কী দুঃসময়ই না পিছে ফেলেছে বাংলাদেশ

1930

Published on আগস্ট 16, 2020
  • Details Image

অজয় দাশগুপ্তঃ

বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের সময়েই যুক্তরাষ্ট্রের সে সময়ের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এবং তার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা (পরবর্তী সময়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী) হেনরি কিসিঞ্জার তাদের ক্ষোভ-রোষ গোপন রাখতে পারেননি। তারা বাংলাদেশে গণহত্যা পরিচালনায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এবং বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকায় দুই জল্লাদ কমান্ডার টিক্কা খান ও আমীর আবদুল্লাহ নিয়াজীকে অস্ত্র ও অর্থ জুগিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে বঙ্গোপসাগরে যুক্তরাষ্ট্র পাঠিয়েছিল সপ্তম নৌবহরের ভয়ঙ্কর অস্ত্রসজ্জিত কয়েকটি জাহাজ। চীনের নেতৃত্বও ভারত-বাংলাদেশ মিত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে রণাঙ্গন খুলতে তৎপর ছিল।

মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর সম্মিলিত অভিযানে বিপর্যস্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনী যেন পুনর্গঠিত হওয়ার সুযোগ পায়, সে জন্য জাতিসংঘে চীন ও পাকিস্তান নানা কূটকৌশল চালতে থাকে। কিন্তু সব অপকৌশল ব্যর্থ হয়। বাংলাদেশের অব্যুদয় ঘটে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে। বিশ্বের সেরা সামরিক ও অর্থনৈতিক পরাশক্তির দাবিদার যুক্তরাষ্ট্রের নেতারা এটাকে ব্যক্তিগত পরাজয় হিসেবে গণ্য করতে থাকেন। ১৯৭৪ সালের প্রলয়ঙ্করী বন্যায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার পর কিউবায় কয়েক লাখ ডলারের চটের ব্যাগ বিক্রি করেছে, এই অজুহাত তুলে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে খাদ্য সহায়তা প্রদানে অস্বীকৃতি জানায়। এখানেই থেমে থাকেনি। হেনরি কিসিঞ্জার ত্রিশ লাখ নারী-পুরুষের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশ সম্পর্কে চরম তাচ্ছিল্যপূর্র্ণ ও অপমানসূচক মন্তব্য করেন এভাবে- “Bangladesh is an International Basket Case.”

জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভের পর ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বঙ্গবন্ধু সাধারণ পরিষদে ভাষণ দিতে নিউ ইয়র্ক গিয়েছিলেন। বিশ্বসভায় বাংলা ভাষায় বক্তব্য রাখেন তিনি। এর পর যান ওয়াশিংটন, সে সময়ের প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ডের সঙ্গে আলোচনার জন্য। কিসিঞ্জারের আগেও বিশ্ব ব্যাংকের দুই সিনিয়র অর্থনীতিবিদ একই ধরনের মন্তব্য করেছিলেন বাংলাদেশ প্রসঙ্গে। তাদের বিবেচনায় ‘বাংলাদেশ যদি উন্নতি করতে পারে, তাহলে বিশ্বের যে কোনো দেশ উন্নতি করতে পারবে।’ এর সহজ অর্থ করা যায় এভাবে-  এই ছেলে যদি এসএসসি পাস করে তাহলে কলাগাছও পাস করবে। স্কুলের চেয়ার-টেবিলও বাদ থাকবে না।

কিন্তু হায়- শকুনের দোয়ায় গরু মরেনি! বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটাতে পেরেছে। স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে পেরেছে।
বঙ্গবন্ধু হেনরি কিসিঞ্জার ও বিশ্বব্যাংকের অর্থনীতিবিদদের বাংলাদেশ সম্পর্কে তাচ্ছিল্যপূর্ণ মন্তব্যের মোক্ষম জবাব দেওয়ার জন্য ওয়াশিংটনকেই বেছে নেন।

ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ গ্রন্থে লিখেছেন-

ওয়াশিংটনে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, কেউ কেউ বাংলাদেশকে International Basket Case বলে উপহাস করেন। কিন্তু বাংলাদেশ Basket Case নয়। দুইশ’ বছর ধরে বাংলাদেশকে লুট করা হয়েছে। বাংলাদেশের সম্পদেই শ্রীবৃদ্ধি করা হয়েছে লন্ডন, ডান্ডি, ম্যাঞ্চেস্টার, করাচি, ইসলামাবাদের।…. আজো বাংলাদেশে অফুরন্ত সম্পদ রয়েছে। একদিন আমরা দেখাবো বাংলাদেশ নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে।

আমাদের দুর্ভাগ্য যে বাংলাদেশেরই কিছু অবিবেচক লোক ‘বাস্কেট কেস’কে বিকৃত করে বলতে শুরু করে- বটমলেস বাস্কেট। বাস্কেট কেসের অর্থ অপরের দয়ার ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তি। হেনরি কিসিঞ্জার ও বিশ্বব্যাংকের অর্থনীতিবিদরা বলতে চেয়েছেন- বাংলাদেশের পক্ষে অর্থনৈতিকভাবে টিকে থাকা সম্ভব হবে না।

কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ভবিষ্যদ্বাণী বৃথা যায়নি। বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। কেউ আর এ দেশকে নিয়ে উপহাস করতে পারে না। বরং সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা ভূখণ্ড এখন প্রকৃতই বিশ্বের বিস্ময়। এ দেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা নিয়ে এমনকি বিশ্বব্যাংক কিংবা উন্নত বিশ্বের পণ্ডিতরাও সংশয় প্রকাশ করেন না। চিরকালের খাদ্য ঘাটতির দেশ- এমন উপহাসের শিকার দেশটি এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। স্বাধীনতা অর্জনের পরের বছরে আমাদের এখানে এক কোটি টনের মতো চাল-গম উৎপন্ন হয়েছিল। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর প্রাক্কালে খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়েছে ৪ কোটি টনের বেশি। মাছ, সবজি, ফল, দুধ, মাংস. ডিম উৎপাদনেও বাংলাদেশের অর্জন বিশ্বের নজর কেড়েছে।

বিএনপি-জাতীয় পার্টির শাসনামলে কত বার যে ঝড়-বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে সাহায্যের জন্য আকুল আবেদন জানানো হয়েছে। কিন্তু জননেত্রী শেখ হাসিনা এ ধারা পাল্টে দিয়েছেন। বাংলাদেশ এখন কারও করুণা-অনুগ্রহ প্রার্থী হয় না, বরং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের মতো অর্থনৈতিক-সামরিক পরাশক্তির কাছেও মডেল হিসেবে স্বীকৃত।

আমাদের শিল্পের বিকাশ ঘটছে। চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। অভিন্ন সড়ক নেটওয়ার্কে এসেছে বাংলাদেশে। বিশ্বব্যাংকের একটি অসৎ চক্রের পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজ ভণ্ডুল করার অপচেষ্টা বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা অনুপম দক্ষতায় নস্যাৎ করে দিয়েছেন। বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের বদনাম করেছিল। অন্যায় অজুহাতে ঋণ সুবিধা প্রত্যাহার করেছিল। অন্যদের একই ভুল পথে চলতে প্ররোচনা দিয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশ নিজের অর্থে এত বড় অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ সম্পন্ন করার ঝুঁকি নিয়েছে, যা স্বল্পোন্নত কিংবা উন্নয়নশীল কোনও দেশ গ্রহণ করেনি। বিশ্বব্যাংকও পরে তাদের ভুল স্বীকার করে নিয়েছে। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক বিভিন্ন প্রকল্পে বেড়েছে তাদের সহায়তা। ডিজিটাল প্রযুক্তির বিস্তারেও বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে দৃঢ়পদক্ষেপে। প্রত্যন্ত গ্রামেও এখন আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির ছোঁয়া সর্বত্র- মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট সেবা, মোবাইল ব্যাংকিং সুবিধা সাধারণ মানুষের নাগালে। পাঁচ কোটির বেশি শিক্ষার্থীর পদচারণায় মুখর হাজার হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ছাত্র-ছাত্রী অনুপাত প্রায় সমান। নারীর ক্ষমতায়নেও বাংলাদেশ বিশ্বে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারছে। অবরোধবাসিনী নারী- এটাই বলা হতো। কিন্তু এখন দৃশ্য একেবারেই ভিন্ন- সর্বত্র তাদের গর্বিত পদচারণা।

বাংলাদেশ মহাকাশে নিজের স্থান করে নিয়েছে। ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্র সীমানা নিষ্পত্তির জন্য সুপরিকল্পিতভাবে ও বিচক্ষণতার সঙ্গে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে নিজের অবস্থান তুলে ধরে জাতীয় স্বার্থ আদায় করে নিয়েছে। ভারতের পত্রিকা টেলিগ্রাফ যথার্থই লিখেছিল-

বাংলাদেশ পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সমান আয়তনের সমুদ্র এলাকার নিয়ন্ত্রণ পেয়ে গেছে আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে। ভারতের সঙ্গে স্থল সীমান্তের বিরোধ নিষ্পত্তিও করেছে শান্তিপূর্ণ উপায়ে।

একের পর এক ষড়যন্ত্র

তবে এ অগ্রযাত্রা সহজে আসেনি। স্বাধীনতার পর থেকেই কত ষড়যন্ত্র। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল গঠনের পর ডানপন্থি ও চীনাপন্থিরা দলে দলে মেজর জলিল ও আসম আবদুর রবের অনুগামী হতে থাকে। জাসদের সভাপতি মেজর জলিল পল্টন ময়দানে বলেন, পাকিস্তান ফেরত সব অফিসার ও সৈন্যরা তাদের সঙ্গে রয়েছে। ১৯৭৪ সালের মার্চ মাসে শেরে বাংলা নগরে নতুন গণভবন তৈরি হয়ে যায়। ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কের ছোট বাড়ি ছেড়ে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের নিয়ে গণভবনে উঠবেন, এটাই ধারণা করা হচ্ছিল। এ ক্ষেত্রে নিরাপত্তার বিষয়টি ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু মহিয়সী নারী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বলেন,

সরকারি ভবনের আরাম-আয়েশে প্রতিপালিত হলে ছেলেমেয়েদের মন-মানসিকতা ও আচার-আচরণে অহমিকাবোধ ও উন্নাসিক ধ্যানধারণা সৃষ্টি হবে। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছ থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে।

এ কারণেই তো তিনি বঙ্গমাতা। দুঃসময়েও তিনি কখনও সাহস হারাননি, বিচলিত বোধ করেননি। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ- এটা ছিল তার সহজাত গুণ।

অন্যদিকে, চক্রান্তকারীদের উদ্দেশ্য ছিল স্পষ্ট- বঙ্গবন্ধুকে অনিরাপদ বাসস্থানে রাখা। ১৯৭৪ সালের ৭ মার্চ জাসদের পত্রিকা ‘গণকণ্ঠ’ চরম মিথ্যাচার করল ‘১০ কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন গণভবন তৈরি’ শিরোনামের খবর প্রকাশ করে। এর ১০ দিন পর জাসদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মনসুর আলী বাসভবন ঘেরাওয়ের নামে সশস্ত্র হামলা পরিচালনা করে। ১৪ এপ্রিল মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত হয় ৬-দলীয় ঐক্যজোট। ২৩ এপ্রিল পল্টন ময়দানে তিনি ঘোষণা করেন- মুজিবের সরকারকে উৎখাত করা হবে, আওয়ামী লীগকে নির্মূল করা হবে।

১৯৭৪ সালের জুন মাসের শেষ দিকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো বাংলাদেশ সফরে আসেন। ফেব্রুয়ারি মাসে পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে বঙ্গবন্ধু ইসলামী সম্মেলন সংস্থার সম্মেলনে যোগ দিতে লাহোর গিয়েছিলেন। জুলফিকার আলী ভুট্টোর ঢাকা সফরকে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি ও বাংলাদেশে অবস্থানরত বিহারিরা কাজে লাগায়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যায় ভুট্টোর ঘৃণ্য অপরাধ আড়ালে নিতে তারা সচেষ্ট হয়। বিমান বন্দর ও শহরের কিছু স্থানে সমবেত হয়ে ‘ভুট্টো জিন্দাবাদ, ভারত ও রাশিয়া নিপাত যাক’– স্লোগান দেয়।

১৯৭৪ সালের জুলাই-অগাস্টের ভয়াবহ বন্যায় বিপুল ফসলহানির সুযোগ কাজে লাগাতে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি সচেষ্ট হয়। বন্যার আগেই বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে গিয়েছিল। এ কারণে বিশ্বের সর্বত্রই মূল্যস্ফীতি ছিল চরমে। চাল-গমের দাম প্রতিদিন বাড়ছিল। পেট্রল-ডিজেলের দাম আকাশছোঁয়া হতে থাকে। বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের সবটাই আমদানি করতে হতো। এর প্রভাব পড়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক পণ্যের দামে। বঙ্গবন্ধুর সরকারকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য হেন চেষ্টা নেই, যা একটি মহল করেনি।

শূন্য থেকে যাত্রা
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিঃশর্ত আত্মসমর্পন করে। পরদিন ১৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ-এর পরিমাণ লেখা ছিল ‘শূন্য’। খাদ্য ঘাটতি ছিল প্রকট। সড়ক ও রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। চট্টগ্রাম বন্দরে পাকসেনাদের মাইন মোতায়েন ও জাহাজ ডুবির কারণে আমদানি-রফতানি কাজ দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছিল। ভারতে যে এক কোটি শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছিল, তারা ফিরে এসেছিল। দেশের অভ্যন্তরেও লাখ লাখ পরিবারের বাড়ি-ঘর লুট হয়েছিল, অনেক বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। তাদের প্রতি সহায়তার হাত বাড়াতে হয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর সরকার এ দুঃসময় কাটিয়ে উঠতে একের পর এক পদক্ষেপ নিতে থাকে। পাশাপাশি নজর দিতে হয় বিভিন্ন দেশের স্বীকৃতি আদায়ের জন্য। বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপন ও জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভে এ স্বীকৃতি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে বিশ্ব সমাজে স্থান করে নিতে হলে বিদেশি সেনার উপস্থিতি সহজে গ্রহণযোগ্য হয় না। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়েছেন ৮ জানুয়ারি। ১০ জানুয়ারি লন্ডন থেকে ঢাকা আসার পথে দিল্লিতে স্বল্প সময় অবস্থান করেন। এ সময়ের মধ্যেই তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বাংলাদেশ ভূখণ্ড থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের গুরুত্বপূর্ণ ও অতি জরুরি আলোচনা সেরে ফেলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে লাখ লাখ ভারতীয় সৈন্য যুদ্ধ করেছে। বিপুল সংখ্যক সৈন্য হতাহত হয়েছে। আমাদের মাটি মুক্তি বাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর রক্তে রঞ্জিত হয়েছে। বাংলাদেশের ভেতরে তখনও নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা ছিল। পালিয়ে বেড়ানো অনেক আলবদর-রাজাকারের হাতে অস্ত্র ছিল। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীর কথা হয় ১০ জানুয়ারি। ৩০ জানুয়ারি ঢাকার মিরপুরে বিহারি এলাকায় আত্মগোপনকারী পাকিস্তানি সৈন্য ও সশস্ত্র সন্ত্রসীদের হাতে নিহত হন খ্যাতিমান চলচ্চিত্র পরিচালক ও সাহিত্যিক মুক্তিযোদ্ধা জহির রায়হান।

সেনা প্রত্যাহারের বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর অনুরোধ শোনার সঙ্গে সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধী উত্তর দেন- আপনি যখন চাইবেন, ভারতীয় সৈন্য চলে আসবে।

বাস্তবে সেটাই ঘটেছিল। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে অঙ্গীকারের মাত্র দুই মাসের মধ্যে ভারতীয় সৈন্য চলে যায়। অথচ ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ শেষ হওয়ার ৭৫ বছর পরও এশিয়া ও ইউরোপে বিভিন্ন দেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনা রয়ে গেছে। এ বিষয় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বা ব্রিটেন কারও আপত্তির তোয়াক্কা করে না।

বঙ্গবন্ধুর সরকারকে দ্রুত আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়। যেমন, লাখ লাখ মুক্তিযোদ্ধার কাছ থেকে তাদের যুদ্ধকালীন হাতিয়ার সমর্পন। একইসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনের বিষয়টিও ভাবতে হয়।

পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধী এবং শান্তি কমিটি-আলবদর-রাজাকারদের বিচারের কাজও চলতে থাকে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য আইন প্রণীত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা জাতির পিতার আহ্বানে তাদের অস্ত্র সমর্পন করে। কিন্তু পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে যারা বাংলাদেশে গণহত্যায় অংশ নিয়েছিল, তাদের সকলে অস্ত্র সমর্পণ করেনি। এই দুষ্টচক্র আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর জন্য পরিকল্পিতভাবে চেষ্টা করে। অনেক আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মী হত্যার শিকার হন। থানায় থানায় আক্রমণ হতে থাকে। সিরাজ শিকদার নামে এক চীনপন্থি যুবক ‘সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব’ ও রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের জন্য সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলে। দেশের আরও কয়েকটি স্থানে ‘শ্রেণি-শত্র“ খতমের’ নামে চলে সন্ত্রাস। মহান বিজয় দিবসে সিরাজ শিকদারের ‘সর্বহারা পার্টি’ হরতাল আহ্বান করে। পাটের গুদামে আগুন দেওয়াসহ বহু ধরনের নাশকতা চলতে থাকে।

বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দেন। অর্থনীতি শক্তিশালী করার জন্য নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেন। কৃষি উৎপাদন বাড়তে শুরু করে। বৈদেশিক বাণিজ্যে গতি আসে। কিন্তু আঘাত আসে অলক্ষ্যে। ৩২ নম্বরের বাসস্থানে নিরাপত্তার ত্রুটি কাজে লাগিয়ে ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট জাতির পিতাকে পরিবারের সদস্যদের হত্যা করা হয়। বাংলাদেশ বেতারের নাম বদলে দিয়ে পাকিস্তানের কায়দায় ‘রেডিও বাংলাদেশ’ হয়ে যায়। জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের স্লোগান ওঠে। বাংলাদেশের নাম পরিবর্তন করে ইসলামি প্রজাতন্ত্র রাখার পক্ষে প্রচার চলতে থাকে। দেশ-বিদেশের সংবাদপত্র ও বেতার-টেলিভিশনে আমরা দেখি বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে কুৎসাপূর্ণ প্রচার। সেনাবাহিনী প্রধান জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করে কলমের এক খোচায় সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেন। সমাজতন্ত্র শব্দ মুছে যায়। রাষ্ট্রপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু, তার পরিবার ও স্বজনদের হত্যাকারীদের বিচার কাজ যেন কখনোই হতে না পারে সে জন্য খুনি চক্রের হোতা খোন্দকার মোশতাকের জারি করা কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে বৈধতা দেন। একাত্তরের ঘাতক-দালালদের মুক্ত করে দেওয়া হয়। ঘৃণ্য আলবদর বাহিনীর সংগঠক গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী ও অন্য পলাতক ঘাতকদের বাংলাদেশে নিয়ে এসে পাকিস্তানি ধারায় রাজনীতি করার সুযোগ দেওয়া হয়।

বঙ্গভবনে একদল রাজনীতিক বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম ও জিয়াউর রহমানের সঙ্গে বৈঠক করে আওয়ামী লীগ, মোজাফফর ন্যাপ ও মনি সিংহের নেতৃত্বত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টিকে রাজনীতি করার সুযোগ না দেওয়ার দাবি জানানো হয়। সাধারণ নির্বাচন যেন অনুষ্ঠিত না হয়, সে দাবিও তোলা হয়।

বাঙালি জাতিসত্ত্বার ওপরও আঘাত আসে। ১৯৭৬ সালের ৩ মার্চ সরকারি ঘোষণা জারি হয়- বাংলাদেশের নাগরিকদের বাঙালি নয়, বাংলাদেশী পরিচয় দিতে হবে। বঙ্গবন্ধু যে রেস কোর্স ময়দানে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ ঘোষণা দিয়েছিলেন, সেই ময়দানেই উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এম জি তাওয়াব জাতীয় সঙ্গীত ও জাতীয় পতাকা পরিবর্তনের দাবি করেন।

জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ প্রভৃতি দল চরম উল্লসিত- মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ তাদের কব্জায়। সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের যে স্থানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পূর্ব পাকিস্তান কমান্ডার আমীর আব্দুল্লা নিয়াজী ১৬ ডিসেম্বর মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পনের দলিলে সই করেছিল, সে স্থানটিতে বানানো হয় শিশু পার্ক। বিশিষ্ট সাংবাদিক গিয়াস কামাল চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেছেন, জিয়াউর রহমান ‘মুসলমানদের’ আত্মসমর্পনের স্থানটি মুছে দিতে চেয়েছেন বলেই এ ‘ভাল’ পদক্ষেপ নিয়েছেন।

অথচ ১৬ ডিসেম্বর কোনো ধর্মীয় গোষ্ঠী নয়, বীর বাঙালির কাছে আত্মসমর্পন করেছিল একটি নিষ্ঠুর ঘাতক দল, যারা পবিত্র ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করেছিল বাংলাদেশের ত্রিশ লাখ মানুষকে হত্যার জন্য, যাদের বেশিরভাগ ছিল ইসলাম ধর্মের অনুসারী।

এ বছরের ৫ অগাস্ট সামরিক আদেশ জারি হয়- বঙ্গবন্ধু কিংবা জাতির পিতা লেখা বা বলা যাবে না। এক বছর আগে জাতির পিতাকে হত্যা করেও তাকে যে মানুষের মন থেকে মুছে ফেলা যায়নি, এ আদেশ থেকে তা স্পষ্ট হয়।

১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের বাসভবনে ছাত্রজনতাকে প্রবেশ করতে বাধা দেওয়া হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আয়োজিত মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠানেও আসে বাধা। পরের বছরগুলোতেও চলতে থাকে বঙ্গবন্ধুর অবদান অস্বীকারের হীন চেষ্টা।

১৫ অগাস্টের পর কারাগারগুলো বঙ্গবন্ধুর অনুসারীতে ভরে যায়। ১৯৭৬ সালের ১৫ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববদ্যিালয় বা বুয়েট এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজের সব হল-হোস্টেল সেনাবাহিনী-পুলিশ-বিডিআর বাহিনী দিয়ে ঘেরাও করে এক হাজারের বেশি ছাত্রছাত্রীকে বন্দি করা হয়। রাজনীতির ময়দানে সক্রিয় কেবল মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীরা, একাত্তরের ঘাতক-দালালরা। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পক্ষে চলছে নির্লজ্জ সাফাই। এই অপশক্তির কাছে ১৫ অগাস্ট ‘নাজাত দিবস’। খুনিরা ‘জাতীয় বীর’। জিয়াউর রহমান তখন ময়দানে নেমে পড়েছেন নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করার অভিলাষ নিয়ে- মুক্তিযুদ্ধ ও আওয়ামী লীগ বিরোধী অপশক্তিকে এক প্লাটফরমে আনায় তিনি সচেষ্ট। কট্টর দক্ষিণপন্থি সাম্প্রদায়িক শক্তি হয়ে ওঠে তার ক্ষমতার ভিত। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বাংলাদেশের বিভিন্ন দূতাবাসে নিয়োগ দেন য়িাউর রহমান। খুনিদের এভাবে পুরস্কৃত করা বিশ্বে নজিরবিহীন। নিজের স্বার্থে প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর যদেচ্ছ ব্যবহার করেন তিনি। ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্টের প্রায় ছয় বছর পর বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফিরে এলে জিয়াউর রহমান তাকে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাসভবনে প্রবেশ করতে দেননি। তার প্ররোচনায় গঠিক হয়েছিল ‘হাসিনা প্রতেরাধ’ কমিটি। এ সব অপরাধরূলক কর্মকাণ্ড চলছিল নির্বিঘ্নে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পদদলিত করে।

আওয়ামী লীগের ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা
বঙ্গবন্ধু ও জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পর আওয়ামী লীগ ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য পথের সন্ধান করতে থাকে। পরিবেশ ছিল বৈরী। কারফিউ জারি রয়েছে। সংবাদপত্র এবং বেতার টেলিভিশন সামরিক সরকারের নিয়ন্ত্রণে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নেই। বঙ্গবন্ধু সমর্থক শত শত নেতা-কর্মী কারাগারে। ১৯৭৬ সালের শেষ দিকে মহিউদ্দীন আহমদকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাজেদা চৌধুরীকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরে আহ্বায়কের দায়িত্ব অর্পিত হয় জোহরা তাজউদ্দিনের ওপর। তিনি সম্মেলনের আয়োজন করেন এবং সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন যথাক্রমে আবদুল মালেক উকিল ও আবদুর রাজ্জাক। এর মধ্যেই সামরিক শাসকদের উস্কানিতে আওয়ামী লীগে ভাঙন ধরানো হয়। মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত হয় পাল্টা আওয়ামী লীগ। ভয়ভীতি দেখানো হতে থাকে। প্রলোভন তো ছিলই। এমন পরিস্থিতিতে ১৯৮১ সালের প্রথম দিকে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগ সভাপতি পদে নির্বাচিত করা হয়। কর্মী-সমর্থকরা উল্লসিত। তিনি ১৭ মে লাখ লাখ মানুষের সংবর্ধনায় সিক্ত হয়ে স্বদেশের মাটিতে পা রাখেন এবং আনুষ্ঠানিকভাবে সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দ্রুতই তিনি দলের কর্মী-সমর্থকদের ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত করতে পারেন। তারা নতুন প্রেরণা খুঁজে পায়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশকে ফিরিয়ে নেওয়ার সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করে।

যেখানে বাধা সেখানেই প্রতিরোধ
জিয়াউর রহমান ও এইচ এম এরশাদের দুঃশাসনের আমলে আমলে আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের লড়াই চালিয়ে যায়। তারা বঙ্গবন্ধু ও জেলখানায় জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচারের দাবি ক্রমাগতভাবে তুলতে থাকে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জননেত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে তোলা হয়। ব্রিটেনে অনুসন্ধান কমিশন গঠিত হয়। কিন্তু জিয়াউর রহমান কমিশনের চেয়ারম্যান ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্য স্যার টমাস উইলিয়ামস এবং অন্য সদস্যদের বাংলাদেশে প্রবেশের ভিসা দেননি। সন্তান পিতা-মাতা-ভাই-চাচাসহ পরিবারের সদস্যদের হত্যার বিচার চাইতে পারবে না, এটাই ছিল সামরিক শাসনামলের বাংলাদেশ।

কিন্তু আওয়ামী লীগ জাতির পিতা হত্যার দাবি থেকে কখনও সরে যায়নি। ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ২১ বছর পর আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশের ক্ষমতায় নিয়ে আসতে সক্ষম হন, খুলে যায় ১৫ অগাস্ট নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ।
জিয়াউর রহমানের পর এইচ এম এরশাদ এবং বেগম খালেদা জিয়াও জাতির পিতার হত্যার বিচারের পথে একের পর এক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে থাকেন। এরা এমনকি জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের বিচারেও কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।

জিয়াউর রহমান হত্যার সময় সেনাবাহিনী প্রধান ছিলেন এইচ এম এরশাদ। তিনি সেই অস্থির সময়ের সুযোগ নিয়ে সেনাবাহিনী থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অফিসারদের কয়েকজনকে প্রহসনের বিচারে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। আরও অনেককে অপসারণ করা হয়। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় থাকার সময়েও একই পথে চলেছিলেন। ১৯৭৭ সালের অক্টোবরে কথিত এক সেনা বিদ্রোহের সুযোগ কাজে লাগিয়ে তিনি সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর শত শত অফিসার ও জওয়ানকে প্রহসনের বিচারে হত্যা করেন। তিনি পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর দালাল শাহ আজিজুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের ঘোরতরবিরোধী মশিউর রহমান জাদু মিয়াকে সিনিয়র মন্ত্রী পদে বসিয়েছিলেন।

এইচ এম এরশাদও পাকিস্তানি ঘাতকদের মন্ত্রী সভায় ঠাঁই দেন। বেগম খালেদা জিয়া একাত্তরের ঘাতক আলবদর কমান্ডার জামায়াতে ইসলামীর দুই শীর্ষ নেতা মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মুজাহিদকে মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ পদ দেন। ধর্মান্ধ চরমপন্থি অপশক্তিকে সশস্ত্র উপায়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের সুদূরপ্রসারী চক্রান্ত বাস্তবায়নে সহায়তা দিতে থাকেন। বাংলা ভাই ও শায়খ আবদুর রহমানের সশস্ত্র বাহিনীর তাণ্ডবে যখন জনজীবন অতিষ্ঠ, তখন জামায়াতে ইসলামীর আমীর ও বেগম খালেদা জিয়ার মন্ত্রিসভার সদস্য মতিউর রহমান নিজামী বলতে থাকেন- সব বানোয়াট কথা, মিডিয়ার কল্পকাহিনী রটনা।

তার আমলেই চট্টগ্রামে ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে দশ ট্রাক অস্ত্রের চালান আসে বাংলাদেশে। জেএমবি-হুজির মতো সংগঠন প্রকাশ্যে সশস্ত্র মহড়া দেয়, একের পর এক নারকীয় গ্রেনেড হামলা চালিয়ে জনজীবন অস্থির করে তোলে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীর প্রত্যক্ষ মদতেই বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে ভয়ঙ্কর গ্রেনেড হামলা চালিয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের গোটা কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ও অগণিত কর্মীকে হত্যার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র হয়। পরের বছর ১৭ অগাস্ট দেশের অন্তত ৫০০ স্থানে একযোগে বোমা হামলা হয়। দুর্ভাগ্য, এ হামলার দায় চাপানোর চেষ্টা চলেছিল আওয়ামী লীগের ওপরেই। সারা দেশে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের নির্দেশ গিয়েছিল- পাইকারী হারে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করতে হবে।

বাংলাদেশকে এই অন্ধকার যুগে ফিরিয়ে নেওয়ার অপচেষ্টা শুরু হয়েছিল বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই। এইচ এম এরশাদ ক্ষমতায় এসে এ ধারাকে এগিয়ে নেন। তিনি একুশের শহীদদের প্রতি অমাননাকর উক্তি করেন, যে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার বাঙালির স্বপ্ন ও সাহসের প্রতীক- আনন্দে-উৎসবে কিংবা শোকে বাঙালি যে অঙ্গনে হাজির হয়, সংকল্পবদ্ধ হয় এগিয়ে চলার প্রেরণা পেতে, সেটা নিয়েও কটূক্তি করা হয়।

শেখ হাসিনা সামরিক শাসকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তার প্রতিবাদ করেন। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়া নিরব থাকেন। ১৯৮৩ সালে কুখ্যাত মজিদ খানের শিক্ষা নীতির প্রতিবাদে ছাত্রসমাজ রাজপথে নেমে এলে এইচ এম এরশাদ সেনাবাহিনী দিয়ে তা দমনের চেষ্টা করেন। শেখ হাসিনা ছাত্রদের পাশে দাঁড়ান এবং এ কারণে তাকে সহ বিপুল সংখ্যক রাজনৈতিক নেতাকে বন্দি করে ক্যান্টনমেন্টে আটক রাখা হয়। বেগম খালেদা জিয়া এ সময়েও নিরব থাকেন।

এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৫ দল ছিল সামনের সারিতে। গণতন্ত্রের জন্য তারা দেশবাসীকে সংগঠিত করেছে। ‘আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব’ দাবিতে জনমত গঠন করেছে। তাদের উদ্যোগে বড় বড় সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের বিশাল অঙ্গনে। সেই তুলনায় বেগম খালেদা জিয়ার সাত দল নিজেদের গুটিয়ে রেখেছিল গুলিস্তান চত্বরে। জনগণের ওপর তাদের ভরসা কখনোই ছিল না। প্রাসাদ ষড়যন্ত্র করেই তারা ক্ষমতায় যেতে চেয়েছে।

১৯৮৬ সালের মে মাসের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটের বিজয় ছিল সুনিশ্চিত। কিন্তু এইচ এম এরশাদ মিডিয়া ক্যু করে নির্বাচনের ফল উল্টে দেয়। তার এ অবৈধ কাজে বেগম খালেদা জিয়ার তরফ থেকে মেলে পূর্ণ সমর্থন। প্রকৃতপক্ষে বিএনপি ও জাতীয় পার্টি, ক্ষমতায় যেই দলই থাকুক, উদ্দেশ্য অভিন্ন- মুক্তিযুদ্ধের ধারা থেকে, গণতন্ত্র-সমাজ প্রগতি ও ধর্মনিরপেক্ষতার পথ থেকে বাংলাদেশকে দূরে রাখা। এ দুটি দলের কেউ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে উদ্যোগী হয়নি। পাকিস্তানি বর্বর সেনাবাহিনী বাংলাদেশে গণহত্যা পরিচালনা করেছে- এ চিরন্তন সত্য তারা পাঠ্যবই থেকে তুলে দেয়, সংবাদপত্র-বেতার-টেলিভিশনেও তা প্রচার করায় বাধা দেওয়া হয়। ‘পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর’ পরিবর্তে কেবল ‘হানাদার বাহিনী’ বলা শুরু হয়। ইতিহাস বিকৃতি চলতে থাকে রাষ্ট্রীয় মদদে। জিয়াউর রহমানকে ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ হিসেবে মিথ্যা প্রচার চলে দিনের পর দিন। অন্য সময় তো নয়ই, এমনকি স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান থাকেন নিষিদ্ধ।

জিয়াউর রহমান ও এইচ এম এরশাদ উভয়েই সামরিক আইনের জারি করে সংবিধান অমান্য করেন। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা বাংলাদেশ সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীকে তারা রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার করেন। উভয়েই তাদের অন্যায় কাজের সাংবিধানিক বৈধতা দেওয়ার জন্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সীমাহীন কারচুপি করেন। নির্বাচন সে সময়ে হয়ে ওঠে কেবলই প্রহসন। উভয়ই গণভোটের আয়োজন করেন এবং শতকরা প্রায় একশ’ ভাগ ভোট নিজের পক্ষে প্রদর্শন করেন। তাদের কাছে ক্ষমতাই ছিল মুখ্য এবং এর ব্যবহার করেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নস্যাতের জন্য। বাংলাদেশের উন্নয়ন ও সৃমদ্ধি তাদের কারও কাম্য ছিল না। বিশ্বের বুকে বংলাদেশ যেন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে এমন কোনো পরিকল্পনা তারা কখনো গ্রহণ করেননি। জনকল্যাণে রাষ্ট্রকে ব্যবহারেও তাদের কোনো আগ্রহ ছিল না।

দুঃসময় যেভাবে শেষ হলো
কী দুঃসময়ই না অতিক্রম করতে হয়েছে বাংলাদেশকে। একটানা ২১ বছর প্রিয় স্বদেশ ছিল এমন শক্তির হাতে, যারা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন চায়নি। সমৃদ্ধি চায়নি। মুষ্টিমেয় লোকের হাতে রাষ্ট্রীয় সম্পদ যেন কুক্ষিগত হতে পারে, সে জন্য সম্ভাব্য সবকিছু করেছে। ক্রমাগত উস্কানি দিয়েছে সাম্প্রদায়িকতার। ধর্মান্ধ চরমপন্থি গোষ্ঠীর বিকাশের সুযোগ করে দিয়েছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের রাহুগ্রাসমুক্ত হয়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা- বিএনপি-জামাত-জাতীয় পার্টির কাছে এটা এখনও দুঃস্বপ্ন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ- এটা তারা মানতেই পারছে না। তারা এ দেশে রাজনীতি করছে। কিন্তু মনপ্রাণ সেই পাকিস্তান আমলের মতো। বাংলাদেশ যখন ধন ধান্য পুষ্প ভরা- তখন তাদের গাত্রদাহ হয়। যখন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পাকিস্তানের দ্বিগুণের বেশি হয়, তখন তারা শোকে মূহ্যমান হয়। যখন একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দণ্ড কার্যকর হয়, তখন তারা চোখের পানি ধরে রাখতে পারে না। যখন পাকিস্তানের একদল অর্থনীতিবিদ বলেন- ‘স্বল্পোন্নত কিংবা উন্নয়নশীল দেশকে উন্নতির পথে নিতে নেতৃত্ব প্রদানে কী কী গুণ থাকা দরকার সেটা জানার জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে শিক্ষা নিতে হবে’, তখন তারা অধোবদন হন।

বাংলাদেশ সৃষ্টির প্রেক্ষাপট ছিল আমাদের এ ভূখণ্ডে পশ্চিম পাকিস্তানের সীমাহীন শোষণ-বঞ্চনা। কতভাবেই না তারা আমাদের সম্পদ লুট করেছে। এই লুটপাট যেন বন্ধ হয়, বাংলাদেশ যেন আপন মহিমায় বিকশিত হতে পারে সেজন্যই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। সে সময়ে যারা তার এ মহতী প্রচেষ্টায় বিরোধিতা করেছে, তাদেরই প্রেতাত্মারা এখনও বিএনপি-জামাত-জেএমবির নামে সক্রিয়। ১৯৯৬ সালে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এ অপশক্তিকে পরাস্ত করেছিল। ২০০১ সালের অক্টোবরে ফের তারা আঘাত হানে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা জনগণের ওপর ভরসা হারাননি। তিনি দলকে সুসংগঠিত করেন, জনগণের দরবারে হাজির হন। জনগণ তাকে শক্তি জোগায় এবং তিনি রাষ্ট্র ক্ষমতায় ফিরে সৃষ্টি করতে পারেন ‘বাংলাদেশ মিরাকল’, যা এখন উন্নয়নের মডেল হিসেবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। বাংলাদেশ যেন আর পথহারা না হয়- সকল শুভশক্তির, কল্যাণকামী শক্তির সেটাই একান্ত কাম্য।

সৌজন্যেঃ www.bdnews24.com 

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত