4582
Published on মার্চ 9, 2020ড. মো. শহীদুর রশীদ ভূঁইয়াঃ
বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে কৃষিই ছিল এ দেশের অর্থনীতির প্রধান খাত। এ দেশের জনসংখ্যার সিংহভাগ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। এই কৃষিকে দেখে দেখেই বেড়ে উঠেছেন বঙ্গবন্ধু। খুব কাছে থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন কৃষিকে অবলম্বন করা আধপেটা-একপেটা কৃষক আর তাদের দারিদ্র্যপীড়িত জীবন। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের ভয়াবহ চিত্র দেখেছেন আর ছুটে বেড়িয়েছেন গ্রাম থেকে গ্রামে এসব বুভুক্ষু মানুষের অন্নসংস্থানে খাদ্য সংগ্রহ কাজে। দেখেছেন পাকিস্তানি শাসকদের বিমাতাসুলভ আচরণ। এ দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক বৈষম্যসহ তাদের নানা রকম অত্যাচার-অবিচার তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন। কীভাবে কৃষির প্রতি তাদের চরম অবহেলা এ দেশকে খাদ্য ঘাটতির দেশে পরিণত করেছে, সে ইতিহাস বঙ্গবন্ধু ভালো করেই জানতেন। ফলে কৃষি ও কৃষক না বাঁচলে যে এ দেশ বাঁচবে না- এ কথা তিনি যথার্থ বুঝতে পেরেছিলেন।
গ্রামের দরিদ্র কৃষক আর ভুখা-নাঙ্গা মানুষদের ভাগ্যের পরিবর্তন করার জন্যই শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর যত আন্দোলন-সংগ্রাম। কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষের জন্য একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্য নিয়েই ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করার পর আলোচনার দ্বার বন্ধ হয়ে গেলে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দেন। সে ডাকে সাড়া দেয় সর্বস্তরের মানুষ। শুরু হয় রক্তক্ষয়ী এক মুক্তিযুদ্ধ। যুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধুকে আটক করে রাখা হয় পাকিস্তানের কারাগারে। দেশ মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জন করে স্বাধীনতা। ১৯৭২ সালে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এসে সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি এ দেশের শাসনভার তুলে নেন নিজ কাঁধে।
দেশটি তখন স্বাধীনতা যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল ঘরবাড়ি, অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ, খাদ্যগুদাম, হাসপাতালসহ কত কী! যুদ্ধবিধ্বস্ত ভঙ্গুর অবকাঠামো আর অতিনাজুক অর্থনীতিকে অবলম্বন করে শুরু তার দেশ পুনর্গঠন কাজ। প্রয়োজন অর্থ, অবকাঠামো, দক্ষ জনশক্তি, সঠিক পরিকল্পনা; সেই সঙ্গে এর বাস্তবায়নে নিবেদিতপ্রাণ কর্মী। শুরুতেই কৃষি ও কৃষকের জন্য ধ্বংসপ্রাপ্ত অবকাঠামো পুনর্নির্মাণ করতে হয় বঙ্গবন্ধুকে। পাকিস্তানি শাসকদের অবহেলার কারণে পূর্ববাংলায় তখন গড়পড়তা ১৫ লাখ টন খাদ্যশস্যের ঘাটতি দেখা দিত। ৯ মাস যুদ্ধের কারণে কৃষক মাঠে ফসল ফলাতে সমস্যায় পড়ে। বহু কৃষককে ঘরবাড়ি ত্যাগ করতে হয় বলে অনেকেই চাষাবাদ করতে পারেনি। ফলে তখনকার হিসাব অনুযায়ী খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৩০ লাখ টনে। সমুদ্রবন্দর যুদ্ধের ক্ষত নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। খাদ্য নিয়ে জাহাজ ভিড়বে কূলে, সে অবস্থাও ছিল না। ছিল না ফসল আবাদ করার প্রয়োজনীয় বীজ, সার, কীটনাশক। সেচসহ কৃষি উপকরণের ঘাটতি ছিল প্রকট। এসব কেনার তহবিলও ছিল না সরকারের হাতে। বিদেশ থেকে ধারদেনা করে এসব সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়েছে তাঁকে। এগুলো ছিল তাঁর স্বল্পমেয়াদি কৃষি সমস্যা সমাধান প্রচেষ্টার অংশ।
কৃষির ক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধি এবং কৃষক যেন ঘুরে দাঁড়াতে পারে সে জন্য তিনি বেশ কিছু যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এসবের মধ্যে ছিল-১৩ মাসে কৃষকদের মাঝে ১০ কোটি টাকার তাকাভী ঋণ বণ্টন; ৫ কোটি টাকার সমবায় ঋণ বণ্টন; ৮৩ হাজার টন সার সংগ্রহ এবং ৫০ হাজার টন সার বণ্টন; ১৬ হাজার ১২৫ টন ধানের বীজ বণ্টন; ৩ হাজার মণ গমবীজ বণ্টন; এক হাজার ৭০০ মণ আলুবীজ বণ্টন; ৪৫৪ টন পাটবীজ বণ্টন; সেচের জন্য ২৯শ' গভীর নলকূপ স্থাপন; তিন হাজারটি অগভীর নলকূপ স্থাপন; ৪০ হাজার শক্তিচালিত লো-লিফট পাম্প সরবরাহ; ৮০ লাখ একর জমিতে সেচের ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ; বিএডিসিকে ২১টি ট্রাক্টর সরবরাহ; নামমাত্র মূল্যে ২১টি পাওয়ার টিলার সরবরাহ; নামমাত্র মূল্যে হালচাষের জন্য এক লাখ বলদ সরবরাহ; ভর্তুকি মূল্যে ৫০ হাজার দুগ্ধবতী গাভি সরবরাহ; একটানা তিন মাস খাদ্যশস্যসহ ৩০ কোটি টাকার রিলিফ বণ্টন।
বঙ্গবন্ধু খাসজমিসহ ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বিতরণযোগ্য জমির পরিমাণ বৃদ্ধি করার জন্য পরিবারপ্রতি জমির সিলিং ১০০ বিঘা নির্ধারণ করে দেন। তিনি উন্নত বীজ, সার, সেচের নানা রকম পাম্প ও অন্যান্য কৃষি উপকরণ সরবরাহের পাশাপাশি ১৯৭২ সালে ইউরিয়া, পটাশ ও টিএসপি সারের মণপ্রতি মূল্য নির্ধারণ করে দেন যথাক্রমে ২০ টাকা, ১৫ টাকা ও ১০ টাকা। সত্যিকার অর্থে বিশ্ববাজারে এসব সারের উচ্চমূল্য যেন কৃষকদের ফসলের জমিতে সার প্রয়োগে বিঘ্ন সৃষ্টি করতে না পারে, সে জন্য সারে কৃষককে ভর্তুকি দেন বঙ্গবন্ধু। তা ছাড়া পাকিস্তানি আমলে রুজু করা ১০ লাখ সার্টিফিকেট মামলা থেকে কৃষকদের রক্ষা করেন। তিনি ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা চিরতরে রহিত করে দেন। দরিদ্র কৃষকদের রক্ষায় নিম্নমূল্যে রেশনপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা হয়। গরিব কৃষক পরিবারের সন্তান যেন সরকারি খরচে লেখাপড়া করতে পারে, সে ব্যবস্থাও করে দেওয়া হয়। সরকার ইজারাদারি প্রথা বিলুপ্ত করে, ভূমি প্রশাসন ও ভূমি সংস্কার মন্ত্রণালয় স্থাপন করে এবং সেলামি ছাড়া জমি বণ্টনের ব্যবস্থা করে।
দায়িত্ব গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে শুরু করলেন দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নে প্রয়োজনীয় উপাত্ত সংগ্রহের কাজ। স্বাধীনতার দেড় বছরের মাথায় অতি দ্রুততায় পরিকল্পনা কমিশনের মাধ্যমে প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (১৯৭৩-৭৮) প্রণয়ন করা হয়। সে পরিকল্পনায় যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের পাশাপাশি দেশের কৃষিসহ অন্যান্য খাতে নানাবিধ ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ প্রণয়ন করা হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের ক্ষত বুকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু এবার কৃষকদের কৃষিকর্মে ফিরে আসার আহ্বান জানালেন। শোষণ কমিয়ে আনার লক্ষ্যে পরিকল্পনায় ভূমি সংস্কারের ওপর জোর দেওয়া হয়। ক্ষুুদ্র চাষি ও ভূমিহীন কৃষক-মজুরদের সমবায় সমিতির মাধ্যমে কৃষি কর্মকাণ্ডে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
কৃষিক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর আরেকটি সুদূরপ্রসারী সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের কৃষিতে এক দীর্ঘমেয়াদি ও যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা করে। অন্যান্য টেকনিক্যাল গ্র্যাজুয়েট যেখানে সরকারি চাকরিতে প্রথম শ্রেণির মর্যাদায় যোগদান করতেন, সেখানে কৃষি গ্র্যাজুয়েটদের সরকারি চাকরিতে দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদায় যোগদান করতে হতো। একই দেশে টেকনিক্যাল গ্র্যাজুয়েটদের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য কর্মক্ষেত্রে এক জটিল ও বহুমাত্রিক টানাপোড়েন সৃষ্টি করেছিল। কৃষিশিক্ষা, কৃষি গবেষণা, কৃষি সম্প্রসারণসহ কৃষির সর্বক্ষেত্রে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছিল। পাকিস্তান সরকার আমাদের কৃষির উন্নতি হোক, সে বিষয়ে ভীষণ রকম উন্নাসিক ছিল। সে কারণে বিভিন্ন প্রকার টেকনিক্যাল গ্র্যাজুয়েটদের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য নিরসনে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। তা ছাড়া কৃষিকে তারা তেমন গুরুত্বই দেয়নি। বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন, মেধাবী শিক্ষার্থীদের যদি কৃষিশিক্ষায় আগ্রহী করে তোলা না যায়, তাহলে কৃষিতে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করা কখনও সম্ভব নয়। অতঃপর সবদিক বিবেচনা করেই বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সরকারি চাকরিতে অন্যান্য টেকনিক্যাল গ্রাজুয়েটদের মতো কৃষি গ্র্যাজুয়েটদেরও প্রথম শ্রেণির মর্যাদা প্রদানের ঘোষণা দেন। তিনি ব্যবহারিক কৃষির ওপর জোর দিতে বলেন। চাষের গরুর তখন বেশ ঘাটতি দেখা দিয়েছিল। কারণ মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি সৈন্যরা ধরে ধরে মোটাতাজা গরু খেয়ে ফেলেছিল। তিনি গরুর মাংস কম খেয়ে সে ঘাটতি পূরণ করার কথাও তাঁর বক্তৃতায় তুলে ধরেন। তিনি আরও বলেন- শতকরা ৯০ জন কৃষক গ্রামে বাস করে। গ্রামের দিকে যেতে হবে। আমার ইকোনমি যদি গণমুখী না করতে পারি এবং গ্রামের দিকে যদি না যাওয়া যায়, সমাজতন্ত্র কায়েম হবে না; কৃষি বিপ্লব হবে না। দেশের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে, মানুষ মানুষকে খাবে। কারণ খাবার অভাব হলে মানুষের মাথা ঠিক থাকে না। সে জন্য খাওয়ার দিকে আমাদের নজর দিতে হবে। সেদিকে আমাদের চেষ্টা করতে হবে। আপনাদের সকলের কাজে এগোতে হবে।
আমাদের দেশের জমিতে বিজ্ঞানভিত্তিক চাষাবাদ করতে পারলে ফসলের ফলন যে বৃদ্ধি পাবে, এ বিষয়ে কোনো সংশয় বঙ্গবন্ধুর মনে ছিল না। তিনি তাঁর বক্তৃতায় এ বিষয়টিও তুলে আনেন... আপনারা জানেন, আমার দেশের এক একর জমিতে যে ফসল হয়, জাপানের এক একর জমিতে তার তিন গুণ ফসল হয়। কিন্তু আমার জমি দুনিয়ার সেরা। আমি কেন সেই জমিতে ডাবল ফসল করতে পারব না? আমি যদি দ্বিগুণ করতে পারি তাহলে আমাকে খাদ্য কিনতে হবে না; ভিক্ষা করতে হবে না। ... আমি চাই বাংলাদেশের প্রত্যেক কৃষক ভাইয়ের কাছে; যারা সত্যিকার কাজ করে, যারা প্যান্ট পরা কাপড় পরা ভদ্রলোক, তাদের কাছেও চাই, জমিতে যেতে হবে। ডাবল ফসল করুন। প্রতিজ্ঞা করুন- আজ থেকে ওই শহীদদের কথা স্মরণ করে ডাবল ফসল করতে হবে। যদি ডাবল ফসল করতে পারি, আমাদের অভাবও ইনশাল্লাহ হবে না। কারও কাছে ভিক্ষুকের মতো হাত পাততে হবে না।
বঙ্গবন্ধু কৃষিক্ষেত্রে গতিশীলতা আনতে স্বল্পমেয়াদি কিন্তু অতি জরুরি বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার পর কৃষিক্ষেত্রে মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মকাণ্ড পরিচালনায় পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মাধ্যমে তিনি মধ্যমেয়াদি লক্ষ্য অর্জন করার দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন। দেশে একটি স্থিতিশীল অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনার পরিবেশ সৃষ্টি করতে সচেষ্ট হন তিনি। দীর্ঘমেয়াদি কর্মকৌশল নির্ধারণেও বঙ্গবন্ধু কাজ চালিয়ে যান। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তিনি ১৯৭৫ সালের ২৫ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তিনি তাঁর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণায় বলেন- আঘাত করতে চাই ঘুণেধরা সমাজব্যবস্থাকে। নতুন সিস্টেমে যেতে চাচ্ছি আমি। গ্রামে গ্রামে বহুমুখী কো-অপারেটিভ করা হবে। ভুল করবেন না। আমি আপনাদের জমি নেব না। পাঁচ বছরের প্ল্যানে বাংলাদেশের ৬৫ হাজার গ্রামের প্রত্যেকটিতে বহুমুখী কো-অপারেটিভ করা হবে। এই কো-অপারেটিভে জমির মালিকের জমি থাকবে। বেকার অথচ কর্মক্ষম প্রত্যেক ব্যক্তিকে কো-অপারেটিভের সদস্য হতে হবে। পয়সা যাবে তাদের হাতে। টেস্ট রিলিফ যাবে তাদের হাতে। ওয়ার্কস প্রোগ্রাম যাবে তাদের আওতাধীন। আস্তে আস্তে ইউনিয়ন কাউন্সিল থেকে টাউটদের বিদায় দেওয়া হবে। তা না হলে দেশকে বাঁচানো যাবে না।
এ দেশের কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের ভাবনা বঙ্গবন্ধু আজীবন লালন করেছেন। বঙ্গবন্ধু জানতেন, এ দেশের কৃষক ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠী এ দেশের কৃষি ও মাটির সঙ্গে সম্পৃক্ত। ফলে উন্নয়নের গতিধারায় এ সম্পর্ক যেন নষ্ট না হয়, সেটি তাঁর ভাবনায় কাজ করেছিল অনুক্ষণ। সে কারণেই ভূমির মালিকানা অক্ষুণ্ণ রেখে যৌথ পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে কৃষিতে গতিশীলতা আনার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, এ দেশের মানুষের মুক্তির জন্য প্রযোজন কৃষি বিপ্লব।
সমবায় পদ্ধতিতে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ভাগ্যোন্নয়নের ওপর সর্্েবাচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়। তিনি তাঁর প্রস্তাবিত রূপরেখায় ২৯৯ একর থেকে ৫০০ একর পর্যন্ত ভূমি নিয়ে একেকটি গ্রাম সমবায় সমিতি গঠনের প্রস্তাব করেন। এ জন্য প্রতিটি সমিতিতে একটি ব্যবস্থাপনা পর্ষদ এবং এদের প্রত্যেকটির অধীনে চারটি উপপর্ষদেরও ব্যবস্থা রাখা হয়। এই ব্যবস্থাপনায় ফসল কাটার সময় বা এর অব্যবহিত পর উৎপাদিত ফসলের ৩৩ শতাংশ জমির মালিকদের ও ৬৭ শতাংশ সমিতির অংশ বলে বিবেচনা করার প্রস্তাব রাখা হয়েছিল। সমিতির অংশের মধ্যে ৭০ শতাংশ চাষাবাদ, উপকরণ সরবরাহ ও আনুষঙ্গিক খরচ মেটানোর জন্য; ৭ শতাংশ সমিতির ব্যবস্থাপনা ও প্রাতিষ্ঠানিক খরচ; ১০ শতাংশ সমিতির মূলধন খরচ; ১ শতাংশ কর ও খাজনা বাবদ সরকারের অংশ; ৫ শতাংশ সমিতির কল্যাণ তহবিলের জন্য। মূলধন তহবিলের ৫০ শতাংশ গ্রামে স্থায়ী উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন, ২৫ শতাংশ সদস্যদের মধ্যে লভ্যাংশ হিসেবে এবং বাকি ২৫ শতাংশ ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে বিতরণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু তাঁর দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সুযোগ পাননি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট অতর্কিত হামলায় ঘাতকের বুলেটে প্রাণ দিতে হয় তাঁকে। তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া আদর্শের ভিত্তিতে কৃষিকে অগ্রাধিকার প্রদান করে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেন। কৃষকের কাছে ফসলের উন্নত জাতের বীজ সহজলভ্য করা হয়। বঙ্গবন্ধুর মতোই শেখ হাসিনা সারের দাম হ্রাস ও পুনর্বিন্যাস করে জমিতে সুষম সার প্রয়োগের ব্যবস্থা করেন। কৃষকের সার প্রাপ্তিকে নিশ্চিত করা হয়। কৃষি উপকরণ সহজলভ্য করা হয়। সার, সেচ, ট্রাক্টর বা অন্যান্য কৃষি যন্ত্রপাতি কৃষকের কাছে যথাসম্ভব সহজলভ্য করার জন্য ভর্তুকি প্রদান করা হয়। ততদিনে কৃষি গবেষণার সাফল্যের কারণে কৃষিক্ষেত্রে উচ্চফলনশীল জাতের পাশাপাশি অনেক প্রকার কৃষি ব্যবস্থাপনা বিষয়ক প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হয়ে গেছে। এসব প্রযুক্তির কোনো কোনোটা কৃষকের মাঠে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম হয়। দেশে ভুট্টার হাইব্রিড জাতসহ ধান ও সবজিরও হাইব্রিড জাত প্রবর্তন করা হয়। দেশেও ধান, ভুট্টাসহ সবজির হাইব্রিড জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। অন্যান্য ফসলের মধ্যে আমাদের দেশে আলুর অনেক জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন করা সম্ভব হয় তেলজাত ফসল, ডাল, মসলা ফসলেরও। ফসলের উন্নত জাতের বীজপ্রাপ্তি ও উন্নত চাষাবাদ পদ্ধতি অনুসরণ করার কারণে দেশের কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন উন্নত কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও প্রয়োগ করে দেশের খাদ্য উৎপাদন দ্বিগুণ করতে। বঙ্গবন্ধুকন্যার শাসনামলে দেশে আজ দানাশস্য উৎপাদন হচ্ছে চার গুণ। কৃষিশিক্ষা ও গবেষণার যে ভিত্তি বঙ্গবন্ধু গড়ে গিয়েছিলেন, তাঁর সে ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে আজ কৃষিক্ষেত্রে এ সাফল্য অর্জিত হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু পশু পালনের দিকে জোর দেওয়ার কথাও বলেছিলেন। শেখ হাসিনার সরকারও পশুসম্পদ উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে। দেশে গরু-ছাগল, মহিষ, হাঁস-মুরগির খামার স্থাপনে সরকার ইতিবাচক সহায়তা দান করে। এদের রোগশোকের হাত থেকে রক্ষায় টিকা ও ভ্যাকসিন সহজলভ্য করা হয়। খামার স্থাপনে সহজ শর্তে ঋণ দিয়ে খামারিদের উৎসাহ প্রদান করা হয়। সে কারণে দেশে মাংস, দুধ ও ডিমের উৎপাদন বেড়েছে। শুধু খাদ্য নয়; পুষ্টির বিষয়টিও এখন সমান গুরুত্ব পাচ্ছে। মৎস্য খাতকেও সরকার যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছে। মৎস্য গবেষণার ফলে দেশে নানা রকম মৎস্য জাত উদ্ভাবিত হয়েছে। মৎস্য পোনা উৎপাদন ও চাষ ব্যবস্থাপনায় যথেষ্ট সাফল্য অর্জিত হয়েছে। বেড়েছে মৎস্য চাষের এলাকা। পাশাপাশি জলাশয় ব্যবস্থাপনার দক্ষতা বৃদ্ধি পাওয়ায় মুক্ত জলাশয়ের স্বাদু মাছের পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষির পাশাপাশি দেশের অন্যান্য খাতেও উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। এগিয়ে চলছে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড। সে উন্নয়নের ধারাকে অবলম্বন করে দেশ আজ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হচ্ছে।
লেখকঃ অধ্যাপক, কৌলিতত্ত্ব ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগ শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়