়েছেন। তারপরও আদর্শ থেকে সরে আসেননি।
তিনি পাকিস্তান কায়েমের জন্য অনেক প্রত্যাশা নিয়ে মুসলিম লীগের রাজনীতি করেছেন। কিন্তু তিনি যে পাকিস্তান চেয়েছিলেন তা পাননি। এজন্য তিনি মুসলিম লীগ ছেড়ে আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগদান করেন। এক সময় আওয়ামী মুসলিম লীগ আওয়ামী লীগে পরিণত হয়। তখন এটি নামেও অসাম্প্রদায়িক রূপ লাভ করে। এক সময় তিনি আওয়ামী লীগের কাণ্ডারির ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। পাকিস্তানের চব্বিশ বছরের শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে তাঁর নেতৃত্বেই আওয়ামী লীগ নানাভাবে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের চেষ্টা করেছে। তিনিই আওয়ামী লীগ তথা বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষকে উজ্জীবিত করে রেখেছেন। এজন্য ১৯৭১ সালের নয় মাস তিনি সশরীরে উপস্থিত না থেকেও প্রতিটি বীর বাঙালির মনে স্থায়ী আসন গেড়ে নিয়েছেন। ফলে প্রতিটি বাঙালি তাঁর আদর্শকে সামনে রেখেই নয় মাস যুদ্ধ করেছে।
জীবনের এতকিছু করতে গিয়ে তাকে পরিবার, সমাজকে সময় দিতে পারেননি। তাঁর পারিবারিক জীবনের নানা কাহিনি আমরা অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে জানতে পারি। তিনি পরিবার থেকেও একাজে উৎসাহ পেয়েছেন। তাঁর পিতা তাকে সাধারণ মানুষের জন্য কিছু করছেন বলে কিছুই বলেননি। এজন্য পিতার ওপর পরিবারের দায়িত্ব দিয়ে তিনি দেশসেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন। দেশের সেবা করতে গিয়ে অনেকবারই নিজের জীবন বিপন্ন হয়েছে। তারপরও তিনি সেখান থেকে একচুল পরিমাণ সরে আসেননি।
তার রক্ত-মাংসে মিশে ছিল এদেশের আলো-বাতাস ও সাধারণ মানুষ। এদেশের মানুষ যাতে মুক্তভাবে বিচরণ করতে পারে এজন্য তিনি সকল প্রকার অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। সাধারণ মানুষের কষ্ট হয় এমন কোন বিষয়কে তিনি কখনো মেনে নেননি।
একজন মানুষ হিসেবেই তিনি বাঙালি জাতিকে মুক্তির বার্তা নিয়ে এসেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন এদেশের সকল মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বসবাস করলে প্রকৃত স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়া যাবে। এজন্য তিনি আজীবন অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক আদর্শকে ধারণ করেছেন। দীর্ঘ চব্বিশ বছরের সাধনার ধন স্বাধীনতার সূর্যকে ছিনিয়ে আনলেও তাঁর চরিত্রে জনগণের প্রতি কোমলতার যে চিত্র ছিল তা আরো দৃঢ় হয়েছে। নিজের জীবনের সুখকে বিসর্জন দিয়ে জনগণের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বিশ শতকের একজন শ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রনায়ক। তিনি সামরিক জান্তার উস্কানি, রক্তচক্ষু, হত্যা, ধর্ষণকে পাশ কাটিয়ে একটি দেশের স্বাধীনতা অর্জনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এমনকি দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই ভারতীয় সেনাবাহিনীকে বাংলাদেশের ভূখণ্ড থেকে প্রত্যাহার করিয়েছিলেন; যা বিশ্ব ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পঞ্চাশ বছর পরও জার্মানিতে মার্কিন, সোভিয়েত, ব্রিটিশ ও ফরাসি সৈন্য ছিল। জাপানে এখনো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য অবস্থান করছে। অথচ তার অসম সাহসী নেতৃত্বের কারণে স্বাধীনতার মাত্র তিন মাসের মাথায় ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করাতে সক্ষম হয়েছেন। পাশাপাশি স্বাধীনতা যুদ্ধে সার্বিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য ভারতের জনগণ ও সরকারকে সাধুবাদ জানিয়েছেন।
আড়ম্বরের কোলাহল কখনো তাঁর চরিত্রকে স্পর্শ করেনি। তিনি সাধারণ মানুষের সঙ্গে সাধারণভাবেই মিশেছেন। এজন্য বিশ শতকেই তিনি ভারতীয় উপমহাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্ব নাগরিক হয়ে ওঠেন। তার এই বিশ্বসভায় স্থান পাওয়ার অন্যতম কারণ তিনি ছিলেন আপাদমস্তক অসাম্প্রদায়িক ছিলেন।
সর্বোপরি তিনি বাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্যকে ধারণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ে জীবনের দীর্ঘ সময় ধরে সংগ্রাম করেছেন। সেই সংগ্রামে তিনি সফল হয়েছেন। তবে তাঁর সেই সফলতার পেছনে আছে অনেক ত্যাগের ইতিহাস। তিনি বাংলার ও বাঙালির জন্য যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তা বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে বিরল। এজন্য তিনি বাঙালি জাতির জনক এবং সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। তার নামের সঙ্গে বাংলাদেশের নাম অঙ্গাঙঈ্গীভাবে জড়িত। তাঁকে ছাড়া বাংলাদেশকে কল্পনা করা যায় না। এই দিশাহারা জাতিকে তিনি পথের সন্ধান দিয়েছেন।
পাকিস্তানের দীর্ঘ চব্বিশ বছরের শাসনামলে একে একে ঘটে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচন, ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা দাবি, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান এবং সর্বশেষ ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম। এসব সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সামনে থেকে নির্ভীক বীরের মতো নেতৃত্ব দিয়েছেন। এই সময়ের মধ্যেই তিনি দেশের অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হন। বাঙালি মুক্তি পায় তাদের হাজার বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে।