শেখ হাসিনার হাত ধরেই বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে মুক্তি পেয়েছে বাংলাদেশ

3150

Published on আগস্ট 15, 2020
  • Details Image

অধ্যাপক ড. মুনাজ আহমেদ নূর:

১৫ আগস্ট। বাঙালি জাতির বেদনাবিধুর শোকের দিন। ১৯৭৫ সালের এই দিনে স্বাধীনতাবিরোধী নরপিশাচদের বর্বরোচিত হামলায় শহীদ হন আমাদের স্বাধীনতার মহানায়ক সর্বকালে সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সহ তাঁর পরিবারের ২০ জন সদস্য। বাঙালির এই শোকের দিনে আমাদের স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সহ তাঁর পরিবারের সকল শহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যা নিছক কোন সাধারণ ঘটনা ছিলো না। সেদিন বাঙালি জাতির পিতাকে হত্যা করে কেবল রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলই খুনিদের মূল উদ্দেশ্য ছিলো না। সেদিন তারা হত্যা করতে চেয়েছে বাংলাদেশ,বাঙালিসত্তা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে। ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধুসহ তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যা করে একাত্তরের পরাজিত শক্তি সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে পাকিস্তানী ধারায় ফিরিয়ে নেয়ার অপচেষ্টা চালায়।

বঙ্গবন্ধুর চিন্তায় কখনও আসেনি যে,বাঙালিরা ষড়যন্ত্র করে তাঁকে হত্যা করতে পারে। যে বাঙালিকে নিজের জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবেসেছেন সেই বাঙালিরাই তাঁকে হত্যা করে। শুধু জাতির পিতা নয় বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব থেকে শুরু করে ছোট্ট রাসেল পর্যন্ত তাঁর পরিবারের ২০ জন সদস্যকে হত্যা করে ঘাতকরা।এমনকি পৃথিবীর ইতিহাসের জঘন্যতম এই হত্যাকাণ্ডের বিচার বাধাগ্রস্ত করতে সংসদকে কলঙ্কিত করে ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টম্বর ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি)অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছিলো।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তাঁর সপরিবারের সদস্যদের হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল। এ বিষয়ে কারো বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই, থাকার কথাও না।এই হত্যাকাণ্ডের মাত্র ৯ দিনের মাথায় ২৪ আগস্ট ১৯৭৫ এ সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন জিয়াউর রহমান। ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টম্বর ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করা হয়। মোশতাকের জারি করা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে বৈধতা দিয়েছিলো। কারণ বৈধতা দেয়া না হলে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল সামরিক আইন প্রত্যাহারের সঙ্গে সঙ্গেই ১৫ আগস্টের খুনিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যেত। জিয়াউর রহমানই ব্যবস্থা নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি ব্যবস্থা নেওয়া দূরে থাক, ভবিষ্যতে কেউ যাতে ব্যবস্থা না নিতে পারে সে ব্যবস্থা করে দিলেন এবং ঐ সময়ে একটি প্রপাগাণ্ডা ছড়িয়ে দিলেন যে, যেহেতু এটি সংবিধানের অংশ হয়ে গেছে এটি আর পরিবর্তন হবে না এবং এই দোহাই দিয়েই জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পরও বিচারপতি আবদুস সাত্তার, এইচ এম এরশাদ এবং ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এলেও ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি বাতিল বা রহিত করেননি। ফলে দায়মুক্তি পেয়ে খুনিরা ১৫ আগস্টের হত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা প্রকাশ্যেই বলে বেড়াত। যা জাতি হিসাবে আমাদের জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক।

জিয়া ক্ষমতা গ্রহণের পর ১৫ ই আগস্ট হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বৈদেশিক মিশনগুলোতে চাকুরি দিয়ে পুনর্বাসন করেন।তাদের বিরুদ্ধে কোন আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ না করে আবার তাহাদের বিদেশে পাঠিয়ে দেন। জিয়া কর্তৃক খুনিদের বৈদেশিক দূতাবাসে পদায়ন করে পুরস্কৃত করা হয় এবং পরবর্তীতে তাদের খুনের দায় থেকে বাঁচানোর জন্য ইনডেমনিটি আইন প্রণয়ন করার ঘটান।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের তদন্তে যুক্তরাজ্যে যে অনুসন্ধান কমিশন গঠিত হয়েছিল, তার সদস্যদের বাংলাদেশে আসতে দেওয়া হয়নি। ১৯৮১ সালে বিদেশি এই কমিশনের সদস্যদের বাধা দেওয়ার সময় বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি ছিলেন জিয়াউর রহমান, যিনি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসেন।যুক্তরাজ্যের এই কমিশন ১৯৮২ সালের ২০ মার্চ তাদের প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। কমিশন তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে আইনি ও বিচার প্রক্রিয়াকে তার নিজস্ব পথে এগোতে দেওয়া হয়নি। আর এজন্য জিয়া সরকারই দায়ী। বিচার পাওয়ার পথে প্রতিবন্ধকতা দূর করতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান রেখেছিল স্বাধীন এই অনুসন্ধান কমিশন তাতেও কান দেওয়া হয়নি। ১৯৮০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর কমিশন প্রথম বৈঠকে বসে, এরপর সদস্যরা সিদ্ধান্ত নেন বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া ঘটনাটির বিষয়ে অনুসন্ধান চালাবেন তারা।এরপর কমিশনের সদস্যরা বাংলাদেশে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এবং ভিসার জন্য লন্ডনের বাংলাদেশ দূতাবাসের শরণাপন্ন হন।

১৯৮১ সালের জানুয়ারিতে কমিশনের পক্ষে বাংলাদেশে আসার ভিসার আবেদন করেছিলেন এবং ভিসা না পাওয়ায় এই সফর হয়নি। কেন ভিসা দেওয়া হয়নি, সে বিষয়ে দূতাবাসের পক্ষ থেকে কিছু জানানোও হয়নি। দূতাবাসে কয়েকবার চিঠি দিলেও তা গ্রহণ করা হয়নি।

‘শেখ মুজিব মার্ডার ইনকোয়ারি: প্রিলিমিনারি রিপোর্ট অব দ্য কমিশন অব ইনকোয়ারি’ প্রতিবেদনটি পুস্তিকা আকারে লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয়,যার মুখবন্ধ লিখেছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা, যিনি এখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।

যুক্তরাজ্যে গঠিত এই কমিশনের সদস্যদের প্রতি আস্থা রেখে তিনি লিখেছিলেন, “তাদের নামগুলো এই নিশ্চয়তা দেয় যে তাদের তদন্ত বিচার ব্যবস্থার সর্বোচ্চ মান অক্ষুণ্ণ রেখেই হত।”বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের একুশ বছর পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর বিচারের পথ খোলে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল সংক্রান্ত আইনগত দিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব আমিন উল্লাহর নেতৃত্বে যে কমিটি গঠন করা হয়, তাদের রিপোর্টেই প্রকাশ পায় এই কুখ্যাত আইনটি বাতিলের জন্য সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন নেই।

বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার সুদক্ষ নেতৃত্বে বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে উত্তরণ ঘটেছে। শেখ হাসিনা চাইলে জাতির পিতার হত্যাকারীরেদর বিচার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেন নি।তিনি আমাদের নিজস্ব বিচার ব্যবস্থার উপর আস্থা রেখেছেন।১৯৯৬ সালে জাতির পিতা হত্যার বিচার শুরু করে শেষ করেছেন ২০০৮ সাল পরবর্তী ক্ষমতায় আসার পর।তাঁর এটা করার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে বিচার বিভাগের প্রতি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা।একই পন্থা তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচারের ক্ষেত্রেও অনুসরণ করেছেন। যে দেশে বঙ্গবন্ধু খুন হয়েছিলেন, জাতীয় চার নেতা খুন হয়েছিলেন, সেখানে এই হত্যাকাণ্ডগুলোর বিচার হয়নি, উল্টো খুনিরা পুরস্কৃত হয়েছিলেন। সেই দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করে দেশকে বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে মুক্ত করেছেন শেখ হাসিনা এবং বাংলাদেশে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণও তিনি নিজে উদ্যোগ নিয়ে করেছেন। স্বাধীনতার ৫০ বছর হতে চললো জনগণের চাপ ছিল বাংলাদেশে যেন বিচারহীনতার রাজনীতির অবসান হয়ে সুশাসন ও জনগণের শাসন যেন ফিরে আসে।শেখ হাসিনা বাংলাদেশের মানুষকে উপহার দিয়েছেন।

লেখক: উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত