5011
Published on মার্চ 26, 2020তোফায়েল আহমেদঃ
আগামী বছর পালিত হবে মহান স্বাধীনতা দিবসের সুবর্ণজয়ন্তী। এ বছর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ তথা ‘মুজিববর্ষ’ দেশব্যাপী সগৌরবে পালিত হচ্ছে। এরই মধ্যে দেখা দিয়েছে ‘করোনা ভাইরাস’-এর প্রাদুর্ভাব! ফলত, ‘মুজিববর্ষ’ ও ‘স্বাধীনতা দিবস’-এর বহু অনুষ্ঠান স্থগিত করা হয়েছে। ‘করোনা ভাইরাস’ বিশ্ব জুড়ে মহামারি আকার ধারণ করে মানবসভ্যতাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। এমনই এক ভয়াবহ বিপর্যয় আর নির্বিচার গণহত্যার কবলে আমরা পড়েছিলাম ১৯৭১-এর পঁচিশে মার্চ। তখন দৃশ্যমান ঘাতকের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বাঙালি জাতি ছিল ঐক্যবদ্ধ; আজ দৃশ্যমান নয়, এমন নীরব এক ঘাতক ‘করোনা ভাইরাস’-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সমগ্র মানবজাতি ঐক্যবদ্ধ। শত্রুকে পরাস্ত করতে ঐক্যের বিকল্প নেই।
একাত্তরের পঁচিশে মার্চ দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। বাইশে মার্চ বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে প্রাক্তন বাঙালি সৈনিকদের সঙ্গে বৈঠকে কর্নেল ওসমানী সাহেব বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘ডু ইউ থিংক দ্যাট টুমরো উইল বি এ ক্রুশিয়াল ডে?’ বঙ্গবন্ধু জবাবে বলেন, ‘নো, আই থিংক, ইট উইল বি টোয়েন্টি ফিফথ্।’ তখন ওসমানী সাহেব পুনরায় প্রশ্ন করেন, ‘কাল তো তেইশে মার্চ। পাকিস্তান দিবস। সে উপলক্ষ্যে ওরা কি কিছু করতে চাইবে না?’ বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘ওরা যে কোনো মুহূর্তে যে কোনো কিছু করতে পারে। তার জন্য কোনো দিবসের প্রয়োজন হয় না।’ নিখুঁত হিসাব করেই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন পঁচিশে মার্চেই পাকিস্তানিরা ক্র্যাকডাউন করবে।
পঁচিশে মার্চ রাতে মনি ভাই (শেখ ফজলুল হক মনি) ও আমি বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নিই। বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যখন যাচ্ছি, তখন রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড। সেগুনবাগিচার একটি প্রেসে মনি ভাই লিফলেট ছাপতে দিয়েছিলেন। সেগুনবাগিচা থেকে হেঁটে মনি ভাইয়ের আরামবাগস্থ বাসায় যাই। রাত ১২টায় জিরো আওয়ারে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী পূর্বপরিকল্পিত ‘অপারেশন সার্চলাইট’ অনুযায়ী শুরু করে বাঙালি নিধনে গণহত্যা, যা অখণ্ড পাকিস্তানের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেয়। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের দাবিকে সশস্ত্র পন্থায় নিশ্চিহ্ন করতেই এই গণহত্যা। চারদিকে প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ ছাপিয়ে আমার কানে তখন বাজছে বিদায়বেলায় বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ, ‘তোমাদের যে দায়িত্ব আমি দিয়েছি, সেই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করো। আমার জন্য ভেবো না। আমি যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছি, আমার স্বপ্নের সেই বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই হবে। ওরা অত্যাচার করবে, নির্যাতন করবে। কিন্তু আমার বাংলাদেশের মানুষকে দাবিয়ে রাখতে পারবে না।’ পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলার মানুষকে দাবিয়ে রাখতে পারেনি। যুদ্ধ শুরু হলে আমরা কোথায় যাবো কী করব সে ব্যাপারে করণীয় নির্দেশ করে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘প্রস্তুত থেকো’; আঠারোই ফেব্রুয়ারি ঠিকানা মুখস্থ করিয়েছিলেন, ‘সানি ভিলা, ২১ নম্বর রাজেন্দ্র রোড, নর্দার্ন পার্ক, ভবানীপুর, কলকাতা।’ এখানেই তিনি আমাদের জন্য সব ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন।
একাত্তরের ছাব্বিশে মার্চ ছিল শুক্রবার। রাতে মনি ভাইয়ের বাসায় ছিলাম। সেখানেই শুনলাম বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সকালে জাতির উদ্দেশে দেওয়া বেতার ভাষণে ইয়াহিয়া খান রাজনৈতিক তত্পরতা নিষিদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘সপ্তাহখানেক আগেই আমার উচিত ছিল শেখ মুজিবুর রহমান ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। কেননা কয়েকটি শর্ত দিয়ে সে আমাকে ট্র্যাপে ফেলতে চেয়েছিল। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সে আক্রমণ করেছে, এই অপরাধ বিনা শাস্তিতে যেতে দেওয়া হবে না।’ সাতাশে মার্চ দুই ঘণ্টার জন্য কারফিউ প্রত্যাহূত হলে আমরা গুলিস্তান দিয়ে নবাবপুর রোড ধরে সদরঘাট গিয়ে কেরানিগঞ্জের উদ্দেশে যাত্রা করি। পেছনে পড়ে থাকে ধ্বংস আর মৃত্যু উপত্যকাসম রক্তাক্ত ঢাকা নগরী। যাওয়ার সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে দফায় দফায় প্রচারিত এম এ হান্নান সাহেবের ভাষণ শুনি, ‘কে বলে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়েছে? তিনি আমাদের মধ্যেই আছেন।’ সকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে হান্নান সাহেব এবং অন্যান্য নেতারা বিরামহীনভাবে ঘোষণা দিতে থাকেন, ‘বাংলাদেশ আজ স্বাধীন। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে প্রিয় মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করতে আমাদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন।’ কেরানীগঞ্জে আওয়ামী লীগ নেতা বোরহানউদ্দিন গগন-যিনি পরে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন-তার বাড়িতে আশ্রয় নিই। কেরানীগঞ্জে দুই রাত থাকার পর উনত্রিশে মার্চ আমি, মনি ভাই, জাতীয় নেতা ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামান সাহেব, এবং আমাদের বন্ধু ’৭০-এ নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ডা. আবু হেনাসহ-যিনি অসহযোগ আন্দোলনের সময় বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে কলকাতা গিয়েছিলেন এবং এসেছিলেন, সেই পথে-আমরা প্রথমে দোহার-নবাবগঞ্জ, পরে মানিকগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, সারিয়াকান্দি, বগুড়া হয়ে বালুরঘাট দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে চৌঠা এপ্রিল ‘সানি ভিলা’য় আশ্রয় গ্রহণ করি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এটিই ছিল বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট সংক্ষেপে বিএলএফ তথা মুজিব বাহিনীর আশ্রয়স্থল। উল্লেখ্য, সমগ্র বাংলাদেশকে চারটি বৃহত্ অঞ্চলে বিভক্ত করে রাজনৈতিকভাবে অগ্রসর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে সংগঠিত ছিল মুজিব বাহিনী। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক নিয়োগকৃত প্রধান সেনাপতি আতাউল গণি ওসমানীর নেতৃত্বে গঠিত বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর (এফএফ) সঙ্গে একত্রে যুদ্ধ করে শত্রু বাহিনীকে মোকাবিলা করাই ছিল মূলত মুজিব বাহিনীর কাজ। মুজিব বাহিনীর অন্যতম প্রধান শ্রদ্ধেয় নেতা শেখ ফজলুল হক মনি ভাইয়ের দায়িত্বে ছিল তত্কালীন চট্টগ্রাম ডিভিশন ও বৃহত্তর ঢাকা জেলা; রাজশাহী বিভাগ (পাবনা ও সিরাজগঞ্জ বাদে) ও উত্তরাঞ্চলের দায়িত্বে ছিলেন সিরাজুল আলম খান; আবদুর রাজ্জাকের দায়িত্বে ছিল বৃহত্তর ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জসহ এক বিরাট অঞ্চলের আর আমার দায়িত্বে ছিল পাবনা, কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা, ফরিদপুর, বরিশাল ও পটুয়াখালী জেলা। মুজিব বাহিনীর ট্রেনিং হতো দেরাদুনে। দেরাদুনে ট্রেনিং শেষে আমার সেক্টরের যারা তাদের প্লেনে করে ব্যারাকপুর ক্যাম্পে নিয়ে আসতাম। মুজিব বাহিনীর সদস্যদের বাংলাদেশে প্রবেশের আগে বুকে টেনে, কপাল চুম্বন করে বিদায় জানাতাম। মুজিব বাহিনীর ট্রেনিং ক্যাম্পে বক্তৃতায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু মুজিবকে উদ্দেশ্য করে আমরা বলতাম, ‘প্রিয় নেতা, তুমি কোথায় আছ, কেমন আছ জানি না! যতদিন প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে হানাদারমুক্ত করতে না পারব, ততদিন আমরা মায়ের কোলে ফিরে যাব না।’
অসহযোগ আন্দোলন আর বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক কৌশলের কাছে পরাস্ত হয়ে গণহত্যার দিকে এগিয়ে যায় পাকিস্তান সামরিক জান্তা। গণহত্যা শুরুর সাথে সাথে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক বাহিনীর প্রধান লে. জেনারেল নিয়াজীর জনসংযোগ কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালিক তার ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘যখন প্রথম গুলিটি বর্ষিত হলো, ঠিক সেই মুহূর্তে পাকিস্তান রেডিও’র সরকারি তরঙ্গের কাছাকাছি একটি তরঙ্গ থেকে ক্ষীণস্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। ঐ কণ্ঠের বাণী মনে হলো পূর্বেই রেকর্ড করে রাখা হয়েছিল। তাতে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানকে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ হিসেবে ঘোষণা করেছেন।’ স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে তিনি আরো লিখেছেন, ‘ঘোষণায় বলা হয়, ‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের মানুষ যে যেখানে আছেন, আপনাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর মোকাবিলা করার জন্য আমি আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে উত্খাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আপনাদের সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।’ প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতার ঘোষণার পর্যায়ে পৌঁছতে বঙ্গবন্ধুকে দীর্ঘ চব্বিশটি বছর ধাপে ধাপে আন্দোলন-সংগ্রাম পরিচালনা করে, জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে শাসকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে, জেল-জুলুম-হুলিয়া, ফাঁসির মঞ্চ উপেক্ষা করে মৃত্যুঞ্জয়ী শক্তি নিয়ে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হয়েছে। এক দিনে হয়নি। বহু বছর ধরে, অগণিত মানুষের আত্মদানের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু মুজিবের স্বাধীনতার ঘোষণাকে শিরোধার্য করেছে।
বাংলার মানুষের অধিকার বিসর্জন দিয়ে বঙ্গবন্ধু কখনোই ভাবেননি তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবেন। বিশ্বখ্যাত সাতই মার্চের ঐতিহাসিক বক্তৃতায় সে কথা স্পষ্ট করে বলেছিলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না; আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই।’ একাত্তরের সতেরোই মার্চ ৫২তম জন্মদিনে পরিষ্কার অক্ষরে বলেছিলেন, ‘আমার জীবন আমি জনগণের জন্য উত্সর্গ করেছি।’ সত্যিকার অর্থেই বঙ্গবন্ধুর জীবন জনগণের জন্য উত্সর্গীকৃত ছিল এবং জীবন দিয়েই তিনি তা প্রমাণ করেছেন। সব সময় লক্ষ্য করেছি, বাংলার স্বাধীনতার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর অনমনীয় মনোভাব। তিনি মৃত্যুকে ভয় পেতেন না। মৃত্যুর জন্য নিজকে প্রস্তুত রাখতেন। পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক গ্রেফতার হওয়ার আগে গণহত্যা শুরুর প্রাক্কালে জীবনানন্দ দাশের কবিতা উদ্ধৃত করে বলেছিলেন, ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে এই বাংলায়...’। একাত্তরের ষোলোই ডিসেম্বর ৩০ লক্ষাধিক প্রাণ আর ৪ লক্ষাধিক মা-বোনের সুমহান আত্মত্যাগের বিনিময়ে প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতা অর্জিত হওয়ার পর, বিশ্ব জনমতের চাপে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে যেদিন বাহাত্তরের দশই জানুয়ারি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলার মাটিতে ইতিহাসের মহানায়কের বেশে প্রত্যাবর্তন করেন, সেদিন আমাদের স্বাধীনতা পূর্ণতা লাভ করে।
লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা, সংসদ সদস্য, সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি
সৌজন্যেঃ দৈনিক ইত্তেফাক (২৬ মার্চ ২০২০)