4970
Published on জানুয়ারি 4, 2021দিল্লিতে বঙ্গবন্ধুর যাত্রাবিরতি ছিল সংক্ষিপ্ত। রাষ্ট্রপতি ভবনে সৌজন্য কথাবার্তার পর ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানেই তিনি যাত্রা করেছিলেন ঢাকার উদ্দেশে। এ সময় বিমানে বঙ্গবন্ধুর অন্যতম সহযাত্রী ছিলেন ফারুক আহমদ চৌধুরী। তিনি সেই যাত্রার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়েছেন এভাবে:
"...দশই জানুয়ারি ১৯৭২-এর সেই অবিশ্বাস্য সকাল। পালাম বিমানবন্দর। আটটা বেজে দশ মিনিট। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর রুপালি কমেট বিমান ধীরে ধীরে এসে সশব্দে সুস্থির। তারপর শব্দহীন পিনপতন নীরবতা। সিঁড়ি লাগলো। খুলে গেল দ্বার। দাঁড়িয়ে আছেন সহাস্য, সুদর্শন, দীর্ঘকায়, ঋজু নবীন দেশের রাষ্ট্রপতি। অকস্মাৎ এক নির্বাক জনতার ভাষাহীন জোয়ারের মুখোমুখি। সুউচ্চ কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন তিনি আবেগের বাধভাঙা দুটি শব্দ-'জয় বাংলা। করতালি, উল্লাস, আলিঙ্গন-আবেগের অশ্রুতে ঝাপসা স্মৃতি। রাষ্ট্রপতি ভি.ভি. গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, ভারতের মন্ত্রিসভার সদস্যবৃন্দ, কূটনীতিবিদগণ, শত শত সাংবাদিক। ক্যামেরা, মাইক্রোফোন, টেলিভিশন। অদূরে ক্যান্টনমেন্টের জনবহুল জনসভা। আন্তরিক অভ্যর্থনায় রাস্তার দু'পাশে লাখো জনতা। রাষ্ট্রপতি ভবন। ঝাপসা স্মৃতিতে আবার ভেসে আসে পালাম বিমানবন্দর।...
আশ্চর্য সেই প্রভাতে হঠাৎ ঢাকাগামী আমরা। প্লেনে বঙ্গবন্ধুর মুখোমুখি।
এ কে? হঠাৎ অপরিচিতকে দেখে অঙ্গুলি নির্দেশে তাঁর জিজ্ঞাসা।
... পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ বললেন, আপনার বিমানবন্দরের ভাষণটি এ-ই লিখেছে।
আমার মনের কথাগুলোই তো লিখেছে, বললেন বঙ্গবন্ধু।
আমার ইতিহাস-সচেতন মন হঠাৎ যেন নাড়া দিল। পকেটে রাখা তাঁর ভাষণটি এগিয়ে দিলাম। স্মৃতি হিসেবে আপনার স্বাক্ষরিত ভাষণটি রাখতে চাই, সভয়ে বললাম।
নিশ্চয়ই। কলম দাও। বললেন তিনি।...
শেখ মুজিবুর রহমান স্বাক্ষরিত ভাষণটি আজো আমার কাছে রয়েছে। তাঁর স্মৃতির একান্ত ব্যক্তিগত বাহক। আর রয়েছে আমার ডায়েরির ১৯৭২ এর ১০ জানুয়ারির পাতাটি। সেটাও সভয়ে এগিয়ে দিয়েছিলাম। আমার ডায়েরির পাতাটি জুড়ে রয়েছে পুলক জাগানো সেই নামটি, শেখ মুজিব স্পষ্ট, দৃঢ়, চির অম্লান!...
প্লেনে বাঙালি সহযাত্রীরা ছিলেন আবদুস সামাদ আজাদ, সপরিবারে কামাল হোসেন, ইনসিওরেন্স জগতে সুপরিচিত বর্তমানে প্রয়াত খোদা বকস মওলা, সাংবাদিক আতাউস সামাদ আর আমি। প্লেনে তাঁর অনেক জিজ্ঞাসা। অনেক পরিচিতের সম্বন্ধে। নাম, পেশা, বয়স, স্থান, ঘটনা-কী আশ্চর্য স্মৃতিশক্তি এই মানুষটির! তার কিছু কথা আমার মনে আছে, অনেক কথাই মনে নেই।...
প্লেনে তার বেশির ভাগ সময়ই কেটেছিলো পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদের সাথে একান্ত আলাপ-আলোচনায়। মনে পড়ে তাঁর সুপরিচিত আতাউস সামাদ তার সাথে কথা বলেছিলেন সাংবাদিকের জড়তাহীনতায়। কামাল হোসেন ছিলেন আমার মতো, শ্রোতার দলে। মাওলাও...
... দুই একটি কথা মনে আসে। দেশের ম্যাপ সম্বলিত জাতীয় পতাকা। বদলাই কি করে? তার জিজ্ঞাসা।..
... বলা হলো, অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন এই ব্যাপারে কিছু প্রাথমিক পদক্ষেপ হয়ত নিয়েছেন। ছাত্রলীগের নেতাদের সাথে তার নাকি এ ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা হয়েছে।...
সব যাত্রার শেষ আছে। সব স্বপ্নের। কথাবার্তার মাঝেই প্লেনের ব্রিটিশ স্টুয়ার্ড এসে বললেন, আমরা তখন ঢাকার ওপরে।...
বঙ্গবন্ধুর চোখে মুখে অবিশ্বাসের ছাপ।” (ফারুক চৌধুরী, দেশ দেশান্তর, ঢাকা, মীরা প্রকাশন, ১৯৯৯]
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ইসলামাবাদ থেকে লন্ডন ও লন্ডন থেকে দিল্লি হয়ে ঢাকা ফেরার আরেকটি বিবরণ পাওয়া যায় সুখরঞ্জন সেনগুপ্তের স্মৃতিকথামূলক ভাঙা পথের রাঙা ধুলায় নামক গ্রন্থে। তিনি বিবরণটি নিয়েছিলেন বেদ মারোয়ার কাছ থেকে। বেদ মারোয়া শশাঙ্ক ব্যানার্জির মতে মুজিবের সঙ্গে লন্ডন থেকে ঢাকা এসেছিলেন। তিনিও যুক্ত ছিলেন লন্ডনে ভারতীয় হাইকমিশনের সঙ্গে। বেদ মারোয়া ভারতীয় হাইকমিশনের ফাস্ট সেক্রেটারির পদমর্যাদার একজন অফিসার ছিলেন। এর পূর্বে তিনি ছিলেন ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিসের পশ্চিম বাংলা ক্যাডারের অফিসার।
তিনি বস্তুতপক্ষে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেছেন। বেদ মারোয়া এবং শশাঙ্ক ব্যানার্জির বর্ণনায় কিছুটা পার্থক্য আছে। সুখরঞ্জন সেনগুপ্ত পরে বেদ মারোয়ার কাছ থেকে বিবরণটি লিপিবদ্ধ করেছিলেন। সুখরঞ্জনের স্মৃতিচারণাটি বঙ্গবন্ধুর ঢাকা আগমনের দলিল হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ বিধায় স্মৃতিচারণাটি উদ্ধৃত করা হলো:
“...পাকিস্তানি ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান লন্ডনের সময় অনুযায়ী মধ্যরাতের শেষলগ্নে (ইংরেজি মতে তখন তারিখটা বদলে গেছে) শেখ মুজিবুর রহমানকে লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে নামিয়ে দিল। ব্রিটিশ সরকার ও তার 'সিক্রেটসার্ভিস' আগে থেকে শেখ সাহেবের মুক্তি জানতে পেরেছিলেন। শেখ সাহেব লন্ডন বিমানবন্দরে অবতরণ করার সঙ্গে সঙ্গেই ব্রিটিশ পুলিশ গোয়েন্দারা তাঁকে একটি গাড়িতে তুলে নির্দিষ্ট হোটেলে পৌছে দিল। হোটেলের ঘরে শেখ মুজিবুর রহমান কিছুটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিলেন। কারণ তখন শেষ রাত। তিনি অনুমানে বুঝেছিলেন যে, এই মুহূর্তে লন্ডন থেকে তিনি টেলিফোনে ঢাকাকে পাবেন । দিল্লিতে কীভাবে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায় সেটাও তিনি বুঝতে পারছিলেন না। হোটেলে তার ঘরে টেলিফোন ডাইরেকটরি থেকে তিনি ভারতীয় হাইকমিশনার আপ্পা-বি পন্থের ফোন নম্বর পেয়ে গেলেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় হাইকমিশনারকে ফোন করলেন। লন্ডনের রাজপথে তখন ভোরে কুয়াশা ও ঝিরঝিরে তুষারে আচ্ছন্ন। আপ্পা-বিপন্থ টেলিফোন তুলতেই শেখ সাহেব তাকে জানালেন, Sheikh Mujibur Rahman on the other side আপ্পা-বিপন্থও লাফিয়ে উঠলেন, তিনি শেখ সাহেব কোন হোটেলে আছেন এবং তার ফোন নম্বর জেনে নিলেন। পন্থজি প্রথম দিল্লিতে ইন্দিরা গান্ধীকে জানিয়ে দিলেন লন্ডনে শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থিতির সংবাদ। ঢাকার সময় অনুযায়ী ভোর সাড়ে সাতটা আটটার মধ্যে সারা বাংলাদেশ জানতে পারল শেখ মুজিবুর রহমান জীবিত এবং তিনি পাকিস্তান থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডনে পৌঁছেছেন। ইন্দিরা গান্ধী তাঁর হাইকমিশনারকে এরকম নির্দেশ দিলেন যে, লন্ডনে ভারতীয় হাইকমিশনে বাংলা জানা ও বাংলা বলতে পারা কোনো পদস্থ অফিসার থাকলে তাকে এখন শেখ সাহেবের জন্য যেন হোটেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। লন্ডনের আকাশে সূর্য ওঠার আগেই আপ্পা-বিপন্থ হোটেলে এসে মুজিবুর রহমানকে আলিঙ্গন করলেন। তখন শুরু হল লন্ডন-কলকাতা এবং কলকাতা-ঢাকা সংবাদ আদান-প্রদানের পালা। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশ অনুযায়ী ভারতীয় হাইকমিশনের ফাস্ট সেক্রেটারির পদমর্যাদার একজন অফিসার যিনি বাংলা বলতে পারেন এবং বাংলা জানেন তাকে শেখ সাহেবের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হল। এই অফিসারের নাম বেদ মারোয়া। তিনি একসময় পশ্চিম বাংলায় সরকারি অফিসার ছিলেন।
ভারত সরকার শেখ সাহেবের জন্য বেদ মারোয়া নামের যে। অফিসারকে নির্দিষ্ট করেছিলেন তিনি ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিসের পশ্চিম বাংলা ক্যাডারের অফিসার। তিনি বস্তুতপক্ষে শেখ মুজিবুর রহমানের চিফ সিকিউরিটি অফিসারের দায়িত্ব পালন করেছেন।
শেখ সাহেবের বিমান দিল্লি থেকে ঢাকার পথে পাড়ি দেয়া আরম্ভ করল। বেদ মারোয়া শেখ সাহেবের ঠিক পিছনের সিটে বসে ছিলেন।
তিনি শুনতে পেলেন শেখ সাহেব আবৃত্তির সুরে গান গাইছেন।... 'এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে না কো তুমি, সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি.... সে যে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে যে স্মৃতি দিয়ে ঘেরা... ভায়ের মায়ের এমন স্নেহ...।' পরমুহূর্তে শেখ সাহেব আবার গুন গুন করে আবৃত্তি করছেন, 'আ মরি বাংলা ভাষা.... কী যাদু বাংলা গানে ... গান গেয়ে দাঁড় মাঝি টানে... গান গেয়ে ধান কাটে চাষা... আ মরি বাংলা ভাষা।' বেদ মারোয়া আর বসে থাকতে পারলেন না। তিনি শেখ সাহেবের সিটের কাছে এসে দাঁড়ালেন। গোয়েন্দা অফিসাররা যেভাবে রাষ্ট্রপ্রধান বা প্রধানমন্ত্রীকে অভিবাদন জানান সেভাবে তিনি শেখ সাহেবকে অভিবাদন জানিয়ে বাংলায় বললেন, 'স্যার, আমি বাংলা জানি স্যার, আমি চব্বিশ পরগনার ডায়মন্ড হারবারে সাব ডিভিশনাল পুলিশ অফিসার ছিলাম। আমি বাংলা পড়তে পারি, বলতে পারি।' শেখ সাহেব উৎফুল্ল হয়ে দাঁড়িয়ে উঠলেন, 'আরে এতক্ষণ সেই কথা বলেন নাই কেন?' শেখ মুজিবুর রহমান বেদ মারোয়াকে হাত ধরে পাশের সিটে বসিয়ে নিলেন। এ সময় বিমানের পাইলট শেখ সাহেবের কাছে এসে জানালেন যে, এই বিমান বাংলাদেশের আকাশসীমায় পৌছেছে। শেখ সাহেবের চোখ সজল হয়ে উঠল। তিনি জানালার কাচ দিয়ে বাংলাদেশের শ্যামল প্রান্তর দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়লেন। পাইলট যখন জানালেন যে, বিমানটি বিমানবন্দরের উপরে এসে পড়েছে। তখন শেখ সাহেব উত্তেজনায় উঠে দাঁড়ালেন, ভারতীয় অফিসার বেদ মারোয়া শেখ সাহেবকে বসিয়ে দিয়ে তার সিট বেল্ট বেঁধে দিলেন। যতদূর মনে পড়ে তখন প্রায় সাড়ে তিনটা হবে। শেখ সাহেব বিমানের গ্যাংওয়েতে দাঁড়াল। যতদূর চোখ যায় কেবল মানুষের মাথা।" দিল্লি থেকে ঢাকা পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমানের সর্বশেষ ভ্রমণের একমাত্র সংবাদদাতা সঙ্গী ছিলেন সাংবাদিক আতাউস সামাদ।
আতাউস সামাদ লিখেছেন, “সাংবাদিকরা বহু রাজনীতিকদের দেখে থাকেন। কিন্তু সাংবাদিকরা রাজনীতিকদের সাধারণ মানুষ হিসেবে দেখার সুযোগ খুব কমই পেয়ে থাকেন, বিশেষ করে তারা যখন নিজেরাই আত্মপ্রকাশ করে থাকেন জীবনের কোন বিশেষ মুহূর্তে। আজ আমি বাংলাদেশের বিপ্লবী নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে সে রকম কয়েকটি মুহূর্তে দেখার এক সুযোগ পেয়েছিলাম। কারণ আমিই ছিলাম শেখ সাহেবের দিল্লি থেকে ঢাকা পর্যন্ত তাঁর সর্বশেষ ভ্রমণের একমাত্র সংবাদদাতা সঙ্গী।"
দিল্লিতে বঙ্গবন্ধুর সাথে আতাউস সামাদের দেখা করার কোনো সুযোগই ছিল না। কিন্তু ঢাকার পথে বিমানে উঠেই তিনি (বঙ্গবন্ধু) আতাউস সামাদকে দেখতে পেয়ে জড়িয়ে ধরেন এবং বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলেন, "তুমি কি এখনো বেঁচে আছো?" দিল্লি থেকে ঢাকা পর্যন্ত ১৬২ মিনিটকাল যাত্রাপথে বঙ্গবন্ধু আতাউস সামাদের কাছে তাঁর সহকর্মী ও বন্ধুদের সম্পর্কে প্রশ্ন করেন। তিনি যশোরের জনাব মশিউর রহমানের হত্যার কথা শুনে একেবারে ভেঙে পড়েন। তিনি সাংবাদিক পেশায় নিয়োজিত সুপরিচিত ব্যক্তিদের অবস্থা সম্পর্কে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলেন। আতাউস সামাদ জবাবে শহীদুল্লা কায়সার, সিরাজুদ্দীন হোসেন, ড. আবুল খায়ের, সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য, নাজমুল হক, নিজাম উদ্দিন আহমেদ, ডা. ফজলে রাব্বি, আহাদ, সায়েদুল হাসান, মামুন মাহমুদ, ডা. আলীম চৌধুরী এরা চিরদিনের মতো চলে গেছেন বলে জানালে বঙ্গবন্ধুর মুখ বিষন্ন ও ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে। এর কিছুক্ষণ পর বঙ্গবন্ধু আপন মনে 'ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোটো ছোটো গ্রামগুলো-কবিতা আওড়াতে থাকেন।
ইয়াহিয়ার সামরিক ট্রাইব্যুনাল বঙ্গবন্ধুকে কী বলেছিলেন সে কথাও হচ্ছিল। বঙ্গবন্ধু বললেন, "আমি তাদের বলেছি যে, আমি তোমাদের কাছ থেকে বিচার চাই না। কারণ তোমরা একা নও। আমি সর্বশক্তিমানের আশীর্বাদ চাই। আমি আল্লাহকে বিশ্বাস করি। আমার কোন ভয় নেই। আমি মরতে প্রস্তুত রয়েছি। কিন্তু আমি জানি যে, আমার বাংলাদেশ মুক্ত হবে।"
এছাড়া আলোচনার এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু আতাউস সামাদের নিকট তাঁর ধানমন্ডি ও গ্রামের বাড়ির অবস্থা সম্পর্কে জানতে চান। আতাউস সামাদের নিকট বঙ্গবন্ধুর প্রশ্ন ছিল, “তারা আমার বাড়িটির কি করেছে। তারা কি সেটি পুড়িয়ে দিয়েছে?"। গ্রামের বাড়িটি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে শুনলে তিনি শান্ত হয়ে পড়েন। এছাড়া মুক্তিবাহিনীতে বঙ্গবন্ধু তাঁর ছেলের তৎপরতার কথা শুনে আনন্দিত হন। ঢাকা অবতরণের ১০ মিনিট আগে বিমানবালা মিলার এসে বললেন, ইচ্ছে করলে শেখ সাহেব ঢাকা দেখতে পারেন।
তিনি প্রথমে সাড়া না দিলেও পরে ঢাকা দেখতে লাগলেন। তিনি বিমানের সহযাত্রীদের দিকে তাকিয়ে বললেন, 'আমি ঢাকা । আমি আমার জনগণের মধ্যে ফিরে এসেছি।' বসে পড়ে আবার তিনি বলতে থাকেন, 'আজ রাতে আমি আবার বাড়িতে বাস করব। আমি মেঝেতে ঘুমাব। কিন্তু আর কোথাও যাব না। বলতে বলতে তার চোখ অশ্রুসজল হয়ে পড়ে। (সূত্র: দৈনিক বাংলা, ১১ জানুয়ারি ১৯৭২)
শ্বেতশুভ্র ব্রিটিশ রাজকীয় কমেট বিমানে করে ১০ জানুয়ারি যিনি বঙ্গবন্ধুকে দিল্লি হয়ে ঢাকায় নিয়ে আসেন তিনি হচ্ছেন, ব্রিটিশ এয়ারলাইন্সের পাইলট মি. কুক। স্কোয়াড্রন লিডার মি. কুকের কাছে ঢাকা অবতরণের পর এই বিমানযাত্রা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান যে, এই বিশেষ বিমান নিয়ে ঢাকায় আসতে হবে রওনা হবার একটু আগেও তা তিনি আঁচ করতে পারেননি। প্রথমে লন্ডন থেকে বিমান চালিয়ে এনেছিলেন মি. হোয়ার্ড। এরপর মি. কুক মাসিরা থেকে বিমান চালিয়ে দিল্লি হয়ে ঢাকা আসেন। তিনি আরও জানান, তেল কমিয়ে বিমানটি হাল্কা করার জন্য এবং বঙ্গবন্ধুকে তার প্রিয় শহর ঢাকা দেখাবার জন্য তিনি বেশ কিছুক্ষণ বিমান নিয়ে ঢাকার আকাশে ঘুরেছিলেন। ভ্রমণ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান, "চমৎকার। শুধু চমৎকার। আবহাওয়া খুবই ভালো ছিল।" আর আবেগকাতর কণ্ঠে বলেন, "আমি গত সতের বছর ধরে বিমান চালাই। প্রিন্স আলেকজান্ডার, এলিজাবেথ থেকে শুরু করে বহু বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিকে আমি আমার প্লেনে যাত্রী হিসেবে পেয়েছিলাম। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে আমার যাত্রী হিসেবে পেয়ে আমি গৌরব বোধ করেছি। কমেট বিমানটি ছিল একটি যাত্রাবাহী বিমান। ব্রিটিশ সরকার এটা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যেতে দিয়েছেন। মোট ৮৬ জন যাত্রী এতে বসতে পারেন। তবে শেখ সাহেব যখন আসছিলেন তখন তাঁর সহযাত্রীর সংখ্যা খুবই অল্প ছিল।” মি. কুক জানান, বিমানটি হাল্কা থাকাতে ল্যান্ড করতে তার সুবিধা হয়েছিল। প্রায় ২০ হাজার ফিট উঁচু দিয়ে এ বিমান উড়ে এসেছিল। দিল্লি থেকে প্রায় আড়াই ঘণ্টার ফ্লাইট। মি. কুক ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা দেখে থমকে যান। তার ভাষায়, "Sheikh Mujib is a Great Man”, লন্ডন থেকে বিমান রওয়ানা হবার পর শেখ মুজিব কিছুক্ষণের জন্য ঘুমিয়ে পড়েছিলেন বলে তিনি জানান। ঘুম থেকে উঠে তিনি শুধুমাত্র এক কাপ চা খান। কুক আরও জানান, দিল্লিতে ইন্দিরা গান্ধী, ভি.ভি. গিরি এঁদের সমাবেশও তাকে আপ্নুত করেছিল।
এই ব্রিটিশ বিমানটিতে ১১ জন ক্রু, ২ জন পাইলট, ১ জন ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার, ৩ জন গ্রাউন্ড ক্রু, ১ জন লেডিসহ ২ জন স্টুয়ার্ট এবং ২ জন সিকিউরিটি কর্মকর্তা ছিলেন।
সূত্রঃ সজীব কুমার বনিক রচিত 'বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন' বই থেকে নির্বাচিত অংশ