1554
Published on ডিসেম্বর 2, 2020মেজর নাসির উদ্দিন (অব.):
আমি খুব অল্প বয়সে ১৯৬৯ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলাম। এক বছর পর ’৭০ সালের মার্চে কমিশন অফিসার হিসেবে পদোন্নতি পাই। আমার প্রথম পোস্টিং ছিল রংপুরে। আমি মূলত ট্যাংকের অফিসার। রংপুরে তখন সবে একটা ট্যাংক রেজিমেন্ট পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এসেছে। সেখানে ৫৫টি ট্যাংক ছিল। মার্কিন এম ২৪ ট্যাংকগুলো সেফি নামে পরিচিত।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ সকালে ক্যান্টনমেন্টজুড়ে ত্রস্ততা ছিল। কিন্তু আমাদের কাছে কোনো রেডিও না থাকায় এবং বাইরে যেতে না পারায় কিছু জানতাম না। আমাদের নির্দেশ দেওয়া হলো- ট্যাংকেই থাকতে হবে, ট্যাংকেই ঘুমাতে হবে। এভাবেই চলছিল। ২৮ মার্চ আমাদের রুমে গিয়ে বিশ্রাম করতে বলা হলো। আমি বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। হঠাৎ বিকাল ৪টার দিকে আমাদের বাঙালি অফিসার সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হাশেম আমাকে ঝাঁকুনি দিয়ে ডাকলেন। বললেন, তাড়াতাড়ি বাইরে আসেন, ক্যান্টনমেন্ট আক্রান্ত হয়েছে। উঠে চোখেমুখে পানি দিয়ে সাবমেশিন গান হাতে নিয়ে রাস্তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছি। রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখি ৪০০-৫০০ গজ দূরে ১৫-২০ হাজার মানুষ ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে আসছে। তাদের হাতে লাঠি, তীর-ধনুক। সেখানে অনেক সাঁওতালও ছিল। সেই মুহূর্তে রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার কর্নেল সাগির জিপ নিয়ে আমাদের পাশে এসে দাঁড়ালেন। এর কিছুক্ষণ পরই চারটি মেশিনগান মাউনটেন জিপ এলো। রাস্তার একপাশে দাঁড় করিয়ে রাখল। মিছিল কাছাকাছি আসতেই কর্নেল সাগির গুলিবর্ষণের নির্দেশ দিলেন। ওই জিপ কয়েক মিনিটে ১২০ রাউন্ড গুলি ছোড়ার ক্ষমতা রাখে। ওই জিপ থেকে গুলিবর্ষণ হতেই শত শত মানুষ চোখের সামনে মাটিতে পড়ে যাচ্ছে। গুলির তোড়ে মিছিলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। চারদিক ধোঁয়ায় ভরে গেছে।
এরপর আমাদের বলা হলো মাঠে গিয়ে কতজন মারা গেছে দেখতে। মারা না গেলে তাদের মৃত্যু নিশ্চিত করার নির্দেশ দেওয়া হলো। আমি গিয়ে দেখলাম শত শত মানুষ মারা গেছে। অনেকের পায়ে গুলি লেগেছে, কোমরে লেগেছে। হাত বাড়িয়ে পানি চাইছে, সাহায্য চাইছে। কিন্তু আমরা কিছুই করতে পারছি না। কারণ, সেখানে পাঞ্জাবি সৈনিকের সংখ্যা বেশি। আমার ধারণা, ৫০০-৭০০ মানুষকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে সেদিন। এত লাশ আনতে ভারী ট্রাক আনা হয়েছে। কিন্তু রাস্তার নিচে মাঠের মাটি নরম থাকায় ট্রাক নামতে পারছে না। তখন তারা সব লাশ এক জায়গায় করে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয়। তখনো অনেক মানুষ জীবিত ছিলেন। সেদিন থেকে রংপুরের মানুষের কাছে ২৮ মার্চ শোকাবহ দিন।
২৮ তারিখ মধ্যরাতে ঝটিকা আক্রমণ করে বাঙালি অফিসারদের কাছ থেকে সব অস্ত্র কেড়ে নেওয়া হলো। আমরা তখন ছয়জন বাঙালি অফিসার ছিলাম। সকালে রেজিমেন্টের অফিসার বললেন, ‘তোমাদের নিরস্ত্র করার জন্য দুঃখিত। আরও দুঃখের বিষয় হলো, এখন থেকে তোমাদের রুমে বন্দী করে রাখা হবে। রুমের বাইরে থেকে তালা দেওয়া থাকবে। তোমাদের খাবার রুমে পৌঁছে দেওয়া হবে।’ ট্রানজিস্টার রেডিও, ম্যাপ, ক্যালেন্ডার সব খুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এপ্রিলের ৮ কিংবা ৯ তারিখ হবে, ক্যাপ্টেন আফসার-উল-আলম ও সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হাশেমকে তুলে নিয়ে গেল। তাদের পলাশবাড়ীতে নিয়ে গিয়ে হত্যা করল পাকিস্তানিরা। পলাশবাড়ীতে আরেক বাঙালি অফিসার সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট রফিককেও হত্যা করা হলো। মধ্য এপ্রিলের মধ্যে চারজন বাঙালি অফিসারকে হত্যা করা হয়।
রংপুর রেজিমেন্টে ৬০০ সৈনিকের মধ্যে ২৪১ জন ছিলেন বাঙালি। সব বাঙালি সৈনিককে এক জায়গায় ঘেরাও করে রাখা হলো। প্রতিদিন রাতে সেখান থেকে কয়েকজন করে তুলে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা শুরু হলো। ছয়জন বাঙালি জুনিয়র কমিশনড্ অফিসারকে হত্যা করা হলো। আমরা তিনজন ছাড়া প্রত্যেক বাঙইল সৈনিককেই হত্যা করেছে পাকিস্তানিরা। অনেক সৈনিকের পরিবারের সদস্যদেরও হত্যা করা হয়েছে। আমি এবং সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট বদিউজ্জামান পাশাপাশি রুমে থাকতাম। কর্নেল সাগিরের স্ত্রী সাদেকার সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক ছিল। তিনি নিঃসন্তান ছিলেন। এজন্য আমাকে স্নেহ করতেন। ১২ এপ্রিল কর্নেল সাগির আমাকে এসে নিয়ে গেলেন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বললেন, ‘সাদেকা চলে যাবেন, তোমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছেন।’ আমাকে নিয়ে তিনি বাসায় নামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘যাও, সাদেকা অপেক্ষা করছেন।’ আমি গিয়ে দেখি সাদেকা জায়নামাজে বসা। তিনি উঠে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘জীবনের চেয়ে মূল্যবান কিছু নেই।’ এরপর আমাকে হাত ধরে নিয়ে গিয়ে কর্নেল সাগিরের হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘আমি তোমার কাছে কোনো দিন কিছু চাইনি। নাসিরের জীবনের নিরাপত্তা আমি তোমার কাছে চাইছি।’ কর্নেল সাগির একটু ইতস্তত করছিলেন। বললেন, ‘আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করব।’ এই বলে আমাকে হাত ধরে টেনে এনে গাড়িতে করে অফিসার মেসের দিকে রওনা হলেন।
২৮ মে বেলা সাড়ে ৩টা। হঠাৎ দেখলাম আমার রুমের সামনে কর্নেল সাগির দাঁড়িয়ে আছেন। প্রহরীকে দরজা খুলে দিতে বললেন। উনি এসে আমাকে বললেন, ‘কেমন আছ?’ আমি বললাম, ‘দেখছেনই তো কেমন আছি।’ সাগির বললেন, ‘কিছু করার নেই, এগুলো তোমাদের কাজের কারণেই হয়েছে।’ এরপর বললেন, ‘অনেক দিন হলো শহরে যাও না। আমি রংপুর ইনটেলিজেন্সের হেড মেজর ইকবালকে বলে দিচ্ছি তোমাকে আর বদিউজ্জামানকে বাইরে ঘুরতে নিয়ে যাবে। ঘুরিয়ে আবার ফিরিয়ে আনবে। বুঝতে পারছ তো?’ কথার মধ্যে কেমন যেন ইঙ্গিত পেলাম। বাইরে গেলে যাতে আমরা পালিয়ে যেতে পারি সে রকম একটা ইঙ্গিত ছিল। আমি পালানোর বিষয়ে মানসিক প্রস্তুতি নিলাম। বিকালে বের হওয়ার আগে আমি প্যান্টের নিচে লুঙ্গি পরলাম। ৪০০-৫০০ টাকা ছিল তাও প্যান্টের পকেটে নিলাম। ৫টার দিকে আমার রুমের সামনে সাদা রঙের জিপ এসে দাঁড়াল। বদিউজ্জামান বলল, ‘স্যার, আমি কী করব?’ আমি আস্তে বললাম, ‘লুঙ্গির ওপরে প্যান্ট পর এবং টাকাপয়সা যা আছে নিয়ে নাও। পালানোর প্রস্তুতি নাও।’ হঠাৎ পাশের রুম থেকে একজন বাংলায় চিৎকার করে উঠলেন, ‘নাসির একটু এদিকে আসেন।’ গিয়ে দেখলাম লেফটেন্যান্ট আবুল হোসেন নামে একজন অফিসারকে সৈয়দপুর থেকে আনা হয়েছে। তিনি বললেন, ‘আপনারা যেখানে যাচ্ছেন আমাকেও একটু নিয়ে যান।’ তখন আমি মেজর ইকবালকে বললাম, ‘স্যার, আপনি অনুমতি দিলে উনাকেও আমাদের সঙ্গে নিয়ে যেতাম।’ উনি কিছু একটা ভেবে বললেন, ‘ঠিক আছে।’ আবুল হোসেনসহ আমরা তিনজন গাড়ির পেছনে চড়লাম। মেজর ইকবাল তীব্র গতিতে গাড়ি চালিয়ে ক্যান্টনমেন্ট ছাড়িয়ে শহরে এলেন। পাবলিক লাইব্রেরির সামনে গাড়ি থামিয়ে বললেন, ‘তোমরা তিনজন এখানে নামো। আমি এক ঘণ্টা পর আবার আসব তোমরা এখানে থেকো।’ সামনে মানুষের জটলা ছিল ওদিকে হেঁটে গেলাম। হাঁট বসেছে, মানুষ সবজি বিক্রি করছে। উত্তর দিকে এগিয়ে গেলে সীমান্ত পাওয়া যাবে। তিনজন হাঁটতে হাঁটতে একটা রিকশা পেয়ে উঠে বসলাম। রিকশাওয়ালা ফ্যাক্টরি পর্যন্ত মাইলখানেক পথ নিয়ে গিয়ে বললেন আর যেতে পারবেন না। আমরা দেরি না করে জুতা খুলে ফেললাম, প্যান্ট খুলে লুঙ্গি পরে হাঁটা দিলাম। স্থানীয়দের সহায়তায় পরদিন হেঁটে সীমান্ত পার হয়ে ভারতে ঢুকলাম। এভাবে শুরু হলো মুক্তিযোদ্ধার জীবন।
সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে ৩ নম্বর সেক্টরের অধীনে কলকলিয়া সাবসেক্টরে আমি একটা কোম্পানির অধিনায়কত্ব করছি। ওখানে রেললাইন ছিল আখাউড়া থেকে শুরু করে হরষপুর পর্যন্ত। ওই ট্রেনে শুক্রবার দুপুরে নতুন সেনা দল, খাবার আসত। আমাদের সেক্টর কমান্ডার জেনারেল শফিউল্লাহ বললেন, ‘এই ট্রেন অ্যামবুশ করার পরিকল্পনা করতে হবে। এটা রেকি কর।’ আমরা দুই সপ্তাহ দেখলাম ৬০-৭০ জন সেনা আসে। আমরা সেপ্টেম্বরের শেষ শুক্রবারকে ঠিক করলাম। ওখানে একটা কালভার্ট ছিল। আমরা সব ধরনের বিস্ফোরক নিয়ে রাতেই সেখানে জমা করলাম। কিন্তু বর্ষাকাল হওয়ায় পানির স্রোতে কালভার্টের নিচে বিস্ফোরক লাগানো কঠিন হয়ে পড়ে। আমরা রেললাইনে ট্রাকের মাঝখানে পাথর সরিয়ে বিস্ফোরক বসালাম। ওর সঙ্গে তার সেট করে দূরে পেয়ারাবাগানে নিয়ে গেলাম। আমরা একটা ফাইটিং প্যাট্রল মোতায়েন করলাম, তদারকি করলাম। দুপুরে রিমোট কন্ট্রোল নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম। ২টা ২০ মিনিটে শব্দ শুনতে পেলাম ট্রেন আসছে। ট্রেনলাইনে বিস্ফোরকের ওপরে উঠতেই রিমোট কন্ট্রোল চেপে দিই আমরা। মুহূর্তে দেখলাম ট্রেন দুই ভাগ হয়ে গেল। এক অংশ ছিটকে এসে পড়ল আমাদের সদস্যরা যেদিকে ছিল সেখানে। বেশ কয়েকজন গুরুতর আহত হলো। এরপর আমরা উঠে দাঁড়িয়ে ওই জায়গায় আক্রমণ চালালাম। ওখানে ৭০-৭৬ জনের মতো পাকিস্তানি সৈন্য মারা যায়। ততক্ষণে পাকিস্তানিরা কাউন্টার অ্যাটাক শুরু করল। আমরা তখন চলে এলাম। মুকুন্দপুর ট্রেন ব্লক অপারেশন ছিল আমাদের সাফল্যজনক অপারেশন।
লেখকঃ সাবসেক্টর কমান্ডার/কোম্পানি কমান্ডার, ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। অনুলিখন : জয়শ্রী ভাদুড়ী
সূত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন