১৫ আগস্টের নিষ্ঠুরতম হত্যাকাণ্ডের পূর্বাপর রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকার পর্যালোচনা

1772

Published on আগস্ট 17, 2020
  • Details Image

শেখর দত্ত : পাকিস্তানি আমলের সুদীর্ঘ ২৪ বছরে জেল-জুলুম, ফাঁসির জন্য প্রতীক্ষা, লড়াই-সংগ্রাম করার ফলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নানাদিক থেকে শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। পাকিস্তানের বন্দিজীবন থেকে লন্ডনে এসে বিজয়ের সীমাহীন আনন্দের মধ্যেও ক্লান্ত ও অবসন্ন বঙ্গবন্ধু তার সাংবাদিক বন্ধু মাসকার্নহাসকে (১৯৫৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় বন্ধুত্ব হয়) বলেছিলেন, “আমার কিছু বিশ্রামের প্রয়োজন। আমি লন্ডনে কয়েকটা দিন বিশ্রাম নিতে চাই।” সকাল ১০টায় এ-কথাগুলো শেষ না-হতেই একে একে ৪টা ফোন একত্রে বেজে ওঠে। কলকাতার বাংলাদেশ মিশন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথ-এর সাথে তিনি শুভেচ্ছাবিনিময় করলেন। চার নম্বর ফোনটি ছিল একান্ত সহকর্মী প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের। মাসকার্নহাস ওই সময়ের কথা স্মরণ করে লিখেছেন, “এরই মধ্যে শেখ মুজিবের কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল যে, তিনি যদি শিগগির ঢাকা না পৌঁছান, তাহলে নবগঠিত সরকার দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যেতে পারে। এমনকি গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।”

কথাটার মধ্যে বাড়তি কিছু থাকতেই পারে। তবে এটাও ঠিক, বঙ্গবন্ধু ফিরে না এলে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সমর্পণ ও নিয়ন্ত্রণ কঠিনতর হতো। ভারতীয় সৈন্যদের ফিরে যাওয়াও সমস্যা ছিল। ১৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় ইপিআর (বিডিআর/বিজিবি)- মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিবিনিময়ের কথাও স্মরণ করা যেতে পারে। বাস্তবে বঙ্গবন্ধু একটুও বিশ্রাম নিতে পারেন নি। জাতি তাকে একদিনের জন্যও বিশ্রাম নিতে দেয়নি। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২, ঢাকা ফিরে এসেই তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত ও সমস্যা-সংকটপূর্ণ নবজাত দেশ পরিচালনার দায়িত্বভার তুলে নিয়েছিলেন। শাসনামলের তিন বছরের মধ্যে তিনি দুবার অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং যথাক্রমে লন্ডন ও মস্কো চিকিৎসার জন্য যান। উল্লিখিত সব আলোচনা থেকে সহজেই অনুধাবন করা যায়, কোন্ ধরনের বিশ্ব ও জাতীয় পরিস্থিতিতে এবং শারীরিক অবস্থায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐকান্তিক ও নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা চালিয়ে দেশকে ‘গণতন্ত্রের পথে সমাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এগিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো ছিল হাজার বছরের এই শ্রেষ্ঠ বাঙালির একমাত্র লক্ষ্য। সে-লক্ষেই বঙ্গবন্ধু নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে অগ্রসর হতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নিয়েছিলেন।

২৪ জানুয়ারি ১৯৭২, অস্ত্র সমর্পণ অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশে তিনি বলেছিলেন, “আমি তিন বছর তোমাদের কিছু দিতে পারবো না। আরো তিন বছর যুদ্ধ চললে, তোমরা যুদ্ধ করতে না।” উত্তর এসেছিল ‘করতাম, করতাম’। তুমুল হাততালি পড়েছিল। কিন্তু জাতির অবিসংবাদিত নেতাকে মুক্তিযোদ্ধাসহ দেশবাসী তেমনভাবে সাহায্য করতে পারেনি, ঐক্যবদ্ধভাবে দৃঢ়তা নিয়ে পাশে দাঁড়াতে পারেনি। জাতি হিসেবে নেতাকে সামনে রেখে ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত প্রতিহত করে আমরা আমাদের অসমাপ্ত মুক্তি-সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে পারিনি। সংসদীয় গণতন্ত্র আর দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর কর্মসূচির পিছনে একদিকে দল ও সরকারের অভ্যন্তরে ‘চাটার দল’ আর অন্যদিকে উগ্রবাম ‘রাতের বাহিনী’ ছুরিকাঘাত করেছে। দল ও সরকারের ভেতরের-বাইরের একাংশের গণবিরোধী কর্মকাণ্ড বঙ্গবন্ধুকে অগ্রসর হতে দিচ্ছিল না বলেই তিনি তখনকার বিশ্ব-বাস্তবতায় এক দল ‘বাকশাল’ গঠন করেছিলেন। পরিস্থিতি উন্নতি হতে থাকলে সময় না দিয়ে তাকে নিষ্ঠুরতমভাবে হত্যা করা হয়। জাতির পিতাকে আমরা বাঁচিয়ে রাখতেও পারিনি। জীবন দিয়ে তিনি বাঙালি জাতিকে রক্তঋণে আবদ্ধ করে গেছেন। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে সাড়ে তিন বছর আর নিহত হওয়ার পরের দিনগুলোর রাজনৈতিক দল ও সংগঠনগুলোর অবস্থান ও ভূমিকা বিবেচনায় নিলেই এ সত্য সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে।

এটা বিষাদময় ও তিক্ত বিষয়ে আলোচনায় যাওয়ার সময় রাজনীতির স্বতঃসিদ্ধ এ-কথা স্মরণে রাখতে হবে যে, চলমান রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতের টানাপড়েন ও প্রভাবে শত্রু হতে পারে মিত্র আবার মিত্রও হতে পারে শত্রু। বাকশাল হওয়ার আগে যেসব দল ও নেতারা বঙ্গবন্ধু সরকারের সবৈব বিরোধিতা করেছেন, উৎখাত চেয়েছেন, অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টিতে প্রয়াসী হয়েছেন; সেসব দল ও নেতাদের কেউ কেউ বাকশাল সমর্থন করেছেন বা নতুন দলে যোগ দিয়েছেন। আবার বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ক্ষমতার পটপরিবর্তন হলে বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতায় ফিরে গেছেন। আরও আগ্রহোদ্দীপক বিষয় হচ্ছে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পরে যেসব দল ও নেতা বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের তীব্র বিরোধিতা করেছে, বাম হঠকারী বা উগ্রবাম অবস্থান নিয়ে তৎপর ছিল; তাদের অনেকে পরবর্তীতে ও বর্তমানে আওয়ামী লীগের সাথে রয়েছে, ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর অবস্থানও স্বীকার করে নিয়ে চলছে। আবার যারা পক্ষে ছিল, তারা এখন চরম বিরোধিতার লাইন নিয়েছে।

সর্বোপরি বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর যেসব আওয়ামী লীগ নেতা-মন্ত্রীরা মোশতাকের সাথে গিয়েছিলেন, তারা আবার দলে ফিরে এসেছেন। বলা বাহুল্য রাজনীতিতে এমন ডিগবাজির ঘটনা ঘটেই থাকে। তাই অতীত ঢেকে বর্তমানকে জায়েজ করে যেমন ইতিহাস বিকৃতি করা যথাযথ নয়, তেমনি তা কোনো দেশপ্রেমিক রাজনীতিকের কাজও হতে পারে না। বাস্তবে রাজনীতির জঞ্জাল পরিষ্কার করার স্বার্থে তথ্য থেকে উৎসারিত সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আয়নায় সবারই মুখ দেখা দেশপ্রেমিক কর্তব্য। আত্মসমালোচনার দুয়ার বন্ধ করে দিয়ে আপাতত হয়তো রাজনৈতিক ফায়দা আদায় করা যাবে; কিন্তু ইতিহাসের কষাঘাত বা আঁস্তাকুড় বলে বিষয়টা থাকবে এবং তাতে এক সময় ইতিহাস বিকৃতকারীরা নিক্ষিপ্ত হবে।

