1764
Published on মে 19, 2020খাজা খায়ের সুজনঃ
১৭ মে, প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি দেশরত্ন শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। ১৯৮১ সালের এই দিনে প্রায় ছয় বছরের নির্বাসিত জীবন শেষে দেশে ফিরে আসেন তিনি। এবার শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ৩৯ বছর পূর্তি হয়েছে।
প্রত্যেক বছর বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ এর সহযোগী সংগঠন গুলো এই দিনটি অনেক কর্মসূচির মাধ্যমে পালন করে থাকে। কিন্তু এইবার বৈশ্বিক অতিমহামারীর কারণে দিবসটি উপলক্ষে ঘরে বসে বিশেষ দোয়া করার জন্য দল এবং সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী ও দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে শেখ হাসিনার নির্দেশনা প্রতিপালনের মধ্য দিয়ে করোনা সংকট মোকাবিলায় চলমান কার্যক্রমকে আরও গতিশীল করে তার প্রতি ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। ১৯৮১ সালের ১৭ মে তিনি পুতুলকে নিয়ে ছ’বছরের নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে দেশে ফেরেন। সেই দিনটি ও ছিল রবিবার।
যেদিন তিনি ফিরে এসেছিলেন এই বাংলাদেশে সে সময় এই বাংলাদেশের পরিবেশ পরিস্থিতি কেমন ছিল ? সেদিনকার সবকিছুই ছিল শেখ হাসিনার জন্য তিমিরবিধারী পথ। প্রত্যেক পদে পদে যেন পাহাড় সমান বাঁধা দাঁড়িয়ে। তাছাড়া তাঁর জীবনের নিরাপত্তার বিষয়টি ও ছিল। কিন্তু না শেখ হাসিনা এইসব কে পরোয়া করার মেয়ে নন। তবে বিদেশে থাকাকালেই ১৯৮১ সালের ১৪-১৫-১৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে আওয়ামী লীগের নেতারা শেখ হাসিনাকে তাঁর অনুপস্থিতিতেই দলের সভানেত্রী নির্বাচিত করেন। দেশে প্রত্যাবর্তনের পর নেতারা তাঁর হাতে তুলে দেন তৎকালীন বহুধাবিভক্ত দেশের সর্ববৃহৎ ও ঐতিহ্যের সাফল্যগাথা মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পতাকা। সেইসময়ে দেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত শেখ হাসিনার জন্য ছিল এক ভয়াবহ ও বিস্ময়কর সিদ্ধান্ত। শেখ রেহানা এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘কিন্তু আমি ভয় পাচ্ছিলাম। ঘাতকরা যদি আবার সক্রিয় হয়ে তাদের আরাধ্য কাজ শেষ করতে তৎপর হয়ে ওঠে? আমি ঠিক করলাম জয় আর পুতুলকে আমি সেই মৃত্যুপুরীতে যেতে দেবো না। ওদের লন্ডনে নিয়ে আসবো। ঠিক তখনই পুতুলের পক্স হলো। এদিকে দিল্লিতে আমার তিন সপ্তাহ থাকার কথা। কিন্তু বিশ্রীভাবে হাত পুড়ে যাওয়ায় প্রায় দু’মাস তখন চলে গেছে। আমার অফিসের ছুটি ও আর বাড়ানো যাচ্ছিল না। তাই কেবল জয় কে নিয়ে আমি লন্ডন ফিরলাম।‘ ফেরার সময় দিল্লি বিমানবন্দরে শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার ছ’বছরের প্রবাস জীবনে আমার প্রতি যে মমতা ও ভালোবাসা দেখানো হয়েছে, তার জন্য আমি ভারতের জনগণকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাই।‘ তার কয়েকদিন আগে মার্কিন সাপ্তাহিক ‘নিউজ উইক’-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা বলেন, ‘জীবনে ঝুঁকি নিতেই হয়। মৃত্যুকে ভয় করলে জীবন মহত্ত্ব থেক বঞ্চিত হয়।‘ এইরকম দৃঢ়চেতা মনোবলই শেখ হাসিনা কে বীরের বেশে দেশে ফিরতে উপযোগী করে তুলেছিল।
তাঁর এ কঠিন ও দৃঢ় মনোবল সেইসময়কার সেনা শাসকচক্র খুব একটা ভালভাবে নেয়নি। সেদিনকার পরিস্থিতি কি ছিল সেটা পরে বলছি কিন্তু সেই সময়কার মুশতাক চক্রের সামরিক জান্তারা এটা ভিন্নভাবে নেয়ার চেষ্টা করেছিল। তৎকালীন মুশতাক-জিয়া ও তাদের মুখপাত্র সাপ্তাহিক ‘ইত্তেহাদ’ এ লেখা হয়, “ইন্দিরার নীলনকশা বাস্তবায়নের পথে এবং বাংলাকে সিকিম বানাবার জন্যই শেখ হাসিনাকে দেশে পাঠানো হচ্ছে।“ সরকারি পত্রিকা ‘দৈনিক বাংলা’ এ ঘটনায় ভারতীয় পত্রিকায় ‘খুশির জোয়ার’ আবিষ্কার করে ।
মাওবাদীদের পত্রিকা ‘হলিডে’ তে লেখা হয়, ‘তাঁর দেশে ফেরার ব্যাপারটি ঢাকা ও দিল্লি কর্তৃপক্ষের মধ্যকার এক চুক্তি অনুসারে বহু আগেই স্থির করা হয়।‘
খুনি সামরিক জান্তা জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করতে না দেওয়ার জন্য সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বকে ভয় পায় ঘাতকগোষ্ঠী।
শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নিয়ে পরদিন ১৯৮১ সালের ১৮ মে দৈনিক ‘সংবাদ’ পত্রিকায় লেখা হয় ‘লাখো জনতা অকৃপণ প্রাণঢালা অভ্যর্থনার মধ্যদিয়ে বরণ করে নেয় তাদের নেত্রীকে’ শিরোনামে লিখে- রাজধানী ঢাকা ১৭ মে মিছিলের শহরে পরিণত হয়েছিল। প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টিও মিছিলের গতিরোধ করতে পারেনি। শ্লোগানেও ভাটা পড়েনি। লাখো কণ্ঠের শ্লোগান নগরীকে প্রকম্পিত করেছে। সংবাদ আরও লিখে- বিকাল সাড়ে ৪টায় আকাশে যখন শেখ হাসিনাকে বহনকারী বিমানটি দেখা যায় তখন সব নিয়ন্ত্রণ আর অনুরোধ আবেদন অগ্রাহ্য করে হাজার হাজার মানুষ বিমানবন্দরের ভেতরে ঢুকে যায়। অনেকটা ঝুঁকি নিয়েই বিমানটি অবতরণ করে। জনতা একেবারেই বিমানের কাছে চলে যায়। বহু চেষ্টার পর জনতার স্রোতকে কিছুটা সরিয়ে ট্রাকটি ককপিটের দরজার একেবারে সামনে নেয়া হয়। এই সময়ে শেখ হাসিনা ভেতর থেকে জনতার উদ্দেশে হাত নাড়েন। বেলা ৪টা ৩২ মিনিটে শেখ হাসিনা কাঠের সিঁড়ি দিয়ে ট্রাকে নেমে আসেন। এই সময় লাখো জনতার কণ্ঠে ছিল গগন বিদারী শ্লোগান- ‘শেখ হাসিনা তোমায় কথা দিলাম- মুজিব হত্যার বদলা নেব’। এ সময় অনেকের চোখে ছিল অশ্রুধারা। আবদুর রাজ্জাক যখন মালা পরিয়ে দেন তাকে, তখন শেখ হাসিনাও অঝোর ধারায় কান্না করছিলেন।
‘বাংলার মানুষের পাশে থেকে মুক্তির সংগ্রামে অংশ নেয়ার জন্য আমি দেশে এসেছি। আমি আওয়ামী লীগের নেত্রী হওয়ার জন্য আসিনি। আপনাদের বোন হিসেবে, মেয়ে হিসেবে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, আজকের জনসভায় লাখো লাখো চেনামুখ আমি দেখছি। শুধু নেই আমার প্রিয় পিতা বঙ্গবন্ধু, মা, আর ভাইয়েরা এবং আরও অনেক প্রিয়জন। শেখ হাসিনা বলেন, ভাই রাসেল আর কোনো দিন ফিরে আসবে না, আপা বলে ডাকবে না। সব হারিয়ে আজ আপনারাই আমার আপনজন।‘
সেদিনের ঝড়-বাদল আর জনতার আনন্দাশ্রুতে অবগাহন করে শেরেবাংলা নগরে লাখ লাখ জনতার সংবর্ধনার জবাবে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘সব হারিয়ে আমি আপনাদের মাঝে এসেছি। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তার আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জাতির পিতার হত্যার বিচার করতে আমি জীবন উৎসর্গ করতে চাই। আমার আর হারাবার কিছুই নেই। পিতা-মাতা, ভাই রাসেল সকলকে হারিয়ে আমি আপনাদের কাছে এসেছি, আমি আপনাদের মাঝেই তাদেরকে ফিরে পেতে চাই। আপনাদের নিয়েই আমি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তা বাস্তবায়ন করে বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চাই, বাঙালি জাতির আর্থসামাজিক তথা সার্বিক মুক্তি ছিনিয়ে আনতে চাই।’
দেশরত্ন শেখ হাসিনার সেই সময়ে দেশে আসার পথটি ও অতোটা সহজ ও মসৃণ ছিল না। সেই সময় আওয়ামীলীগ ও ছিল বহুদা বিভক্ত। অনেকেই জানতেন না বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে দেশের বাহিরে কিভাবে আছেন। কিন্তু দেশে আসার ও আওয়ামীলীগ এর নেতৃত্ব নেওয়ার পথ সৃষ্টি করেন বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে দেশের বাহিরে বসে। শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দেশের বাহিরে বসে অন্যরকম সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন পিতামাতা ও পরিবারের অন্য সবার খুনের বিচারের জন্য। আসতে আসতে সমস্ত ইউরোপে জনমত গড়ে তোলার কাজ করেন। সেইসময় ১৯৭৯ সালের ১০, মে সুইডেনে একটি অনুষ্ঠানে প্রথম বঙ্গবন্ধু ও জেলখানায় জাতীয় চার নেতার হত্যার প্রতিবাদে প্রথম ভাষণ পাঠ করেন বঙ্গবন্ধুর ছোট কন্যা শেখ রেহানা। সেই ছিল বিশ্বের দরবারে দুই বোনের প্রথম প্রতিবাদ। পরবর্তীতে ১৯৮০ সালের ১৬ আগস্ট লন্ডনের ইয়র্ক হলে ১৯৭৫’র ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। শেখ হাসিনা সেখানে প্রধান অতিথি ছিলেন। সেটাই ছিল তাঁর লন্ডনে প্রথম রাজনৈতিক সভা। সেখানে তিনি বিষয়টি উত্থাপন করেন। এছাড়াও ১৯৮০ প্রথম দিকে লন্ডনে বঙ্গবন্ধু পরিষদ গঠন করেন। যার সভাপতি করা হয়েছিল বিখ্যাত আইনজ্ঞ স্যার টমাস ইউলিয়ামস কে। এর পরবর্তীতে এই সংগঠনের সভাপতি হয়েছিলেন নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত শন ম্যাকব্রাইড। তাদের দুইবোনের এইসব প্রচেষ্টায় ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৮০ তারিখে বঙ্গবন্ধুর হত্যার তদন্ত করার জন্য আন্তর্জাতিক কমিশন গঠন করা হয়। এইভাবেই সংগ্রাম করে গেছেন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা।
১৭ মে থেকে থেকে তাঁর কমিটমেন্ট অত্যন্ত সুস্পষ্ট এই বাংলাদেশ ও এই জাতির প্রতি। সেই থেকে শেখ হাসিনার সত্য কথা বলার অবিচল দৃঢ়তা তাকে অপশাসকদের কাছে বিপজ্জনক করে তুলেছিল। তারা তাঁকে তাঁর পিতার বাসভবনে বন্দী করে রাখলেও তাঁর উদ্যমকে, চেতনাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি।
বিশাল দুর্গের মতো পৈতৃক বাড়ি ও তার উত্তরাধিকারের মধ্যে আটকে থাকলেও তাঁর বসবাস ছিল সেই মুক্তির মধ্যে, যে মুক্তি হলো সাহসিকতার মুক্তি। আর জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর একটি স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখার সিকি শতাব্দী পর আজ দেশরত্ন শেখ হাসিনা সেখানে গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনেছেন। দেশরত্ন শেখ হাসিনা একজন মহান পিতার সুযোগ্য কন্যা, একটি যোগ্য জনগোষ্ঠীর মহান সেবক। সেই থেকেই গভীর ষড়যন্ত্র, বার বার প্রাণনাশের চেষ্টা, গ্রেফতার-নির্যাতনসহ শত সহস্র বাধা অতিক্রম করে জনগণের আস্থা অর্জনের মাধ্যমে দেশে ফেরার ১৫ বছরের মাথায় আওয়ামী লীগকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় নিতে সক্ষম হন দেশরত্ন শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা সেদিন জনগণকে দেয়া সেই অঙ্গীকার পূরণে ৩৯ বছর ধরে প্রতিনিয়ত মৃত্যুকে মোকাবেলা করে জনগণের ভাগ্যবদলে নিরলস প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন।
সেই থেকে বাংলাদেশ কে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। শেখ হাসিনা তাঁর নিজেকে নিয়ে গেছের অন্য উচ্চতায়। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে তিনি আজ বিশ্ব নেতার আসনে । শেখ হাসিনার এই সংগ্রাম কে এক কথায় বলা যায় ইতালির বিখ্যাত সাংবাদিক অরিয়ানা ফ্যালাচির ভাষায় তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘লেটার টু এ চাইল্ড নেভার বর্ন’ এর শেষ লাইনে বলেছেন, life doesn’t die-জীবন কখনো মরে না। সেই সাথে বাংলাদেশকেও আর কখনো ফিরে যেতে হয়নি পাকিস্তানি ভাবধারায়। তাই এটি বলা যায় সেইদিন শুধু শেখ হাসিনা ফিরে আসেনি, ফিরে এসেছে বাংলাদেশও।
সেইদিন ফিরে এসেছিলেন শেখ হাসিনা, সেই সাথে বাংলাদেশও
লেখক: শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ছাত্রলীগ নেতা।