2324
Published on নভেম্বর 3, 2020অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান ঃ
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড কোনো সাধারণ অভ্যুত্থানের ঘটনা ছিল না। এটি ছিল জাতীয় চেতনাকে ধ্বংস করা বা দেশকে পুনরায় পিছিয়ে দেওয়ার একটি সুপরিকল্পিত চক্রান্তের অংশ। এই একই চক্রান্তের ধারাবাহিকতায় সংঘটিত হয় ৩ নভেম্বরের জেল হত্যাকাণ্ড। এসব হত্যাকাণ্ড কোনো বিচ্ছিন্ন বা কাকতালীয় ঘটনা ছিল না। পরাজিত শক্তি বাঙালি জাতির মূল্যবোধকে ধ্বংস করে দেওয়ার সুগভীর চক্রান্তের অংশ হিসেবেই এসব হত্যাকাণ্ড ঘটায়। পরাজিত শক্তি বলতে আমি শুধু ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের যারা সরাসরি বিরোধিতা করেছিল বা পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করেছিল, তাদের বোঝাচ্ছি না।
১৯৪৮ সালেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অনুধাবন করতে পেরেছিলেন, পাকিস্তান নামক অদ্ভুত রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ বা বাঙালির অধিকার অর্জন করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী প্রথমেই আমাদের মাতৃভাষার ওপর আঘাত হানে। পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু বাঙালিদের ভাষা বাদ দিয়ে তারা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতিদানের উদ্যোগ গ্রহণ করে। তখন বাঙালিরা তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। একে একে অর্থনৈতিক, সামাজিক বৈষম্যগুলো সাধারণ মানুষের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, পরে ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচন এবং এরই ধারাবাহিকতায় পরে মুক্তিযুদ্ধ- এই ঘটনাগুলো ধারাবাহিকভাবে ঘটে যেতে থাকে।
বাঙালির প্রতিটি আন্দোলনেই কতিপয় বাঙালি বিরোধিতা করে। বাঙালিরা যাতে কখনই তাদের ন্যায্য অধিকার ভোগ করতে না পারে, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ওই চেষ্টাই করেছে। বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধের সময় পুরো জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু আমি এটি বিশ্বাস করি না। মুক্তিযুদ্ধ বলি বা অন্য যে কোনো আন্দোলনের কথাই বলি না কেন, আমরা কখনই শতভাগ ঐক্যবদ্ধ ছিলাম না।মুক্তিযুদ্ধের সময়ও অনেক মানুষ এর বিরোধিতা করেছে। বঙ্গবন্ধু যখন ঐতিহাসিক ৬ দফা ঘোষণা করেন, তখন অনেকেই এর বিরোধিতা করেছে। ছয় দফার ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত ’৭০-এর নির্বাচনে ২৩ দশমিক ৭৪ শতাংশ বাঙালি ভোটার নৌকা মার্কার বিপক্ষে ভোট দিয়েছিল। যখন রেডিও-টিভিতে রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করা হয়, তখনো অনেক বুদ্ধিজীবী রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করার পক্ষে ছিলেন। ১০ বুদ্ধিজীবী এর বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়েছেন ও ৪০ বুদ্ধিজীবী এর পক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন।
১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের সময় থেকেই যারা এ অঞ্চলের মানুষের মুক্তবুদ্ধির কথা বলতেন, প্রগতির কথা বলতেন বা অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার স্বপ্ন দেখতেন- তাদের ভারতের চর বা দালাল বলা হতো। অপবাদ দেওয়া হতো, ভারতীয় চররা এ দেশে ইসলামকে ধ্বংস করার চক্রান্ত করছে। তারা পাকিস্তানি শাসকদের যে কোনো কাজকেই ইসলামের সঙ্গে যুক্ত করে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করত। পাকিস্তান আমলজুড়ে এই অবস্থা বিরাজ করে। তারা শুধু বুদ্ধিবৃত্তিক বিরোধিতা করেই ক্ষান্ত হয়নি। ১৯৭১ সালে এসে তারা সরাসরি পাকিস্তানি দখলদার সামরিক জান্তার পক্ষে অস্ত্র হাতে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। রাজাকার-আলবদর বাহিনী তৈরি করে তারা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে সহায়তা করে। তাদের অনেকেই পরে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি হয়েছে।
স্বাধীনতা অর্জনের পর মনে করা হয়েছিল, এই পরাজিত গোষ্ঠী হয়তো তাদের ভুল বুঝতে পেরে দেশ গঠনে অংশ নেবে। কিন্তু তারা তা না করে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশেও তাদের অপকর্ম চালিয়ে যেতে থাকে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার মাধ্যমে ওই গোষ্ঠীটি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। ১৯৪৮ সাল থেকে আমাদের এই দেশে যেসব প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী ছিল, যারা বাঙালি অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধ্বংস করার জন্য সব সময় সচেষ্ট ছিল- তারা ক্ষমতাসীন হয়। ১৯৭১ সালে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য, সাংস্কৃতিক চেতনা ও মূল্যবোধের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভ করি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী ক্ষমতাসীন হয়ে পুরো চিত্রটি পাল্টে দেয়। তারা আবারও পাকিস্তানি ভাবধারায় দেশ পরিচালনা করতে শুরু করে। রাতারাতি ‘বাংলাদেশ বেতার’ হয়ে যায় ‘রেডিও বাংলাদেশ’। ‘জয় বাংলার’ বদলে চলে আসে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’।
সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্য সচিব রাজাকার বাহিনীর সৃষ্টিকর্তা রাও ফরমান আলীর ঘনিষ্ঠ সহচর শফিউল আলম হন কেবিনেট সচিব। আইয়ুব-ইয়াহিয়ার প্রিয় ব্যক্তি কাজী আনোয়ারুল হক হলেন খুনি মোশতাকের উপদেষ্টা। জেনারেল ওসমানী হলেন উপদেষ্টা। মওলানা ভাসানীও খোন্দকার মোশতাককে অভিনন্দন জানালেন। ’৭০-এর দশকে পুরো দুনিয়ায় বিভিন্ন দেশে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটেছিল। তখন বিশ্বব্যাপী সমাজতান্ত্রিক ব্লক ও পুঁজিবাদী শক্তির মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছিল। এ কারণে বিভিন্ন দেশে প্রায়ই সামরিক অভ্যুত্থান ঘটত। কিন্তু সেসব সামরিক অভ্যুত্থানের মূল উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতির পিতাকে হত্যার মাধ্যমে শুধু রাষ্ট্রক্ষমতায় পরিবর্তন আসেনি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধের মূলে কুঠারাঘাত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে নবীন দেশটি আমরা লাভ করেছিলাম, তাকে আবারও পিছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়।
বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর সেনাবাহিনীতে যদি শৃঙ্খলা ফিরে আসে, সংবিধান যদি পুনঃস্থাপিত হয় এবং জাতীয় সংসদ কার্যকর হয় তা হলে সংসদের নেতৃত্বে কারা আসবে এসব প্রশ্ন দেখা দেয়। অভ্যুত্থানকারীরা বুঝতে পারে জেলখানায় বন্দি চার জাতীয় নেতা বেরিয়ে আসবে এবং তারাই জাতীয় সংসদ ও সরকারের নেতৃত্ব দেবে। এই চার জাতীয় নেতা সম্পর্কে তাদের ভীতি ছিল। কারণ নানাভাবে চেষ্টা করে, চাপ দিয়ে এমনকি প্রলোভন দেখিয়েও এই চার নেতাকে তারা সরকারে নিতে পারেননি। মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে এই চার নেতা ৯ মাস যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কাজেই তাদের নেতৃত্বের গুণাবলি এবং ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে অভ্যুত্থানকারীরা সচেতন ছিল। বঙ্গবন্ধুর কোনো কোনো অনুসারী অভ্যুত্থানকারীদের সঙ্গে হাত মেলালেও এই চার জাতীয় নেতা ছিলেন সম্পূর্ণ আলাদা। কাজেই অভ্যুত্থানকারীরা তাদের বাঁচিয়ে রাখার সাহস করেনি। তারা বুঝতে পেরেছিল এই চার নেতাকে বাঁচিয়ে রাখা হলে এক সময় এরা বিপদের কারণ হতে পারে। এ ছাড়া এদের জনপ্রিয়তাও ছিল আকাশচুম্বী। অভ্যুত্থানকারীরা বঙ্গভবনে বসেই এই চার নেতাকে হত্যার পরিকল্পনা করে।
পৃথিবীর ইতিহাসে এমন নির্মম হত্যাকাণ্ড বিরল। জেলখানার কোনো জাতীয় নেতাকে গুলি করে হত্যা করার ঘটনা বিশ্ব রাজনৈতিক ইতিহাসে নজিরবিহীন। জেলখানায় চার জাতীয় নেতাকে হত্যার ঘটনার সঙ্গে আমি মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের মিল খুঁজে পাই। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এবং তাদের স্থানীয় দোসররা যখন দেখল স্বাধীনতা কোনোভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না তখন তারা জাতিকে মেধাশূন্য করার জন্য দেশের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের নির্মমভাবে হত্যা করে। বঙ্গভবনে অবস্থানকারী বিপথগামী সেনা কর্মকর্তারা যখন দেখল মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তির পাল্টা অভ্যুত্থান ঠেকানো যাচ্ছে না তখন তারা জেলখানায় বন্দি চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করার পরিকল্পনা করে এবং নির্মমভাবে তা বাস্তবায়ন করে। এই হত্যাকা-ের জন্য খন্দকার মোশতাকের অনুমোদন ছিল। হত্যাকারীরা জেলখানায় যাওয়ার পর জেলার তাদের বাধা দিয়েছিলেন। পরে জেলার মোশতাকের সঙ্গে কথা বললে তিনি (মোশতাক) বলেন, তারা যা করতে চায় তা করতে দিন। কোনো ধরনের বাধা দেবেন না। জেল হত্যাকা- কোনো কাকতালীয় ঘটনা ছিল না। এটি ছিল একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা বা ষড়যন্ত্রেরই অংশ। উল্লেখ্য, মেজর ফারুক ও রশীদ দুই মাস আগে পাল্টা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হলে কারাগারে বন্দি চার নেতাকে হত্যার পরিকল্পনা করে। এই পরিকল্পনায় খন্দকার মোশতাকের সম্মতি ছিল। তখন বঙ্গভবনেই থাকত ফারুক, রশীদরা। এমনকি রশীদ রাষ্ট্রপতির মর্যাদার গাড়িটিও ব্যবহার করতেন।
৩ নভেম্বর ভোররাতে ডিআইজি প্রিজন বঙ্গভবনে ফোন করলে রশীদই ফোন ধরেন। রশীদ খন্দকার মোশতাকের কাছে ফোনের রিসিভার হস্তান্তর করেন। মোশতাক ফোন ধরে বেশ কিছুক্ষণ শান্তভাবে শুনে বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ। উপায়ান্তর না দেখে মোসলেউদ্দিনও তার দলকে আর বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেননি। তাজউদ্দীন আহমদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম এক সেলেই ছিলেন। পাশের অন্য সেলটিতে ছিলেন ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এএইচএম কামারুজ্জামান। তাদের একটি সেলে জড়ো করে গুলি করে হত্যা করা হয়। তিনজন সঙ্গে সঙ্গে মারা যান। অবশেষে রক্তক্ষরণে মারা যান তাজউদ্দীন আহমদ। অভ্যুত্থানকারীরা এই চার নেতাকে বাঁচিয়ে রাখাটাকে নিরাপদ মনে করেনি। তাই তাদের হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা আর জেলহত্যা একই সূত্রে গাঁথা। জেল হত্যাকা-ের মাধ্যমে হত্যার রাজনীতি শেষ হয়নি।
বর্তমানে যে জঙ্গিবাদের উত্থান লক্ষ করা যাচ্ছে এদের টার্গেটও কিন্তু প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাজার বছরের শাশ্ব্ত বাঙালির চেতনা এবং মূল্যবোধ ধারণ করে চলেছেন। তিনি অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারক এবং গণতন্ত্রের মানসকন্যা। এসব কারণে জঙ্গিরা শেখ হাসিনাকেই বারবার টার্গেট করছে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ওপর বারবারই আঘাত এসেছে। এই আঘাত আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আরও শানিত করেছে। যে কোনো প্রতিবন্ধকতা এলেই জাতীয়তাবোধ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা শানিত হয়। কারণ সবকিছু স্বাভাবিকভাবে চললে সেখানে চেতনা ততটা কাজ করে না। কিন্তু প্রতিবন্ধকতা এলেই চেতনাবোধ জাগ্রত হয়। বারবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ওপর আঘাত এসেছে বলেই আমাদের দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ক্রমেই শানিত হচ্ছে।
লেখক: উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্রঃ আমাদের সময়