3531
Published on নভেম্বর 9, 2020মুজিববর্ষে জাতীয় সংসদের বিশেষ অধিবেশনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক এবং কর্মজীবন ও দর্শনের ওপর আলোচনার জন্য সাধারণ প্রস্তাব তুলে প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেছেন ইতিহাসকে কেউ মুছতে পারবে না।
সংসদের কার্যপ্রণালি বিধির ১৪৭-এর আওতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক এবং কর্মজীবন ও দর্শনের ওপর আলোচনার জন্য সাধারণ প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন। এর আগে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বঙ্গবন্ধুর কর্মজীবনের ওপর ভাষণ দেন।
সোমবার (৯ নভেম্বর) সন্ধ্যায় স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে রাষ্ট্রপতির ভাষণের পর সংসদ কিছু সময়ের জন্য বিরতি দেওয়া হয়। বিরতির পর বৈঠকের কার্যক্রম শুরু হলে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা প্রস্তাবটি তোলেন। প্রস্তাব উত্থাপনের পর সোমবারই এর ওপর বিশেষ আলোচনা শুরু হয়। এদিকে প্রস্তাব তোলার সময়ে শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর কর্মময় জীবনের ওপর আলোকপাত করেন। তিনি বলেন, ‘সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণ ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আলোচনায় ইতিহাসের অনেক কথা সবার জানার একটা সুযোগ হয়েছে।’
সংসদের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সাধারণ আলোচনার জন্য খোদ সংসদ নেতার প্রস্তাব তোলার নজির নিকট অতীতে নেই। সাধারণত জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ বা সংসদের সিনিয়র কোনও নেতা সাধারণ প্রস্তাব উত্থাপন করে থাকেন। স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর মর্যাদার বিষয়টি বিবেচনায় এনে তাঁরই মেয়ে শেখ হাসিনা এবার প্রস্তাব তুললেন।
প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনার উত্থাপিত ১৪৭ বিধির সাধারণ প্রস্তাবটি ছিল—‘সংসদের অভিমত এই যে, ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা ও স্থপতি, বাঙালির অবিসংবাদিত মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালি জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনে তিনি সারা জীবন সংগ্রাম করেছেন। জেল-জুলুম, অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করেছেন। কিন্তু অন্যায়ের সঙ্গে কখনও আপস করেননি। ১৯৫৭-৪৮ থেকে ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট গঠন, ১৯৬৬-এর ছয় দফা, ১৯৬৮-এর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০-এর নির্বাচন— দীর্ঘ ২৪ বছরের সংগ্রাম ও আন্দোলনের পথ ধরে ১৯৭১-এর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে অর্জিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা। ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে বজ্রকণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। বঙ্গবন্ধুর ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলার নিরস্ত্র জনগণ ঘরে ঘরে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে দুর্গ গড়ে তুলেছিল। ২৬ মার্চ ১৯৭১-এর প্রথম প্রহরে জাতির পিতা শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এরপর দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ৩০ লাখ মহান শহীদ ও দুই লাখ মা-বোনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে স্থান লাভ করে। বঙ্গবন্ধু আমাদের দিয়েছেন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। লাল-সবুজের পতাকা ও সংবিধান। বঙ্গবন্ধু বিশ্বসভায় বাঙালিকে আত্মপরিচয় নিয়ে গর্বিত জাতিরূপে মাথা উঁচু করে চলার ক্ষেত্র রচনা করেছেন। স্বাধীনতার পর একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ে তোলার জন্য মাত্র সাড়ে তিন বছর সময় পেয়েছিলেন তিনি। সেই সময়কালে বাংলাদেশের উন্নয়নের সামগ্রিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের কাজ শুরু করেন তিনি। ২০২০ সালে জন্মশতবার্ষিকীতে মুজিববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে তাঁর বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক এবং কর্মজীবন ও দর্শনের ওপর জাতীয় সংসদে আলোচনার মাধ্যমে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদন করা হোক।’
প্রস্তাব তোলার সময় দেওয়া বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করে বলেন, ‘পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর বাঙালিদের ওপর যে অত্যাচার নির্যাতন শুরু হয়, তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন জাতির পিতা। তিনি সবসময় মানুষের কথা চিন্তা করতেন। মানবতার সেবা করার বিষয়টি তাঁর ভেতরে সব থেকে বেশি দেখেছি। অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করতে গিয়ে বারবার জেল-জুলুমের শিকার হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু বারবার গ্রেফতার হয়েছেন। কারাগারে ছিলেন। সন্তান হিসেবে আমরা একটানা দুই বছর বাবাকে পাইনি। দেখা করতে হয়েছে জেলখানায়।’
তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শ নিয়ে বাংলাদেশটাকে আমরা গড়ে তুলতে চাই। সেটাই আমাদের লক্ষ্য। আমাদের দুর্ভাগ্য, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট না হলে বাংলাদেশ বহু আগেই উন্নত দেশে পরিণত হতো।’
সংসদে প্রচার করা বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ভাষণের প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘১০ জানুয়ারি তিনি ওই কষ্ট করে এসে সবাইকে যে ঐক্যবদ্ধ থাকতে বললেন, সেই ঐক্যবদ্ধ তো থাকতে পারে নাই। যাদের তিনি গভীরভাবে ভালোবাসতেন সেই দেশের মানুষের হাতেই তাঁকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। দেশের মানুষের প্রতি তাঁর বিশ্বাস ছিল। তার বিশ্বাসটা বাঙালি জাতি রাখতে পারলো না। সেই বিশ্বাসের মধ্যে একটি ঘাতকচক্র ঢুকে গেলো। কিন্তু কারা পেছনে ছিল জানতে পারলেন না। এই বিশ্বাসঘাতক একটি মুষ্টিমেয় ক্ষুদ্রগোষ্ঠী, এদেশের আপামর জনগণ নয়।’
বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তী বাংলাদেশের চিত্র তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর প্রচার নিষিদ্ধ ছিল। একসময় ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম সম্পূর্ণ মুছে ফেলা হয়েছিল। এত কষ্ট করে যিনি স্বাধীনতা এনে দিলেন, সেই স্বাধীন দেশটাকে তিনি যখন গড়ে তুলছিলেন, তিনি চেয়েছিলেন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, পঁচাত্তরে তাকে হত্যা করা হলো। কত অপবাদ দিয়ে। কত মিথ্যা অপপ্রচার চালিয়ে। তাঁর মৃত্যুর পরে কত রকমের মিথ্যা অপপ্রচার! ইতিহাস মুছে ফেলা যায় না। ইতিহাসও প্রতিশোধ নেয়। আজকে সেই নাম (বঙ্গবন্ধুকে) আর কেউ মুছতে পারবে না। ইতিহাসকে কেউ মুছতে পারবে না। এটাই হচ্ছে বাস্তবতা।’
মুজিববর্ষ পালনের প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এটা সৌভাগ্য ২০২০ সাল জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীতে এই সংসদে আমরা আছি। আমাদের সৌভাগ্য আমরা মুজিববর্ষ উদযাপন করতে পারছি। রাষ্ট্রপতি চমৎকার ভাষণ দিয়েছেন। এর মাধ্যমে ইতিহাসের অনেক কথা সবার জানার একটা সুযোগ হয়েছে। আমাদের পরিবারের সব সদস্যকে হত্যার চেষ্টা হয়েছে। আমরা দুই বোন বিদেশে থাকার কারণে বেঁচে যাই। কিন্তু আমাদের দেশে ফিরতে বাধা দেয়। তবে, জনগণের কাছে কৃতজ্ঞ আমরা দেশে ফিরে এসেছি। আজকে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী যখন উদযাপন করছি, তখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী আমরা ২০২১ সালে উদযাপন করবো।’
তিনি বলেন, ‘জাতির পিতা আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তাঁর যে আদর্শ, তিনি যে কথাগুলো বলে গেছেন—তার প্রতিটি লাইন, প্রতিটি কথা আমাদের জন্য যে কত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের জন্য কত শেখার।’