কারাগার যখন অনিরাপদ, কান্না যেদিন রক্ত

2214

Published on নভেম্বর 3, 2020
  • Details Image

অজয় দাশগুপ্তঃ

আজকের প্রজন্ম সেভাবে ইতিহাস জানে না। এ দীনতা যতোটা তাদের, ততোটাই আমাদের লজ্জা। আমরা তখন যৌবনের শুরুতে , বাংলাদেশে ঘটে চলেছে একের পর এক হত্যাকাণ্ড। তাও রাষ্ট্রের মসনদ নিয়ে। ক্যু এর পর ক্যু। কে যে কখন গদিতে বসবে তার কোনও দিশা পাওয়া যাচ্ছিল না। ক্ষমতার পালাবদলের আগেই ঘটছিল নারকীয় সব ঘটনা। পঁচাত্তর সালের ১৫ই অগাস্ট বাংলাদেশের বাঙালির জীবনে নিকৃষ্টতম অধ্যায়। সবচেয়ে শোকাবহ দিন। কিন্তু ৩রা নভেম্বরকে আমি বলি পথ হারানো ও নেতা হারানোর রাত। গভীর রাতে দুনিয়ার সকল ইতিহাস সব সভ্যতা ভব্যতা ভঙ্গ করে যা ঘটেছিল তার কোন ব্যাখ্যা নাই। সবার আগে আমরা ইতিহাসের পাতায় চোখ রেখে জেনে নেব আসলে কী ঘটেছিল সে রাতে।

১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর মধ্যরাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে একটি পিকআপ এসে থামে। তখন রাত আনুমানিক দেড়টা থেকে দুইটা। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় সে গাড়িতে কয়েকজন সেনা সদস্য ছিল। ঢাকা তখন এখন অস্থিরতার নগরী। সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে অভ্যুত্থান এবং পাল্টা অভ্যুত্থান নিয়ে নানা রকম কথা শোনা যাচ্ছে তখন।

সে সময় ঢাকা কেন্দ্রিয় কারাগারে জেলার হিসেবে কর্মরত ছিলেন আমিনুর রহমান। রাত দেড়টার দিকে কারা মহাপরিদর্শক টেলিফোন করে জেলার মি. রহমানকে তাৎক্ষণিকভাবে আসতে বলেন। দ্রুত কারাগারের মূল ফটকে গিয়ে মি. রহমান দেখলেন, একটি পিকআপে কয়েকজন সেনা সদস্য সশস্ত্র অবস্থায় আছে।

মূল ফটকের সামনে সেনা সদস্যরা কারা মহাপরিদর্শককে একটি কাগজ দিলেন। সেখানে কী লেখা ছিল সেটি অবশ্য জানতে পারেননি মি. রহমান। মূল ফটক দিয়ে ঢুকে বাম দিকেই ছিল জেলার আমিনুর রহমানের কক্ষ। তখন সেখানকার টেলিফোনটি বেজে ওঠে। মি. রহমান যখন টেলিফোনের রিসিভারটি তুললেন, তখন অপর প্রান্ত থেকে বলা হলো- প্রেসিডেন্ট কথা বলবেন। ২০১০ সালে বিবিসি বাংলার কাছে সে ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে মি. রহমান বলেন, “টেলিফোনে বলা হলো প্রেসিডেন্ট কথা বলবে আইজি সাহেবের সাথে। তখন আমি দৌড়ে গিয়ে আইজি সাহেবকে খবর দিলাম। কথা শেষে আইজি সাহেব বললেন যে প্রেসিডেন্ট সাহেব ফোনে বলছে আর্মি অফিসাররা যা চায়, সেটা তোমরা কর।”

কে এই প্রেসিডেন্ট? আওয়ামী লীগের নেতা মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক। বাংলাদেশের ইতিহাসে জঘন্যতম মীরজাফর মোশতাক তার সহকর্মী বন্ধুদের খুন করার জন্য জেল ফটক খুলে দেওয়ার ঘোষণা দিতে একটুও ভাবেনি। একাত্তরের সূচনা লগ্ন থেকে এই মানুষটি তাজউদ্দীন আহমেদের সরকারের বিরুদ্ধে কাজ করেছিল। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের ঘনিষ্ট হবার ভান করে ফায়দা লুটে বঙ্গবন্ধুর শোকাবহ মৃত্যুর পর রাষ্ট্রপতি হওয়া এই কুলাঙ্গার পৃথিবীর কাছে আমাদের মাথা হেঁট করে দিয়েছে বারবার।

আজ এতো বছর পর আমরা কি এই প্রশ্ন করতে পারি না কেন এই হত্যাকাণ্ড? তখন তো তাজউদ্দীন বঙ্গবন্ধুর সরকারেও ছিলেন না। ছিলেন না দলের কোন গুরুত্বপূর্ণ পদে। একা নি:সঙ্গ এই নিপাট আদর্শবাদী মানুষটিকে কেন হত্যা করা হলো? কেন মরলেন অজাতশত্রু নামে পরিচিত কামরুজ্জামান, কী অপরাধ করেছিলেন সৈয়দ নজরুল কিংবা মনসুর আলী। একটাই ধারণা চালু যে এরা বঙ্গবন্ধুর রক্তের ওপর পা দিয়ে আদর্শের সাথে বেঈমানি করতে রাজি ছিলেন না।

যেমনটা করেছিলেন বহু আওয়ামী নেতা। ফণী বাবু, মনোরঞ্জন ধরের মতো নেতারাও নাম লিখিয়েছিলেন মোশতাক সরকারে। আবদুল মালেক উকিলের ভূমিকাও ছিলো কলঙ্কিত। কিন্তু এই চার নেতা মাথা নোয়াননি। কারণ একাত্তরে এরাই ছিলেন আমাদের মূল স্তম্ভ। আর সে স্তম্ভগুলো ধ্বংস করে বাংলাদেশের নেতৃত্ব ধ্বংস করার জন্যই এ হত্যাকাণ্ড। বলাবাহুল্য সে কারণেই আজ অবধি আমাদের দেশে তেমন নেতা জন্মেনি। আমরা ভুগছি নেতৃত্বের চরম সংকটে।

ঠাণ্ডা মাথার এই চার নেতা বেঁচে থাকলে বাংলাদেশ কোন পথে যেতো তা অনুমান করতে মেধার দরকার পড়ে না। ইতিহাসকে ভিন্নপথে ধাবিত করার শেষ ষড়যন্ত্রের ফলাফল এই রাত। কি করুণ সে রাত! শোনা গেছে পাগলা ঘণ্টির শব্দ শুনেই টের পেয়ে গিয়েছিলেন তাজউদ্দীন আহমেদ । তার সাথে ছিলেন কামরুজ্জামান। একটু নাভার্স এই নেতা তাকে প্রশ্ন করেছিলেন, কী হচ্ছে এসব? আমাদেরকে কি ওরা মেরে ফেলবে? শান্ত তাজউদ্দীন প্রত্যুত্তোর দিয়েছিলেন, যান ওজু করে নামাজ পড়ে নিন। কারণ তিনি জানতেন এই হবে তাদের জীবনের শেষ প্রার্থনা। আমি যৌবন পেরিয়ে যখন গোধূলী বেলায়- তখনো আমার চোখ ভিজে যায় কল্পনা করলে। যে মানুষেরা এই স্বাধীন দেশের জন্য লড়াই সংগ্রাম করে আমাদের স্বাধীন মাটি, পতাকা, সঙ্গীত দিয়ে গেলেন- এই ছিল তাদের প্রাপ্য?

সত্যি বলতে কি এখনো তাদের সেভাবে মূল্যায়ন হয় নি। গতবছর আমি নভেম্বরের প্রথম দিন আমি ঢাকায় ছিলাম। শান্ত নিস্তেজ দুপুরে গিয়েছিলাম বনানী কবরস্তানে। যেখানে ঘুমিয়ে আছেন দেশের শ্রেষ্ঠ চার সন্তান। চার নেতা। যাদের বিরুদ্ধে টাকা পয়সা থেকে কোন কেলেংকারীর অভিযোগ দূরে থাক একটি আঙুলও তুলতে পারেনি কেউ। অথচ কি নির্মম পরিণতি তাদের! এ জন্যেই কি স্বাধীন হয়েছিল এইদেশ?

বহুকাল ধরে এই অভিশাপ আমাদের তাড়িয়ে বেড়াবে। তাদের হাহাকার ও শেষ সময়ের বুকভাঙা দীর্ঘশ্বাস কি বাতাস ভুলে গেছে? ভুলে গেছে কি দেশের রক্তনদী? যে প্রজন্ম এখন স্বাধীন দেশের আর্থিক উন্নতি ও সুবাতাস নিয়ে বড় হচ্ছে, যাদের ঘরে ধন উপচে পড়ছে, যারা কথায় কথায় হিল্লী-দিল্লী ঘুরে বেড়ায়, তাদের একটা কথা মনে রাখা উচিৎ বাংলাদেশ বহু ত্যাগ আর রক্তের দেশ।

স্বাধীনতার পরও সে রক্ত ঝরা থামেনি। এই চার জাতীয় নেতার প্রতি সম্মান জানানোর একটাই উপায় , তাদের স্বপ্নের অসাম্প্রদায়িক উদার গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ।

শ্রদ্ধা জানাই তাদের।

সূত্রঃ বিডিনিউজ২৪

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত