18883
Published on জুন 1, 2021ছয় দফা আন্দোলন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সুচনাবিন্দু। নিজেদের অধিকার আদায়ের আদায়ের সংগ্রাম বাঙ্গালি জাতি অনেক আগে থেকেই করে আসছে। কিন্তু নিজেদের আত্মপরিচয়ের চাহিদা, এর জন্য সংগ্রামের প্রেরণা, নিজেদের স্বপ্নের বাস্তবিক কাঠামো বাঙ্গালি জাতি ছয় দফা থেকেই পেয়েছে। এই ছয় দফার প্রচারের ভয়ে ভীত হয়েই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ফাঁসানো হয়েছিলো তাঁকে। '৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিলো এই ছয় দফার কারনেই। ছয় দফা আন্দোলন শেখ মুজিবকে করেছে 'বঙ্গবন্ধু'। এই কর্মসূচিকে ঘিরে গবেষণা করেছেন অনেকেই। পক্ষে-বিপক্ষে অনেক আলোচনা-সমালোচনা ছিল তখন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ছয় দফা কর্মসূচির প্রণেতা এবং আমাদের স্বাধিকার আন্দোলনের রুপকার, তাঁর কাছে ছয় দফা কি ছিল? কেন তিনি দলের ভেতরে-বাইরে এত সমালোচনা স্বত্ত্বেও ছয় দফাকে আঁকড়ে ছিলেন? কেন তাঁর কাছে মনে হয়েছিলো যে ছয় দফাই আমাদের বাঁচাবে? কেন তিনি এই কর্মসুচিকে বলেছিলেন "আমাদের বাঁচার দাবি"? নিচের লেখাগুলো বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী মুলক গ্রন্থ 'কারাগারের রোজনামচা' থেকে উদ্ধৃত। বইটির বিভিন্ন স্থানে ছয় দফা সম্পর্কিত লেখা পাওয়া যায়। সেগুলোই সংকলন করে এখানে তুলে ধরা হয়েছেঃ
২রা জুন ১৯৬৬ঃ
সকালে ঘুম থেকে উঠেই শুনলাম রাত্রে কয়েকজন গ্রেফতার হয়ে এসেছে। কয়েদিরা, সিপাহিরা আলোচনা করছে। ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। বুঝতে বাকি রইলনা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ এবং কর্মীদের নিয়ে এসেছে, ৭ই জুনের হরতালকে বানচাল করার জন্য। অসীম ক্ষমতার মালিক সরকার সবই পারেন। এত জনপ্রিয় সরকার তাহলে গ্রেপ্তার শুরু করেছেন কেন। পোস্টার লাগালে পোস্টার ছিড়ে ফেলা, মাইক্রোফোনের অনুমতি না দেওয়া, অনেক অত্যাচারই শুরু করেছে। জেলের এক কোণে একাকী থাকি, কিভাবে খবর জানব?
শুনলাম ১২/১৩ জন রাতে এসেছে। নাম কেউ বলতে পারে না বা বলতে পারলেও বলবে না। খবরের কাগজে কারও কারও নাম উঠবে। একই জেলে থেকেও কারও সাথে কারও দেখা হওয়া তো দূরের কথা, খবর পাওয়ার সাধ্য নাই নতুন লোকের পক্ষে। তবে আমি পুরানা লোক- বহুবার এই জেলে অতিথি হয়েছি। এই জেলের সকলেই আমাকে জানে। নিশ্চয়ই বের করে নেব।
আবদুল মোমিন এডভোকেট, প্রচার সম্পাদক আওয়ামী লীগ, ওবায়দুর রহমান, সাংস্কৃতিক সম্পাদক, হাফেজ মুছা, ঢাকা শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি, মোস্তফা সরোয়ার, নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহাবুদ্দিন চৌধুরী, সহ-সভাপতি ঢাকা শহর আওয়ামী লীগ, রাশেদ মোশাররফ, সহ সম্পাদক, ঢাকা শহর আওয়ামী লীগ, আওয়ামী লীগ কর্মী হারুনুর রশিদ ও জাকির হোসেন | দশ সেলে এদের রাখা হয়েছে । এত খারাপ সেল ঢাকা জেলে আর নাই। এখানে আমাদের প্রথম রাখা হয়েছিল । আমরা প্রতিবাদ করে ওখান থেকে চলে আসি । বাতাস ঐ সেলে ভুল করেও ঢোকে না। মন খুব খারাপ হয়ে গেল। ডেপুটি জেলার সাহেবকে বললাম । শুনলাম মোমিন সাহেব ডিআইজি সাহেবকে বললেন।
এই নেতৃবৃন্দ গ্রেপ্তার হওয়ার জন্য আন্দোলন যে পিছাইয়া যাবে না, সে সম্বন্ধে আমার সন্দেহ নাই। বুঝলাম সকলকেই আনবে জেলে। ধরতে পারলে কাউকে ছাড়বে না । মীজান ফিরে এসেছে এই একটা ভরসা। অনেকে আবার ভয়েতে ঘরে বসে যাবে, সে আমার জানা আছে। হাফেজ মুছা সাহেব বুড়া মানুষ কষ্ট পাবেন হয়তো, পূর্বে কোনো দিন জেলে আসেন নাই। তবে শক্ত মানুষ। চৌধুরী সাহেব বেচারা খুবই নরম। আর সকলেই শক্ত আছে। আন্দোলনের ক্ষতি হবে এই ভাবনা আমার মনটাকে একটু চঞ্চল করেছে।
কোনোমতে খেয়ে বসে রইলাম, খবরের কাগজ কখন আসবে? কাগজ এল… ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা থেকে খবর এসেছে পুলিশ বাহিনী নিজেরাই দিনের বেলায় ৭ই জুনের পোস্টার ছিড়ে ফেলছে। ঢাকা ও অন্যান্য জায়গায় তো করছেই। এই তো স্বাধীনতা আমরা ভোগ করছি।
এক অভিনব খবর কাগজে দেখলাম, মর্নিং নিউজ কাগজে ন্যাপ নেতা মিঃ মশিউর রহমান ফটো দিয়ে একটা সংবাদ পরিবেশন করেছে। ইত্তেফাক ও অন্যান্য কাগজেও খবরটি উঠেছে। তিনি ছয় দফার দাবি সম্বন্ধে তার মতামত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, 'ছয় দফা কর্মসূচী কার্যকর হইলে, পরিশেষে উহা সমস্ত দেশে এক বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাব জাগাইয়া তুলিবে। এমনকি তিনি যদি প্রেসিডেন্ট হতেন তাহা হলে ছয় দফা বাস্তবায়িত হতে দিতেন না।' এদের এই ধরনের কাজেই তথাকথিত প্রগতিবাদীরা ধরা পড়ে গেছে জনগণের কাছে। জনগণ জানে এই দলটির কিছু সংখ্যক নেতা কিভাবে কৌশলে আইয়ুব সরকারের অপকর্মকে সমর্থন করছে। আবার নিজেদের বিরোধী দল হিসেবে দাবি করে এরা জনগণকে ধোকা দিতে চেষ্টা করছে। এরা নিজদেরকে চীনপন্থী বলে থাকেন। একজন এক দেশের নাগরিক কেমন করে অন্য দেশপন্থী, প্রগতিবাদী হয়? আবার জনগণের স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে চিৎকার করে । ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করতে চাই না, তবে যদি তদন্ত করা যায় তবে দেখা যাবে, মাসের মধ্যে কতবার এরা পিন্ডি করাচী যাওয়া-আসা করে, আর পারমিটের ব্যবসা বেনামীভাবে করে থাকে। এদের জাতই হলো সুবিধাবাদী। এর পূর্বে মওলানা ভাসানী সাহেবও ছয় দফার বিরুদ্ধে বলেছেন, কারণ দুই পাকিস্তান নাকি আলাদা হয়ে যাবে।।
মওলানা সাহেবকে আমি জানি, কারণ তিনিই আমার কাছে অনেকবার অনেক প্রস্তাব করেছেন । এমন কি ন্যাপ দলে যোগদান করেও। সেসব আমি বলতে চাই না। তবে ‘সংবাদে'র সম্পাদক জহুর হোসেন চৌধুরী সাহেব জানেন। এসব কথা বলতে জহুর ভাই তাকে নিষেধও করেছিলেন। মওলানা সাহেব পশ্চিম পাকিস্তানে যেয়ে এক কথা বলেন, আর পূর্ব বাংলায় এসে অন্য কথা বলে। যে লোকের যে মতবাদ সেই লোকের কাছে সেই ভাবেই কথা বলেন। আমার চেয়ে কেউ তাকে বেশি জানে না। তবে রাজনীতি করতে হলে নীতি থাকতে হয়। সত্য কথা বলার সাহস থাকতে হয়। বুকে আর মুখে আলাদা না হওয়াই উচিত।
৪ঠা জুন ১৯৬৬ঃ
ইত্তেফাক দেখে মনে হলো ৭ই জুনের হরতল সম্বন্ধে কোন সংবাদ ছাপতে পাড়বে না বলে সরকার হুকুম দিয়েছে। কিছুদিন পূর্বে আরও হকুম দিয়েছে এক অংশ অন্য অংশকে শোষণ করছে এটা লিখতে পারবা না। ছাত্রদের কোন নিউজ ছাপতে পারবা না। আবার এই যে হুকুম দিলাম সে খবরও ছাপাতে পারব না।' ইত্তেফাকের উপর এই হুকুম দিয়েছিল। এটাই হল সংবাদপত্রের স্বাধীনতা।
আওয়ামী লীগ কর্মীরা আর ছাত্র তরুন কর্মীরা কাজ করে যেতেছে। বেপরোয়া গ্রেপ্তারের পরও ভেঙে পড়ে নাই দেখে ভালই লাগছে। রাজনৈতিক কর্মীদের জেল খাটতে কষ্ট হয় না যদি বাইরে আন্দোলন থাকে।
৫ই জুন ১৯৬৬ঃ
আওয়ামী লীগ কর্মীদের গ্রেপ্তার করে চলেছে। আরও আটজন কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে বিভিন্ন জায়গার। দমননীতি সমানে চালাইয়া যেতেছে সরকার। নির্যাতনের মধ্য দিয়ে গণদাবি দাবাইয়া দেওয়া যায় না। গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে, গণতান্ত্রিক পথেই মোকাবিলা করা উচিত। যে পথ অবলম্বন করেছে তাতে ফলাফল খুব শুভ হবে বলে মনে হয় না। আওয়ামী লীগ কর্মীরা যথেষ্ট নির্যাতন ভোগ করেছে। ছয় দফা দাবি যখন তারা দেশের কাছে পেশ করেছে তখনই প্রস্তুত হয়ে গিয়াছে যে তাদের দুঃখ কষ্ট ভোগ করতে হবে। এটা ক্ষমতা দখলের সংগ্রাম নয়, জনগণকে শোষণের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য সংগ্রাম। যথেষ্ট নির্যাতনের পরেও আওয়ামী লীগ কর্মীরা দেশের আইন শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে নাই। তবুও পোস্টারগুলি পুলিশ দিয়ে তুলে ফেলান হতেছে। ছাপানো পোস্টার জোর করে নিয়ে যেতেছে সরকারি কর্মচারীদের দিয়ে।
এখন একমাত্র চিন্তা কর্মীরা নেতা ছাড়া আন্দোলন চালাইয়া যেতে সক্ষম হবে কিনা! আমার বিশ্বাস আছে আওয়ামী লীগের ও ছাত্রলীগের নিঃস্বার্থ কর্মীরা, তাদের সাথে আছে। কিছু সংখ্যক শ্রমিক নেতা-যারা সত্যই শ্রমিকদের জন্য আন্দোলন করে—তারাও নিশ্চয়ই সক্রিয় সমর্থন দেবে । এত গ্রেপ্তার করেও এদের দমাইয়া দিতে পারে নাই। ৭ই জুন হরতালের জন্য এরা পথসভা ও মিছিল বের করেই চলেছে । পোস্টার ছিড়ে দিলেও নতুন পোস্টার লাগাইতেছে, প্যামফ্লেট বাহির করছে। সত্যই এতটা আশা আমি করতে পারি নাই।
মাথার ভিতর শুধু ৭ই জুনের চিন্তা। কি হবে। তবে জনগণ আমাদের সঙ্গে আছে। জনমত আমার জানা আছে।
৬ই জুন ১৯৬৬ঃ
আগামীকাল ধর্মঘট। পূর্ব বাংলার জনগণকে আমি জানি, হরতাল তারা করবে। রাজবন্দিদের মুক্তি তারা চাইবে। ছয়দফা সমর্থন করবে। তবে মোনায়েম খান সাহেব যেভাবে উস্কানি দিতেছেন তাতে গোলমাল বাধার চেষ্টা যে তিনি করছেন। এটা বুঝতে পারছি । জনসমর্থন যে তার সরকারের নাই তা তিনি বুঝেও, বোঝেন না।
ঘরে এসে বই পড়তে শুরু করে আবার মনটা চঞ্চল হয়ে যায়, আবার বাইরে যাই-কেবল একই চিন্তা! দুপুর বেলা খাওয়ার পূর্বেই কাগজগুলি এল।
ধরপাকড় চলছে সমানে। কর্মীদের গ্রেপ্তার করছে। যশোরে আওয়ামী লীগ অফিস তল্লাশি করেছে । ভূতপুর্ব মন্ত্রী আওয়ামী লীগ নেতা জনাব মশিয়ুর রহমান প্রতিবাদ করেছেন। জনাব নূরুল আমীন সাহেব আওয়ামী লীগ কর্মী ও নেতাদের গ্রেপ্তারের তীব্র সমালোচনা করেছেন এবং মুক্তি দাবি করেছেন। তিনি বলেছেন, 'শত্রু নাশের জন্য রচিত আইনে দেশবরেণ্য নেতৃবৃন্দের গ্রেপ্তার দেশবাসীকে স্তম্ভিত করিয়াছে।' ঢাকার মৌলিক গণতন্ত্রী সদস্যরা এক যুক্ত বিবৃতিতে আমাকে সহ সকল রাজবন্দীর মুক্তি দাবি করিছে, আর ৬ দফা দাবিকে সমর্থন করিয়াছে এবং জনগনকে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে শরিক হওয়ার আহবান জানিয়েছেন।
৯ জন আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি ও ধরপাকড়ের তীব্র প্রতিবাদ করিয়াছে এবং তাদের মুক্তি দাবি করিয়াছেন। আওয়ামী লীগ, শ্রমিক, ছাত্র ও যুব কর্মীরা হরতালকে সমর্থন করে পথ সভা করে চলেছেন। মশাল শোভাযাত্রাও একটি বের করেছে। শত অত্যাচার ও নির্যাতনেও কর্মারা ভেঙে পড়ে নাই। আন্দোলন চালাইয়া চলেছে। নিশ্চয়ই আদায় হবে জনগণের দাবি।
গভর্ণর নারায়ণগঞ্জ জনসভায় আবার হুমকি ছেড়েছেন। তিনি বলেছেন, আইন শৃঙ্খলা ভঙ্গের চেষ্টা করলে কঠোর হস্তে দমন করবেন। আইন শৃখলা আওয়ামী লীগ কোনোদিন ভাঙতে চায় নাই। তারা বিশ্বাস করে না ঐ রাজনীতিতে। কিন্তু যিনি আইন শৃঙ্খলার মালিক হয়ে আইন শৃখলা ভাঙতে উস্কানি দিতেছেন তার বিচার কে করবে? যার সরকার বেআইনি এবং অন্যায়ভাবে কর্মীদের হয়রানি করছেন, গ্রেপ্তার করছেন তার বিচার কবে হবে? মোনায়েম খান সাহেবের জানা উচিত ১৯৪৯ সাল থেকে আওয়ামী লীগ কর্মীরা অনেকবার জেলে গেছেন, মিথ্যা মামলার আসামিও হয়েছেন। পূর্বের সরকার এবং মুখপাত্ররা এ রকম হুমকি অনেকবার দিয়েছেন। সরকার কর্মীদের বন্দি করেও অত্যাচার করেছে, ২৪ ঘণ্টা তালা বন্ধ করে রেখেছে জেলের মধ্যে। নারায়ণগঞ্জে মোস্তফা সারওয়ার, শামসুল হক ভূতপূর্ব এম এ, হাফেজ মুছা সাহেব, আব্দুল মোমিন এডভোকেট, ওবায়দুর রহমান, শাহাবুদ্দিন চৌধুরীর মতো নেতৃবৃন্দকে 'সি' ক্লাস করে রাখা হয়েছে । কি করে এই সরকার সভ্য সরকার বলে দাবি করতে পারে আমি ভেবে পাই না!
আজাদ যেটুকু সংবাদ পরিবেশন করিতেছে তাহাতে ধন্যবাদ না দিয়ে পারা যায় না। আমি একা থাকি, আমার সাথে কাহাকেও মিশতে দেওয়া হয় না। একাকী সময় কাটানো যে কত কষ্টকর তাহা যাহারা ভুক্তভোগী নন বুঝতে পারবেন না। আমার নিজের উপর বিশ্বাস আছে, সহ্য করার শক্তি খোদা আমাকে দিয়েছেন । ভাবি শুধু আমার সহকর্মীদের কথা। এক এক জনকে আলাদা আলাদা জেলে নিয়ে কিভাবে রেখেছে? ত্যাগ বৃথা যাবে না, যায় নাই কোনদিন । নিজে ভোগ নাও করতে পারি, দেখে যেতে নাও পারি, তবে ভবিষ্যৎ বংশধররা আজাদী ভোগ করতে পারবে। কারাগারের পাষাণ প্রাচীর আমাকেও পাষাণ করে তুলেছে। এ দেশের লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি মা-বোনের দোয়া আছে আমাদের উপর। জয়ী আমরা হবই। ত্যাগের মাধ্যমেই আদর্শের জয় হয়।
৭ই জুন ১৯৬৬ঃ
সকালে ঘুম থেকে উঠলাম। কি হয় আজ? আবদুল মোনায়েম খান যেভাবে কথা বলছেন তাতে মনে হয় কিছু একটা ঘটবে আজ। কারাগারের দুর্ভেদ্য প্রাচীয় ভেদ করে খবর আসলো দোকান-পাট, গাড়ি, বাস, রিকশা সব বন্ধ। শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল চলছে। এই সংগ্রাম একলা আওয়ামী লীগই চালাইতেছে। আবার সংবাদ পাইলাম পুলিশ আনসার দিয়ে ঢাকা শহর ভরে দিয়েছে। আমার বিশ্বাস নিশ্চয়ই জনগণ বে-আইনী কিছুই করবে না। শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করার অধিকার প্রত্যেকটি গণতান্ত্রিক দেশের মানুষের রয়েছে। কিন্তু এরা শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করতে দিবে না।
আবার খবর এল টিয়ার গ্যাস ছেড়েছে। লাঠি চার্জ হতেছে সমস্ত ঢাকায়। আমি তো কিছুই বুঝতে পারি না। কয়েদিরা কয়েদিদের বলে । সিপাইরা সিপাইদের বলে। এই বলাবলির ভিতর থেকে কিছু খবর বের করে নিতে কষ্ট হয় না। তবে জেলের মধ্যে মাঝে মাঝে প্রবল গুজব রটে।
অনেক সময় এসব গুজব সত্যই হয়, আবার অনেক সময় দেখা যায় একদম মিথ্যা গুজব। কিছু লোক গ্রেপ্তার হয়ে জেল অফিসে এসেছে। তার মধ্যে ছোট ছোট বাচ্চাই বেশি। রাস্তা থেকে ধরে এনেছে। ১২ টার পরে খবর পাকাপাকি পাওয়া গেল যে হরতাল হয়েছে, জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালন করেছে। তারা ছয়দফা সমর্থন করে আর মুক্তি চায়, বাঁচতে চায়, খেতে চায়, ব্যক্তি স্বাধীনতা চায় । শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি, কৃষকের বাঁচবার দাবি তারা চায়- এর প্রমাণ এই হরতালের মধ্যে হয়েই গেল ।
এ খবর শুনলেও আমার মনকে বুঝাতে পারছি না। একবার বাইরে একবার ভিতরে খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে আছি। বন্দি আমি, জনগণের মঙ্গল কামনা ছাড়া আর কি করতে পারি। বিকালে আবার গুজব শুনলাম গুলি হয়েছে, কিছু লোক মারা গেছে। অনেক লোক জখম হয়েছে। মেডিকেল হাসপাতালে একজন মারা গেছে। একবার আমার মন বলে, হতেও পারে, আবার ভাবি সরকার কি এতো বোকামি করে? ১৪৪ ধারা দেওয়া হয় নাই। গুলি চলবে কেন? একটু পরেই খবর এল ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। মিটিং হতে পারবে না। কিছু জায়গায় টিয়ার গ্যাস মারছে সে খবর পাওয়া গেল।
বিকালে আরও বহুলোক গ্রেপ্তার হয়ে এল। প্রত্যেককে সামারী কোর্ট করে সাজা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। কাহাকেও একমাস, কাহাকে দুই মাস। বেশির ভাগ লোকই রাস্তা থেকে ধরে এনেছে শুনলাম। অনেকে নাকি বলে রাস্তা দিয়া যাইতেছিলাম ধরে নিয়ে এল। আবার জেলও দিয়ে দিল । সমস্ত দিনটা পাগলের মতোই কাটলো আমার। তালা বন্ধ হওয়ার পূর্বে খবর পেলাম নারায়ণগঞ্জ, তেজগা, কার্জন হল ও পুরান ঢাকার কোথাও কোথাও গুলি হয়েছে, তাতে অনেক লোক মারা গেছে। বুঝতে পারি না সত্য কি মিথ্যা। কাউকে জিজ্ঞাসা করতে পারি না। সেপাইরা আলোচনা করে, তার থেকে কয়েদিরা শুনে আমাকে কিছু কিছু বলে।
তবে হরতাল যে সাফল্যজনকভাবে পালন করা হয়েছে সে কথা সকলেই বলছে। এমন হরতাল নাকি কোনোদিন হয় নাই, এমনকি ২৯ শে সেপ্টেম্বর । তবে আমার মনে হয় ২৯শে সেপ্টেম্বরের মতোই হয়েছে হরতাল ।
গুলি ও মৃত্যুর খবর পেয়ে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেছে। শুধু পাইপই টানছি যে এক টিন তামাক বাইরে আমি ছয়দিনে খাইতাম, সেই টিন এখন চারদিনে খেয়ে ফেলি। কি হবে? কি হতেছে? দেশকে এরা কোথায় নিয়ে যাবে, নানা ভাবনায় মনটা আমার অস্থির হয়ে রয়েছে। এমনিভাবে দিন শেষ হয়ে এল। মাঝে মাঝে মনে হয় আমরা জেলে আছি । তবুও কর্মরা, ছাত্ররা ও শ্রমিকরা যে আন্দোলন চালাইয়া যাইতেছে, তাদের জন্য ভালবাসা দেওয়া ছাড়া আমার দেবার কিছুই নাই।
দৈনিক আজাদ পত্রিকা সংবাদ পরিবেশন ভালই করেছে, আওয়ামী লীগের উদ্যোগে আজ প্রদেশে হরতাল'। 'হরতাল কে সাফল্যমন্ডিত করার জন্য আওয়ামী লীগের একক প্রচেষ্টা। প্রোগ্রামটাও দিয়েছে ভাল করে।
পাকিস্তান অবজারভার হেড লাইন করেছে হরতাল' বলে। খবর মন্দ দেয় নাই। মিজানের বিবৃতিটি চমৎকার হয়েছে। হলে কি হবে, 'চোরা নাহি শোনে ধর্মের কাহিনী।
৮ই জুন ১৯৬৬ঃ
ভোরে উঠে শুনলাম সমস্ত রাত ভর গ্রেপ্তার করে জেল ভরে দিয়েছে পুলিশ বাহিনী। সকালেও জেল অফিসে বহু লোক পড়ে রয়েছে। প্রায় তিনশত লোককে সকাল ৮টা পর্যন্ত জেলে আনা হয়েছে। এর মধ্যে ৬ বৎসর বয়স থেকে ৫০ বছর বয়সের লোকও আছে। কিছু কিছু ছেলে মা মা করে কাঁদছে। এরা দুধের বাচ্চা, খেতেও পারে না নিজে। কেস টেবিলের সামনে এনে রাখা হয়েছে । সমস্ত দিন এদের কিছুই থাবার দেয় নাই। অনেকগুলি যুবক আহত অবস্থায় এসেছে। কারও পায়ে জখম, কারও কপাল কেটে গিয়াছে, কারও হাত ভাঙ্গা এদের চিকিৎসা করা বা ঔষধ দেওয়ার কোনো দরকার মনে করে নাই কর্তৃপক্ষ। গ্রেপ্তার করে রাখা হয়েছিল অন্য জায়গায়, সেখান থেকে সন্ধ্যার পর জেলে এনে জমা দেওয়া শুরু করে । দিনভরই লোক আনছিল অনেক। কিছু সংখ্যক স্কুলের ছাত্র আছে। জেল কর্তৃপক্ষের মধ্যে কেহ কেহ খুবই ভাল ব্যবহার করেছে। আবার কেহ কেহ খুবই খারাপ ব্যবহারও করেছে । বাধ্য হয়ে জেল কর্তপক্ষকে জানালাম, অত্যাচার বন্ধ করুন। তা না হলে ভীষণ গোলমাল হতে পারে। মোবাইল কোর্ট করে সরকার গ্রেফতারের পরে এদের সাজা দিয়ে দিয়েছে। কাহাকেও তিন মাস, আর কাহাকেও দুই মাস, এক মাস ও কিছু সংখ্যার ছেলেদের দিয়েছে। সাধারণ কয়েদি, যাদের মধ্যে অনেকেই মানুষ খুন করে অথবা ভাকাতি করে জেলে এসেছে তারাও দুঃখ করে বলে, এই দুধের বাচ্চাদের গ্রেপ্তার করে এনেছে! এরা রাত ভর কেঁদেছে। ভাল করে খেতে পারে নাই। এই সরকারের কাছ থেকে মানুষ। কেমন করে বিচার আশা করে?
জেল কর্তৃপক্ষ কোথায় এত লোকের জায়গা দিবে বুঝে পাই না। ছোট ছোট ছেলেদের আলাদা করে রাখতে হয়। এর জেলে আসার পরে খবর এল ভীষণ গুলিগোলা হয়েছে, অনেক লোক মারা গেছে তেজগাঁ ও নারায়ণগঞ্জে। সমস্ত ঢাকা শহরে টিয়ায় গ্যাস ছেড়েছে, লাঠিচার্জও করেছে। চুপ করে বসে নীরবে সমবেদনা জানান ছাড়া আমার কি করার আছে। আমার চরিত্রের মধ্যে ভাবাবেগ একটু বেশি। যদিও নিজকে সামলানোর মতো ক্ষমতাও আমার আছে। বন্দি অবস্থায় এই সমস্ত খবর পাওয়ার পরে মনের অবস্থা কি হয় ভুক্তভোগী ছাড়া বুঝতে পারবে না।
মেটের পীড়াপীড়িতে নাস্তা খেতে বসেছিলাম। খেতে পারি নাই। দুপুরে ভাত খেতে বসেছি একই অবস্থা। সঠিক খবর না পাওয়ার জন্যই মন আরও খারাপ। খবরের কাগজের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। কাগজ আসতে খুব দেরি হতেছে, ২টার সময় কাগজ এল। আমি পূর্বে যা অনুমান করেছি তাই হলো । কোনো খবরই সরকার সংবাদপত্রে ছাপতে দেয় নাই।
ধর্মঘটের কোনো সংবাদই নাই। শুধু সরকারি প্রেস নোট। ইত্তেফাক, আজাদ, অবজারভার সকলেরই একই অবস্থা। একেই বলে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা! ইত্তেফাক মাত্র চার পৃষ্ঠা । কোন জেলার কোন সংবাদ নাই । প্রতিবাদ দিবস ও হরতাল যে পুরাপুরি পালিত হয়েছে বিভিন্ন জেলায় সে সম্বন্ধে আমার কোনো সন্দেহ রইল না।
খবরের কাগজ গুলো দেখে আমি শিহরিয়া উঠলাম । পত্রিকার নিজস্ব খবর ছাপতে দেয় নাই। তবে সরকারি প্রেসনোটেই স্বীকার করেছে পুলিশের গুলিতে দশজন মারা গিয়াছে। এটা তো ভয়াবহ খবর । সরকার যখন স্বীকার করেছে দশজন মারা গেছে, তখন কতগুণ বেশি হতে পারে ভাবতে আমার ভয় হলো! কত জন যখম হয়েছে সরকারি প্রেসনোটে তাহা নাই। সমস্ত দোষই যেন জনগণের । যেখানে উসকানি দিতেছে সরকারের প্রতিনিধিরা, আওয়ামী লীগ সেখানে পরিস্কার ভাষায় বলে দিয়েছে, শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ দিবস পালন করতে চাই । এবং সে অনুযায়ী তারা কর্মীদের নির্দেশও দিয়েছে । এখন জনগণকে দোষ দিয়ে লাভ নাই । যেখানে পুলিশ ছিল না সেখানে কোনো গন্ডগোল হয় নাই। চকবাজার ও অন্যান্য জায়গায় শান্তিপূর্ণভাবে ধর্মঘট হয়েছে। সে খবর পেয়েছি।
বেলা ১১টার সময় ১৪৪ ধারা জামি করে আর সাথে সাথে গুলি শুরু হয়। পূর্বে জারি করলেই তো কর্মী আর জনসাধারণ জানতে পারে। যখন আওয়ামী লীগ তার প্রোগ্রাম খবরের কাগজে বের করে দিল যাতে পরিষ্কার লেখা ছিল, ১টায় শোভাযাত্রা, বিকালে সভা শেষে আবার শোভাযাত্রা। তখন তো ১৪৪ ধারা জারি করে নাই। পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় সরকারের দালালেরা ও কিছুসংখ্যক অতি উৎসাহী কর্মচারী কোনো এক উপর তলার নেতার কাছ থেকে পরামর্শ করে এই সর্বনাশ করেছে।
সরকার যদি মিথ্যা কথা বলে প্রেসনোট দেয়, তবে সে সরকারের উপর মানুষের বিশ্বাস থাকতে পারে না। জীবন ভরে একই কথা শুনিয়াছি আত্মরক্ষার জন্যই পুলিশ গুলি বর্ষণ করতে বাধ্য হয়। এ কথা কেউ বিশ্বাস করবে? যারা মারা গেল তাদের ছেলেমেয়ে, মা-বাবা তাদের কি হবে? কত আশা করে তারা বসে আছে, কবে বাড়ি আসবে তাদের বাবা। কবে আসছে তাদের ছেলে। রোজগারের টাকা আসবে মাসের প্রথম দিকে। এরা জেলে বন্দি, সহসা আর ফিরে যাবে না, টাকাও আর পৌছবে না সংসারে। একথা ভেবে ভীষণভাবে ভেঙে পড়েছি আমি । কিছুতেই মনকে শান্তনা দিতে পারছি না। কেন মানুষ নিজের স্বার্থের জন্য পরের জীবন নিয়ে থাকে?
তবে এদের ত্যাগ বৃথা যাবে না। এই দেশের মানুষ তার ন্যায্য অধিকার আদায় করবার জন্য যখন জীবন দিতে শিখেছে তখন জয় হবেই, কেবলমাত্র সময় সাপেক্ষ। শ্রমিকরা কারখানা থেকে বেরিয়ে এসেছে। কৃষকরা কাজ বন্ধ করেছে। ব্যবসায়ীরা দোকান পাট বন্ধ করে দিয়েছে। ছাত্ররা স্কুল কলেজ ছেড়েছে। এতবড় প্রতিবাদ আর কোনোদিন কি পাকিস্তানে হয়েছে?
ছয় দফা যে পূর্ব বাংলার জনগণের প্রাণের দাবি-পশ্চিমা উপনিবেশবাদী ও সাম্রাজ্যবাদের দালাল পশ্চিম পাকিস্তানের শোষকশ্রেণী যে আর পূর্ব বাংলার নির্যাতিত গরীব জনসাধারণকে শোষণ বেশি দিন করতে পারবেনা, সে কথা আমি এবার জেলে এসেই বুঝতে পেরেছি। বিশেষ করে ৭ই জুনের যে প্রতিবাদে বাংলার গ্রামে গঞ্জে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ফেটে পড়েছে, কোনো শাসকের চক্ষু রাঙানি তাদের দমাতে পারবে না। পাকিস্তানের মঙ্গলের জন্য শাসকশ্রেণীর ছয়দফা মেনে নিয়ে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করা উচিত।
যে রক্ত আজ আমার দেশের ভাইদের বুক থেকে বেরিয়ে ঢাকার পিচঢালা কাল রাস্তা লাল করল, সে রক্ত বৃথা যেতে পারে না। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য যেভাবে এ দেশে ছাত্র-জনসাধারণ জীবন দিয়েছিল তারই বিনিময়ে বাংলা আজ পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা। যারা হাসতে হাসতে জীবন দিল, আহত হলো, গ্রেপ্তার হলো, নির্যাতন সহ্য করল তাদের প্রতি এবং তাদের সন্তান-সম্পদের প্রতি নীরব প্রাণের সহানুভূতি ছাড়া জেলবন্দি আমি আর কি দিতে পারি। আল্লাহর কাছে এই কারাগারে বসে তাদের আত্মার শান্তির জন্য হাত তুলে মোনাজাত করলাম। আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, এদের মৃত্যু বৃথা যেতে দেব না, সংগ্রাম চালিয়ে যাবো। যা কপালে আছে তাই হবে। জনগণ ত্যাগের দাম দেয়। ত্যাগের মাধ্যমেই জনগণের দাবি আদায় করতে হবে।
সমস্ত দিন পাগলের মতোই ঘরে বাইরে করতে লাগলাম । যদি কেহ বন্দি পশুপক্ষী দেখে থাকেন তারা অনুভব করতে পারে । শত শত লোককে গ্রেপ্তার করে আনছে। তাদের দুরবস্থা চিন্তা করতে ভয় হয়। রাস্তায় যাকে পেয়েছে তাকেই গ্রেপ্তার করে নিয়ে এসেছে। খালি গা-কাপড় নাই, একদিন একরাত পর্যন্ত থানায় বা অন্য কোথাও আটকাইয়া রেখেছিল । খাবারও দেয় নাই। গোসল নাই। সাজা দিয়ে নিয়ে এসেছে। এদের কিছু লোককে কয়েদির কাপড় পরাইয়া দিয়েছে। আমি যেখানে ছিলাম তার পাশেই পুরান বিশ সেলে রাতে ৮২ জন ছেলেকে নিয়ে এসেছে, বয়স ১৫ বৎসরের বেশি হবে না কারও। অনেকের মাথায় আঘাত। অনেকের পায়ে আঘাত, অনেকে হাঁটতে পারে না । হাকিম বাহাদুর বোধ হয় কারও কথা শোনেন নাই, জেল দিয়ে চলেছেন। রাতে জানালা দিয়ে দেখলাম এই ছেলেগুলিকে নিয়ে এসেছে । দরজা বন্ধ । জানালা দিয়ে চিৎকার দিয়ে বললাম, “জমাদার সাহেব। এদের খাবার বন্দোবস্তু করে দিবেন। বোধ হয় দুই দিন না খাওয়া।" মানুষ যখন অমানুষ হয় তখন হিংস্র জন্তুর চেয়েও হিংস্র হয়ে থাকে। রাত্রে আমি ঘুমাতে পারলাম না। দুই একজন জমিদার ও সিপাই এদের উপর অত্যাচার করছে । আর সবাই এদের আরাম দেবার চেষ্টা করেছে। কয়েদি ছোট ছোট ছেলেদের খুব আদর করে থাকে। নিজে না খাওয়াইয়া অনেকে খাওয়ায় থাকে। অনেকে নিজের গামছা দিয়েছে । যারা এদের উপর অত্যাচার করেছে। তাদের কথা আমার মনে রইলো । নাম আমি দেখব না।
রাত কেটে গেল । একটু ঘুম আসে, আবার ঘুম ভেঙে যায় ।
৯জুন ১৯৬৬ঃ
অনেক রিকশাওয়ালাকে এনেছে, বোধ হয় বাড়িতে তাদের ছেলে মেয়ে না খেয়েই আছে। দুই মাসের সাজা দিয়েছে অনেকে। দুপুর হয়ে গেল এই ভাবে। কাগজ এল, দেখলাম তথাকথিত জাতীয় পরিষদ ও পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ থেকে বিরোধী দল ওয়াক আউট করেছে প্রতিবাদে। কারণ মুলতবি প্রস্তাব স্পিকার সাহেব উঠাতে দেন নাই । একেই বলে আইন সভা। আর একেই বলে আইন সভার ক্ষমতা! চমৎকার ফার্স। ডিবেটিং ক্লাব বললেও চলে। তাহাও সব ক্ষেত্রে বলা চলে না। আমাদের দেশে একটা কথা আছে, যেই না মাথার চুল তার আবার লাল ফিতা।
সরকার স্বীকার করেছে আরও একজন হাসপাতালে মারা গিয়াছে। এই নিয়ে ১১ জনের মৃত্যু হলো। যারা আহত হয়েছে তাদের কোনো সংবাদ নাই আজ পর্যন্ত। প্রশ্ন জাগে, '১১ জন মারা গেছে না অনেক বেশি মারা গেছে?
