আগস্ট ট্র্যাজেডি ও বাংলাদেশে হত্যার রাজনীতি

2598

Published on আগস্ট 18, 2020
  • Details Image

মিজানুর রহমান খান:

ব্রিটিশ-ভারতে ভারতবাসীর ভুল রাজনীতির ফসল বর্তমান ভারত-উপমহাদেশে ক্রমাগত সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উত্থান। এ অঞ্চলের প্রধান তিনটি দেশ হিন্দুত্ব আর মুসলমানত্বের দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগছে সেই ১৯৪৭ সাল থেকে। যে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মুসলমান একদিন পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্য আন্দোলন করেছিলো, সেই একই বাঙালি মুসলমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য সংগ্রাম করেছে দীর্ঘ চব্বিশ বছর। ঐতিহাসিক সেই আন্দোলন-সংগ্রামের অকুতোভয় দার্শনিক নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। একদা পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্য আন্দোলন এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রের মধ্যে থেকেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য বাঙালির যে আন্দোলন সে আন্দোলনের ইতিহাস সবারই জানা। তবু বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে বলতে গেলে পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ইতিহাসের কথা প্রসঙ্গক্রমে চলে আসে। আর অনিবার্যভাবে চলে আসে হত্যার রাজনীতির কথা।

এক

১৯৪৮ সালেই বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন যে, আমরা যা চেয়েছিলাম তা হলো না। হলো জোড়াতালি দেওয়া এক বিকৃত রাষ্ট্র পাকিস্তান। তৎকালীন পূর্ব-বাংলার বাঙালি হয়ে ক্রমশ তিনি ভাবতে থাকেন এবং রাজনৈতিক সমাধানের প্রশ্নে থাকেন অটল। ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠন তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণ স্বাভাবিকভাবে নেয়নি। পশ্চিম পাকিস্তানিদের দমননীতি আর বঞ্চনার রাজনীতির বিরুদ্ধে ক্রমশ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ সংগঠিত হতে থাকে। তখন উদীয়মান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রত্যেকটি সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে। ফলে পশ্চিম পাকিস্তানিদের শাসনবিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলন শাণিত হতে থাকে। সংগ্রামের প্রথম পদক্ষেপে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন রাজনৈতিক আন্দোলনের মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে এ অঞ্চলের জনমানসে প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ হয়। কারণ আত্মপরিচয়ের সূত্রে আত্মানুসন্ধানে ব্যাপৃত সাড়ে সাত কোটি মানুষ প্রথমেই তার আত্মপরিচয়ের জায়গাটি স্পষ্ট করে নিয়েছিলো। ওই নির্ভুল সিদ্ধান্তের ফলে বাঙালি তার জাতিরাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়ায় রেখেছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

সাংস্কৃতিক পরিচয় স্পষ্ট হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছিলেন। সেটি হলো ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ নাম সংশোধন করে ‘মুসলিম’ শব্দ বাদ দিয়ে পার্টির নামকরণ করেন ‘আওয়ামী লীগ’। অর্থাৎ প্রথমেই পার্টির নামটাকে অসাম্প্রদায়িকরূপে প্রতিষ্ঠা করা। কারণ তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানে ছিলো হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ও অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠীর বাস। এই মাটির যারা আদিম মানুষ তাদের নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য, ভাষা ও সংস্কৃতির কথা বিবেচনা করে শতকরা নব্বই ভাগ মুসলমান-অধ্যূষিত জনপদে পার্টির অসাম্প্রদায়িক নাম রাখা একজন প্রকৃত রাজনৈতিক নেতারই দূরদর্শিতা, উদারতা ও মানবতার পরিচায়ক। ভাষা-আন্দোলন-পরবর্তী তৎকালীন পাকিস্তানের রাজনীতি ছিলো সর্বৈব উত্থান-পতনময় এবং অন্যায়-অবিচারে পূর্ণ। ফলে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের হয়েছিল ভরাডুবি। ভাষার প্রশ্নে বাঙালির প্রথম বিজয় ১৯৫২ সালে। আর বিধিবদ্ধ জাতীয় নির্বাচনে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্টের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন বাঙালির দ্বিতীয় বিজয়। পাকিস্তান রাষ্ট্রের শুরুতেই বাঙালির এই যে বিজয় এ-বিজয় পাকিস্তানবিরোধী স্বাধীনতাকামী বাঙালির বিজয়। এ বিজয় তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের মানুষের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছিলো। তারা অনুধাবন করতে শুরু করেছিলো এই ভূখণ্ড আমাদের এবং বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। এ প্রসঙ্গে গবেষক গোলাম মুরশিদের বক্তব্য অনুধাবনীয়— “সত্যিকার অর্থে ভাষা আন্দোলনের পর কেবল ভাষা এবং সাহিত্য সম্পর্কেই মানুষের মনোভাব বদলে গেলো না, মনোভাব বদলে গেলো পাকিস্তান সম্পর্কেও। পাকিস্তান হওয়ার পর বাঙালি মুসলমানরা সেই দেশে তাঁদের সব ইচ্ছে পূরণের স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের পর তাঁরা নিজেদের সত্যিকার অবস্থান বুঝতে পারলেন। বুঝতে পেরে হতাশ হলেন। তাছাড়া, ভাষা আন্দোলন তাঁদের মনে যে-গণতান্ত্রিক চেতনার জন্ম দিয়েছিলো, তা রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক নিপীড়ন এবং শোষণ সম্পর্কেও তাঁদের সচেতন করলো।”

দুই

এরপর বাঙালিদের আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৯৫৩ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত পার্টির নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর থাকা ছিলো যেমন নিয়মতান্ত্রিক, তেমনই সময়োপযোগী। ১৯৬৬ সালের ছয় দফা এবং ১৯৬৮-৬৯ সালের ১১ দফা পাঠ করলে বোঝা যায় বাংলাদেশ নামক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনই কেবল নয়, বাংলাদেশ হবে ধর্মনিরপেক্ষ আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। দফাভিত্তিক এই রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রতি সাধারণ মানুষের ছিল স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন। সেখানে ভবিষ্যতের জাতিরাষ্ট্র এবং স্বাধীনতার ইঙ্গিত ছিল পরিষ্কার। বঙ্গবন্ধুর প্রতি সাধারণ মানুষের ভালোবাসা এবং অপরিসীম শ্রদ্ধার মূল কারণ ছিলো তাঁর আপসহীন রাজনীতি তথা নির্ভুল নেতৃত্ব। এ-কারণে ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে দিশেহারা পশ্চিম পাকিস্তানিরা সাধারণ নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। আবারও পরাজিত হয় পশ্চিম পাকিস্তানিরা। তখন থেকেই পাকিস্তানিরা মূলত বুঝে ফেলে পূর্ব-পাকিস্তান নামক ভূ-খণ্ড হাতছাড়া হবে অনিবার্যভাবে। দেশ ভাগ হলেও বাংলাভাষী মানুষের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়ার হার্দিক মূল্য এবং ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পরিণামী সত্য পশ্চিম পাকিস্তানিদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের দিকে নিয়ে যায়। কারণ ভূ-রাজনৈতিক তাৎপর্য সম্পর্কে পশ্চিম পাকিস্তানিরা যথেষ্ট অবহিত ছিলো।

১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের ভাষণে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ উচ্চারণের মধ্য দিয়েই মূলত মুক্তিযুদ্ধের শুরু। চব্বিশ বছরের আন্দোলন-সংগ্রাম-কারাবরণ-নেতৃত্ব-নির্বাচনে জয়লাভ এবং মুক্তিযুদ্ধের তথা স্বাধীনতার ঘোষণা সবই যেন স্তরীভূত এক বিশাল কর্মযজ্ঞ, যে কর্মযজ্ঞের কেন্দ্রে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। অথবা তিনিই ছিলেন কেন্দ্র। সুতরাং সড়ে সাত কোটি মানুষ সেদিন আবর্তিত হয়েছিল নিয়তির মতো। রেসকোর্সের মঞ্চের তর্জনী উঠলে সাড়ে সাত কোটি উঠে দাঁড়ায়, আর তর্জনী নামালে সাড়ে সাত কোটি বসে পড়ে। রাজনীতির এমন যাদুকর বাংলার মানুষ কখনো দেখেনি। এমন মানুষকে সাধারণ বাঙালির মাঝে ছেড়ে দিয়ে পূর্ব-পাকিস্তান শাসন করা বেল্লিকপনার শামিল মনে করেছিলো পশ্চিম পাকিস্তানিরা। সুতরাং ২৫শে মার্চের মধ্যরাতে বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হলেন পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যাওয়া হলো পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে। অন্যদিকে পূর্ব-পাকিস্তানের মানুষের ওপর চালানো হলো ব্যাপক অত্যাচার। নির্যাতন, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, ধর্মান্তরকরণ ও হত্যা-ধর্ষণে বিধ্বস্ত বাংলাদেশ ও বাঙালি সেদিন প্রতিরোধযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দীর্ঘ নয় মাসের সশস্ত্র যুদ্ধে সেদিন বাংলাদেশকে প্রভূত সাহায্য করেছিলো ভারত এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন। তিরিশ লক্ষ জীবন ও তিন লক্ষ নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে বাঙালি পেয়েছে পরম কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে নয় মাস যুদ্ধ করেছে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা। পক্ষান্তরে এ দেশের কিছু সংখ্যক দালাল যারা রাজাকার, আলবদর ও আল শামস বাহিনী গঠন করে পাকিস্তানি সৈন্যদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করেছে।

তিন

যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু ফিরে এলেন ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি। দেশ গড়ার কাজে হাত দিলেন তিনি। দেশ পরিচালনার জন্য প্রথমেই দরকার হলো অর্থের এবং একটি সংবিধানের। বিশ্বের অনেক দেশ সেদিন সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিল সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের জন্য। খুব অল্প সময়ের মধ্যে সংবিধান প্রণয়ন করা হলো যে সংবিধান ছিলো বিশ্বের যে কোনো আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সংবিধানের সমতুল্য। সেই সংবিধানের চারটি মূল স্তম্ভ ছিলো জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। একটি নতুন রাষ্ট্র কী উপায়ে গতিশীল হবে এবং বিশ্বসভায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকবে তার সমস্ত পরিকল্পনা বঙ্গবন্ধুর মধ্যে ছিলো। কিন্তু সেসব বুঝতে পেরেছিলো পাকিস্তানসহ অন্যান্য দেশ, যারা স্বাধীনতা অর্জনের পরও দীর্ঘদিন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। দেশের অভ্যন্তরে ঘাপটি মেরে থাকা বাংলাদেশবিরোধী কিছু সেনা কর্মকর্তা বহিঃশক্তির যোগসাজসে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরিকল্পনা করতে থাকে। এ পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯৭৫ সালের মার্চ মাসে একবার হত্যাপ্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এরপর ১৫ই আগস্ট ভোররাতে সপরিবার হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধুকে। এ হত্যাকাণ্ডে কোনো বিদেশি সৈনিক অংশ নেয়নি বা অপারেশন চালায়নি। পরিকল্পনামাফিক সরাসরি ট্রিগার টিপে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছে বাংলাদেশেরই লোক। বঙ্গবন্ধু থেকে শিশু রাসেল, এমনকি গর্ভবতী নারীও ঘাতকের বুলেটে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। ১৫ই আগস্ট রাতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি পরিণত হয় রক্তগঙ্গায়। বিদেশে অবস্থান করায় নির্মম সেই হত্যাকাণ্ড থেকে সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।

চার

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের শেষ সময়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালি বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করে। রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সহায়তায় শিক্ষক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, চিকিৎসক ও প্রকৌশলীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাঁদের চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে যায় বিভিন্ন বধ্যভূমিতে হত্যার নীলনকশা অনুযায়ী। এই ঘটনা সংঘটিত হয় ১৬ই ডিসেম্বরের ঠিক দুয়েকদিন আগে। কারণ পাকিস্তানি সৈন্যরা জানতে পারে যে ১৬ই ডিসেম্বর তাদের আত্মসমর্পণ করতে হবে। সুতরাং শেষ মুহূর্তের শেষ হত্যাযজ্ঞে তারা মেতে ওঠে। দেশ স্বাধীনের পরও এই শক্তি তৎপর ছিলো বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে। তারা চেয়েছে পাকিস্তানি ভাবধারায় বাংলাদেশকে পরিচালিত করতে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরপর পাকিস্তান এবং পাকিস্তানের দালালদের তৎপরতা তাই-ই প্রমাণ করে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরপরই রেডিও-তে ঘোষিত হয়— “আমি মেজর ডালিম বলছি। স্বৈরাচারী শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। জননেতা খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে। দেশে সামরিক আইন জারি করা হয়েছে এবং সারাদেশে কারফিউ জারি করা হয়েছে। বাংলাদেশ এখন থেকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র” (সূত্র : ইন্টারনেট)। মেজর ডালিমের এই ঘোষণা হাওয়া থেকে পাওয়া নয়। পাকিস্তানের সঙ্গে হত্যাকারীদের যোগাযোগ ছিলো ঘনিষ্ঠ। তাই বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তান সরকারের পক্ষে ভুট্টো যে বিবৃতি দেয় তাতে বাংলাদেশকে ‘ইসলামী প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য বিশ্বের দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হয়। ভুট্টোর উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়— As a first and spontaneous gesture to the fraternal people of Bangladesh, I have decided to immediately dispatch to Bangladesh as a gift from the people of Pakistan 50,000 tons of rice, 10 million yards of long cloth and five million yards of bleached mull. This is only a modest contribution of our people to our brothers in Bangladesh in their hour of need. We are prepared to make a greater contribution within our greater capacity for the well-being of the people of Bangladesh with whom we have shared common nationhood and destiny. Let the world know that we stand together in weal and woe. We respectfully urge the state members of the Islamic conference of the Islamic Republic of Bangladesh and we appeal to all countries of the third world to do likewise. This appeal stems from our country has dismembered by an international conspiracy culminating in aggression. (সূত্র: ইন্টারনেট)

বাংলাদেশকে ‘ইসলামী প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ হিসেবে স্বীকৃতি দানের ভুট্টোর আহ্বান পরবর্তীকালে ভেস্তে যায়। কিন্তু খন্দকার মোশতাক কর্তৃক বাংলাদেশকে পাকিস্তানিকরণের উদ্যোগগুলো পরবর্তীকালে কাজে লাগান সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান। যেমন ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দ উচ্চারণ না করা, ভাষণে ‘জয়বাংলা’ না বলা এমনকি ‘জয়বাংলা’ স্লোগানও নিষিদ্ধ করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ বলা, বাংলাদেশ বেতারের পরিবর্তে ‘রেডিও বাংলাদেশ’ বলা পুরনো পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার অপচেষ্টার প্রমাণ। এতদ্ব্যতীত জেনারেল জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক বানানোর অপচেষ্টাও করা হয় এবং স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে তা মুদ্রিতও হয়।

পাঁচ

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরপরই অর্থাৎ ২৬ সেপ্টেম্বর স্বঘোষিত ও অবৈধ রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ ৫০/১৯৭৫ জারি করে। “অধ্যাদেশটিতে দুটি ভাগ রয়েছে। প্রথম অংশে বলা হয়েছে, ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট ভোরে বলবত আইনের পরিপন্থী যা কিছুই ঘটুক না কেন, এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টসহ কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না। দ্বিতীয় অংশে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি উল্লিখিত ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত যাদের প্রত্যয়ন করবেন তাদের দায়মুক্তি দেওয়া হলো।” (সূত্র : ইন্টারনেট)। এ অধ্যাদেশ ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক ও মানবিক সংকট শুরু হয় সে সংকটের সর্বোচ্চ সুবিধাভোগী ব্যক্তি হলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান।

১৯৭৭ সালের ২২ এপ্রিল এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তৎকালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সায়েমকে সরিয়ে জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করেন। ক্ষমতা দখল করার পর যে রাজনৈতিক দল তিনি গঠন করেন তার নাম দেন ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল’। অতীতের মুসলিম লীগ, চীনপন্থী কমিউনিস্ট, অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা এবং মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানিদের প্রত্যক্ষ সহচর জামায়াতপন্থীদের তিনি তার দলে জায়গা দেন এবং নেতৃত্বে বসান। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের পুনর্বাসিত করার লক্ষ্যে তাদের বিদেশে বাংলাদেশ মিশনে চাকরি দেন। এসব কর্মকাণ্ডের ফলে ১৯৭১ সালে যারা বাংলাদেশ-বিরোধী ছিলো তারা রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়। জেনারেল জিয়াউর রহমান আরও যে কাজটি করেন তা হলো- সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ যুক্ত। এও এক মানবতাবিরোধী অপরাধ। কারণ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্য যারা সুপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন তাঁদের পক্ষে কেউই আদালতে কোনো বিচার চাইতে পারবে না। এ রকম একটি নিষ্ঠুর ও অমানবিক অধ্যাদেশ যে সংসদে তফসিলভুক্ত হয়েছিলো সে সংসদের সকলেই মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত হতে পারেন।

মনে পড়ে ১৯৭৮ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের জেলায় জেলায় আওয়ামী লীগের কর্মীরা সন্ধ্যার পর নিয়মিত ঝটিকা মিছিল করতো। সে সব মিছিল থেকে গ্রেফতার হতো আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। চলতো তাদের ওপর পুলিশি নির্যাতন। সে সময়ে বাংলাদেশের সর্বত্র দেয়ালে দেয়ালে লেখা থাকতো একটি কথা- “জাতি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার চায়।” এরপর ১৯৮১ সালে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে সামরিক শাসক জেনারেল জিয়া হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। ওই বছরই রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে বিচারপতি আব্দুস সাত্তার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তিনি বেশিদিন ক্ষমতায় থাকতে পারেননি। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ বন্দুকের নল ঠেকিয়ে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করেন আরেক সামরিক শাসক জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ঠিক এ সময় থেকেই আওয়ামী লীগের গণতান্ত্রিক আন্দোলন পুনরায় বেগবান হয়। পূর্বের সে দেয়াল লিখনের ভাষায় পরিবর্তন আসে। আগে দেয়াল লিখন ছিলো- “জাতি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার চায়।” পরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের জন্য দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত হয় এভাবে- “জাতি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করবেই।”

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালের ১৭ মে বাংলাদেশে ফিরে আসেন এবং আওয়ামী লীগের হাল ধরেন। পার্টিকে নেতৃত্ব দিয়ে দেশের নেতাকর্মীদের উদ্যমী করে তোলেন। আশির দশক জুড়ে সামরিক স্বৈরাচার-বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে সমাবেশে যাওয়ার পথে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার গাড়িবহরে জেনারেল এরশাদের পুলিশবাহিনী এলোপাতাড়ি গুলি চালালে ২৪ জনের মৃত্যু হয়। ওই সময় আসলে শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্যই পুলিশ গুলি চালিয়েছিল। তারপরও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ একের পর এক নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনের পর ১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করে শেখ হাসিনা সরকার গঠন করেন। কিন্তু তার আগের সরকারের আমলে রাজনীতিতে পুনর্বাসিত মৌলবাদী শক্তি দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা অব্যাহত রাখে। এরই ধারবাহিকতায় ১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ যশোর টাউন হল মাঠে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর দ্বাদশ জাতীয় সম্মেলনে শক্তিশালী বোমা হামলা চালায় মৌলবাদী জঙ্গিগোষ্ঠী। বোমার আঘাতে শিল্পীসহ ১০ জন নিহত হন। আহত হয় শতাধিক মানুষ। ২০০১ সালের নির্বাচনে জামাত-বিএনপি (জামায়াত ছিলো বাংলাদেশবিরোধী, আর বিএনপি’র জন্ম হয় ১৯৭৭ সালে।) গাটছাড়া বেঁধে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনকে ব্যবহার করে নির্বাচনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে এবং ক্ষমতায় আসে। এছাড়া ২০০০ সালে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় শেখ হাসিনার জনসভায় বোমা পেতে রাখা হয়। এরপর ২০০১ সালের ২০ জানুয়ারি সিপিবি সমাবেশে বোমা হামলা হয়। ওই হামলায় পাঁচজনের মৃত্যু হয়। একই বছর ১৪ই এপ্রিল বাংলা নববর্ষের দিন রমনা বটমূলে বোমা হামলা চালায় জঙ্গিগোষ্ঠী। ওই হামলায় ১০ জনের মৃত্যু হয়। যেগুলোতে বিএনপি-জামায়াতের জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ করে। এরপর ২০০৪ সালে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা ও ২০০৫ সালের অগাস্টে দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলা হয়। এছাড়া ২০০৪ সালের ৭ মে দুপুরে একদল সন্ত্রাসী টঙ্গীর নোয়াগাঁও এমএ মজিদ মিয়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে প্রকাশ্যে গুলি ছুড়ে হত্যা করে আওয়ামী লীগ নেতা আহসানউল্লাহ মাস্টারকে। আর ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জ সদর উপজেলার বৈদ্যের বাজারে আওয়ামী লীগের ঈদ-পরবর্তী জনসভা থেকে বের হওয়ার পথে গ্রেনেড হামলার শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেন সাবেক অর্থমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা শাহ এ এম এস কিবরিয়া।

অতঃপর ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করে। বস্তুত বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা পার্টির নেতৃত্বে আসেন বলে পার্টি টানা তিনবার ক্ষমতায় এসেছে এবং তিনি সরকার-প্রধান বলেই বিচারহীনতার সংস্কৃতির বিপরীতে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় কাজ করে চলেছেন। এমনকি তাঁরই নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার, জেলহত্যা মামলার বিচার এবং মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের রায় কার্যকর করাও সম্ভবপর হয়েছে।

ছয়

বাঙালি নিধনের যে রাজনীতি করে গেছে পাকিস্তানীরা, মূলত সেই সংস্কৃতিই আজও লালন করে চলেছে বাংলাদেশ-বিরোধীরা। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দেশপ্রেমিক বাঙালিদের হত্যা, মুক্তিযুদ্ধোত্তরকালে সপরিবার বঙ্গবন্ধু হত্যা, জাতীয় চার নেতাকে জেলখানায় অন্তরীণ অবস্থায় হত্যা, জেনারেল জিয়া কর্তৃক মুক্তিযোদ্ধা, সামরিক অফিসার হত্যা, জামাত-শিবির কর্তৃক প্রগতিশীল ছাত্র ও শিক্ষক হত্যা, পেট্রোল বোমা দিয়ে অসংখ্য নিরীহ মানুষ হত্যা- এসবের সঙ্গে সম্পৃক্ত ধর্মান্ধ মৌলবাদী গোষ্ঠী যারা সবসময় আওয়ামী লীগ-বিরোধী, বাংলাদেশে বসবাসরত হিন্দু-বিরোধী, ভারতবিরোধী এবং কার্যত স্বাধীনতা-বিরোধী। এই অপশক্তিই বারবার বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করে যাচ্ছে। ২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা করে শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করে। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হওয়ায় তিনি বেঁচে যান। কিন্তু ওই হামলায় নিহত হন আওয়ামী লীগের ২৪ জন নেতাকর্মী। একেকজনের দেহ সেদিন ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় গ্রেনেডের আঘাতে। তবু রক্তপায়ী পলিটিকাল হায়েনারা থামে না। অন্যদিকে রাজনীতিকে মানুষের রাজনীতিতে পরিণত করার তাগিদ রাজনীতিবিদদের মধ্যে নেই। শিক্ষা ব্যবস্থায় মানবিকতা চর্চার সুদূরপ্রসারী কোনো পরিকল্পনা নেই। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা জড়বস্তুর মতো পড়ে আছে। তাদের কর্মকাণ্ডে সাধারণ মানুষ হতাশ এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে আজ দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। ক্ষমতার বিভিন্ন স্তরে আসীন ব্যক্তিবর্গ ক্ষমতার মোহে মশগুল। তারা কেনাবেচায় অধিক ব্যস্ত। এসবের সত্যতা মেলে বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার কথায়। তিনি বলেন- “শেখ হাসিনাকে ছাড়া আওয়ামী লীগের সব নেতাকে কেনা যায়।” (সূত্র : প্রথম আলো, অনলাইন ভার্সন, ১৪-০৯-২০১৪) রাজনৈতিক দলকে রাজনৈতিক দলের মতো করে বাঁচিয়ে তোলার চেষ্টা কারও মধ্যে নেই। অসুস্থ রাজনীতিকে সুস্থ করে তোলার কোনো পরিকল্পনা নেই রাজনীতিকদের মধ্যে। দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতির কারণে গোটা সমাজ আজ দুর্নীতিগ্রস্ত। দুর্নীতির করাল গ্রাস থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষার করার পদ্ধতি রাজনীতিকদেরই বের করা উচিত। এর কোনো বিকল্প নেই।

লেখক: শিক্ষাবিদ

সৌজন্যেঃ www.sarabangla.net 

 

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত