977
Published on জানুয়ারি 21, 2021প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের চলচ্চিত্র শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সম্ভব সবকিছু করার আশ্বাস দিয়ে বিজয়ের ইতিহাসকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য অধিকহারে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘সঠিক ইতিহাস যাতে সবাই জানতে পারে। কারণ, আমরা মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনকারি বীরের জাতি। সেই বিজয়ের ইতিহাস প্রজন্মের পর প্রজন্ম যেন মনে রাখতে পারে, সেই ধরণের চলচ্চিত্র আরো নির্মাণ হওয়া দরকার।’
’৭৫ এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে হত্যার পর আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করার অপচেষ্টা করা হয়েছে, উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের চলচ্চিত্রে শিল্প ও সংস্কৃতি যেমন থাকবে তেমনি বিশ্বের সংগে তাল মিলিয়ে চলার আন্তর্জাতিক ভাবে গ্রহণযোগ্য উপকরণও থাকতে হবে। পাশাপাশি, সেখানে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিজয়, নীতি-আদর্শ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতিফলন থাকাটা দরকার।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ সকালে ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার -২০১৯’ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে তথ্য মন্ত্রণালয় আয়োজিত মূল অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন।চলচ্চিত্রকে একটি শক্তিশালী গণমাধ্যম আখ্যায়িত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা রাজনীতিবিদরা যত কথাই বলি না কেন একটি নাটক, সিনেমা বা গান বা কবিতা দিয়ে অনেক কথা বলা যায় এবং মানুষের অন্তরে প্রবেশ করা যায়। মনের গহীনে প্রবেশ করা যায়। সেজন্য এর একটা আবেদন রয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম চলচিচত্র। অথচ এটি কিন্তু দিনে দিনে শেষ হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া, এই ডিজিটাল যুগে, যুগের সংগে তাল মিলিয়ে না করা হলে এর আকর্ষণ যেমন থাকে না তেমনি বাজারও পাওয়া যায় না। সেজন্যই বিএফডিসিকে উন্নত করায় তাঁর সরকার একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। ২০১৯ সালে ২৬টি ক্যাটাগরিতে ৩৩ জন শিল্পী এবং কলাকুশলীকে পুরস্কৃত করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে তথ্য মন্ত্রী ড.হাছান মাহমুদ পুরস্কার বিজয়ীদের মাঝে পদক, রেপ্লিকা, সম্মাননার চেক এবং সনদ বিতরণ করেন।
শ্রেষ্ঠ অভিনেতা তারিক আনাম খান (আবার বসন্ত) এবং অভিনেত্রী হিসেবে প্রসুনেরাহ বিনতে কামাল (ন ডরাই) ২০১৯ সালের এই পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া, শ্রেষ্ঠ খল চরিত্রের জন্য জাহিদ হাসান (সাপলুডু) এবং শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসেবে তানিম রহমান অংশু (ন ডরাই) পুরস্কার লাভ করেন এবং যৌথভাবে ‘ন ডরাই’ এবং ‘ফাগুন হাওয়ায়’ শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র মনোনীত হয়। মাসুদ পারভেজ সোহেল রানা এবং কোহিনুর আক্তার সুচন্দা আজীবন সম্মাননা পুরস্কার লাভ করেন।
ঢাকার নিকটে কালিয়াকৈরের কবিরপুরে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ফিল্ম সিটি’ নির্মাণের প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হয়েছে বলেও শেখ হাসিনা তাঁর ভাষণে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, সেখানে আধুনিক সিনেমা তৈরি করতে যা যা প্রয়োজন সেই ধরনের সকল সুবিধা রাখা হচ্ছে। যাতে আমাদের সিনেমা শিল্পটা আরো উন্নত মানের হয়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রেও আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি, কেননা, এখন ডিজিটাল যুগ। আমাদের চলচ্চিত্র কেবল দেশে নয় বিদেশেও যাতে যেতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আমরা সেন্সর সংক্রান্ত আইন ও বিধি আধুনিকভাবে তৈরী এবং সেগুলো কঠোর ভাবে যেন মানা হয় সেদিকেও বিশেষ ভাবে দৃষ্টি দিচ্ছি।
শেখ হাসিনা বলেন, ১ হাজার কোটি টাকার একটি ফান্ড আমরা তৈরী করবো। যেখান থেকে অল্প সুদে টাকা নিয়ে সংশ্লিষ্টরা সিনেমা হল বা সিনেপ্লেক্স তৈরী করতে পারবে। যাতে ঐ অঞ্চলের মানুষের বিনোদনের ব্যবস্থাটা হবে। তিনি বলেন, অনেকগুলো সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গেছে। কাজেই সেগুলোকে পুণরায় চালু করা শুধু নয়, এর আধুনিকায়ন করা প্রয়োজন। কারণ ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে এখন অনেক উন্নতমানের সিনেমা তৈরী করা যায়। সেই দিকেই আমরা বিশেষভাবে দৃষ্টি দিচ্ছি এবং সেভাবেই কাজ করে যাচ্ছি।তেজগাঁও আসনের সংসদ সদস্য থাকার সময় তিনি বিএফডিসির সড়কটি নির্মাণ করেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, এরকাছেই থাকা কারওয়ান বাজারের পাইকারী বাজারও ধীরে ধীরে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করবে সরকার। কাছেই থাকা হাতির ঝিলসহ আশপাশের এই এলাকাটাকেও সরকার সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে চায়। তিনি বলেন, ‘এজন্য ৩২৩ কোটি টাকা ব্যয়ে সরকারের বিএফডিসি কমপ্লেক্স নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে।’ পুরস্কার বিতরণ এবং আলোচনা পর্ব শেষে প্রধানমন্ত্রী চলচ্চিত্র শিল্পীদের পরিবেশনায় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও উপভোগ করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের এই শিল্প নষ্ট হয়ে যাক কখনো সেটা আমরা চাই না। আমাদের দর্শক টানতে হবে। মানুষ যাতে সিনেমা দেখে তার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী সুস্থ ধারার চলচ্চিত্রের পাশাপাশি শিশুদের জন্য শিক্ষণীয় শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণের ওপরেও গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি বলেন, পরিবার-পরিজন নিয়ে দেখা যায় তেমন সিনেমা যেমন তৈরী করতে হবে, তেমনি শিশুদের জন্য চলচ্চিত্র নির্মাণটাও একান্ত ভাবে জরুরি। কারণ, এর মাধ্যমেই একজন শিশু তার জীবনটাকে দেখতে পারবে এবং আগামীর জন্য নিজেকে তৈরী করতে পারবে।
এই শিল্পের আধুনিকায়নে যা যা দরকার তাঁর সরকার সেসব কিছুই করে যাচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও করে যাবে বলেও বঙ্গবন্ধু কন্যা উল্লেখ করেন। তিনি এ প্রসঙ্গে আরো বলেন, ‘আমি তো রয়েছিই সব সময় আপনাদের পাশে। কেননা, এই এফডিসি আমার বাবার হাতে গড়া এবং এই সিনেমা তৈরীর উৎসাহ তিনি নিজেই দিয়েছিলেন। কাজেই, সেটি মাথায় রেখেই আমি সব সময় কাজ করি।’
করোনার কারণে বিশ্ব স্থবিরতার প্রসঙ্গ টেনে এর মধ্যেও তাঁর সরকার চলচ্চিত্র শিল্পের বিকাশে কার্যকর ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত যাতে সিনেমা শিল্প ভালভাবে প্রচলিত হয়, মানুষ যেন বিনোদনের সুযোগ পায়, সে চিন্তা থেকেই আমরা ফান্ড সৃষ্টি করছি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকারের প্রচেষ্টায় ইতিহাস ও ঐতিহ্য সুরক্ষায় চলচ্চিত্র ব্যবস্থার উন্নয়ন, ডিজিটাল পদ্ধতিতে সনাতন চলচ্চিত্রের সংরক্ষণ এবং বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভের কার্যক্রম পুনরুদ্ধারকরণ প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে।
বিশ্বমানের চলচ্চিত্র নির্মাণে প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার এ জন্য ট্রেনিং ইনস্টিটিউট স্থাপন করেছে এবং বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট এবং জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউট ভবন সম্প্রসারণ করা হয়েছে। যেন যথাযথ প্রশিক্ষণ নিয়ে আমাদের শিল্পীরা উন্নতমানের চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে পারেন।
সরকার প্রধান বলেন, চলচ্চিত্রে তরুণ প্রজন্মের ভাবনা, মেধা ও মননশীলতাকে কাজে লাগানোর উদ্দেশে ২০১৪ সালে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউট ও কলকাতার সত্যজিৎ রায় চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউট এর মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে।
তাছাড়া, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্র্ষিকী উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর জীবনী নিয়ে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ প্রযোজনায় একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। এজন্য, ইতোমধ্যে বিখ্যাত ভারতীয় পরিচালক শ্যাম বেনেগালকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে, বলেন তিনি।
অনুষ্ঠানে সোহেল রানার নিজস্ব অনুভূতি ব্যক্ত করার সময় চলচ্চিত্র শিল্পে নিয়োজিত নেপথ্য শিল্পীদের জন্য সহযোগিতার ক্ষেত্র সৃষ্টির আবেদন প্রসঙ্গে ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী কল্যাণ ট্রাস্ট আইন-২০২০’ নিয়ে বিস্তারিত কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী এবং তিনি চলচ্চিত্রে আজীবন সম্মাননা প্রাপ্তদের সিআইপি (কালচারাল ইমপর্টেন্ট পারসন) হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের বিষয়টিও আলোচনা করার আশ্বাস দেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী কল্যাণ ট্রাস্ট আইন, ২০২০’ প্রণয়নে আমি নিজেই উদ্যোগ নিয়েছি কেননা আমার পরিচিত অনেক শিল্পীকেই দুর্দশাগ্রস্থ দেখেছি। দুর্দশাগ্রস্থ শিল্পীদের তিনি যেমন সহযোগিতা করেন তেমনি তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা অনলাইন পত্রিকা থেকে এ সম্পর্কিত কোন তথ্য পেলে তাঁর নজরে আনেন বলেও প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, ‘আমি এখন আছি এখন সাহায্য করছি কিন্তু যখন থাকবো না, তখন কি হবে সেই চিন্তা থেকেই বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী কল্যাণ ট্রাস্ট আইন-২০২০ এই আইনটা করার উদ্যোগ নিয়েছি। এর মাধ্যমে চলচ্চিত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত সকলের জন্য ব্যবস্থা করেছি। যারা নেপথ্যে থেকে এই চলচ্চিত্রকে সুন্দর করার জন্য দিনরাত কাজ করছেন, সেই যন্ত্রশিল্পী থেকে কলা-কুশলী, মঞ্চসজ্জায় সম্পৃক্ত সকলের বিষয়টাই তাঁর সরকার এই ট্রাস্টে রেখেছে। যাতে বিপদে আপদে প্রত্যেকেই এই ট্রাস্ট থেকে অনুদান নিতে পারেন, বলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি এই ফান্ড সম্প্রসারণে চলচ্চিত্র শিল্পের সাথে সম্পৃক্ত সামর্থ্যবানদের এগিয়ে আসারও আহ্বান জানান।
সূত্রঃ বাসস