3498
Published on জানুয়ারি 1, 2021দীর্ঘ ৯ মাস কারাবাসের পর ১৯৭২ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয় পাকিস্তান সরকার। পাকিস্তানের ইচ্ছাতেই তাকে পাঠানো হয় লন্ডনে। এ খবরে বঙ্গবন্ধুর পরিবার, দেশের আপামর জনসাধারণ ও বিশ্ব নেতৃত্বসহ সবার চোখ ছিল তখন লন্ডনে।
বঙ্গবন্ধু হিথ্রো বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করলেও সেখানে কোনও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে চাননি। ১৯৭২ সালের ৯ জানুয়ারি দৈনিক বাংলার সংবাদ বলছে— বঙ্গবন্ধু বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন আমি সুস্থ আছি, বেঁচে আছি। এ মুহূর্তে আপনারা শুধু আমাকে দেখুন, কিছু শোনার আশা করবেন না। তাই এখন আমি আর বেশি কিছু বলতে চাই না। সম্ভবত আজকের পরে একটা বিবৃতি দিতে পারি।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাওয়ালপিন্ডি থেকে পাকিস্তান সরকারের চার্টার করা পিআইএ-এর একটি বিশেষ বিমানে লন্ডনের উদ্দেশে রওনা হন। রাউয়ালপিন্ডি ত্যাগের ১০ ঘণ্টা পর ৮ জানুয়ারি গ্রিনিচ সময় ৬টা ৩৬ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় ১২টা ৩৬ মিনিট) হিথ্রু বিমানবন্দরে পৌঁছান। লন্ডনের উদ্দেশে রওনা হওয়ার সাত ঘণ্টা পর বিষয়টি জানাজানি হয় বলে সেই সময়ের পত্রিকাগুলো সংবাদ প্রকাশ করে।
বঙ্গবন্ধু লন্ডনে পৌঁছে তিন ঘণ্টা বিমানবন্দরে অবস্থান করেন। পাকিস্তান ত্যাগের সময় তার গন্তব্য নিয়ে কিছুই জানানো হয়নি। এটুকুই বলা হয় যে, বঙ্গবন্ধু বিমানে যে স্থানে গমন করেছেন, সেখানেই তিনি তার পরবর্তী কর্মসূচি জানাবেন। এসময় পরনে ছিল টাইবিহীন সাদা শার্ট, ধুসর স্যুট ও ওভারকোট। তিন ঘণ্টা পর বঙ্গবন্ধু বিমানবন্দর থেকে ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে ওয়েস্ট অ্যান্ড এর ক্লারিজ হোটেলের উদ্দেশে রওনা দেন। গাড়িতে ওঠার সময় তিনি সামনে বসতে পারেন কিনা জিজ্ঞাসা করলে কর্মকর্তারা বলেন, অবশ্যই। এসময় তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কোনও কথা বলেননি।
ইউএনআই পরিবেশিত নয়াদিল্লির খবরে বলা হয়, মুক্তির পর প্রথম বিবৃতিতেই বঙ্গবন্ধু নিজ ইচ্ছায় লন্ডনে গিয়েছেন বলে দেওয়া পাকিস্তানের বক্তব্যের বিরোধিতা করেন। সংবাদ সম্মেলনে বলেন, তাকে ব্রিটিশ রাজধানীতে পাকিস্তানের সিদ্ধান্তেরই পাঠানো হয়েছে। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি বন্দি ছিলাম, পাকিস্তান সরকারের ইচ্ছে অনুযায়ী এই সিদ্ধান্ত হয়েছে, আমার সিদ্ধান্তে নয়।’ অথচ নয়াদিল্লি থেকে পিটিআইয়ের খবরে বলা হয়, বঙ্গবন্ধু স্বেচ্ছায় লন্ডন ভ্রমণের অভিপ্রায় জানান।
পরবর্তীতে হোটেলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন। তিনি বলেন, ‘আমি এখানে আর এক মুহূর্ত থাকতে রাজি নই। আমি আমার জনগণের কাছে ফিরে যেতে চাই।’ বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের জানান, ‘তিনি আগামীকাল বা পরের দিন ঢাকা ফিরবেন বলে আশা করছেন। বাংলাদেশ শিগগির জাতিসংঘে সদস্য পদের জন্য অনুরোধ করবে। বাংলাদেশের দাবিকে সমর্থনের জন্য ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, পোল্যান্ড, ফ্রান্সকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ এখন অবিসংবাদিত সত্য এবং এদেশকে বিশ্বের স্বীকৃতি দিতে হবে।’