বাকশাল গঠনের আগ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে প্রকাশ্যে বঙ্গবন্ধু সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ছিল- জাসদ, ন্যাপ (ভাসানী), বাংলা জাতীয় লীগ (অলি আহাদ), বাংলাদেশ জাতীয় লীগ (আতাউর রহমান), জাতীয় গণমুক্তি ইউনিয়ন (হাজী দানেশ-সিরাজুল), শ্রমিক-কৃষক সমাজবাদী দল (মোকলেসুর), বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি লেনিনবাদী-নাসিম আলী)। জাসদ বাদে ব্রাকেটবন্দি অন্য ৬টি দল সর্বদলীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে। রাজবন্দিদের মুক্তি, বিশেষ ক্ষমতা আইন বাতিল, রক্ষীবাহিনী বাতিল, দুর্নীতিবিরোধীসহ কতক দাবি থাকলেও ঐক্যফ্রন্টের মূল দাবি ছিল ‘বিদেশি আগ্রাসন ও আধিপত্য থেকে মুক্ত করা এবং জাতীয় স্বার্থ ও সার্বভৌমত্ববিরোধী সকল গোপন ও অসম চুক্তি বিশেষ করে ভারতের সাথে সকল গোপন ও অসম চুক্তি বাতিল।’ এই জোটের দলগুলো মূলে রুশ ও ভারতবিরোধী আওয়াজ সামনে রেখে অগ্রসর হয়। সাম্প্রদায়িক উসকানিমূলক বক্তব্যও ছিল এই জোটের। হরতাল ও অনশন দিয়ে দাবি আদায়ে সচেষ্ট থাকেন ফ্রন্টের নেতা মওলানা ভাসানী। ‘হক কথা’র মতো কতক হঠকারী পত্রিকা ছিল এদের প্রচারের বাহন। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো উল্লিখিত সব দল উগ্রবাম সশস্ত্র ‘রাতের বাহিনী’র থানা-ফাঁড়ি-বাজার-ব্যাংক লুট, অস্ত্র লুট ও নাশকতা-হত্যার বিরুদ্ধে তাদের কোনো অবস্থান বা বক্তব্য ছিল না; বরং এই দলগুলোর কারও কারও ওইসব সশস্ত্র গ্রুপের সাথে সংযোগ বা প্রশ্রয়-আস্কারা ছিল।

আওয়ামী লীগ থেকে বের হওয়া জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জাসদ ছিল খুবই উগ্র মেজাজে সরকারবিরোধী। কেন যে বঙ্গবন্ধু সমাজতন্ত্র কায়েমের লক্ষ্য ঘোষণা করলেও স্বাধীনতার মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ঐতিহ্যবাহী ছাত্র-সংগঠন ছাত্রলীগের একাংশের নেতা-কর্মীদের ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’র স্লোগান তুলে বিভ্রান্ত ও বিভক্ত করে প্রথমে আলাদা ছাত্রলীগ এবং পরে জাসদ গঠন করেছিল, তার রহস্য এখনও অজানা। হঠকারী স্লোগান ও রাজনীতি ছাড়া কী দিয়েছে এই দল দেশকে, জনগণকে? কী পেয়েছে ওই দলের অগণিত কর্মীরা? দেশের কী লাভ হলো? হত্যা-খুন-ক্যু-পাল্টা ক্যুয়ের রাজনীতির গোলকধাঁধার মধ্যে কখনো থেকে আর কখনো শিকার হয়ে শক্তিক্ষয় ও ক্রম বিভক্ত হওয়া ছাড়া? এই দল ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ ও ‘পুতুল মুজিব সরকারকে উৎখাত’ এবং ‘মার্কিন-রাশিয়া-চীন-ভারতবিরোধী’ দাবি ও স্লোগান সামনে রাখে এবং উগ্র ও হঠকারী সব কর্মসূচি ও পদক্ষেপ গ্রহণ করতে থাকে। বঙ্গবন্ধু সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবন আক্রমণ ছিল তাদের হঠকারী কার্যকলাপের শ্রেষ্ঠ কীর্তি। দৈনিক গণকণ্ঠ-র মাধ্যমে দলটি প্রচারকাজ চালায়।

বাকশাল গঠনের আগে আগে ইউনাইটেড পিপলস পার্টি (জাফর-রনো-মেনন) গঠিত হয়। দলটি বঙ্গবন্ধু সরকারকে ‘ফ্যাসিস্ট’ সরকার আখ্যায়িত করে এবং স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র আসেনি বলে এবং রুশ-ভারতবিরোধী অবস্থান নেয়। প্রসঙ্গত, বঙ্গবন্ধু সরকারের সমর্থনে ছিল ন্যাপ (মোজাফফর) ও কমিউনিস্ট পার্টি। ন্যাপ (মোজাফফর) বঙ্গবন্ধু আমলের পুরো সময় সরকারের পক্ষে-বিপক্ষে পেন্ডুলামের মতো দোল খায়। এই দলের অফিস ব্যবহার করে ভিয়েতনাম দিবসে ছাত্র ইউনিয়নের মিছিলে মার্কিন তথ্যকেন্দ্রের সামনে, কমিউনিস্ট পার্টির দলিলের ভাষায় ‘সামান্য গোলযোগ’ ঘটলেই ১ জানুয়ারি ১৯৭৩ পুলিশের ‘নির্বিচার গুলিবর্ষণে’ স্বাধীন দেশের ইতিহাসে কেন্দ্রীয়ভাবে প্রথম হৃদয়বিদারক রক্তাক্ত ঘটনা সংঘটিত হয়। ১৯৭২ সালে সংবিধান গ্রহণের সময় গণপরিষদে এই দলের একমাত্র সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত স্বাক্ষর দেননি এবং ১৯৭৩-এ সাধারণ নির্বাচনের আগে পাল্টা বা বিকল্প সরকারের আওয়াজ তোলে। কমিউনিস্ট পার্টি এই অবস্থানকে ‘পেটি বুর্জোয়া সংকীর্ণতা’, ‘বিচ্যুতি’ প্রভৃতি বলে সমালোচনা করলে এই দল আবারও আওয়ামী লীগের সাথে ঐক্য ও সমঝোতার লাইনে ফিরে আসে। একমাত্র কমিউনিস্ট পার্টি পূর্বাপর প্রশংসা-সমালোচনা, ঐক্য-সংগ্রামের নীতি নিয়ে বঙ্গবন্ধু সূচিত ‘বিপ্লবী প্রক্রিয়ার’ পক্ষে সীমিত শক্তি নিয়ে দৃঢ়ভাবে অবস্থান নেয়।

উল্লিখিত প্রকাশ্য দলগুলো ছাড়াও নকশাল ও চীনপন্থি অগণিত উগ্রবাম গোপন গ্রুপ ছিল। যাদের একটা অংশ মূলত ন্যাপ (ভাসানী)-এ প্রকাশ্যে ছিল। পূর্ব বাংলার সাম্যবাদী দল (সুখেন্দু- তোয়াহা), বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (এমএল-নগেন), পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল-আবদুল হক), পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল-দেবেন-সিরাজ), সর্বহারা পার্টি (সিরাজ শিকদার) প্রভৃতি দল ব্যতিক্রম বাদে ‘রাতের বাহিনী’ হিসেবে নাশকতামূলক কাজ চালাত। ‘পূর্ব বাংলা’ ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নাম যুক্ত থাকায় অনুধাবন করা যায়, এসব গ্রুপের সবটি স্বাধীন দেশকে মেনে নিতে পারেনি। পাকিস্তানি আমলের ধারাবাহিকতা নিয়ে এসব গ্রুপের কোনো কোনোটি মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘দুই কুকুরের লড়াই’ ইত্যাদি স্লোগান তুলে কার্যত মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে। আবার কোনো কোনো গ্রুপ বাংলাদেশ সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থেকে বিচ্ছিন্নভাবে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অংশ নেয়।

বাংলাদেশ ‘জুলফি ভুট্টো অব পাকিস্তান’ গ্রন্থে বিশিষ্ট আমেরিকান ঐতিহাসিক ও পাক-ভারত বিশেষজ্ঞ স্টেইনলি ওয়ালপার্ট লিখেছেন, “পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল) নেতা আবদুল হক বিজয় দিবস ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭৪ পাকিস্তানের মিনিস্টার অব স্টেট বাঙালির কলঙ্ক মাহমুদ আলী (মুসলিম লীগ-গণতন্ত্রী দল-ন্যাপ সাধারণ সম্পাদক হয়ে এনডিএফ) মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী ভুট্টোর কাছে পত্রে “মুজিব পুতুল সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য অর্থ, অস্ত্র ও বেতার যন্ত্র’র জন্য আবেদন করেন। ওই চিঠির ওপরে ১৬ জানুয়ারি ১৯৭৫ ভুট্টো লেখেন এই ‘সৎ’ ও ‘কার্যকর’ ব্যক্তিকে সাহায্য করা হোক। কেউ বলতে পারেন, এই চিঠি ভুয়া। কিন্তু আবদুল হকের দলের নামে পূর্ব পাকিস্তান থাকায় অনেক কিছুই প্রমাণ হয়ে যায়। এ সময়ে জাসদের সশস্ত্র গণবাহিনী ছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রামে সন্তু লারমার নেতৃত্বে সশস্ত্র শান্তিবাহিনী গঠিত হয়। এসব গোপন বাহিনীও নানা স্থানে সশস্ত্র হামলা ও নাশকতামূলক কাজ চালায়।”

১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি একদল বাকশাল গঠনের পর উল্লিখিত তীব্র বঙ্গবন্ধু সরকারবিরোধী দল ও নেতা কারও কারও অবস্থার কম-বেশি পরিবর্তন হয়। ন্যাপ (ভাসানী) প্রধান মওলানা ভাসানী, জাতীয় লীগপ্রধান আতাউর রহমান খান এমপি, জাগমুই-কমিউনিস্ট নেতা হাজী মোহাম্মদ দানেশ একদল গঠনকে সমর্থন করেন। আতাউর রহমান খান ও হাজী মোহাম্মদ দানেশ বাকশাল কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন। এটা সকলেরই জানা, বঙ্গবন্ধু বাকশালে যোগ দেওয়ার জন্য বিভিন্ন পেশা-শ্রেণিসহ সকলকে আহ্বান জানালেও কাউকে জোর করেন নি। অর্থাৎ স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই তারা যোগ দিয়েছিলেন বা সমর্থন করেছিলেন। প্রসঙ্গত, সামরিক বাহিনীর উপ-প্রধান জিয়াউর রহমান ও তার গৃহবধূ খালেদা জিয়া বাকশালের সভায় উপস্থিত থাকেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় সোয়াত জাহাজ ও পাকিস্তানিদের অস্ত্র নামানো ইত্যাদি প্রসঙ্গ-কথা বাদ দিয়ে তার নিজের কথায়ই বলা যায়, বঙ্গবন্ধুর ‘গ্রিন সিগনাল’ পেয়েই তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেছিলেন। কিন্তু পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে প্রথমে জিয়া ও পরে বেগম জিয়ার ক্ষমতায় বসার পর যথাক্রমে সামরিক ফরমান দিয়ে বঙ্গবন্ধুর নাম-নিশানা মুছে ফেলার প্রচেষ্টা এবং বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার দিনে ভুয়া জন্মদিন পালন করা ছিল দেশে কুরুচিপূর্ণ ডিগবাজির রাজনীতির বড় উদাহরণ।

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে দল ও নেতাদের অবস্থান অনেকটাই পাল্টে যায়। বলার অপেক্ষা রাখে না, প্রতিবাদ-প্রতিরোধ কিংবা বিরুদ্ধ অবস্থান যতটা পরিলক্ষিত হয়, তার চেয়ে সহযোগিতা- যোগদান, কাপুরুষতা-সুবিধাবাদিতা ও ভয়ভীতিই বেশি সুস্পষ্ট হয়। রাজনৈতিক আদর্শ ও নৈতিকতার ধস ক্রমে বাড়তে থাকার কারণেই হত্যা-ক্যু-খুনের রাজনীতি পরবর্তীতে বহু বছর টিকে থাকতে পারে। বঙ্গবন্ধুর অন্ধ বিরোধিতাকারী বলতে যারা সুখানুভব পান তারা বলে বেড়ান বঙ্গবন্ধু-হত্যার পর কোনো প্রতিবাদ হয়নি। এ-কথা সামগ্রিক বিচারে একেবারেই সঠিক নয়। মর্মান্তিক ওই খবর শোনার সাথে সাথে কিশোরগঞ্জ, বরগুনা, পটুয়াখালী ও খুলনাসহ কতক জায়গায় বিক্ষিপ্তভাবে প্রতিবাদ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। ১৮ অক্টোবর ১৯৭৫, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খুললে হত্যার প্রতিবাদে ও খুনি সরকারের বিরুদ্ধে আশপাশে চিকা মারা (দেয়াল লিখন) এবং প্রচারপত্র বিলি হয়। ২০ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মধুর কেন্টিনের সামনে প্রথম প্রতিবাদ সমাবেশ হয়। ৪ নভেম্বর সকালে বিরাট জমায়েত করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিছিল ৩২ নম্বরে গিয়ে গায়েবানা জানাজা, পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ ও প্রতিবাদ সভা করা হয়। এই ছিল খুনি মোশতাকের বিরুদ্ধে রাস্তার প্রতিবাদের সংক্ষিপ্তসার। বঙ্গবন্ধু অনুসারী ছাত্রনেতারা (ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগ) ১৯৭৬ সালে আইনানুগ ঘরোয়া রাজনীতি শুরুর আগে পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু-হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে এবং সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গোপন ও প্রকাশ্য সমাবেশ, পত্র-পত্রিকা, লিফলেট প্রকাশ এবং বিভিন্ন দিবস পালনের বিরুদ্ধে বিশেষত ছাত্র-সমাজকে সংগঠিত করার চেষ্টা করেছে।

সশস্ত্র প্রতিবাদও হয়। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পরপরই প্রতিবিপ্লবের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের মতো ভারত গিয়ে সশস্ত্র লড়াইয়ের প্রচেষ্টা চলে। মুক্তিযুদ্ধে কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান কাদের সিদ্দিকীসহ আওয়ামী লীগ, ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থক ছাত্র-যুবক অনেক মুক্তিযোদ্ধা খুনি মোশতাকের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের মতো লড়াই করার জন্য ভারত চলে যান এবং সেখান থেকে সশস্ত্র লড়াইয়ের প্রস্তুতি নেওয়ার সাথে সাথে সীমান্তে গেরিলা কায়দায় আক্রমণ করতে থাকে। ন্যাপ (মোজাফফর)-এর সাধারণ সম্পাদক পংকজ ভট্টাচার্যসহ কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের কয়েকজন নেতাও তখন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ বা ওইদিক থেকে প্রতিরোধ দাঁড় করার সম্ভাবতা যাচাই করতে ভারত যান। কিন্তু ওই সশস্ত্র প্রতিরোধ দানা বেঁধে উঠতে পারেনি। তাই কোনো ফলদায়ক প্রভাব সৃষ্টি করতে পারেনি। মোশতাকের পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় বসলে কিছুকাল ওই সশস্ত্র তৎপরতা চলে। পরে ওই তৎপরতার অবসান ঘটে।

বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর খুনি ও ধূর্ত মোশতাক অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে আওয়ামী লীগকে দিয়েই বঙ্গবন্ধু-হত্যাকে জায়েজ করতে উদ্যোগ নেয়। এতে আওয়ামী লীগের দুই বিপরীত ধরনের প্রতিক্রিয়া ও অবস্থান সৃষ্টি হয়। বঙ্গবন্ধুর একান্ত সহযোগী, মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ নেতৃত্বদানকারী জাতীয় চার নেতা স্বাভাবিকভাবেই মাথা নত করেন নি। উপ-রাষ্ট্রপতি নজরুল ইসলাম ও শিল্পমন্ত্রী কামারুজ্জামান মোশতাকের বিরোধী অবস্থান নেন এবং বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভা কিংবা দলের কোনো পদে না থাকা সত্ত্বেও তাজউদ্দীন আহমদ ও বাকশালের সাধারণ সম্পাদক এবং বিদ্যমান প্রধানমন্ত্রী এম মনসুর আলী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে বিরুদ্ধে দাঁড়ান। প্রথমেই জাতীয় চার নেতা এবং পরে আবদুস সামাদ আজাদ, জিল্লুর রহমান, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করে জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। গোপন কমিউনিস্ট পার্টি এ-সময়ে দৃঢ়ভাবে বঙ্গবন্ধুর হত্যার তীব্র বিরোধিতা করে এবং মোশতাক সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। ন্যাপ নেতা মোজাফফর আহমেদ ওয়েট অ্যান্ড সি-নীতি নিয়ে দুর্বলতা দেখান। এতে বাম-কমিউনিস্ট মহলে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। তিনি মোশতাকের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন বলেও জানা যায়। তবে ন্যাপের মধ্যে কর্মরত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরা পার্টির লাইন গ্রহণ করে যথাযথ ভূমিকা গ্রহণ করেন।

উল্টোদিকে চরম দুর্ভাগ্য ও কলঙ্কজনক ঘটনা হলো, বঙ্গবন্ধুর লাশ ৩২ নম্বরের বাসায় সিঁড়িতে পড়ে থাকতেই তার সহকর্মী ও মন্ত্রিসভার প্রায় সবাই খুনি মোশতাক মন্ত্রিসভার উপ-রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী হিসেবে যোগ দেন। এতেই বঙ্গবন্ধু-সমর্থক রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের প্রতিরোধ-স্পৃহাকে হতাশায় রূপান্তরিত করে। প্রকৃত বিচারে এজন্য প্রতিরোধ আন্দোলন শুরুতেই সংগঠিত রূপ পাওয়া সম্ভব ছিল না। প্রসঙ্গত, কেবল সাবেক আওয়ামী লীগের নেতা-মন্ত্রীরা নয়, বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, শিক্ষক ড. এ আর মল্লিক, ড. মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী এবং সাবেক ন্যাপ নেতা সৈয়দ আলতাফ হোসেন পর্যন্ত কাপুরুষতা দেখিয়ে মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। বঙ্গবন্ধুর সময়ে স্পিকার আবদুল মালেক উকিল লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধুর হত্যার নিন্দা বা প্রতিবাদ জানান নি এবং নেতিবাচক মন্তব্য করে কার্যত খুনি মোশতাকের পক্ষে দাঁড়ান।

দেশের বাইরে থেকে তার এই অবস্থান গ্রহণ থেকে সুস্পষ্টভাবে অনুধাবন করা যায়, মোশতাক বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘদিনের সহযোগী সবাইকে গান পয়েন্টে তার পক্ষে দাঁড় করিয়েছিলেন, কথাটা সর্বাংশে সঠিক নয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি ও বঙ্গবন্ধু সরকারের সাবেক মন্ত্রী ওসমানী সরাসরি খুনি মোশতাককে সমর্থন দেন এবং সরকারের প্রধান সামরিক উপদেষ্টার পদ গ্রহণ করেন। ন্যাপের সাবেক নেতা বাকশালের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য মহিউদ্দিন আহমেদ খুনি মোশতাকের বিশেষ দূত হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নে যান। বলা বাহুল্য ‘রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই’ কথাটা প্রমাণ করে এসব ডিগবাজি দেওয়া সাবেক নেতাদের প্রায় সবাই কর্মী-জনগণের কাছে ক্ষমা বা মাপ না চেয়ে আবার আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন।

এটা সত্য, আওয়ামী লীগের মধ্যে বঙ্গবন্ধু-হত্যার পর দুর্ভাগ্যজনকভাবে চরম দুর্বলতা প্রকাশ পায়। তবে এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, আওয়ামী লীগই খুনিচক্রের কবর রচনা করে। আওয়ামী লীগকে দিয়ে বঙ্গবন্ধু-হত্যা জায়েজ করে সরকার পরিচালনা করার পরিকল্পনা কার্যকর করতে গিয়েই খুনি মোশতাক মরণ-ফাঁদে জড়িয়ে পড়ে। ১৬ অক্টোবর মোশতাক এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে ঢাকায় আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের সভা আহ্বান করে। আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যদের একাংশ সভা বয়কট করে। অপর অংশ সভায় উপস্থিত হয়ে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার জন্য সরাসরি মোশতাককে দায়ী করে এবং তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে। সভায় মুষ্টিমেয় মোশতাকের দালাল সংসদ সদস্যদের নীরব-নিষ্ক্রিয় থাকা ছাড়া উপায় ছিল না। এক পর্যায়ে সভা পণ্ড হয় এবং মোশতাকের রাজনৈতিক উদ্যোগ সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়। তাই যেসব ব্যক্তি দল গোষ্ঠী বলেন, বঙ্গবন্ধু মৃত্যুর পর কেউ চোখের পানি ফেলেনি অথবা কেউ প্রতিবাদ করেনি, তারা হয় ইতিহাস সম্পর্কে কিছুই জানে না অথবা জেনেও না জানার ভান করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চায়।

বাকশাল হওয়ার আগে বিরোধিতা ও পরে যোগদান বা সমর্থনকারী নেতা রাজনৈতিক নেতা ও ব্যক্তি অনেকের ক্ষেত্রেও সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী ডিগবাজির ঘটনা ঘটে। মওলানা ভাসানী ১৭ আগস্ট ১৯৭৫, ১৫ আগস্ট বিপ্লবকে ‘ঐতিহাসিক পদক্ষেপ’ আখ্যায়িত করে অভিনন্দন জানান। ৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫, হাজী মোহাম্মদ দানেশ ‘দেশে যেভাবে এক ব্যক্তির শাসন প্রতিষ্ঠিত হতে চলছিল উহা নস্যাৎ করে দেওয়ার জন্য দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনীকে অভিনন্দন’ জানান। আতাউর রহমান খানের অবস্থাও ছিল তথৈবচ। এদিকে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর যারা বাকশালে যোগ দেয়নি, সেসব দল ও তাদের নেতাকর্মীরা উল্লসিত হয়ে ওঠেন। সবচেয়ে আহ্লাদিত হয় গোপন চীনপন্থি গ্রুপগুলোর কয়েকটি। যেমন পূর্ব বাংলার সাম্যবাদী দল (এমএল-তোয়াহা) ১৮ আগস্ট ১৯৭৫ এক বিবৃতিতে বলে, ‘বিগত ১৫ই আগস্ট সেনাবাহিনী রুশ-ভারতের নিয়ন্ত্রিত খুনি দুর্নীতিবাজ মুজিব সরকারকে উৎখাত করেছেন। দেশবাসী তাতে আনন্দিত। আমরা সেনাবাহিনীর দেশপ্রেমিক অংশকে স্বাগত জানাই।’

এদিকে জাসদ নেতৃত্ব মুজিব-হত্যার বিষয় জানতো বলে কথাটা এখন প্রতিষ্ঠিত। জাসদ/গণবাহিনী ১৭ আগস্ট ১৯৭৫ যে প্রচারপত্র বিলি করে, তার শিরোনাম ছিল : ‘খুনি মুজিব খুন হয়েছে/অত্যাচারীর পতন অনিবার্য।’ ৩০ আগস্ট জাসদ, ইউনাইটেড পিপলস পার্টি (জাফর-রনো-মেনন) ও সমাজবাদী দল যৌথ প্রচারপত্রে ‘শেখ মুজিব ও মোশতাক সমান স্বৈরাচারী’ বলে তুলে ধরে। সর্বোপরি গণবাহিনী ও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নেতা লে. কর্নেল তাহের যে খুনিচক্রের অনুরোধে ঢাকা বেতার কেন্দ্রে গিয়েছিলেন, তা এখন প্রতিষ্ঠিত সত্য। এদিকে ১৫ আগস্টের ঘটনা ঘটার পরপরই জাসদ আশু বিপ্লবের লক্ষে জনগণের মধ্যে কর্মরত সশস্ত্র গণবাহিনী এবং সেনাবাহিনীতে কর্মরত ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’কে সচল করে। সর্বোপরি বঙ্গবন্ধু-হত্যার পরই যদি জিয়া-তাহের সমঝোতা হয়েছিল এবং যার ফলশ্রুতিতে ৭ নভেম্বর সিপাহী বিদ্রোহে জিয়াউর রহমান মুক্ত হতে পেরেছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর শাসনামল ও হত্যার ঘটনাপ্রবাহ ও ফলাফল প্রমাণ করে যে, একটি রোমান প্রবাদ বাক্য রাজনীতির ক্ষেত্রে সত্য। ‘চরম বাম ও ডান- দুই বিপরীত মেরু একবিন্দুতে মিলিত হয়।’ আমাদের দেশের অভিজ্ঞতা হলো, জাতীয় মূলধারা আন্দোলন-সংগঠন ক্ষমতায় থাকলে আক্রমণ ও আঘাত হতে থাকে উগ্রবাম দিক থেকে কিন্তু লাভবান হয় ও ক্ষমতায় বসে ডান প্রতিক্রিয়াশীলতা। ১৫ আগস্টের ধারাবাহিতকায় ৭ নভেম্বরও একই ধরনের উগ্রবাম-ডানের খেলা চলে এবং একই ফলাফল হয়। এ দুই ঘটনার ভেতর দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে পাকিস্তানের মতো হত্যা-ক্যু, প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সামরিক কর্তাদের শাসনের যুগ শুরু হয়। দেশে সাম্প্রদায়িকতার পুনরুত্থান ঘটে এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদকে উৎখাত করার প্রচেষ্টা চলে। সাম্প্রদায়িক দলগুলো দল গঠনের সুযোগ পায়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বিকৃতি ঘটানোর সবৈব প্রচেষ্টা চলে। লুটপাটের অর্থনীতি তথা ‘মানি ইজ নো প্রবলেম’-এর অর্থনীতি চালু হয়। রাজনীতি হয় যথার্থ অর্থেই রাজনীতিকদের জন্য ডিফিক্যাল্ট। সার্বিক বিচারে রাষ্ট্র ও সমাজজীবনের সর্বক্ষেত্রে সামরিকীকরণ ও পাকিস্তানিকরণই হচ্ছে ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের প্রত্যক্ষ ফল।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেঁচে থাকলে এ-বছর তার শতবর্ষ পূর্ণ হতো। কিন্তু আমরা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, মানুষের মুক্তির সংগ্রামে নিবেদিতপ্রাণ বঙ্গবন্ধুকে বাঁচিয়ে রাখতে পারিনি। বঙ্গবন্ধু তার সময়কালের স্বনামধন্য জনপ্রিয় জাতীয়তাবাদী-স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতাদের একজন, যাদের অনেককেই ক্যুয়ের ঘটনার ভেতর দিয়ে প্রাণ দিতে বা ক্ষমতা থেকে সরে যেতে হয়েছে। এই বিচারে বলা যায়, আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হচ্ছেন তার সময়ের বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সন্তানের একজন; যিনি দেশের জন্য, নিজ আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য, জনগণের প্রত্যাশাকে বাস্তবায়নের জন্য সংগ্রাম করে জীবন দিয়ে বিশ্ব ইতিহাসে চিরকালের জন্য অক্ষয় হয়ে রয়েছেন।

সৌজন্যেঃ উত্তরণ (বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মুখপত্র)

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত