3374
Published on নভেম্বর 17, 2020ড. এ কে আবদুল মোমেনঃ
একটা গল্প দিয়ে শুরু করি। আমি তখন যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় চেয়ারম্যান হিসেবে কর্মরত। সে সময় আমেরিকার খুব নামকরা প্রতিষ্ঠান National Organisation for Women (NOW) জানাল, তারা আমাকে ‘gentleman of the year’ পুরস্কারে ভূষিত করতে চায়। এ ধরনের প্রস্তাবে আমি খুব অবাক হয়েছিলাম। কারণ, NOW যুক্তরাষ্ট্রে নারীর প্রতি বৈষম্য দূরীকরণ, নারীর ক্ষমতায়ন এবং রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করে। তাছাড়া এ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। বিভাগীয় চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনের সময় অধিকসংখ্যক নারী ফ্যাকাল্টি নিয়োগ দেয়ার কারণে তারা আমাকে মনোনয়ন দেয়। আসলে সে সময় যোগ্য নারী প্রার্থীর সংখ্যা বেশি ছিল এবং নিয়োগ কমিটি চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ করে তাদের জন্য সুপারিশ করেছিল। আর বিভাগীয় প্রধান হিসেবে আমি তাদের নিয়োগ দেয়ার গৌরব অর্জন করেছিলাম। আমি ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের প্রতি কোনো আনুকূল্য প্রদর্শন করিনি। তারা অধিক যোগ্য ছিল বলে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল।
যে কারণে এ গল্পের অবতারণা সেখানে আসি এবার। নারীর ক্ষমতায়ন তথা তাদের যোগ্য হিসেবে গড়ে তোলা এবং উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্তকরণ দেশের উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। আমরা সৌভাগ্যবান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারীর ক্ষমতায়নে নিজেকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নক্ষত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বাংলাদেশের মতো রক্ষণশীল সমাজ, যেখানে একশ্রেণির লোক ধর্মীয় খোলস নিয়ে নারীকে কর্ম থেকে দূরে রাখার জন্য কত ওয়াজ নসিহত করে, সেখানে তিনি নারী কর্মীর সংখ্যা ৬ থেকে ৩৮ শতাংশে উন্নীত করেছেন; যা একাধারে বিস্ময়কর ও গর্বের ব্যাপার। নারীর ক্ষমতায়নের মাধ্যমে সমতার সমাজ বিনির্মাণেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদক্ষেপ বিশ্বে রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃত। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও আমরা প্রধানমন্ত্রীর ভিশন অর্জনে কাজ করে যাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে সিনিয়র ও যোগ্য নারী কূটনীতিকদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রাষ্ট্রদূতসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দিচ্ছে।
বাংলাদেশ সব সময় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পররাষ্ট্রনীতি ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে শত্রুতা নয়’ অনুসরণ করে চলেছে। এখন আমাদের দেশের অন্যতম বড় লক্ষ্য হচ্ছে উন্নয়ন; কেবল অর্থনৈতিক উন্নয়ন বা জিডিপি বৃদ্ধি নয়, বরং সামগ্রিক উন্নয়ন। গত ১২ বছরে বাংলাদেশ বিস্ময়কর উন্নয়ন করতে সক্ষম হয়েছে। বিভিন্ন সামাজিক সূচক, যেমন শিশুমৃত্যু ও মাতৃমৃত্যু রোধ, উন্নত স্যানিটেশন ব্যবস্থা, এমনকি দারিদ্র্য বিমোচনে আমাদের অর্জন ঈর্ষণীয়। যুক্তরাজ্যের ১০০ বছরের পুরনো ম্যাগাজিন ‘স্পেকটেটরের’ রিপোর্ট অনুসারে, মোট জিডিপি ১৮৮ শতাংশ সম্প্রসারণসহ গত ১০ বছরে বড় বড় ২৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির রেকর্ড করেছে। আমাদের পরে চীন ও ভারত। ভারতের জিডিপি মাত্র ১১৫ শতাংশ বেড়েছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের মাথাপিছু আয় বেশি হতে পারে; কিন্তু দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশ অনেক ভালো করেছে। বাংলাদেশের দারিদ্র্যসীমা গত দশ বছরে ৪২ থেকে ২০.৫ শতাংশে নেমে এসেছে এবং অতি দারিদ্র্যের হার ২৪ থেকে ১০.৫ শতাংশে নেমে এসেছে। করোনাকালেও এশিয়ার সব দেশের মধ্যে বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ ৫.২ শতাংশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ৫ বছরে অতি দারিদ্র্যের হার আরও ৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে কাজ করে যাচ্ছেন। আমাদের এ অর্জনগুলো পৃথিবীর অনেকে জানে না। দেশের এ অর্জনগুলো বিদেশিদের জানানোর মাধ্যমে দেশের ভাবমূর্তির উন্নয়ন আমাদের কূটনীতিকদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।
আমাদের দুটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হল- মানবসম্পদ ও পানিসম্পদ। এ দেশে রয়েছে বিপুলসংখ্যক তরুণ জনগোষ্ঠী এবং এ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা আগামী ১৫ বছর বাড়বে। আর আমাদের পানির কোনো অভাব নেই; বড় বড় পানির উৎস নদ-নদী, খাল-বিল ও সাগর রয়েছে। তবে এ সম্পদের যথোপযুক্ত ব্যবহার করতে না পারলে তা বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। পানিসম্পদকে সঠিকভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে বন্যা, প্লাবন, নদীভাঙন, খরাসহ বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। আমরা পানি ব্যবস্থাপনাকে এখনও উন্নত করতে পারিনি। এ বিষয়ে আমাদের বিশেষ দক্ষতা অর্জন করতে হবে। পানি ব্যবস্থাপনায় সফল দেশের অভিজ্ঞতা আমরা যেন কাজে লাগাতে পারি, সে বিষয়ে বিভিন্ন দেশে কর্মরত বাংলাদেশের কূটনীতিকরা লক্ষ রাখবেন বলে আশা করি। তাহলে নদীভাঙনে ক্ষয়ক্ষতি বন্ধ হবে এবং মানুষ গৃহহারা বা উদ্বাস্তু হবে না।
বাংলাদেশের মতো জাপানিদের কোনো খনিজসম্পদ নেই; তাদের আছে মানুষ। জাপানিরা তাদের জনশক্তি কাজে লাগিয়ে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হয়েছে। মানবসম্পদ ও পানিসম্পদ সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা অর্জন আমাদের জন্য সহজ হবে। এ দুটি সম্পদ যথাযথভাবে কাজে লাগানো এবং প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ও আমাদের স্বপ্ন ‘সোনার বাংলা’ অর্জনের জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দুটি প্যাকেজ পলিসি চালু করেছে। এগুলো হচ্ছে অর্থনৈতিক কূটনীতি (Economic Diplomacy) ও জনকূটনীতি (Public Diplomacy)।
অর্থনৈতিক কূটনীতির ক্ষেত্রে আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে : ১. বিনিয়োগ বৃদ্ধি; বিনিয়োগের পরিধি বাড়িয়ে আমরা গ্লোবাল ম্যানুফ্যাকচারিং হাব হয়ে গড়ে উঠতে চাই। ২. নতুন নতুন প্রযুক্তিতে সিদ্ধহস্ত হতে হবে। ৩. রফতানির পরিধি ও বৈচিত্র্য বাড়াতে হবে। ৪. জনশক্তির যথোপযুক্ত কর্মসংস্থানের (Gainful employment) ব্যবস্থা করা এবং ৫. প্রবাসী বাংলাদেশিদের উন্নত সেবা প্রদান।
আমি জনকূটনীতির ওপর জোর দিতে চাই। বাংলাদেশের কূটনীতিকরা পৃথিবীর সব দেশে জনকূটনীতির ওপর গুরুত্বারোপ করবেন বলে আমি প্রত্যাশা করি। বঙ্গবন্ধু বলেছেন, বাংলাদেশ একটি শান্তির দেশ। আমরা শান্তির সংস্কৃতি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিতে চাই। এছাড়া আমাদের অর্জনগুলো বিভিন্ন সেমিনার, ওয়ার্কশপ ও পাবলিকেশন্সের মাধ্যমে তুলে ধরে বিশ্বে আমাদের দেশের ভাবমূর্তি আরও বাড়াতে হবে।
প্রবাসী বাংলাদেশিদের উন্নয়নের মহাসড়কে সম্পৃক্তকরণে আমার একটা বিশেষ প্রকল্প ছিল RIPEN. আমি এ বিষয়ে প্রস্তাব দিয়েছিলাম এবং সরকার এ প্রস্তাবের অনেকাংশ গ্রহণ করেছে। RIPEN-এর ‘R’ হল রেমিট্যান্স। যেহেতু রেমিট্যান্স বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্কিত, সরকার এ বিষয়টি ওই প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব প্রদান করেছে। তবে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, রেমিট্যান্স সঠিকভাবে কাজে লাগানোর জন্য একটি বিশেষ সেল থাকা প্রয়োজন।
‘I’ হল Investment. বহু প্রবাসী বাংলাদেশি বিনিয়োগ প্রস্তাব নিয়ে আসে। আমরা এদেশে বিনিয়োগ বাড়ানোর ক্ষেত্রে আমাদের প্রবাসীদের কাজে লাগাতে চাই। প্রবাসীদের বিনিয়োগ প্রস্তাব কাজে লাগাতে বিনিয়োগের শর্ত ও পদ্ধতি সহজতর করা উচিত বলে আমি মনে করি। উল্লেখ্য, গণচীনের ৬৬ শতাংশ বৈদেশিক বিনিয়োগ এসেছে তাদের প্রবাসী চৈনিকদের মাধ্যমে। ভারতে ব্যাঙ্গালুরু ও চেন্নাইয়ে প্রবাসী ভারতীয়দের জয়জয়কার।
RIPEN-এর ‘P’ হচ্ছে Philanthrophy. প্রবাসীরা অনেক কিছু দান করেন। যেমন অ্যাম্বুলেন্স, হাসপাতালের সরঞ্জামাদি ইত্যাদি। হয়রানিমুক্তভাবে এসব দানসামগ্রীর ব্যবহার নিশ্চিত করতে একটি সেল তৈরি করা যেতে পারে। ‘E’ হচ্ছে ‘Exchange of Expertise and Experiance’. আমাদের ছেলেমেয়েরা আমেরিকার সাইবার সিকিউরিটির ওপর বড় বড় কাজ করে; বড় বড় কনসালটেন্ট। তারা অনেক সময় স্বদেশের জন্য সস্তায় সার্ভিস দেয়; এমনকি বিনা পয়সায়। প্রবাসে বড় বড় ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক আছেন। তারা যখন দেশে আসেন, তাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে একটি সেল তৈরি করা যেতে পারে। এতে উভয় পক্ষ লাভবান হবে। প্রবাসীরা কিছু দিতে পারলে খুশি হবেন। আর দেশবাসী উপকৃত হবেন। ‘N’ হচ্ছে নেটওয়ার্কিং। বিদেশে নেটওয়ার্কিং বৃদ্ধিতে আমাদের কাজ করতে হবে। আমি একজন মন্ত্রী হিসেবে বিদেশে গিয়ে যদি বলি বাংলাদেশ অপার সম্ভাবনার দেশ, এটি কিছু লোক বিশ্বাস করলেও অনেকে করবে না; কারণ আমরা সরকারি লোক। কিন্তু সংশ্লিষ্ট দেশে যে ব্যক্তির নিজ কর্মদক্ষতার জন্য গ্রহণযোগ্যতা আছে, তিনি যদি একই কথা বলেন, তবে অনেকে বিশ্বাস করবে। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, জিই-এর সিইও, কংগ্রেসম্যান বা এমপিরা যদি বলেন, ‘বাংলাদেশ অপার সম্ভাবনার দেশ’ তাহলে সবাই বিশ্বাস করবে। আমি এ ধরনের লোকদের নিয়ে একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে চাই। বাংলাদেশের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন ব্যক্তিদের নিয়ে ক্লাব গড়ে তোলা যেতে পারে। এ ধরনের ব্যক্তিদের তালিকা তৈরি করে তাদের দেশের ভাবমূর্তি বৃদ্ধিতে কাজে লাগাতে হবে।
আমি নিউইয়র্কে থাকাকালীন বাংলাদেশকে স্বাধীনতা যুদ্ধে সহায়তাকারী বিদেশিদের সম্মানিত করার চিন্তা করেছিলাম। আমি ও মমতাজ, স্যার রবিশঙ্কর, জর্জ হারিসনসহ ৭ জনকে মরণোত্তর নাগরিকত্ব দেয়ার জন্য সুপারিশ করেছিলাম। প্রায় এক বছর পর একটি কমিটি করে ৬৭০ জনের একটা তালিকা তৈরি করা হয় এবং কয়েকশ’ ব্যক্তিকে পর্যায়ক্রমে সম্মানিত করা হয় ‘Friends of Bangladesh’ পদক দিয়ে। আমি যখন সরকারে ছিলাম না তখন ১৯৯৬ সালে অনুরূপ অনুষ্ঠান করেছিলাম এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের হাতে উপহার তুলে দেন। যতজনকে তাদের ত্যাগের জন্য আমরা সম্মাননা দিয়েছি, তাদের পরিবারের সবাই এখন বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। যারা বিদেশে বাংলাদেশের বন্ধু তাদের একটা তালিকা তৈরি করে দেশের ভাবমূর্তি বৃদ্ধিতে কাজে লাগানো যেতে পারে।
দায়িত্ব পাওয়া যেমন কষ্টকর ও ভাগ্যের বিষয়, তেমনি সম্মানের সঙ্গে দায়িত্ব ছেড়ে যাওয়া আরও কঠিন। প্রত্যাশা করি, বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে এ দেশের কূটনীতিকরা এমনভাবে কাজ করবেন, যাতে তার পরিবার, সমাজ এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তথা বাংলাদেশ তাকে নিয়ে গর্ব করতে পারে।
লেখক: পররাষ্ট্রমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
সৌজন্যেঃ দৈনিক যুগান্তর