‘জানতাম বাংলাদেশ মুক্ত হবেই’
লন্ডনে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হতে সম্মেলন কক্ষে প্রবেশের সময় বঙ্গবন্ধু ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে সাংবাদিকদের অভিনন্দিত করেন। পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পর্ক রাখবে এমন কোনও প্রতিশ্রুতি তিনি মি. ভুট্টোকে দেননি। দৈনিক বাংলা বিএসএস ও এনার বরাত দিয়ে করা সংবাদে জানায়, তিনি সেদিন দরাজ কণ্ঠে কথা বলেন, দেহে কোনও অসুস্থতার লক্ষণ ছিল না। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘যখন তার জনগণ তাকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করেছে, তখন আমি ‘রাষ্ট্রদ্রোহের’ দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে কারাগারে বন্দি জীবন কাটাচ্ছি। এই ট্রাইব্যুনালের বিচারের রায় কখনও প্রকাশ করা হয়নি। একটি খুব খারাপ স্থানে কল্পনাতীত একাকিত্বে বন্দিজীবন কাটাতে হয়েছে। কোনও রেডিও না চিঠি না বাইরের জগতের সঙ্গে কোনও যোগাযোগই ছিল না। মরার জন্য মনের দিক থেকে আমি প্রস্তুত ছিলাম। যেদিন জেলে নেওয়া হলো তখন আমি বাঁচবো কিনা ধারণা ছিল না। তবে এটা জানতাম বাংলাদেশ মুক্ত হবেই। আমার দেশের লাখ লাখ লোককে হত্যা করা হয়েছে, নিষ্ঠুর অত্যাচার চালিয়েছে। বেঁচে থাকলে হিটলারও লজ্জা পেতো।’
পাকিস্তানের সঙ্গে ভবিষ্যৎ সম্পর্ক-ভাবনা
পাকিস্তানের সঙ্গে ভবিষ্যৎ সম্পর্ক বিষয়ে লন্ডনে সাংবাদিকদের বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘যত বেশি দেশের সঙ্গে সম্ভব তার দেশ সম্পর্ক স্থাপন করবে, এটুকুই তিনি বলতে পারবেন। মুক্তি সংগ্রামের বিজয়কে আমি পরম আনন্দে অনুভব করছি। একটি স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাই যে সঙগ্রামের উদ্দেশ্য ছিল।’ তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের বিসয়টি বিবেচনায় রাখতে ভুট্টো বলেছিলেন। আমি বলেছি, আমার জনগণের মাঝে ফিরে যাওয়ার আগে আমি কিছু বলতে পারছি না।’
ঢাকায় নেতাদের প্রস্তুতি
বঙ্গবন্ধু লন্ডনে পৌঁছানোর পর থেকেই তার বাংলাদেশে ফেরার প্রস্তুতি শুরু হয়। কোন পথে কবে দেশে ফিরবেন, এই আলাপের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু লন্ডনেই ঘোষণা দেন— তিনি এক-দুই দিনের ভেতরেই ফিরতে চান। এদিকে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা ও স্বাগত জানানোর পরিকল্পনা করতে বঙ্গভবনে মন্ত্রিসভার বিশেষ বৈঠক বসে শনিবার। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেই সভায় সভাপতিত্ব করেন। সভায় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু ভারতের ওপর দিয়ে আসবেন বলে তিনি আশা করছেন। তিনি এসে রমনা রেসকোর্স, শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ অর্পণ করবেন বলে সিদ্ধান্ত হয়।’ এনা ও বিএসএস এ খবর প্রকাশ করে। বৈঠক থেকে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বন্ধু রাষ্ট্রকে ধন্যবাদও জানানো হয়।
পরিবারের সঙ্গে টেলিফোনে আবেগঘন আধাঘণ্টা
লন্ডন থেকে টেলিফোনে বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথম প্রশ্ন ছিল— বেঁচে আছো তো? ২৫ মার্চের দুর্বিসহ কালোরাতের পর ৮ তারিখ শনিবার (১৯৭২) প্রথমবারের মতো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কথা শুরু করেন, ‘তোমরা সবাই বেঁচে আছো তো? সেই শনিবার সন্ধ্যার একটু আগে হোটেল থেকে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আধাঘণ্টা কথা বলেন। লন্ডনে বঙ্গবন্ধু হোটেল ক্লারিজেসে অবস্থান করেন। প্রথমে বড় ছেলে শেখ কামাল, পরে ক্রমান্বয়ে বেগম মুজিব, শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা ও ছোট ছেলের সঙ্গে কথা বলেন। ঘটনাবহুল ও দুর্বিষহ ৯ মাস পর পরিবারের সদস্যরা পরস্পরের কণ্ঠ শুনতে পেলেন। বেগম মুজিব আবেগঘন কণ্ঠে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। এনা পরিবেশিত খবরে বলা হয়— বেগম মুজিব সাংবাদিকদের জানান তিনি আবেগে এত অভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন যে, প্রথমবার কথা বলতে পারেননি। দ্বিতীয়বার কল আসলে শেখ সাহেব জানতে চান— আমি কেমন আছি। আমি বললাম, ‘আমরা ভালো আছি, আপনি কেমন আছেন?’
রাজনৈতিক সহযোদ্ধাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা
লন্ডনে থাকাকালেই প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি শেখ মুজিবের সঙ্গে কথা বলেন এবং নয়াদিল্লি সফরের আমন্ত্রণ জানান। ইন্দিরা গান্ধী শেখ মুজিবুর রহমানের কুশল জানতে চেয়ে বলেন, ‘আমরা খুবই খুশি আপনি মুক্তি পেয়েছেন।’ শেখ মুজিবুর রহমান ইন্দিরা গান্ধীর মাধ্যমে ভারতের জনগণকে অভিনন্দন জানান। এরপর ইন্দিরা গান্ধী জানতে চান, ‘কেমন আছেন?’
জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি ভালো আছি। আমি আপনাদের কাছে খুবই কৃতজ্ঞ।’ ৮ তারিখে তার কথা হয় সহযোদ্ধা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে। বঙ্গবন্ধু টেলিফোনে যুক্ত হয়ে বলেন, ‘হ্যালো তাজউদ্দিন, আমি সাংবাদিক পরিবৃত আছি, তাদের কী বলবো? দেশের মানুষ কেমন আছে? বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশে যে অগণিত নারী-পুরুষ ও শিশু নিহত হয়েছেন, এই মুহূর্তে তাদের কথা আমার জানতে খুব ইচ্ছে করছে।’
তখন সবার মূল লক্ষ্য বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানানো। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের চার নেতা নূরে আলম সিদ্দিকী, শাহজাহান সিরাজ, আ স ম আব্দুর রব ও আব্দুল কুদ্দুস মাখন আহ্বান জানিয়েছেন বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়। ছাত্র নেতারা বলেন, নেতার মুক্তিতে মানুষের আত্মহারা হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে কোনও দুর্ঘটনার সৃষ্টি না করার জন্য এবং মুক্তিবাহিনীকে গোলাগুলি ছোড়া থেকে বিরত থাকতে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
পত্রিকা কার্টেসি: ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্যাটেজি ফোরাম
সৌজন্যেঃ বাংলা ট্রিবিউন