১২ই জুন ১৯৬৬ঃ
দেখেই খুশি হলাম যে আমি ও আমার সহকর্মীরা অনেকেই জেলে আটক থাকা অবস্থায়ও আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীরা শান্তিপূর্ণ গণআন্দোলন চালাইয়া যাওয়ার সঙ্কল্প করিয়াছে। রক্ত এরা বৃথা যেতে দিবে না। সৈয়দ নজরুল ইসলাম এক্টিং সভাপতি, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের। তার সভাপতিত্বে ১১ ঘন্টা ওয়ার্কিং কমিটির সভা হয়েছে। মিজানুর রহমান চৌধুরী জাতীয় পরিষদে যোগদান করতে পিন্ডি চলে গেছে। ১৭ই, ১৮ই, ১৯শে জুন জুলুম প্রতিরোধ দিবস উদযাপন করার আহ্বান জানাইয়াছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটি ১৬ আগস্ট এর পূর্বে সমস্ত গণবিরোধী ব্যবস্থার অবসান দাবি করিয়াছে। তা না করিলে ১৬ই আগস্ট থেকে জাতীয় পর্যায়ে গণআন্দোলন শুরু করা হবে। মনে মনে ভাবলাম আর কেউ আন্দোলন নষ্ট করতে পারবে না। দাবি আদায় হবেই ।
৬ দফার বাস্তবায়ন সংগ্রাম আওয়ামী লীগ অব্যাহত রাখবে তাও ঘোষণা করেছে। এখন আর আমার জেল খাটতে আপত্তি নাই, কারণ আন্দোলন চলবে। ভাবতে লাগলাম কর্মীদের টাকার অভাব হবে। পার্টি ফান্ডে টাকা নাই। আমিও বন্দোবস্ত করে দিয়ে আসতে পারি নাই। মাসে যে টাকা আদায় হয় তাতে অফিসের খরচ চলে যেতে পারে। তবে আমার বিশ্বাস আছে, অর্থের জন্য কাজ বন্ধ হয়ে থাকে না। জনসমর্থন যখন আওয়ামী লীগের আছে, জনগণের প্রাণও আছে। আমি দেখেছি এক টাকা থেকে হাজার টাকা অফিসে এসে দিয়ে গিয়াছে, যাদের কোনো দিন আমি দেখি নাই। বোধ হয় অনেককে দেখবোও না। ভরসা আমার আছে, জনগণের সমর্থন এবং ভালবাসা দুইই আছে আমাদের জন্য । তাই আন্দোলন ও পার্টির কাজ চলবে।
১৪ই জুন ১৯৬৬ঃ
আজ থেকে হাইকোর্টে আমার হেবিয়াস কর্পাস মামলার শুনানি হবে। কি হবে জানি না । অন্যায়ভাবে আমাকে গ্রেপ্তার করেছে, ডিপিআরএ গ্রেপ্তার চলেছে। ঘাটাইল আওয়ামী লীগ অর্গানাইজিং সেক্রেটারি মোহাম্মদ আলি মোক্তারকে গ্রেফতার করে ময়মনসিংহ জেলে পাঠিয়েছে
Rawle Knox (Daily Telegraph, June 4, S) East Pakistan's Case এই নামে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। তার ব্যক্তিগত মতামত। কাগজ যে কোন মতামত দিতে পারে তাতে আমার কিছুই বলা উচিত না। তবে পূর্ব পাকিস্তানের উপর জুলুমের খবর আজ আর शগে নাই ৬ দফা দাবি পেশ করার সাথে সাথে দুনিয়া জানতে পেরেছে বাঙালিদের আঘাত কোথায় ?
পাকিস্তানের মঙ্গলের জন্য আমারও মনে হয় ৬ দফা দাবি মেনে নেওয়া উচিত -শাসকগোষ্ঠীর বিশেষ করে আইয়ুব খান ও তার অনুসারীদের। তা না হলে পরিণতি ভয়াবহ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। বাঙালির একটি গোঁ আছে, যে জিনিস একবার বুঝতে পারে তার জন্য হাসিমুখে মৃত্যুবরণও করতে পারে। পূর্ব বাংলার বাঙালি এটা বুঝতে পেরেছে যে এদের শোষণ করা হতেছে চারদিক দিয়ে। শুধু রাজনৈতিক দিক দিয়েই নয়, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে।
আমি বিকালে সেলের বাইরে বসে আছি। কয়েকজন ছোট ছোট বালক জামিন পেয়ে বাইরে যেতেছে । খুব তাড়াতাড়ি হাঁটছে, মনে হয় যেতে পারলেই বাচে; থাকতে আর চায় না, এই পাষাণ-কারার ভিতরে। আমার কাছে এসে থেমে গেল । বলল, আমরা চললাম স্যার, আপনাকে বাইরে নেওয়ার জন্য আবার আন্দোলন করব।"
আমি বললাম, "যাও, সকলকে আমার সালাম দিও। আমার জন্য চিন্তা করিও না
ওদের দিকে আমি চেয়ে রইলাম ওদের কথা শুনে আনন্দে আমার বুকটি ভরে পেল । মনে হলো এটা তো আমার কারাগার নয়, শান্তির নীড়। এই দুধের বাচ্চাদের কথা শুনে কিছু সময়ের জন্য আমার দুঃখ ভুলে গেলাম । শক্তি পেলাম মনে। মনে হলো পারব। বহুদিন জেল খাটতে পারব । এরাও যখন এগিয়ে এসেছে দেশের মুক্তির আন্দোলনে তখন কে আর রুখতে পারে?
১৫ই জুন ১৯৬৬ঃ
ইংল্যান্ড থেকে আমাকে এফ তারবার্তা পাঠাইয়াছে 'প্রবাসী বাঙ্গালীরা সমগ্র ব্রিটেনে শহীদ দিবস পালন করবে ১৭ ও ১৮ জুন।' ব্রিটেন পাকিস্তানিদের প্রতিষ্ঠান প্রগতি ফ্রন্টের জেনারেল সেক্রেটারি এস এম হোসেন বৃটেনের সকল পাকিস্তানি নাগরিক ও পাকিস্তানি সংস্থাসমূহের প্রতি সাফল্যজনকভাবে শহীদ দিবস উদযাপনের স্বায়া অত্যাচারী জালেমশাহীর পাশবিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জ্ঞাপনের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, 'বর্তমান সরকারের অত্যাচার, নির্যাতন, শোষণ, দুর্নীতি, অবিচার ও গণতান্ত্রিক কার্যকলাপের অবসানের জন্য আমাদের সংঘবদ্ধভাবে আওয়াজ তুলিতে হইবে।
এই সংবাদ দৈনিক আজাদ কাগজে ৭ই জুলাই ৩১ জ্যৈষ্ঠ তারিখে বাহির হয়েছে।
বৃটেনস্থ পাকিস্তানিদের পক্ষ হইতে জনাব হোসেন ও পাকিস্তান সমিতির প্রেসিডেন্ট জনাব আফরোজ বখত দেশ ও জনগণের জন্য সাহসিকতাপূর্ণ সংগ্রাম পরিচালনা ও দুঃখ ভোগের জন্য পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি অভিনন্দন জানাইয়া এক তারবার্তা প্রেরণ করিয়াছেন।
তারবার্তায় তাহারা বলেন, “প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আপনি যে সংগ্রাম চালাইয়া যাইতেছেন তাহাতে আমাদের সমর্থন রহিয়াছে। এই আন্দোলনকে নৈতিক, আর্থিক ও সামাজিক প্রভৃতি সর্বপ্রকার সাহায্য দানের জন্য আমরা প্রস্তুত রহিয়াছি। আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন যে আমাদের প্রাণদানকারী ভ্রাতাদের রক্তপাত ব্যর্থ যাইবে না। আমরা তাহাদের জন্য ও একই উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য কাজ করিয়া যাইতেছি—জনসাধারণের প্রতি ইহাই আমাদের বাণী।
জাতীয় পরিষদের ভিতর ও বাহিরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম পরিচালনার উদ্দেশ্যে তারবার্তা জনাব নুরুল আমীনের প্রতিও অভিনন্দন জ্ঞাপন করা হয়।
তারবার্তায় পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রতিক রক্তপাতের তীব্র নিন্দা করা হয় এবং বলা হয় যে ইহার ফলে পাকিস্তানের ইতিহাসে সর্বাধিক কলঙ্কময় অধ্যায়ের সৃষ্টি হইল ।
১৮ই জুন ১৯৬৬ঃ
আওয়ামী লীগের ডাকে জনগণ জুলুম প্রতিরোধ দিবস পালন করছে খবর পেলাম, আর সরকার অত্যাচারের স্টিম রোলার চালাইয়া যেতেছে। দেখা যাক কি হয়।
বিকালটা ভালই ছিল। বৃষ্টি হয় নাই। হাসপাতালে আহত কর্মীরা দরজার কাছে দাঁড়াইয়া আছে। নারায়ণগঞ্জের খাজা মহিউদ্দিন ও অন্যান্য কর্মীরা এবং সাহাবুদ্দিন চৌধুরী সাহেবও হাসপাতালে আছেন। তিনি নেমে এসেছেন দরজার কাছে । আমি একটু এগিয়ে যেয়ে ওদের বললাম, চিন্তা করিও না। কোনো ত্যাগই বৃথা যায় না। দেখ না আমাকে একলা রেখেছে। সিপাই সাহেবের মুখ শুকাইয়া গেছে, কারণ কথা বলা নিষেধ, চাকরি যাবে। আমি এদের ক্ষতি করতে চাই না, তাই চলে এলাম আমার জায়গায় । শুধু ওদের দূর থেকে আমার অন্তরের স্নেহ ও ভালবাসা জানালাম। জানি না আমার কথা ওরা শুনেছিল কিনা, কারণ দূর তো আর কম না!
২৫ জুন ১৯৬৬ঃ
ন্যাপের কোনো কোনো নেতা ৬ দফা গোপনে গোপনে সমর্থন করলেও লজ্জায় বলেন না, আর কেউ কেউ এর বিরুদ্ধাচরণ করেন। দিন আসছে ৬ দফা ও স্বায়ত্তশাসনের দাবি মেনে এদেশে রাজনীতি করতে হবে না। তবে রাজনীতিকে ব্যবসা হিসেবে ব্যবহার করতে পারবেন অনেকেই।
সন্ধ্যায় দেখলাম পুরানা বিশ সেলে নারায়ণগঞ্জের খাজা মহীউদ্দিনকে নিয়ে এসেছে। ওর বিরুদ্ধে অনেকগুলি মামলা দিয়েছে। হাইকোর্টের নির্দেশে ওকে পরীক্ষা দিতে অনুমতি দিয়েছে । ডিভিশন দেয় নাই। ভীষণ মশা, পরশু পরীক্ষা, মশারিও নাই। তাড়াতাড়ি একটা মশারির বন্দোবস্ত করে ওকে পাঠিয়ে দিলাম। আমার কাছাকাছি যখন এসে গেছে একটা কিছু বন্দোবস্ত করা যাবে। বেশি কষ্ট হবে না। খাজা মহীউদ্দিন খুব শক্তিশালী ও সাহসী কর্মী দেখলাম। একটুও ভয় পায় নাই। বুকে বল আছে। যদি দেশের কাজ করে যায় তবে এ ছেলে একদিন নামকরা নেতা হবে, এ সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ নাই। ত্যাগ করার মন প্রাণ আছে, আদর্শ যখন ঠিক আছে, বুকে যখন সাহস আছে একদিন তার প্রাপ্য দেশবাসী দেবেই।
২৮ শে জুন ১৯৬৬ঃ
খবরের কাগজ এসেছে। ভাসানী সাহেবের রাজনৈতিক অসুখ ভাল হয়ে গেছে। যখন গুলি চলছিল, আন্দোলন চলছিল, গ্রেপ্তার সমানে সমানে চলেছে তখন দেখলাম শুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। আবার দেখলাম দুই তিন দিন পরে কোথায় যেতে ছিলেন পড়ে যেয়ে পায়ে ব্যথা পেয়েছেন। হঠাৎ অসুস্থ মানুষ আবার বাড়ির বাহির হলেন কি করে? যখন আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য কর্মীরা কারাগারে-এক নারায়ণগঞ্জে সাড়ে তিনশত লোকের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা ঝুলছে, তখনও কথা বলেন না। আওয়ামী লীগ যখন জুলুম প্রতিরোধ দিবস পালন করল তখন একদল ভাসানী পন্থী প্রগতিবাদী(!) এই আন্দোলনকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন বলে সরকারের সাথে হাত ও গলা মিলিয়েছে। এখন তিনি হঠাৎ আবার সর্দলীয় যুক্তফ্রন্ট করবার জন্য আহবান জানিয়েছেন এবং নিজে ময়দানে নামবেন।
মওলানা সাহেব পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষতাবে আইযুৰ খানকে সমর্থন করে চলেছেন। মাওলানা সাহেবের সাথে যদি যুক্তফ্রন্ট করতে হয় তবে আইয়ুব সাহেবই বা কি অন্যায় করেছেন? মওলানা সাহেব তো দেশের সমস্যার চিন্তা করেন না। বৈদেশিক নীতি নিয়ে ব্যস্ত। দেশে গণআন্দোলন বা দেশের জনগণের দাবি পূরণ ছাড়া বৈদেশিক নীতিরও কোনো পরিবর্তন হতে পারে। জনগণের সরকার কায়েম হলেই, জনগণ যে বৈদেশিক নীতি অবলম্বন করতে বলবে, নির্বাচিত নেতারা তাহাই করতে বাধ্য। ডিক্টেটর যখন দেশের শাসন ক্ষমতা অধিকার করেছে এবং একটা গোষ্ঠীর স্বার্থেই বৈদেশিক নীতি ও দেশের নীতি পরিচালনা করছে তার কাছ থেকে কি করে এই দাবি আদায় করবেন আমি বুঝতে পারছি না পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ যখন তাদের স্বায়ত্তশাসনের দাবি, খাদ্য, রাজবন্দিদের মুক্তির দাবি নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এগিয়ে চলেছে তখন পিছন থেকে ছুরিকাঘাত করে এখন এসেছেন যুক্তফ্রন্ট করতে। আওয়ামী লীগের প্রায় সকল নেতা ও কর্মী কারাগারে বন্দি কেহ কেহ আত্মগোপন করে কাজ করছে, এখন যে কয়েকজন বাইরে আছে তারা কিছুতেই এদের সাথে যোগদান করতে পারে না। আর ছয় দফা দাবি ছেড়ে দিয়ে কোনো নিম্নতম কর্মসূচি মেনে নিতে পারে না। ছয় দফাই নিম্নতম কর্মসূচি। কোনো আপোষ নাই। জনগণ যখন এগিয়ে এসেছে। দাবি আদায় হবেই। আওয়ামী লীগ সংগ্রাম করে যাবে। জনগণকে আর ধোকা দেওয়া চলবে না। অনেক জগাখিচুড়ি পাকানো হয়ে গেছে । আর না। ভাসানী সাহেব এগিয়ে যান আইয়ুব সাহেবের দল নিয়ে। এখন তো তিনি সুখেই আছেন, আর কেন মানুষকে ধোকা দেওয়া? আওয়ামী লীগ বা তার নেতারা যদি ছয় দফা দাবি ত্যাগ করে আপোষ করতে চান তারা ভুল করবেন। কারণ তাহলে জনগণ তাদেরও ত্যাগ করবে।
চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এম এ আজিজ, জহুর আহমদ চৌধুরী, মানিক বাবু ও আবদুল মান্নানের জন্য হাইকোর্টে রিট পিটিশন করা হয়েছে। বিচারে কি হয় দেখা যাক।
২রা জুলাই ১৯৬৬ঃ
আজ যারা ৬ দফার দাবি যথা স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানকে আলাদা করার দাবি বলে উড়াইয়া দিতে চায় বা অত্যাচার করে বন্ধ করতে চায় এই আন্দোলনকে, তারা খুবই ভুল পথে চলছে। ছয় দফা। জনগণের দাবি। পূর্ব পাকিস্তানের বাচা মরার দাবি । এটাকে জোর করে পাবান যাবে না। দেশের অমঙ্গল করা হবে একে চাপা দেবার চেষ্টা করলে । কংগ্রেস যে ভুল করেছিল প্রদেশের স্বায়ত্তশাসনের দাবি ও ফেডারেল না মেনে আমাদের শাসকগাষ্ঠাও সেই ভুল করতে চলেছেন। যখন তুল বুঝবে তথন আর সময় থাকবে না। আমরা পাকিস্তানের আওতায় বিশ্বাস করি, তবে আমাদের নায়া দাবি চাই, অন্যকে দিতে চাই। কলোনি বা বাজার হিসেবে বাস করতে চাই না। নাগরিক হিসেবে সমান অধিকার চাই।
৮ই জুলাই ১৯৬৬ঃ
প্রাত ভ্রমন করছি এমন সময় হাসপাতালের দিকে চেয়ে দেখি শাহবুদ্দিন চৌধুরী সাহেব তাকাইয়া আছেন। আমাকে হাত ইশারা দিয়ে দেরি করতে বলে হঠাৎ চলে গেলেন ভিতরে। তিনটা ছেলেকে কোলে করে কয়েকজন কয়েদি নিয়ে এল বাইরে। দেখলাম একজনের হাত কেটে ফেলেছে একজনের বুকের কাছে গুলি লেগেছিল, আর একজন হাঁটতেই পারে না কোলে করে রেখেছে। বাইরের হাসপাতাল থেকে এদের এনেছে। অত্যাচার করে, মারপিট করে, গুলি করে জখম করেছে এদের জীবন শেষ করে নিয়েছে, তারপর আবার আসামি করে গ্রেপ্তার করে জেলে নিয়ে এসেছে। কি নিষ্ঠুর এই দুনিয়া! এরাই তো আমাদের ভাই, চাচা, প্রতিবেশী। পূর্ব পাকিস্তানের অধিকার আদায় হলে এদের বংশধররা সুযোগ সুবিধা পাৰে। এদেরকে বাদ দিয়ে তো কেউ অধিকার ভোগ করবে না। যারা মৃত্যুবরণ করল আর যারা পঙ্গু হয়ে কারাগারে এসেছে, জীবনভর কষ্ট করবে আমাদের সকলের জন্যই। কেন এই অত্যাচার? কেনই বা এই জুলুম! অত্যাচার কতকাল চলবে!
মনকে শক্ত করতে আমার কিছু সময় লাগলো। ভাবলাম সকল সময় ক্ষমা করা উচিত না, ক্ষমা মহত্বের লক্ষণ, কিন্তু জালেমকে ক্ষমা করা দুর্বলতার লক্ষণ। ইসলামে ঠিক কথাই বলেছে, ক্ষমা করতে পারলে ভাল না করতে পারলে, হাতের পরিবর্তে হাত, চক্ষুর পরিবর্তে চক্ষু নিতে আপত্তি নাই।
আজ আরও একটা ছেলেকে সাতাশ সেল থেকে নিয়ে এসেছে পুরাতন সেলে। ম্যাট্রিক দেবে । নারায়ণগঞ্জের চাষাড়ায় বাড়ি। মাথায় আঘাত পেয়েছিল। ধরে নিয়ে ভীষণভাবে মারপিট করেছে। অনেকে জখম নিয়েই কারাগারে এসেছে। খাজা মইনুদ্দিন আমাকে তার পিঠটা দেখালে, এখনও দাগ রয়ে গেছে। তাকে ধরে এনে মেরেছে। শুনলাম ইপিআর-এর লোকগুলি এদের মারধর করে নাই। তারা বেঙ্গল পুলিশকে মিছামিছি গুলি করার জন্য জনসাধারণের সামনেই গালাগালি করেছে। এখনও বহুলোক জেলে আছে। নারায়ণগঞ্জে মামলায় এখনও গ্রেপ্তার চলছে। এদের মধ্যে বেশির ভাগই বাচ্চা ছেলের দল। কি কষ্টেই যে এরা আছে, বলব কি? বলবার ভাষা নেই। একই কাপড় পরে জেলে এসেছে। দিনের পর দিন সেই কাপড় পরেই রয়েছে।
১৮ই জুলাই ১৯৬৬ঃ
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ প্রায় সকলেই কারাগারে বন্দি অবস্থায় দিন কাটাতে বাধ্য হতেছে। নরসিংদী আওয়ামী লীগের দুইজন ককেও গ্রেপ্তার করে আনা হয়েছে। কাহাকেও আর বাইরে রাখবে না। তবুও দেখে আনন্দই হলো যে, ২৩ তারিখে ওয়ার্কিং কমিটির সভা আহবান করেছে। কাজ করে যেতে হবে। ৬ দফা দাবির সাথে কোনো আপোষ হবে না। আমাদেরও রাজনীতির এই শেষ। কোনো কি আওয়ামী লীগ কর্মীরা চায় না। তারা শুধু চায় জনগণ তাদের অধিকার আদায় করুক।
ন্যাপের সভাপতি নিম্নতম কর্মসূচির ভিত্তিতে সব দলকে এক করতে চান, আজ তাদের সভায় বলেছেন। নিম্নতম কর্মসূচি দিয়ে চুপচাপ তাঁহার নতুন বাড়ি বিন্নাচর গ্রামে যেয়ে বসে থাকলেই দেশ উদ্ধার হয়ে যাবে। সোহরাওয়ার্দী সাহেব যখন আওয়ামী লীগ শুরু করেন সেই সময় হতে এই ভদ্রলোক বহু খেল দেখাইছেন। মিস জিন্নাহর ইলেকশন ও অন্যান আন্দোলনকে তিনি আইয়ুব সরকারকে সমর্থন করার জন্য বানচাল করতে চেষ্টা করছেন পিছন থেকে। তাকে বিশ্বাস করা পূর্ব বাংলার জনগণের আর উচিত হবে না। এখন আর তিনি দেশের কথা ভাবেন না। আন্তর্জাতিক হয়ে গেছেন। মাঝে মাঝে আইযুব-ইয়াহিয়ার কাছে টেলিগ্রাম পাঠান আর কাগজে বিবৃতি দেন। বিরাট নেতা কিনা? আফ্রো-এশীয় ও ল্যাটিন আমেরিকার জনগণের মজলুম জননেতা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ বাঁচুক আর মরুক তাতে তার কি আসে যায়। আইয়ুব সাহেব আর একটা ডেলিগেশনের নেতা করে পাঠালে খুশি হবেন। বোধহয় সেই চেষ্টায় আছেন।
নুরুল আমীন সাহেব সকল দলকে ডাকবেন একটা যুক্তফ্রন্ট করার জন্য। ৬ দফা মেনে নিলে কারও সাথে মিলতে আওয়ামী লীগের আপত্তি নাই। মানুষকে আমি ধোকা দিতে চাই না। আদর্শে মিল না থাকলে ভবিষ্যতে আবার নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ দেখা দিতে বাধ্য। সেদিকটা গভীরভাবে ভাবতে হবে। আইয়ুব সরকারের হাত থেকে জনগণের হাতে ক্ষমতা আনতে হলে আদর্শের সাথে যাদের মিল নাই তাদের সাথে এক হয়ে গোজামিল দিয়ে থাকা সম্ভবপর হতে পারে না। এতে আইয়ুব সাহেবের ক্ষতি কিছু করা গেলেও জনগণের দাবি আদায় হবে না । এত অত্যাচারের মধ্যেও ছয় দফার দাবি এগিয়ে চলেছে। শত অত্যাচার করেও আন্দোলন দমাতে পারে নাই এবং পারবেও না। এখন যারা আবারও যুক্তফ্রন্ট করতে এগিয়ে আসছেন তারা জনগণকে ভাওতা দিতে চান। যারা আন্দোলনের সময় এগিয়ে আসে নাই তাদের সাথে আওয়ামী লীগ এক হয়ে কাজ করতে পারে না। কারণ এতে উপকার থেকে অপকার হবে বেশি। কোনো নিম্নতম কর্মসূচির কথা উঠতেই পারে না । নিম্নতম কর্মসূচি হলো ছয় দফা। শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ঠিক না হলে কোনো দাবি আদায় হতে পারে না। পাকিস্তানের শাসনতান্ত্রিক কাঠামো পূর্বে ঠিক হওয়া দরকার।
১৯ জুলাই ১৯৬৬ঃ
মওলানা ভাসানী সাহেব হঠাৎ সুস্থ হয়ে ঢাকায় এসেছেন এবং সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন, ৬ দফা সমর্থন করেন না। তবে স্বায়ত্তশাসন সমর্থন করেন। কারণ, তার পার্টির জন্ম হয় স্বায়ত্তশাসনের দাবির মাধ্যমে। কাগমারি সম্মেলনের কথাও তিনি তুলেছেন। তিনি নাকি দেখে সুখী হয়েছেন যে, একসময়ে যারা স্বায়ত্তশাসনের দাবি করবার জন্য তার বিরোধিতা করেছেন তারাই আজকাল স্বায়ত্তশাসনের দাবি তুলেছে। মওলানা সাহেব বোধহয় ভুলে গিয়াছেন, ভুলবার যদিও কোনো কারণ নাই, সামান্য কিছুদিন হলো ঘটনাটা ঘটেছে। খবরের কাগজগুলি আজও আছে। আওয়ামী লীগ ও ন্যাপের কর্মীরা আজও বেঁচে আছে। তারা জানে, বিরোধ ও গোলমাল হয় বৈদেশিক নীতি নিয়ে। সে গোলমালও মিটমাট হয়ে গিয়েছিল সম্মেলনের পূর্বের রাতে ওয়ার্কিং কমিটির মিটিং-এ। মওলানা সাহেব ৬ দফা সমর্থন না করলেও আন্দোলন চলছে, চলবে এবং আদায়ও হবে। জনগণ ৬-দফাকে মনে প্রাণে গ্রহণ করেছে।
২০শে জুলাই ১৯৬৬ঃ
মোনায়েম খান প্রেসিডেন্ট আইয়ুব ও নবাব কালাবাগ সাহেবকে বলেছেন পূর্ব বাংলার ৬ দফার আন্দোলন শেষ করে দিয়েছেন। আর কিছুদিন থাকলে একদম নস্যাৎ করে দিতে পারবেন। তাই হয়তো কোনো সমঝোতায় আসলেন না সরকার। খুবব ভাল কাজ বোধহয় করলেন । পরিণতি বেশি ভাল হবে বলে মনে হয় না। মানিক মিয়া রাজনীতি করেন না, তবে তার নিজস্ব মতবাদ আছে তাকে দেশরক্ষা আইনে বন্দি করা যে কত বড় অন্যায় ও নীতিবিরুদ্ধ তা কেমন করে ভাষায় প্রকাশ করব । সাংবাদিকরা অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট বন্ধ করে দিয়েছে। কোনো একটা ভরসা বোধহয় পেয়ে থাকেন। গতকাল থেকে আমার, তাজউদ্দিনের, খন্দকার মোশতাকের ও নুরুল ইসলাম চৌধুরীর রিট আবেদনের শুনানি শুরু হয়েছে। জানি না কি হবে । তবে আমাদের ছাড়বে না সরকার, তা বুঝতে পারি। দেশরক্ষা আইন থেকে মুক্তি পেলে, অন্য কোনো আইনে জেলে বন্দি করতে পারে আটটা মামলা চলছে, আরও কয়েকটা বন্দোবস্ত করে রেখে দিয়েছে। দরকার হলে চালু করে দিবে।
নুরুল আমিন সাহেব ঐক্যবদ্ধ হতে অনুরোধ করেছেন । ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঘরে বসে থাকলেই দাবি আদায় হয় না। নূরুল আমীন সাহেব যাদের নিয়ে দল করেছেন তাদের মধ্যে অনেকেই আব্দোলনের ও জেলে যাবার কথা শুনলে প্রথমে ঘরের কোণেই আশ্রর নিয়ে থাকেন। আর পিছন থেকে আন্দোলনকে আঘাত করতে দ্বিধাবোধ করেন না। বেশি গোলমাল দেখলে পাসপোর্ট নিয়ে স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য বিদেশে রওয়ানা হয়ে যান। ৬ দফার দাবিতে যে গণঐক্য দেশে গড়ে উঠেছিল, যার জন্য হাসিমুখে কত লোক জীবন দিল, কত লোক কারাবরণ করছে, তখন এই ঐক্যবদ্ধ করার আগ্রহশীল নেতারা কেহ ঘর থেকে বের হওয়া তো দূরের কথা প্রতিবাদ পর্যন্ত করেন নাই। আজ ঐক্যবদ্ধ হয়ে এরা সংগ্রাম করবে'! অন্য কেহ বিশ্বাস করলে করতে পারে, কিন্তু আমি করি না। কারণ এদের আমি জানি ও চিনি।
আওয়ামী লীগ সংগ্রামী দল, সংগ্রাম করে যাবে। আদর্শের মিল নাই, সামান্য সুবিধার জন্য আর জনগণকে ধোকা দেওয়া উচিত হবে না। নিম্নতম কর্মসূচিই ছয় দফা। সেই সঙ্গে রাজবন্দিদের মুক্তি, কৃষকদের পচিশ বিঘা পর্যন্ত খাজনা মওকুফ, শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি, গরিব কর্মচারীদের সুবিধা ও খাদ্য সমস্যা সম্বন্ধে কর্মসূচি নেওয়া চলে । তবে ৬ দফা বাদ দিয়া কোনো দলের সাথে আওয়ামী লীগ হাত মেলাতে পারে না। আর করবে না।
২৫শে জুলাই ১৯৬৬ঃ
আওয়ামী লীগ শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালাতে জনগণকে অনুরোধ করেছে-যে পর্যন্ত ৬ দফা দাবি আদায় না হয়। যদিও শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করে চলেছে আওয়ামী লীগ, তথাপি সরকার অত্যাচার করে চলেছে। গুলি হলো, গ্যাস মারল, শত শত কর্মীকে জেলে দিল, বিচারের নামে প্রহসন করল, কত লোক গুলি খেয়ে মারা গেছে কে তা বলতে পারে? সরকার নিজেই স্বীকার করেছে ১১ জন মারা গেছে ৭ই জুনের গুলিতে। আমরা পাকিস্তানকে দুই ভাগ করতে চাই বলে যারা চিৎকার করেছে তারাই পাকিস্তানের ক্ষতি করছে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ন্যায্য দাবি মেনে নেওয়া উচিত। তারা আলাদা হতে চায় না। পাকিস্তান একই থাকবে, যদি স্বায়ত্তশাসনের দাবি মেনে নেওয়া হয়।
আমি জানি আওয়ামী লীগ নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্বাস করে, তাদের উপর অত্যাচার করা কোন মতেই উচিত হতেছে না। সরকার বলে দিলেই তো পারে, তোমরা রাজনীতি করতে পারবা না। আমরা চিন্তা করে দেখতাম রাজনীতি করব, কি করব না? মার্শাল ল'-এর সময় তো আমরা রাজনীতি করি নাই । চুপচাপ ছিলাম, কারণ রাজনীতি তখন বেআইনী ছিল। আজ দিন যে কিভাবে কেটে গেল আমি জানি না।
১৬ই সেপ্টেম্বর ১৯৬৬ঃ
যদি স্বায়ত্তশাসন ও ৬ দফা আদায় করে নিতে পারি নিব তবে আমরা রাজবন্দিরা তারে খুনী, ডাকাত, একরারীর থেকেও আজকাল খারাপ দেখুন পুরানা ২০ সেলে রণদা সাহেব বার-অ্যাট-ল', বাবু চিত্ত সুতার ভূতপূর্ব এমপিএ, আবদুল জলিল এডভোকেট, দুইজন ছাত্র-একজন এমএ পরীক্ষা দিবে নুরে আলম সিদ্দিকী, আর একজন বিএ পরীক্ষা দিয়েছে কামরুজ্জামান । আরও আছে শংকর বাবু, পুরানা রাজনৈতিক কর্মী বাড়ি রংপুর, আরও কয়েকজনকে রেখেছেন। তাদের অবস্থা কি? উপর দিয়ে পানি পড়ে। দরজা দিয়ে পানি ঢোকে, একটা করে টিনের পায়খানা। ৭ সেল অনেক ভাল। সেখানে রেখেছেন একরারীদের, আরও অনেক জায়গা ভাল আছে সেখানেও রাখতে পারেন, কিন্তু রাখবেন না। কষ্ট দিতে হবে। আপনারা আমাদের বাধ্য করেছেন মোকাবেলা করে দাবি আদায় করতে।
১৮ই মার্চ, ১৯৬৭ঃ
জেলগেটে আমার দ্বিতীয় মামলার সওয়াল জবাব হবে। ১০ ঘটিকা হতে বসে আছি প্রস্তুত হয়ে। ১২টার সময় আমাকে জেলগেটের কোর্টে নিতে এসেছে। যেয়ে দেখি জহির সাহেব, রব সাহেব, মাহমুদুল্লা সাহেব, আবুল হোসেন, জোহা চৌধুরী প্রমুখ এডভোকেট সাহেব এসে বসে আছেন হাকিমের সামনে। আমার আত্মীয়স্বজন ছাড়াও মোস্তফা আনোয়ার চৌধুরী নিজাম, আলি হোসেন ও কর্মীরাও এসেছে। ছাত্রলীগের অন্যতম নেতা রেজাও এসেছে। ছাত্রলীগের নির্বাচন নিয়ে খুব গোলমাল। শুধু অনুরোধ করলাম, 'তোমরা প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করিও। ছাত্রলীগকে ভেঙে ফেলে দিও না। সকলকে আমার সালাম দিও। ঐতিহ্যবাহী এই ছাত্র প্রতিষ্ঠান আমি গড়েছিলাম কয়েকজন নিঃস্বার্থ ছাত্র কর্মী নিয়ে। প্রত্যেকটি আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে এই প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলন, রাজবন্দিদের মুক্তি আন্দোলন, ব্যক্তি স্বাধীনতার আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন ও ছাত্রদের দাবি দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করে বহু জেল-জুলুম সহ্য করেছে এই কর্মীরা। পূর্ব বাংলার ছয় দফার আন্দোলন ও আওয়ামী লীগের পুরাভাগে থেকে আন্দোলন চালিয়েছে ছাত্রলীগ । এই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে গোলমাল হলে আমার বুকে খুব আঘাত লাগে। তাই রেজাকে বললাম, প্রতিষ্ঠান রক্ষা করিও।
২৩ শে মার্চ ১৯৬৭ঃ
লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী শাসনতন্ত্র তৈয়ার না করার জন্য দুই পাকিস্তানে আজও ভুল বুঝাবুঝি চলছে, বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানকে একটি কলোনিতে পরিণত করা হয়েছে। আমি যে ৬ দফা প্রস্তাব করেছি, ১৩ই জানুয়ারি ১৯৬৬ সালে লাহোর প্রস্তাব ভিত্তি করে, সে প্রস্তাব করার জন্য আমি ও আমার সহকর্মীর কারাগারে বন্দি। ইত্তেফাক কাগজ ও প্রেস বাজেয়াপ্ত এবং মালিক ও সম্পাদক মানিক ভাই কারাগারে বন্দি। এই দাবির জন্যই ৭ই জুন ৭ শত লোক গ্রেপ্তার হয় এবং ১১ জন জীবন দেয় পুলিশের গুলিতে। আমি দিব্যচোখে দেখতে পারছি দাবি আদায় হবে, তবে কিছু ত্যাগের প্রয়োজন হবে। আজকাল আবার রাজনীতিবিদরা বলে থাকেন লাহোর প্রস্তাবের দাম নাই পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন দিলে পাকিস্তান দুর্বল হবে। এর অর্থ পূর্ব পাকিস্তানের ছয় কোটি লোককে বাজার হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না, যদি স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয় । চিরদিন কাহাকেও শাসন করা যায় না, যতই দিন যাবে তিক্ততা আরও বাড়বে এবং তিক্ততার ভিতর দিয়ে দাবি আদায় হলে পরিণতি ভয়াবহ হবার সম্ভাবনা আছে।
৮ই এপ্রিল–১০ই এপ্রিল ১৯৬৭ঃ
আজ ৮ই এপ্রিল জেল গেটে ১৯৬৫ সালের ২০শে মার্চ তারিখে পল্টন ময়দানের সভায় যে বক্তিতা করেছিলাম সেই বক্তৃতার মামলার সাওয়াল জবাব শেষ হয়। জনাব আবদুস সালাম খান সাহেব ও জিয়াউদ্দিন সাহেব আমার পক্ষে সওয়াল জবাব করেন। সরকারি উকিল জনাব মেজবাহউদ্দিন সরকারের পক্ষে করেন । প্রায় চার ঘণ্টা চলে। ৬ দফা দাবি কেন সরকারের মেনে নেওয়া উচিত তার উপরই বক্তৃতা করেছিলাম। পূর্ব পাকিস্তানকে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া দরকার। দেশ রক্ষা শক্তিশালী করা প্রয়োজন। গত পাক-ভারত যুদ্ধের সময় পূর্ব বাংলার সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের বিশেষ করে কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো যোগাযোগ ছিল না। অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে হবে। আরও অনেক কিছু আমি নাকি হিংসা, দ্বেষ ও ঘৃণা পয়দা করতে চেয়েছি পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। আমার বুকে ব্যথা, কিন্তু তা বলতে পারব না। আমার পকেট মেরে আর একজন টাকা নিয়ে যাবে, তা বলা যাবে না। আমার সম্পদ ছলে বলে কৌশলে নিয়ে যাবে বাধা দেওয়া তো দুরের কথা-বলা যাবে না। পশ্চিম পাকিস্তানে তিনটা রাজধানী করা হয়েছে যেমন করাচী, পিন্ডি এখন ইসলামাবাদ। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা বন্ধ করার টাকা চাওয়া যাবে না।
দেশরক্ষা আইনে বিচার হয়েছে এই একই ধরনের বক্তৃতার জন্য ডজন খানেক মামলা দায়ের করা হতেছে। মামলার কিছুই নাই, আমাকে জেল দিতে পারে না। যদি নিচের দিকে জেল দিতে বাধ্য হয় তবে জজকোর্ট ও হাইকোর্টে টিকে না। পাৰনায় জনসাধারণ ও আওয়ামী লীগ কর্মীদের উপর চরম অত্যাচার চলছে। আওয়ামী লীগের সকল নেতা ও কর্মীদের গ্রেপ্তার করে ফেলেছে। জামিন দেওয়া হয় নাই। সালাম সাহের নিজে গিয়েছিলেন জামিন নিতে। তাকে দেখা করতে দেয় নাই বন্দিদের সাথে।
২২ এপ্রিল ১৯৬৭ঃ
আজ ২২ তারিখ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ নবাবজাদা নসরুল্লাহ খা, মালিক গোলাম জিলানী, গোলাম মোহাম্মদ খান লুন্দখোর, মালিক সরফরাজ ও জনাব আকতার আহম্মদ খান পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এবং আবদুস সালাম খান, জহিরুদ্দিন, মশিয়ুর রহমান, নজরুল ইসলাম, এম এ আজিজ, আবুল হোসেন এবং আরো অনেকে জেল গেটে কোটে আমার সাথে দেখা করতে আসে। যশোর থেকে আব্দুর রশিদ, খুলনা থেকে আবদুল মোমেন এসেছিল । অনেক আলাপ হলো। যুক্তফ্রন্ট করা যায় কিনা? নিম্নতম কর্মসূচির ভিত্তিতে যুক্তফ্রন্ট করার আপত্তি অনেকেরই নাই তবে ৬ দফা দাবি ছাড়তে কেহই রাজি নয়। এটা আওয়ামী লীগের কর্মসূচি হলেও জনগণ সমর্থন দিয়েছে, প্রাণ দিয়েছে, জেল খাটছে। এই দাবি পূরণ না হলে পূর্ব বাংলার জনগণের বাঁচবার কোনো পথ নাই । আমি আমার মতামত দেই নাই কারণ ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যরা নিজেরাই আলোচনা করে তাদের পথ ঠিক করুক। আমি আমার মত চাপিয়ে দিতে যাবে কেন? আমি বন্দি। বাইরের অবস্থা তারাই ভাল জানে। তবে ৬ দফা দাবি দরকার হলে একলাই করে যাবো।
২৩ এপ্রিল- ২৭ এপ্রিল ১৯৬৭ঃ
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ প্রস্তাব দিয়েছে আমার মত নিয়ে কাজে অগ্রসর হতে। কোর্টে জহির সাহেব আমার কাছে মত জিজ্ঞাসা করেছেন আর বলেছেন অনেকদূর অগ্রসর হয়ে গেছে-পিছান কষ্টকর। আমি আমেনা, আজিজ, মোস্তফা ও জহির সাহেবকে বলে দিয়েছি ঐক্যে আমার আপত্তি নাই তবে সকল বিরোধী দলকে নিতে হবে, ন্যাপ কে বাদ দেওয়া চলবে না; দ্বিতীয়ত পার্টির কাজ বন্ধ হবে না-৬ দফা আন্দোলন চালিয়ে যাবে পার্টি। আমি ও আমার সহকর্মী যারা জেলে আছে বিশেষ করে খন্দকার মোশতাক, তাজউদ্দীন ও আমাকে কোনো সর্বদলীয় কমিটিতে রাখবা না। আমরা ৬ দফা দাবির জন্য জেলে এসেছি। অনেক লোক গুলি খেয়ে মারা গেছে, অনেক কর্মী জেল খাটছে তাদের ত্যাগের দাম আমাকে দিতেই হবে। তাদের রক্তের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা আমি করতে পারব না। তবে ঐক্য হউক, এই সমস্ত নেতারা করে দেখি? এরা ত্যাগ করতে প্রস্তুত আছে কিনা আমি জানি না। তবে আমার সন্দেহ আছে! আমি তোমাদের বাধা দিতে চাই না, তবে উপরে উল্লেখিত দাবি না মানলে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ যোগদান করবে না। যদি করে তাতে আমি আর কি করতে পারি। আমিতো জেলেই আছি
২৭ তারিখে আমার একটা মামলার রায়, ১৯৬৬ সালের ২০শে মার্চ ক ময়দানে আওয়ামী লীগ কর্তৃক আয়োজিত সভায় বক্তৃতা দানের অভিযোগে। জনাব আফসার উদ্দিন প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট জেলগেটের অভ্যন্তরে কোর্ট করে আমার বিচার করেন এবং আমাকে পাকিস্তান দেশরক্ষা আইনের ৪২ ধারা বলে ১৫ মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন।
এই দণ্ড দেওয়ার পরেই জহিরের সাথে আমার আলাপ হয়। আমি তাকে বললাম আমাকে জেল দিয়েছে আমি বিনা বিচারে বন্দি আছি। কতকাল থাকতে হয় জানি না, আমার পক্ষে পূর্ব বাংলার মানুষের সাথে বেঈমানী করা সম্ভব নয় । যাহা ভাল বোঝ কর। আমি জানি ৬ দফা দাবি পূরণ হওয়া ছাড়া এদের বাঁচানোর উপায় নাই। আজ আমি এক বৎসর দেশরক্ষা আইনে বিনা বিচারে জেলে আছি। আমার সহকর্মীরাও আছে । আমি দেখলাম আমার অবর্তমানে দুই গ্রুপ সৃষ্টি হয়েছে । একদল ৬ দফা ছাড়া আপোষ করবে না আর একদল নিম্নতম কর্মসূচিতেই রাজি।
৩রা মে- ২৩শে মে ১৯৬৭ঃ
হাইকোর্ট থেকে একটা হুকুম পেয়েছি যে বক্তৃতার মামলায় জনাব মালেক- প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট, আমাকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন, তার বিরুদ্ধে সরকার হাইকোর্টে আপীল করেছেন। আগামী ২৯ তারিখে হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে তার শুনানি হবে বলে নোটিশ পেয়েছি । কাগজটা পাঠাইয়া দিয়েছি রেণু'র কাছে এডভোকেটদের সাথে পরামর্শ করে যে কোনো একজন ভাল এডভোকেট দিয়ে মামলা পরিচালনা করতে। এতগুলি বক্তৃতার মামলা দিয়েছে। দুইটায় সাজা হয়েছে, একটায় খালাস পেয়েছি, তার বিরুদ্ধেও আপীল করতে সরকারের কত উৎসাহ। যদিও এডভোকেট সাহেব টাকা নেয় না, তথাপি নকল ও অন্যান্য খরচ বাবদ অনেক টাকা ব্যয় হয়। জেলে আছি উপার্জন নাই । ছেলেমেয়েদের খুবই অসুবিধা হবে। লড়তে হবে, উপায় কি? রাজনৈতিক কারণে মানুষ মানুষকে অত্যাচার করে তবে তার একটা সীমা আছে ও লজ্জা আছে । নিশ্চয়ই জনগণ বুঝতে পারে যে একটা লোককে ধ্বংস করার জন্য সরকার উঠে পড়ে লেগেছে। সরকার নিশ্চয়ই জানে 'যার কিছুই নাই তার আবার কিছু নষ্ট হবার ভয় কি?' একটা 'দোয বোধ হয় আমার আছে সেটা হলো জনগণ আমাকে ভালবাসে এবং যে ৬ দফা দাবি করেছি তাহা সমর্থন করে, তাই বোধ হয় এই অত্যাচার। দুনিয়ার ইতিহাসে দেখা গেছে যে কোনো ব্যক্তি জনগণের জন্য এবং তাদের অধিকার আদায়ের জন্য কোনো প্রোগ্রাম দিয়েছে, যাহা ন্যায্য দাবি বলে জনগণ মেনে নিয়েছে । অত্যাচার করে তাহা দমানো যায় না। যদি সেই ব্যক্তিকে হত্যাও করা যায় কিন্তু দাবি মরে না এবং সে দাবি আদায়ও হয়। যারা ইতিহাসের ছাত্র বা রাজনীতিবিদ, তারা ভাল করে জানেন । জেলের ভিতর আমি মরে যেতে পারি তবে এ বিশ্বাস নিয়ে মরব। জনগণ তাদের ন্যায্য অধিকার একদিন আদায় করবে।
শুনলাম বাইরে খুব গোলমাল আওয়ামী লীগের মধ্যে । একদল পিডিএমএ যোগদান করার পক্ষে, আর একদল ছয় দফা ছাড়া কোনো আপোষ করতে রাজি নয়। ১৯ তারিখে ওয়ার্কিং কমিটির বর্ধিত সভা । জেলা ও মহকুমার সম্পাদকদেরও ডাকা হয়েছে । সভা আমার বাড়িতেই করতে হবে বলে একটিং সভাপতি ও এক্টিং সম্পাদক রেনুকে অনুরোধ করেছে। আমি বলেছি সকলে যদি রাজি হয় তাহা হইলে করিও । আমার আপত্তি নাই।
আপোষ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নাই। জেলের ভিতর যারা আছে তাদের মধ্যেই মতবিরোধ আছে । তাজউদ্দীন, মোমিন সাহেব, ওবায়দুল, শাহ মোয়াজ্জেম ও মণি কিছুতেই ৬ দফা ছাড়া পিডিএমএ যোগদান করতে রাজি নয়। খোন্দকার মোশতাক যাতে দলের মধ্যে ভাঙন না হয় তার জন্যই ব্যস্ত। যদিও আমার কাছে মিজানুর রহমান এ কথা ও কথা বলে, তবে সে পিডিএমএর পক্ষপাতী। রফিকুল ইসলাম আমার কাছে এক কথা বলে আর বাইরে অন্য খবর পাঠায়। জালাল ও সিরাজের মতামত জানি না, কারন কমিলায় আছে । তাজউদ্দীন ময়মনসিংহ থেকে আমাকে খবর দিয়েছে নারায়ণগঞ্জের মহীউদ্দিনের মতামত আমি জানি না। তবে ছাত্রনেতা নুরে আলম, নূরুল ইসলাম--আওয়ামী লীগ কর্মী, সুলতান ঢাকা সিটি কর্মী, শ্রমিত নেতা মান্নান ও রুহুল আমিনও আমাকে খবর দিয়েছে ৬ দফা ছাড়া আপোষ হতে পারে না। কিছু কিছু নেতা পিডিএম এর পক্ষে, কর্মীরা কেউই রাজি না মানিক ভাই ও পিডিএম এর পক্ষে। ৮ দফা পিডিএম দিয়েছে। আমাদের দলের চার নেতা জহির, রশিদ, মুজিবুর রহমান ও নুরুল ইসলাম সাহেব তো বিবৃতিই দিয়েছে আট দফা আওয়ামী লীগের মানস পুত্র বলে। তাদের বিবৃতিতে মনে হয় ৮ দফা দাবি ৬ দফা দাবির চেয়েও ভাল। আমি এটা স্বীকার করতে পারি নাই—তাই আমার মতামত পূর্বেই দিয়ে দিয়েছি। আকাশ-পাতাল ব্যবধান রয়েছে এর মধ্যে । পূর্ব বাংলার লােকেদের ধােকা দিতে চেষ্টা করছে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা, বিশেষ করে মওলানা মওদুদী ও চৌধুরী মহম্মদ আলী। ৮ দফা পূর্ব বাংলাকে ৬ দফা দাবি থেকে মোড় ঘুরাইবার একটা ধোঁকা ছাড়া কিছুই না । ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন আমিও চাই, তবে এই সকল বড় বড় নেতারা আন্দোলন করার ধার দিয়েও যাবে না আমার জানা আছে। মওলানা মওদুদী আমাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে আক্রমণও করেছে। ১৮ তারিখে জহির সাহেব, সৈয়দ নজরুল সাহেব, মশিয়ুর রহমান ও আবুল হোসেন আমার সাথে দেখা করতে আসেন। অনেক আলাপ করার পরে আমি বলে দিয়েছি পিডিএম এ যোগদান করতে পারেন না এবং যারা দস্তখত করেছে সেটা অনুমোদনও করতে পারে না ওয়ার্কিং কমিটি। কারণ কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত হয়েছে ৬ দফা ছাড়া কোনো আপোষ হবে না। জন্য কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হলে কাউন্সিল ডেকে সিদ্ধান্ত করাইয়া নিবেন। আমার ব্যক্তিগত মত ৬ দফার জন্য জেলে এসেছি বের হয়ে ৬ দফার আন্দোলনই করব। যারা রক্ত দিয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিসনদ ৬ দফার জন্য, যারা জেল খেটেছে ও খাটছে তাদের রক্তের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে আমি পারব না। পরে জানাইয়া দেই। এও বলেছি এমনভাবে প্রস্তাব করবেন যাতে যারা দস্তখত করেছে তারা যেন সসম্মানে ফিরে আসতে পারে। তবে যদি পিডিএম কোন আন্দোলন করে তাদের সাথে সহযোগিতা করতে রাজি আছি-সহযোগিতা চাইলে, এইভাবে প্রস্তাব করবেন। প্রস্তাব সেইভাবেই করা। হয়েছে।
ওয়ার্কিং কমিটির সভা শেষ করেই জনাব জহিরুদ্দিন, মশিয়ুর রহমান, মুজিবর রহমান (রাজশাহী), আব্দুর রশিদ ও নুরুল ইসলাম চৌধুরী পিডিএফ এ যোগদান করার জন্য লাহোর রওয়ানা হয়ে গিয়েছে। তারা সভায় যােগদান করেছে। বুঝতে আর বাকি রইল না এরা পিডিএম করতেই চায় ৬ দফার আর প্রয়োজন নেই তাদের কাছে।
২৭মে-২৮মে ১৯৬৭ঃ
জহিরুদ্দিনের ইচ্ছা আর সালাম সাহেব চান পূর্ব-পাক আওয়ামী লীগ পিডিএম-এ যোগদান করুক। যেভাবে পিডিএম প্রস্তাব গ্রহণ করেছে তাতে আছে ৮ দফার বিপরীত কোনো দাবি করা যাবে না। অর্থ হলো, ৬ দফা দাবি ছেড়ে দিতে হবে। আমি পরিষ্কার আমার ব্যক্তিগত মতামত দিয়ে দিতে বাধ্য হলাম । ৬ দফা ছাড়তে পারব না । যেদিন বের হব ৬ দফারই আন্দোলন করব। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ পিডিএফ কমিটিতে যোগদান করতে পারবে না । কাউন্সিল সভা হউক দেখা যাবে । যদি পার্টি যেতে চায় আমার আপত্তি কি? কতদিন থাকব ঠিক তো নাই । এটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে ৬ দফা আন্দোলনকে বানচাল করার ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই না। পশ্চিমা নেতৃবৃন্দ, শোষক ও শাসকগোষ্ঠী এই ষড়যন্ত্র করছে। আমাদের নেতারা বুঝেও বুঝতে চায় না। আমেনাকে বললাম, "৭ই জুন শান্তিপূর্ণভাবে পালন করিও। হরতাল করার দরকার নাই। সভা শোভাযাত্রা পথসভা করবা।"
২৮ তারিখের কাগজে দেখলাম ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, জয়দেবপুর ও ফতুল্লা থানা এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে, যাতে ৭ই জুন ৬ দফা দাবি দিবস' পালন করতে না পারে। বুঝতে আর কষ্ট হলো না।
সংবাদ ও ইত্তেফাক বন্ধ করার ব্যাপার নিয়ে আন্দোলন শুরু হয়েছে, আমাকে দমাতে হবে। এটাই হলো সরকারের উদ্দেশ্য।
১৭ জানুয়ারি ১৯৬৮
রাত ১২ টার দিকে আমাকে জেলার সাহেব ঘুম থেকে ডেকে তুললো। বললো, আপনার মুক্তির আদেশ দিয়েছে সরকার, এখনই আপনাকে মুক্ত করে দিতে হবে। আমি তাকে প্রশ্ন করলাম, আমার যে অনেকগুলি মামলা রয়েছে যার জামানত নেওয়া হয় নাই। চট্টগ্রাম থেকে কাস্টডি ওয়ারেন্ট রয়েছে, আর যশোর, সিলেট ময়মনসিংহ, নোয়াখালী, পাবনা থেকে প্রােডাকশন ওয়ারেন্ট রয়েছে। ছাড়বেন কি করে? এটাতো বেআইনি হবে। তিনি বললেন, সরকারের হুকুমে এগুলি থাকলেও ছাড়তে পারি। আমি তাকে হুকুমনামা দেখাতে বললাম। তিনি জেল গেটে ফিরে গেলেন হুকুমনামা আনতে। আমি মোমিন সাহেবকে বললাম, মনে হয় কিছু একটা ষড়যন্ত্র আছে এর মধ্যে। হতে পারে এরা আমাকে এ জেল থেকে অন্য জেলে পাঠাবে | কিছু একটাও হতে পারে, কিছুদিন থেকে আমার কানে আসছিলোল আমাকে ষড়যন্ত্র' মামলায় জড়াইবার জন্য কোনো কোনো মহল থেকে চেষ্টা করা হতেছিল। ডিসেম্বর মাস থেকে অনেক সামরিক, সিএসপি ও সাধারণ নাগরিক গ্রেপ্তার হয়েছে দেশরক্ষা আইনেরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা উপলক্ষ্যে, সত্য মিথ্যা খোদাই জানে।
দেশরক্ষা আইনে জেলে রেখেছে, ১১টা মামলা দায়ের করেছে। আমার বিরুদ্ধে। কয়েকটাতে জেলও হয়েছে, এরপরও এদের ঝাল পড়ল না, ৬ দফার ঝাল এতো বেশি জানতাম না। ডেপুটি জেলার হুকুমনামা নিয়ে এলেন, আমাকে দেখালেন। আমি পড়ে দেখলাম, দেশরক্ষা আইন থেকে আমাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।
বিছানা কাপড়গুলি বেঁধে দিল কয়েদিরা। আমি দেখলাম, ডিপুটি জেলার ও সিপাহি জমাদার, যারা আমাকে ও মালপত্র নিতে এসেছে তাদের মুখ খুব ভার। কারো মুখে হাসি নাই। আমার বুঝতে আর বাকি রইল না যে, অন্য কোনো বিপদে আমাকে ফেলছে সেটা আর কিছু না, যড়যন্ত্র মামলা।
জেলগেটে এসেই দেখি এলাহি কান্ড। সামরিক বাহিনীর লোকজন যথারীতি সামরিক পোশাকে সজ্জিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমাকে 'অভ্যর্থনা করা জন্য। আমি ডিপুটি জেলার সাহেবের রুমে এসে বসতেই একজন সামরিক বাহিনীর বড় কর্মকর্তা আমার কাছে এসে বললেন, "শেখ সাহেব আপনাও গ্রেপ্তার করা হলো"। আমি তাকে বললাম, নিশ্চয় আপনার কাছে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আছে। আমাকে দেখালে বাধিত হব । তিনি একজন সাদা পোশাক পরিহিত কর্মচারীকে বললেন পড়ে শোনাতে। তিনি পড়লেন 'আর্মি, নেভি ও এয়ারফোর্স আইন অনুযায়ী গ্রেপ্তার করা হলো।' আমি বললাম ঠিক আছে চলুন কোথায় যেতে হবে।
জেলের লোহার দরজা খুলে দেওয়া হলো। সামনেই একটি গাড়ি দাঁড়াইয়া আছে । চারদিকে সামরিক বাহিনীর জওয়ানরা পাহারায় রত আছেন। একজন মেজর সাহেব আমাকে গাড়িতে উঠতে বললেন। আমি গাড়ির ভিতরে বসলাম । দুই পার্শ্বে দু’জন সশস্ত্র পাহারাদার, সামনের সিটে ড্রাইভার মেজর সাহেব। গাড়ি নাজিমুদ্দীন রোড হয়ে রমনার দিকে চলল। আমি পাইপ ধরাইয়া রাত্রের স্নিগ্ধ হাওয়া উপভোগ করতে লাগলাম, যদিও শীতের রাত। ভাবলাম কোথায় আমার নূতন আস্তানা হবে! কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে! কিছুই তো জানি না। গাড়ি চলে কুর্মিটোলার দিকে।
বহুকাল পরে ঢাকা শহর দেখছি, ভালই লাগছে । মনে মনে শেরে বাংলা ফজলুল হক, জননেতা সোহরাওয়ার্দী ও খাজা নাজিমুদ্দিনের কবর কে সালাম করলাম । চিরনিদ্রায় শুয়ে আছ, একবারও কি মনে পড়ে না এই হতভাগা দেশবাসীর কথা! শাহবাগ হোটেল পার হয়ে, এয়ারপোর্টের দিকে চলেছে।
এয়ারপোর্ট ত্যাগ করে যখন ক্যান্টনমেন্ট ঢুকলাম তখন আর বুঝতে বাকি রইল না। মনে মনে বাংলার মাটিকে সালাম দিয়ে বললাম, "তোমাকে আমি ভালবাসি, মৃত্যুর পরে তোমার মাটিতে যেন আমার একটু স্থান হয়, মা।"
এর মধ্যেই এসে পৌছলাম একটা ঘরের সামনে । এখানেও সামরিক বাহিনী পাহারা দিচ্ছে । দরজা খুলে দিল । আমি নেমে পড়লে আমাকে সাথে করে একটা কামরায় নিয়ে গেল। সেখানে তিনজন সাদা পোশাক পরিহিত কর্মচারী দাঁড়াইয়া আছে। আমার কেহ কোনো আলাপ করলেন না, আমিও চুপ করে দাঁড়াইয়া রইলাম। কয়েক মিনিট পরে বললাম, শরীর ভাল না, কোথাও বসতে অনুমতি দিন। আমাকে পাশের আর একটা কামরায় নিয়ে বসতে দেওয়া হলো । কয়েক মিনিট পরে এক ভদ্রলোক এলেন এবং আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন যড়যন্ত্র ব্যাপার সম্বন্ধে । বললাম, কিছুই জানি এর মধ্যে এক ভদ্রলোক বলিষ্ঠ গঠন, সুন্দর চেহারা, আমার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে শুরু করলেন। তিনি একজন ডাক্তার। আমার হার্ট পেট রক্তচাপ পরীক্ষা করলেন । কিছুই না বলে চলে গেলেন পাশের কামরায়। কয়েক মিনিট পরে আর একজন কর্মচারী এসে বললেন, চলুন । একটা জীপ গাড়িতে। করে আমাকে অন্য এক জায়গায় নিয়ে যাওয়া হলো। এক কামরা বিশিষ্ট। একটা দালান । সাথে গোসলখানা, ড্রেসিং রুম, স্টোর রুম আছে । দু'খানা খাট পাশাপাশি । একটা খাটে একটা বিছানা আছে । আর একটা খাট খালি। পড়ে আছে। আমাকে বলা হলো আপনার মালপত্র এসে গেছে দেখে নেন । বিছানা খুলে বিছানা করে নিলাম। একজন কর্মচারী-যার নাম লেফটেন্যান্ট জাফর ইকবাল সাহেব, তিনি আমার পাশের খাটেই ঘুমাবেন সামরিক পোশাক পরে—সাথে রিভলবার আছে। লেফটেন্যান্ট সাহেব একাকী প্যাসেন্স খেলতে লাগলেন । আমি বিছানায় বসে পাইপ টানতে লাগলাম, কোনো কথা নাই । কুর্মিটোলার কোন জায়গায় আমি আছি নিজেই জানি না ।
আমাকে সন্ধ্যার পরে আলো বন্ধ করে মেস এরিয়ার বাইরে একটা রাস্তায় বেড়াতে নিয়ে যাওয়া হতো। একজন অফিসার আমার সাথে সাথে হাঁটতো আর দুজন মিলিটারী রাস্তার দুইদিকে পাহারা দিত। কোনো যানবাহন চলাচল করতে পারে না। রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হতে। কয়েকদিন বেড়াবার পরে আমার একটু সন্দেহ হলো । মেস এরিয়ার মধ্যে এত জায়গা থাকতে আমাকে বাইরে বেড়াতে নেওয়া হচ্ছে কেন? দু' একজনের ভাবসাবও ভাল মনে হচ্ছিল না। একটা খবরও আমি পেলাম । কেহ কেহ ষড়যন্ত্র করছে আমাকে হত্যা করতে। আমাকে পিছন থেকে গুলি করে মেরে ফেলা হবে। তারপর বলা হবে পালাতে চেষ্টা করেছিলাম, তাই পাহারাদার গুলি করতে বাধ্য হয়েছে। যেখানে আমাকে বেড়াতে নিয়ে যাওয়া হতো জায়গাটা মেসের বাইরে। কাউকে দেখাতে পারবে যে আমি ভেগে বাইরে চলে গিয়াছিলাম তাই গুলি করা হয়েছে। আমি যে ষড়যন্ত্রটা বুঝতে পেরেছি এটা কাহাকেও বুঝতে না দিয়ে বললাম, এরিয়ার বাইরে বেড়াতে যাবো না, ভিতরে বেড়াবো। ষড়যন্ত্রকারীরা বুঝতে পারল যে আমি বুঝতে পেরেছি। আমি অফিসারদের সামনেই বেড়াতাম । আর একটা খবরও পেয়েছিলাম পরে। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান নাকি বলে দিয়েছেন, আমার উপর যেন কোন শারিরিক অত্যাচার না হয়। আমিও কথায় কথায় কর্মচারীদের জানাইয়া দিয়েছিলাম, আমার গায়ে যদি হাত দেওয়া হয় তবে আমি আত্মহত্যা করব। জানি ইহা একটি মহাপাপ। কিন্তু উপায় কি? মানসিক অত্যাচার যাহা করেছে তাহার চেয়ে গুলি করে মেরে ফেলা অনেক ভাল।
সূত্রঃ কারাগারের রোজনামচা- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান