মুদ্রার অপর পীঠে রয়েছে ভালো কিছু !

2849

Published on জুলাই 24, 2020
  • Details Image

মাহমুদ মেননঃ  

কিছু পরিসংখ্যান দিয়ে শুরু করা যাক। দেশে কোভিড-১৯ এর চিকিৎসায় হাসপাতালে শয্যা সংখ্যা প্রস্তুত রয়েছে ১৫৪৬৮টি। রোগী ভর্তি আছে ৪২৬১ জন। সারাদেশে আ্‌ইসিইউ প্রস্তুত রাখা হয়েছে ৫১১টি। রোগী ভর্তি আছে ২৮২। অক্সিজেন সিলিন্ডার ১২২৩৩টি। হাই ফ্লো ন্যাজল ক্যানোলা রয়েছে ২৭৭টি, অক্সিজেন কনসেন্ট্রেটর ১১০টি। এই পরিসংখ্যান ২৩ জুলাই ২০২০ তারিখের।

এবার আমরা জুনের প্রথম ও দ্বিতীয় সপ্তাহের শুরুতে সংবাদমাধ্যমের খবরের হেডলাইনগুলো একটু দেখে আসি- সারাদেশের হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ’র জন্য হাহাকার। ঘুরে ঘুরেও মিলছে না আইসিইউ, মিলছে না শয্যা, আইসিইউ অক্সিজেন, দেশে আইসিইউ কতটি? কিভাবে চলে? প্রশ্ন হাইকোর্টের, ইত্যাকার আরও অনেক। খবরের কাগজ, অনলাইন ছাড়াও টেলিভিশন টকশো’রও মূল উপজীব্য ছিলো এই আইসিইউ সঙ্কট।

এবার দুটি সময়ের কোভিড-১৯ সংক্রমণের তুলনামূলক চিত্রটি দেখি। জুনের প্রথম সপ্তাহের তৃতীয় দিনটিতে কেমন ছিলো পরিস্থিতি। এই দিন করোনা ভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা করা হয় ১২ হাজার ৫১০ জনের। এর মধ্যে কোভিড-১৯ শনাক্ত হয় ২৬৯৫ জনের শরীরে। এই দিন মৃত্যুবরণ করেন ৩৭ জন। আর ওই দিনে করোনা আক্রান্ত রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন ৪৭০ জন।

এবার ২৩ জুলাই তারিখের পরিসংখ্যানে নজর দেই। ২৪ ঘণ্টার সবশেষ সাইকেলে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এই সময়ে ভাইরাসটির অস্তিত্ব শনাক্ত হয়েছে ২ হাজার ৮৫৬ জনের শরীরে। সবশেষ ২৪ ঘণ্টায় দেশের মোট ১২ হাজার ২৯৮ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। ২৪ ঘণ্টায় ২ হাজার ৬ জন কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত রোগী সুস্থ হয়ে ওঠেন।

দেড় মাস সময়ের ব্যবধানে আমরা কোভিড-১৯ এর বিস্তার ও মৃত্যুর পরিসংখ্যানে একইরকম পরিস্থিতি দেখছি। এর মধ্যে অবশ্য এক দিনে সর্বোচ্চ ৬০ জনে উঠেছে। তবে ধীরে ধীরে তা নেমে আবার ৩০ থেকে ৪০ এর ঘরেই বেশি থাকছে। কোনও কোনও দিন তা ৩০ এর নিচেও নামছে আবার কোনো দিন ৫০ শেও উঠছে। শনাক্তের ক্ষেত্রে পরীক্ষা করার নমুনা সংখ্যার তুলনামূলক বিচারে পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হয়নি। তবে অবনতিও হয়নি। আর রোগীর সুস্থ হয়ে ওঠার পরিসংখ্যান বলছে এই সংখ্যা প্রায় ৫ গুন বেড়েছে। এটা নিঃসন্দেহে চিকিতসকদের পরম নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে চিকিতসা নিশ্চিত করার কারণেই হয়েছে। তবে যেটা সবচেয়ে চোখে পড়ার মতো পরিবর্তন তা হচ্ছে চিকিতসা ব্যবস্থার সক্ষমতা। জুনের গোড়ায় যেখানে আইসিইউ’র জন্য হাহাকার ছিলো, এখন সেখানে সারাদেশে ৫১১টি আইসিইউ প্রস্তুত রাখা রয়েছে, যার মধ্যে খালি রয়েছে ২২৯টি। অর্থাত কোনও কারণে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর যদি আইসিইউ প্রয়োজন হয়, তার জন্য কোনো হাহাকার হবে না। আর একটি বিষয় গোটা বিশ্বেই যতজন রোগী হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে তাদের মধ্যে মাত্র ১ শতাংশ এখন ক্রিটিক্যাল অবস্থায় রয়েছেন। এছাড়া আমরা যদি সাধারন হাসপাতাল শয্যার দিকে তাকাই তাতেও এই মূহূর্তে দেশে যতজন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন তার চেয়ে প্রায় তিনগুন বেশ হাসপাতাল শয্যা্ কোভিড-১৯ ডেডিকেটেড করে খালি রয়েছে।

ঠিক দেড় মাসের ব্যবধানে করোনা রোগীর চিকিতসার সক্ষমতা এভাবেই বাড়ানো হয়েছে। অক্সিজেন সিলিন্ডার এখন ১২২৩৩টি রয়েছে। অথচ রোগী ভর্তি রয়েছে ৪২৬১ জন। এই অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়েও সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে দিনের পর দিন। একটি শিরোনাম- করোনাকালে অক্সিজেন সিলিন্ডার যেনো সোনার হরিণ। অথচ এখন প্রয়োজনের চেয়ে তিনগুন অক্সিজেন সিলিন্ডার জমা রাখা রয়েছে। এছাড়া অক্সিজেন কনসেন্ট্রেটর ১১০টি যার খুব কমই এখন ব্যবহৃত হচ্ছে। এর বাইরে হাই ফ্লো ন্যাজল ক্যানোলা রয়েছে ২৭৭টি। আইসিইউতে ভর্তি রোগীর সকলকেই এই ক্যানোলা দেওয়া সম্ভব। যদিও চিকিতসকরা বলছেন, সকল রোগীর এটি প্রয়োজন হয় না।

তাহলে, করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের এই ডেমোগ্রাফিগুলো অন্তত তিনটি পথে বাংলাদেশের সাফল্য তুলে ধরে, এক. ভাইরাসটির বিস্তার নিয়ন্ত্রণে রাখা, দুই ভাইরাসটিতে মৃত্যুর হার নিয়ন্ত্রণে রেখে ধীরে ধীরে কমিয়ে আনা, আর তিন. এর জন্য প্রয়োজনীয় চিকিতসা ব্যবস্থায়, চিকিতসা সামগ্রিতে সক্ষমতা বাড়ানো।

বিষয়গুলো মিডিয়ায় সেভাবে আসছে না। বেড়েছে আইসিইউ’র সক্ষমতা এই কথাটি লিখে গুগল সার্চ দিয়ে প্রথম পাতায় পাওয়া চারটি শিরোনাম-আইসিইউ'র জন্য হাহাকার, জুন ৬, ইনকিলাব, আইসিইউ'র জন্য আহাজারি, জুন ৯, মানবজমিন, করোনা ভাইরাস: আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, বাড়েনি কোন চিকিৎসা সুবিধা- বিবিসি বাংলা, জুন ১৩। করোনা চিকিৎসায় সক্ষমতা বাড়ছে চট্টগ্রামে, হাসপাতালে গতকাল খালি ছিল ৩২১ বেড ও ১৭ আইসিইউ, দৈনিক আজাদী, চট্টগ্রাম।

একমাত্র দৈনিক আজাদী খবরটা এভাবে আনলো। বাকি মিডিয়াগুলোতে সেরকম কোনও খবর নেই। বরং পুরোনা হাহাকার, আহাজারিই এখনো শোভা পাচ্ছে অনলাইনের পাতায় পাতায়।

এখন আমরা একটু বিদেশি উদাহরণের দিকে তাকাই। আমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে- জার্মানি যখন কোভিড-১৯ এর বিস্তার মোকাবেলা করে অনেকটা সফল, তখন একটা ঘোঘণা দিয়েছিলো তাদের দেশে যতজন রোগী তার চেয়ে শয্যা সংখ্যা কিংবা আইসিইউ’র সংখ্যা তিনগুন বেশি। বিশ্ব মিডিয়ায় খবরের শিরোনাম হয়- ওভারসাপ্লাই অব হসপিটাল বেডস হেলপস জার্মানি টু ফাইট ভাইরাস। একই ধরনের শিরোনাম কি এখন বাংলাদেশের জন্য হতে পারে না। হয়তো পারে।

একটি উদাহরণ দিচ্ছি এই জার্মানিকে নিয়ে আমাদের দেশের মিডিয়াগুলোর খবর থেকেই। ১ জুলাইয়ে একটি প্রধান সারির মিডিয়ায় প্রকাশিত খবরের শিরোনাম- ‘জার্মানির করোনা ব্যবস্থাপনা থেকে আমরা কী শিখতে পারি’। সেই খবরের মেজর ডিটেইলসে গিয়ে লেখা হচ্ছে- জার্মানিতে আজ অবদি ১ লাখ ৯৫ হাজার মানুষের করোনা শনাক্ত হলেও মৃত্যুর সংখ্যা ৮ হাজার ৯০০। এই হার তুলনামূলকভাবে অনেক ইউরোপীয় রাষ্ট্রের চেয়ে কম (৪ শতাংশ)। এর কারণ, সবাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেন। করোনার উপসর্গ দেখা দিলেই ডাক্তারের কাছে যাওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

পরিসংখ্যাণটি লক্ষ্য করুন- ১ লাখ ৯৫ হাজার আক্রান্তের মধ্যে ৮ হাজার ৯০০ জনের মৃত্যু মানে হচ্ছে আক্রান্ত মানুষের মধ্যে ৪.৫ শতাংশ রোগীরই মৃত্যু হয়েছে। বাংলাদেশের সবশেষ পরিসংখ্যান বলছে- মোট মৃত্যু ২৮০১ জন। আর আক্রান্ত হয়েছে ২ লাখ ১৬ হাজার ১১০ জন। তাতে আক্রান্ত মানুষের ১.২ শতাংশ মানুষ। তার পরেও আমাদের মিডিয়াগুলো বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার নিন্দাই করে চলেছে।

হ্যাঁ নিন্দা করার মতো রয়েছে অনেক কিছুই। শাহেদ করিম, সাবরিনা রয়েছে, রিজেন্ট জিকেজি রয়েছে। এসবের নোংরামি ভয়াবহ। মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তরের দুর্নীতি চরমে। সেগুলোকে হাইলাইট করতেই হবে। কিন্তু তাই বলে- সাফল্যগুলো একেবারেই সামনে আসবে না, সেটা হতে পারে না্। আমাদের বোধ হয়, বিষগুলো নিয়ে আরেকটু ভাবা উচিত।

কোভিড-১৯ আসার পর থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগগুলো, সবকিছু্তে তার সার্বক্ষণিক মনিটরিং এবং উন্নয়নে, উন্নতকরণে সরাসরি হস্তক্ষেপ ছিলো, তাতেই এসব অর্জন। সে প্রশংসা কিন্ত বিশ্বের কাছ থেকে তিনি ঠিকই পাচ্ছেন। ফোর্বস ম্যাগাজিন এ নিয়ে রিপোর্ট করছে, যা হয়তো অনূদিত হয়ে আসছে আমাদের কোনো কোনো মিডিয়ায়। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম শেখ হাসিনার ভূমিকাকে ‘অ্যডমায়রবল’ বলছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশের প্রশংসা করছে, বিশ্বের নেতারা পাঠাচ্ছেন প্রশংসার বাণি। সবশেষ বাংলাদেশের চেয়ে দ্বিগুন মৃত্যুহার নিয়ে দিশেহারা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান শেখ হাসিনাকে ফোন করে জানতে চেয়েছেন কিভাবে তিনি মোকাবেলা করছেন করোনা ভাইরাসের এই মহামারী।

তার মানেই হচ্ছে- স্বাস্থ্যখাতের ভঙ্গুরতা এই কোভিড-১৯ আমাদের সামনে তুলে ধরেছে, সেটা যেমন সত্য। নেতৃত্বের দৃঢ়তায় সে ভঙ্গুর দশার মাঝেও দেশের অর্জন কিংবা সক্ষমতা নেহায়েত কম নয় সেটাও সত্য। মুদ্রার এ পীঠটি আমরা যেমন দেখছি, অপর পীঠটিও বোধহয় এক-আধবার উল্টে দেখা উচিত। তাতে ভালো কিছু নজরে পড়তে পারে।

ব্যাড নিউজ ইজ গুড নিউজ, সেটা সত্যি। দেখার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টালে, গুড নিউজেও আমরা সংবাদের উপাদান খুঁজে পাবো। সে অনুযায়ী খবর লিখলে, প্রকাশ করলেও সাংবাদিকতার উতকর্ষতা হবে বৈকি! 

লেখকঃ সাংবাদিক ও শিক্ষক

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত