1309
Published on মার্চ 2, 2020একাত্তরের অদম্য মুক্তিযোদ্ধা অভিনয়শিল্পী মজিবুর রহমান দিলু। ১৯৭০ সালে মেট্রিক পরীক্ষায় মানবিক বিভাগে প্রথম বিভাগে পাস করে একাত্তরে ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন একাদশ শ্রেণিতে। স্কুলে পড়ার সময়ই স্বাধিকার আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে যে মিছিলে গুলিতে আসাদ শহীদ হয়েছিলেন সেই মিছিলে ছিলেন দিলুও। স্মৃতিচারণা করে তিনি বলেন, ‘মিছিলে গুলির শব্দে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলাম। আজিমপুরে যখন ফিরে এলাম তখন শুনলাম আসাদ মারা গেছেন। রাজনৈতিক অনুপ্রেরণা হয়ে থাকলেন শহীদ আসাদ।’
দিলুর মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া একটি আকস্মিক ঘটনার মধ্য দিয়ে। নিজের মুখেই শোনালেন, “যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। এপ্রিল মাসের ঘটনা। একদিন মহল্লার বন্ধুদের দুই গ্রুপের মধ্যে কী একটা ঘটনায় মারামারি বাধে। আমি তখন মিটমাট করে দিয়েছিলাম। কিন্তু বাবার কাছে নালিশ গেল, আমি নাকি ছুরি নিয়ে কাউকে মারতে গিয়েছি। বাবা ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা, অসম্ভব ঠাণ্ডা মেজাজের। তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার শোনার জন্য রেডিও কানের কাছে লাগিয়ে রাখতেন। নালিশ পেয়ে তিনি খ্যেপে গেলেন। বাসায় ফেরার পর বললেন, ‘এত ছেলে যুদ্ধে যায়, তুমি যুদ্ধে না গিয়ে বসে বসে গুণ্ডামি কর। তুমি যুদ্ধে যেতে পার না?’ কথাটা মনে খুব আঘাত করল। মনে মনে শপথ নিলাম কালই যুদ্ধে যাব। কোথায় যাব, কিভাবে যাব—কিছুই জানি না। বন্ধুদের বললাম। আরো ছয়জন রাজি হয়ে গেল। যাওয়ার জন্য অর্থ সংগ্রহ করলাম বড় বোনের ব্যাগ থেকে না বলেই। তাঁর সন্তান হয়েছে, তিনি আমাদের বাসায় থাকেন। পরদিন সকাল থেকেই যাওয়ার প্রস্তুতি নিলাম, সব রুমে গিয়ে সবাইকে একবার দেখে নিলাম। মনে হলো যদি আর ফিরে না আসি, শেষ দেখাটা দেখে নিই। আমাদের বাড়ির একটা নিয়ম ছিল—ভাইয়েরা একেক দিন একেকজন বাজার করতাম, সাত ভাইয়ের মধ্যে ছোট দুইজন বাদে। ওই দিন আমারই বাজার করা কথা। মনে হলো, যদি বাজার করে দিয়ে না যাই তাহলে হয়তো বাজারই করা হবে না। মা দশ টাকা দিলেন। বাজারের ব্যাগে নিজের দুটি কাপড় নিয়ে বেরিয়ে গেলাম। বাজারটা বাসায় পৌঁছে দিয়েই চলে গেলাম। জিনজিরা-আটি পার হয়ে ফরিদপুর-কুষ্টিয়া হয়ে ভারতের কৃষ্ণনগর পৌঁছেছি। যাওয়ার পথে টানা সাত দিন আমরা হেঁটেছি। রাত হলে কোনো আওয়ামী লীগ নেতার বাড়ি খুঁজে রাত কাটিয়েছি। কোথাও খাবার দিতে পেরেছে, কোথাও পারেনি। ডাকাতের কবলেও পড়েছি। এক রাতে গিয়ে কলকাতা পৌঁছলাম। সবই অচেনা। কোথায় কিভাবে যাব। রাত কাটালাম ওই স্টেশনেই। খাবারের মতো কোনো টাকাও ছিল না আমাদের, সারাটা রাত অভুক্ত ছিলাম।”
মজিবুর রহমান দিলু বলেন, ‘প্রথমে দেখা করলাম গাজী গোলাম মোস্তফার সঙ্গে। তাঁকে জানালাম, যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য আমরা আগরতলা যেতে চাই। তিনি পরিচয়পত্র তৈরি করে যাত্রা খরচ হিসেবে কিছু টাকা দিলেন। গুয়াহাটিতে যাওয়ার পর আমাদের টাকা শেষ হয়ে গেল। সেখানে এক ডিসি অফিসে গিয়ে সহায়তা চাইলে তিনি আমাদের পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন এক পাহাড়ের চূড়ার আর্মি ক্যাম্পে। সেখানে গিয়ে দেখলাম আরো অনেক বাঙালি যুবক। তারাও যুদ্ধের জন্য এসেছে। কিন্তু তারা জানাল এখানে তাদের আটকে রাখা হয়েছে। যুদ্ধে যেতে দিচ্ছে না। পরে জেনেছিলাম, ওই আসাম সরকার আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেনি। তাই ষড়যন্ত্র করছে। আমরা খুঁজে বের করলাম একটা চোরাপথ। কিন্তু নামতে হবে খাড়া পাহাড় বেয়ে। উপায় না পেয়ে অনেক কষ্টে একদিন ভোরে রক্তাক্ত হয়ে নেমে এলাম। সাতজনের দলকে দুই ভাগে ভাগ করে ফেলেছিলাম। নিচে নেমে দেখলাম চারজনের দল নেই। আমরা কোনো রকমে এক ট্যাক্সিচালকের সহায়তায় কামরূপকামাক্ষা রেলস্টেশনে পৌঁছে কলকাতায় ফিরলাম। বাকি চারজন আর্মির হাতে ধরা পড়ে ব্যাপক নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। তাদের কয়েক দিন আটকে রেখে পরে সীমান্তে এনে ছেড়ে দিয়েছিল। এরা আর যুদ্ধে অংশ নিতে পারেনি।’
দিলু বলেন, ‘কলকাতায় ফিরে নূরে আলম সিদ্দিকীর সঙ্গে দেখা করে সব জানালাম। তিনি ট্রেনিংয়ের জন্য টকিপুর ক্যাম্পে পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন। সেখানে গিয়ে মেজর জলিলকে দেখলাম, তিনি অস্ত্র নিতে এসেছেন। সেখান থেকে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য বিহার চকুরিয়ায় পাঠানো হলো। প্রথম দিনই শেখানো হলো সাপে কাটলে কী করতে হবে। ভয়াবহ অবস্থা। শুরু হলো কঠোরতর প্রশিক্ষণ। প্রশিক্ষণ শেষে পাঠানো হলো মেলাঘরে। প্রথমেই পরিচয় হলো ক্যাপ্টেন হায়দারের সঙ্গে। সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ, ২ নম্বর সেক্টর। উনারা পাঠিয়ে দিলেন একজনের কাছে। গিয়ে দেখলাম বিশাল ঝাঁকড়া চুল, বসে কয়লা দিয়ে বঙ্গবন্ধুর ছবি আঁকছেন। তিনি শিল্পী শাহাবুদ্দিন, আমাদের প্লাটুন কমান্ডার। কম্পানি কমান্ডার ছিলেন মানিক ভাই। সেকেন্ড ইন কমান্ডার নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু ভাই। মানিক ভাই যুদ্ধে শহীদ হলে বাচ্চু ভাই কমান্ডার হয়েছিলেন। সেখানে ক্যাম্পে জায়গা দেওয়া হলো। খাবার নিতে গিয়ে দেখলাম তিনবার লাইন দিতে হয়। একলাইনে টিনের থালায় ভাত, আরেক লাইনে ডাল, আরেক লাইনে বাটিতে তরকারি। তরকারিটা ছিল শুঁটকির। দেখে তো অবস্থা খরাপ। জীবনে কখনো শুঁটকি খেতে পারিনি। বাড়িতে যেদিন শুঁটকি রান্না হতো সেদিন বাসায় ওই বেলা খেতেই পারতাম না। শুঁটকির গন্ধ যাওয়ার পর বাড়ি ফিরলে মা ডিম দিয়ে ভাত দিতেন। সে কথা মনে করে টপ টপ করে চোখের পানি পড়ল। কিন্তু কী করব, প্রচণ্ড ক্ষুধা। আঙুল দিয়ে নাড়া দিয়ে দেখি পোকা। কিন্তু ট্রেনিংয়ে যে শিক্ষা দেওয়া হয়েছিল তা কাজে লাগিয়ে পোকাটা ফেলে খাবার খেয়ে নিলাম। সেখানে অস্ত্রের অভাবে আমরা যুদ্ধে যেতে পারছিলাম না। শুয়ে শুয়ে ভাবতাম। ভাইবোনদের চেহারা দেখি মনে পড়ছে না। শুধু ছোট ভাইটার চেহারা ভেসে উঠছে, আর মায়ের মুখ।’
দেশে ঢুকে অভিযান শুরু করার বর্ণনা দিয়ে দিলু বলেন, ‘অস্ত্র সংগ্রহ হওয়ার পর একপর্যায়ে সাভার পাঠানো হলো আমাদের কম্পানিকে। সাভার আসার পর কমান্ডার মানিক ভাই ছুটি দিয়ে বললেন ঢাকার যারা তারা বাসা থেকে ঘুরে আসতে। বাসায় এসে না বলে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য ক্ষমা চাইলাম এবং জানিয়ে দিলাম থাকতে আসিনি, চলে যাব আবার। একদিন অবস্থা দেখার জন্য ঢাকা কলেজে গেলাম। আব্বা আমার কলেজের বেতন নিয়মিত দিয়ে যাচ্ছিলেন। কখনো বাসায় যদি রেইড হয়, যদি আমাকে খোঁজে, তখন তিনি যাতে বলতে পারেন, তাঁর ছেলে নিয়মিত কলেজে পড়ছে। কলেজে গিয়ে দেখি লোকে লোকারণ্য। কিসের যুদ্ধ চলছে? কেউ বলবে না এখানে কোনো যুদ্ধ হচ্ছে। বিভিন্ন কলেজের পাকিস্তানি নন-বাঙালি ছাত্ররাও এখানে এসে ভর্তি হয়েছে, যারা স্বাভাবিকভাবে এই কলেজে ভর্তির সুযোগ পেত না। কারণ এখানে মেধাবী ছাত্ররাই কেবল ভর্তির সুযোগ পেত। বিষয়টি খুব মনে লাগল। সিদ্ধান্ত নিলাম, প্রথম অপারেশনটি এখানেই করব। কলেজটি বন্ধ করে দেব। প্লাটুন কমান্ডার শাহাবুদ্দিন তখন নদীর ওপারে আটিতে অবস্থান করছেন। গিয়ে জানালাম। তিনি দুটি স্টেনগান ও দুটি গ্রেনেড দিলেন। বাজারের ব্যাগের মধ্যে স্টেনগান ও মুড়ির ঠোঙ্গায় গ্রেনেড নিয়ে অপারেশনের লক্ষ্যে দুইজন এলাম। একজনের বাসায় আশ্রয় নিলাম। আমাদের লক্ষ্য স্বাভাবিক অবস্থা স্থিমিত করে দেওয়া। আমি ঢাকা কলেজে আর অন্যজন ইডেন কলেজে অপারেশন চালাবে।’
ঢাকা কলেজে অভিযানের স্মৃতিচারণা করে দিলু বলেন, ‘ঢাকা কলেজে ঢুকলাম। বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হলো। পরিচিতদের বললাম, কেউ কোনো প্রশ্ন করো না, যার যার মতো চলে যাও। এক বন্ধু ছিল ডাকনাম ক্যাঙ্গারো, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হয়েছিল। ওকে বললাম, ওই মাড়োয়ারি ছাত্ররা কোন গ্যালারিতে ক্লাস করে তা দেখে দিতে। ও এসে জানাল গ্যালারি নম্বর ৬। নিয়ম অনুসারে অপারেশন শেষে কোন দিক দিয়ে পালাব তা দেখে নিলাম। নিয়ম হলো একদিকে ঢুকবে, অন্যদিক দিয়ে পালাবে। টয়লেটে ঢুকে দেখলাম পেছনে দরজা আছে, পালানো যাবে, সেটি খুলে দিলাম। সেখানে দাঁড়িয়েই গ্রেনেডটি ছোড়ার জন্য প্রস্তুত করলাম। তারপর ৬ নম্বর গ্যালারিতে গিয়ে দেখলাম, শিক্ষক এখনো আসেননি। ছাত্ররা আড্ডা দিচ্ছে। গ্রেনেড ছুড়ব, একটু মায়া হলো, যদি মাঝখানে মারি তাহলে কয়েকজন মারা যাবে। তাই এমন জায়গায় মারব যাতে কেউ না মরে। চাবিটা পকেটে ঢুকিয়ে গ্রেনেড ছুড়ে মারলাম। একটা আলো জ্বালিয়ে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হলো। বোম বোম বলে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেল। আমিও বোম বোম বলে সবার সঙ্গে বেরিয়ে এলাম। পরদিন সংবাদ মাধ্যমে খবর বের হলো সন্ত্রাসীরা বোমা ছুড়েছে ঢাকা কলেজে। কলেজও বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল।’
মজিবুর রহমান দিলু আরো কয়েকটি সফল অপারেশন পরিচালনা করেছেন ঢাকায়। একটি উল্লেখযোগ্য অপারেশন ছিল একজন বিশ্বাসঘাতককে খতম করে দেওয়া। কেন্দ্রীয়ভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে তাদের তালিকা তৈরি করে খতম করে দিতে হবে। দিলু বলেন, ‘সেই তালিকা অনুসারে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ঢাকার প্রথম যে আইনজীবী বিবৃতি দিয়েছিলেন, তাঁকে খতম করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হলো। তাঁর বাসা ছিল সেন্ট্রাল রোডে আমাদের বাসার কাছেই। একদিন অপারেশন চালিয়ে সে নির্দেশ কার্যকর করা হয়েছিল। এই ঘটনাটি এখনো আমাকে তাড়িত করে। কিন্তু করার কিছু ছিল না। ঘটনাটি জেনে গিয়েছিলেন মা-বাবা। ঘটনার পনেরো দিন পর বাসায় গেলে মা মাথায় হাত রেখে শপথ করতে বললেন, কোনো লোককে যেন ঠাণ্ডা মাথায় না মারি। আমি এরপর তা রক্ষার চেষ্টা করেছি।’
প্রকাশঃ দৈনিক কালের কণ্ঠ,