নিষ্ঠা, সততা ও সাহসের মূর্ত প্রতীক

1587

Published on সেপ্টেম্বর 28, 2020
  • Details Image

তোফায়েল আহমেদঃ

বাংলার গণমানুষের নন্দিত নেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭৪তম শুভ জন্মদিন উপলক্ষ্যে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীসহ দেশ-বিদেশের মানুষ করোনা মহামারিকালের মধ্যেই তার দীর্ঘায়ু কামনা করে দোয়া ও আশীর্বাদ করছেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের কোল আলো করে ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জ জেলার ছায়াসুনিবিড় টুঙ্গিপাড়া গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে তিনি জ্যেষ্ঠ। রাজনৈতিক পরিবারে জন্মগ্রহণের সুবাদে শৈশব থেকেই সংগ্রামী চেতনার সুমহান উত্তরাধিকার বহন করছেন। পিতার সংগ্রামী জীবনের আত্মত্যাগ কাছ থেকে দেখেছেন শিখেছেন। ছাত্রলীগের নেত্রী শেখ হাসিনা ইডেন মহিলা কলেজের নির্বাচিত ভিপি হিসেবে ’৬৯-এর গণ-আন্দোলনে সক্রিয় সংগঠকের ভূমিকা পালন করেছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব প্রদানকারী দল আওয়ামী লীগকে দীর্ঘ ৩৯ বছর নিষ্ঠা, সততা ও সাহসের সঙ্গে নেতৃত্ব দিয়ে, অত্যাচার-অবিচার, জেল-জুলুম সহ্য করে, গণরায়ে অভিষিক্ত হয়ে চার বার সরকারে অধিষ্ঠিত হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনায় যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখেছেন। আগরতলা মামলায় জাতির জনক কারারুদ্ধ থাকাবস্থায় অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তিনি বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ব্যক্তিগত জীবনে আইটি বিশেষজ্ঞ পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় ও অটিজম বিশেষজ্ঞ কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের গর্বিত জননী তিনি।

১৯৭৫-এর মর্মন্তুদ ঘটনার পর আওয়ামী লীগ যখন ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছিল, তখন তিনি দলের হাল ধরেন। সমগ্র সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা তখন সামরিক শাসকের দুঃশাসনে নিপতিত। স্বৈরশাসনের অবসান ঘটাতে তিনি জাতিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ’৮১-র সম্মেলনে সবাই ধরে নিয়েছিল, আওয়ামী লীগ বিভক্ত হয়ে যাবে। আমরা জীবনপণ চেষ্টা করে সব ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দলের ঐক্য ধরে রেখে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ওপর দলের নেতৃত্বভার অর্পণ করে তার হাতেই তুলে দিয়েছিলাম আওয়ামী লীগের রক্তেভেজা সংগ্রামী পতাকা। ১৯৮১ সালের ১৩ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে অনেক আলাপ-আলোচনার পর জাতীয় ও দলীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে তার অনুপস্থিতিতে তাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। যেদিন তিনি প্রিয় মাতৃভূমিতে ফিরে এলেন সেদিন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা মনে করেছিলেন, শেখ হাসিনার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকেই ফিরে পেয়েছেন। ’৮১-র ১৭ মে নির্বাসন শেষে স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রিয় মাতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তন করেন। যেদিন প্রিয় নেত্রী স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন, সেদিন শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছিল না, ছিল সর্বব্যাপী সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দুর্যোগ। মাত্র ৩৪ বছর বয়সে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি স্বেচ্ছায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আসেননি। দলীয় ও জাতীয় ঐক্যের বৃহত্তর ও মহত্তর প্রয়োজনে তার আগমন এবং নেতৃত্ব গ্রহণ। নেতৃত্ব গ্রহণের পর তাকে বারবার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। মৃত্যু ঝুঁকি নিয়েই তিনি রাজনীতি করছেন। কোনো পদ বা ক্ষমতা নয়, বরং পিতার মতোই বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতেই দলীয় নেতাকর্মীদের প্রস্তাবে শহিদের রক্তে ভেজা দলীয় ও জাতীয় পতাকা স্বহস্তে তুলে নিয়েছেন। প্রমাণ হয়েছে সেদিনের কাউন্সিল অধিবেশনে গৃহীত আমাদের সিদ্ধান্তটি ছিল ভবিষ্যতের জন্য অপরিহার্য। নব প্রজন্মের অনেকেরই জানা নেই কত আত্মত্যাগ আর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ আজ রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পালন করছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে আমরা যদি দেশের উন্নয়নের দিকে তাকাই তাহলে দেখব, বিস্ময়কর উত্থান এই বাংলাদেশের। ‘বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট’ উেক্ষপণের মাধ্যমে ৫৭তম দেশ হিসেবে আমরা স্যাটেলাইট ক্লাবের গর্বিত সদস্য হয়েছি। এর আগে পরমাণু বিদ্যুেকন্দ্রের প্রথম ইউনিটের লাইসেন্স প্রাপ্তির মাধ্যমে ‘নিউক্লিয়ার নেশন’ হিসেবে আমরা বিশ্ব পরমাণু ক্লাবের সদস্য হয়েছি। আমাদের রিজার্ভ সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করে ৩৯ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। সেবা খাতসহ দেশের রপ্তানি আশাতীতভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৯ থেকে আজ পর্যন্ত ১১ বছর তার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত। অনেক বড় প্রকল্প তার নেতৃত্বে সমাপ্তির পথে এগিয়ে চলেছে। পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন বন্ধ করার পরেও দৃঢ়তার সঙ্গে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করে আজ তা সমাপ্তির পথে। সামগ্রিক আর্থসামাজিক উন্নতি ও সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠনের এসব কৃতিত্বের জন্য জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এ পর্যন্ত বহু আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত করেছে। জাতির জনকের পদাঙ্ক অনুসরণ করে জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধু কন্যার প্রিয় মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা প্রদান বাংলাদেশকে বিশ্বে মর্যাদার আসনে আসীন করেছে। দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এত উন্নয়নমূলক কাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং হচ্ছে যা এই ক্ষুদ্র লেখায় প্রকাশ করা অসম্ভব। মানবসূচক উন্নয়নে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় বিস্মিত জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন বলেছেন, ‘অন্যান্য স্বল্পোন্নত দেশের উচিত বাংলাদেশকে অনুসরণ করা।’ সামাজিক জীবনের সব ক্ষেত্রেই আজ আমরা এগিয়ে চলেছি। শিক্ষার হার বেড়েছে, দারিদ্র্যের হার কমেছে, শিল্প ও কৃষিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে, নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে, মাতৃমৃত্যু ও নবজাতকের মৃত্যুহার কমেছে। ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশে করোনা মহামারিও তার নেতৃত্বে সফলভাবে মোকাবিলা করা হচ্ছে। বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত গ্রামগুলো আজ শহরে রূপান্তরিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক বিশ্বে আমরা যখন যাই, তখন আমাদের যারা একদিন তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে বলেছিল, ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’, আজ তারাই বলে, ‘বিস্ময়কর উত্থান বাংলাদেশের’।

বাংলাদেশের বিস্ময়কর উত্থানের স্থপতি শেখ হাসিনা নিয়মিত পড়াশোনা করেন। ক্যাবিনেট মিটিংগুলোতে যথাযথ হোমওয়ার্ক করে সার্বিক প্রস্তুতি নিয়ে মিটিংয়ে আসেন। একনেক বা ক্যাবিনেট মিটিংয়ের দু-এক দিন আগেই মিটিংয়ের আলোচ্যসূচি, প্রস্তাবাবলি ফাইলে দেওয়া হয়। যখন একটি বিষয় প্রস্তাব আকারে পেশ করা হয় তখন সেই বিষয়ের খুঁটিনাটি সমস্ত বিষয় তিনি সভায় সবিস্তারে তুলে ধরেন এবং সঠিকভাবে প্রতিটি প্রস্তাবের ওপরে সুচিন্তিত মতামত ব্যক্ত করেন। তার এই অবাক করা প্রস্তুতি আমাদের মুগ্ধ করে। সারা দিন তিনি কাজ করেন। ভীষণ পরিশ্রমী, হাস্যোজ্জ্বল এবং আবেগময়ী মানুষ তিনি। ধর্মপ্রাণ হিসেবে প্রতি প্রত্যুষে তাহাজ্জুদ ও ফজরের নামাজ আদায় করে তবেই তিনি দিনের কাজ শুরু করেন। পিতার মতোই গরিবের প্রতি তার দরদ অপরসীম। বঙ্গবন্ধুর ফান্ড আমার কাছে থাকত। তিনি গরিব-দুঃখী মানুষকে অকাতরে সাহায্য করতেন। আমাকে নির্দেশ দিতেন—তাদের সাহায্য করো। জাতির পিতার কন্যার কাছে গরিব-দুঃখী মানুষ যখন হাত পাতে পিতার মতো তিনিও তাদের সাহায্য করেন। আমাদের দেশে যারা বুদ্ধিজীবী-কবি-সাহিত্যিক-সমাজসেবক, তাদের বিপদ-আপদে পাশে দাঁড়ান তিনি। একাধিক গ্রন্থের প্রণেতা শেখ হাসিনা একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক। রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে বহু পুরস্কার ও খেতাবে তিনি বিভূষিত। পিতা-মাতার মতো সাদামাটা জীবনে অভ্যস্ত শেখ হাসিনা সংস্কৃতিমান এবং খাঁটি বাঙালি নারী। বাংলার মানুষের প্রতি তার দরদ-মমত্ববোধ, তার জ্যোতির্ময় পিতার চেতনা থেকেই আহরিত। তবে এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে, তিনি কেবল বঙ্গবন্ধুকন্যা হিসেবে পরিচিত; বরং আপন যোগ্যতায় স্বমহিমায় বাংলার কোটি মানুষের হূদয়ে তিনি অধিষ্ঠিত। শুধু বাংলাদেশের রাষ্ট্রনায়ক নন, আন্তর্জাতিক নেতা হিসেবে ইতিমধ্যে বিশ্বজনমত ও নেতৃবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণে তিনি সক্ষম হয়েছেন।

২০০৮-এর নির্বাচনে রূপকল্প তথা ভিশন-২০২১ ঘোষণা করেছিলেন তিনি। যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ হবে ডিজিটাল বাংলাদেশ এবং মধ্যম আয়ের দেশ। ডিজিটাল বাংলাদেশ আজ স্বপ্ন নয়, বাস্তব। ইতিমধ্যে আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশে রূপান্তরিত হয়েছি। করোনার কারণে সীমিত পরিসরে এ বছরের ১৭ মার্চ থেকে বর্ষব্যাপী জাতির জনকের জন্মশতবার্ষিকী তথা ‘মুজিববর্ষ’ সগৌরবে পালিত হচ্ছে। ২০২১-এ যখন স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি হবে, তখন আমরা পরিপূর্ণভাবে মধ্যম আয়ের দেশে প্রবেশ করে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এক অনন্য উচ্চতায় তুলে ধরব। এসব অর্জন সম্ভবপর হয়েছে তার গতিশীল নেতৃত্বের কারণে। জাতির পিতা দুটি লক্ষ্য নিয়ে রাজনীতি করেছেন। একটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা, আরেকটি অর্থনৈতিক মুক্তি। তিনি আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছেন কিন্তু অর্থনৈতিক মুক্তি দিয়ে যেতে পারেননি। সেই কাজটি দক্ষতা, নিষ্ঠা, সততা ও সাহসের সঙ্গে সম্পন্ন করে দেশকে তিনি অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছেন। সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন তার নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশ হবে মর্যাদাশালী ক্ষুধামুক্ত দারিদ্র্যমুক্ত বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা। বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে নিবেদিত প্রিয়নেত্রী শেখ হাসিনার শুভ জন্মদিনে তার নীরোগ ও দীর্ঘজীবন কামনা করি।

লেখক :আওয়ামী লীগ নেতা; সংসদ সদস্য; সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ

সৌজন্যেঃ দৈনিক ইত্তেফাক 

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত