6314
Published on আগস্ট 29, 2019আব্দুল জব্বার খাঁনঃ
আব্দুল হাই ছিল গোপালগঞ্জ টুঙ্গিপাড়ার শেখ সাহেরা খাতুন রেডক্রস হাসপাতালের ওয়ার্ড বয়। প্রায় ৩৪ বছর পর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার সাক্ষী দিতে গিয়ে এতদিন বুকে চেপে থাকা লাশ দাফনের স্মৃতিকথা তুলে ধরেছিল আদালতে। তার বর্ণনা মতে জাতির পিতার দাফন সম্পাদন করতে ১৯৭৫-এর ১৬ আগস্টে দুই থেকে তিন হাজার মানুষ সমবেত হতে চেষ্টা করেছিল টুঙ্গিপাড়ার সেই বিষাদময় থমথমে পরিবেশে। কিন্তু সেনাবাহিনীর সদস্যদের বাধার মুখে তারা সেখানে থাকতে পারেনি। বলা হয়েছিল, গোসল না করিয়েই রক্তস্নাত বঙ্গবন্ধুকে দাফন করা হবে। স্থানীয় সাব-ডিভিশনাল পুলিশ অফিসার, সার্কেল ইন্সপেক্টর এবং অফিসার ইনচার্জ সেটি মানতে রাজি হননি। তারা বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু একজন মুসলিম। তাঁকে গোসল না করিয়ে দাফন করা যাবে না।’ পরে আব্দুল মান্নাফ শেখ, কনস্টেবল সিরাজুল ইসলাম, ইমামউদ্দীন গাজি, নুরুল হক শেখ এবং কেরামত হাজী কাছের দোকান থেকে আনা ৫৭০ সাবান দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে গোসল করান। আব্দুল হাই এবং মৌলভী আব্দুল হালিম তাঁকে রেড ক্রিসেন্টের তিনটি মার্কিন কাপড়ের শাড়ি দিয়ে কাফন পরান। মাওলানা আব্দুল হালিম বঙ্গবন্ধুর ভিটাবাড়িতে অল্প কিছু মানুষের উপস্থিতিতে জানাজা পড়ান। সেনাসদস্যদের নির্দেশে পুরো প্রক্রিয়া শেষ করতে হয়েছিল মাত্র দশ মিনিটে! কথাগুলো বলতে গিয়ে আব্দুল হাইয়ের চোখদুটো ছলছল করে উঠেছিল।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ সন্তান আজকের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আবারও বাংলার মাটিতে রচিত হলো বেঈমানীর ইতিহাস। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে বেঈমানী করেছিল তাঁরই সেনাপতি মীর জাফর ক্ষমতার লোভে, নবাব হওয়ার আশায়। ১৯৭৫ সালে সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল বাংলাদেশে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করল তাঁরই মন্ত্রিপরিষদ সদস্য খন্দকার মোশতাক, রাষ্ট্রপতি হওয়ার খায়েশে।’ ইতিহাস তার নিয়মেই চলে। মীর জাফর যেমন তিন মাসের বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারেনি, মোশতাকও তেমনি মাত্র ৮৭ দিন ক্ষমতায় ছিল। ইতিহাসে দুজনেরই স্থান হয়েছে ঘৃণ্যদের তালিকায়, অপরপক্ষে নবাব সিরাজউদ্দৌলা এবং বঙ্গবন্ধু গভীর শ্রদ্ধার স্থানেই থেকে গেছেন মানুষের মনে।
মুজিব হত্যার ১২ ঘণ্টার মধ্যেই পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশের নতুন সরকারকে বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে ৫০ হাজার টন চাল, ১০ মিলিয়ন গজ সুতা এবং ৫ মিলিয়ন গজ নরম মসলিন উপহার দেয়ার কথা ঘোষণা দেয়। পাকিস্তান সরকার ইসলামী সম্মেলন সংস্থা এবং তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’ হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার আহ্বান জানায়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খুনীচক্রের সদস্য মেজর ডালিম হত্যাকারীদের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ বেতার থেকে ঘোষণা করে ‘শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। বাংলাদেশ এখন থেকে একটি ইসলামিক রিপাবলিক।’ স্পষ্টতই মেজর ডালিমের এই ঘোষণা পাক-মার্কিন-চীন অক্ষশক্তিসহ সৌদিআরব এবং লিবিয়াকে বিশেষভাবে খুশি করেছিল। কারণ, ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী বঙ্গবন্ধুর সরকার ১৯৭২ এ বাংলাদেশবিরোধী ভূমিকা গ্রহণকারী দক্ষিণপন্থী ও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করেন। তবে মনে রাখা দরকার, ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ ধর্মহীনতা নয়; বঙ্গবন্ধু নিজে তা মনে করেননি কখনও। তিনি ছিলেন একজন সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সন্তান, মাছে-ভাতে একজন আপাদমস্তক বাঙালী। তাঁর পরিবারে যে ইসলাম ধর্মের নিয়মিত চর্চা ছিল সেটি আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৈনন্দিন ধর্মচর্চা থেকেই প্রতীয়মান হয়। বঙ্গবন্ধুকে সরাসরি ধর্মহীন বা ইসলাম ধর্মবিরোধী হিসেবে অপপ্রচার না চালালেও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের গায়ে ‘ভারতের দালাল’ এবং ‘ধর্মহীন’ তকমা লাগানোর সফল অপপ্রচার চালাতে সক্ষম হয়ছিল ’৭১-এর পরাজিত শক্তি এবং ’৭৫-এর খুনীরা।
একান্ত স্বাভাবিকভাবেই মুজিব হত্যাকাণ্ডে সবচেয়ে বেশি উৎসাহ প্রকাশ করে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা স্বাধীনতা-বিরোধীরা। তাদের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত লন্ডনে মুজিব হত্যাকাণ্ডের পরের দিনই তারা বাংলাদেশের হাই কমিশনার সৈয়দ আব্দুস সুলতানসহ স্বাধীনতাপন্থীদের দূতাবাস থেকে বের করে দেয়। বিক্ষোভকারীরা বঙ্গবন্ধুর ছবি টেনে নামায় এবং তা ভেঙ্গে রাস্তায় ফেলে দেয়। যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযম জেদ্দা থেকে নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দানের জন্য মোশতাক ও ভুট্টোকে ধন্যবাদ জানিয়ে পত্র পাঠান। পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে বাঙালী নেতা আহম্মদ আলী, খাজা খয়ের উদ্দিন, হামিদুল হক চৌধুরী, যুদ্ধাপরাধী কামারুজ্জামান পাকিস্তান সরকারের বাংলাদেশের নীতিকে সমর্থন করেন এবং মোশতাক সরকারের সাফল্য কামনা করেন। মূলত তাদের আগ্রহেই কনফেডারেশনের ইস্যুটি আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ৯ সেপ্টেম্বর রাওয়ালপিণ্ডি ও ইসলামাবাদে ‘ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তান’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ‘পাকিস্তান-বাংলাদেশ সংহতি পরিষদ’ নামে একটি সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে।
পরাজিত শক্তিদের ক্ষোভ ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মিত্রশক্তি ভারত ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী মুক্তিযুদ্ধের সময় বিশ্ব নেতাদের মধ্যে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত তৈরি করতে ব্যাপক দুতিয়ালি করেন। সীমান্তে প্রায় এক কোটি শরণার্থীদের আশ্রয়ও দিয়েছিল ভারত। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে ডিসেম্বরের শুরুতে ভারত-সোভিয়েত ইউনিয়ন যৌথবাহিনী বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যোগ দিয়েছিল সরাসরি সশস্ত্র যুদ্ধে। তাই এই শক্তি এবং দেশের ভেতরকার আওয়ামী লীগ বিরোধীরা কখনও ভারতের দালাল, কখনও অধার্মিক কমিউনিস্টের অপবাদ দিয়ে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মনে বিষোদগার সৃষ্টি করতে থাকে। তাদের এই ধারাবাহিক অপপ্রচারে দেশের মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি জন্ম নেয় এবং সেখান থেকে ক্রমান্বয়ে তৈরি হয় বিভক্তির শত ধারা। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে মস্কোপন্থী এবং পিকিংপন্থী সমাজতান্ত্রিক ধারাতেও দেখা দেয় বিভেদ। ধর্মভিত্তিক দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে যে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল সেখান থেকে বেরিয়ে এসে অসাম্প্রদায়িক চেতনানির্ভর বাঙালী সংস্কৃতির যে ‘সোনার বাংলা’ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু, সেটিকে চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলে দিতে সক্ষম হলো বিপরীত ধারার অপশক্তিরা।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পরও মুজিব আদর্শকে বাংলার মাটি থেকে মুছে ফেলতে পারবে কিনা এ নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিল ঘাতকদের মনে। তাই খন্দকার মোশতাকের সরকারে থাকতে না চাওয়ার অপরাধে গ্রেফতার করা হয় জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এএইচএম কামরুজ্জামান এবং ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীকে। পরে ১৯৭৫ সালের ৩ নবেম্বর ৬০ রাউন্ড গুলি ও বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জেলের ভেতরেই হত্যা করা হয় তাদের।
বিগত প্রায় ৪০ বছরে ধরে চলে আসা ‘কে স্বাধীনতার ঘোষক?’ বিতর্কের সন্দেহাতীত এবং আইনসিদ্ধ সমাধান পাওয়া যায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে। বিজয় অর্জনের এক বছরের মধ্যে গৃহীত (৪ নবেম্বর ১৯৭২) আমাদের এই মহান সংবিধানের ১৫০(২) অনুচ্ছেদের ৬ষ্ঠ তফসিলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক প্রদত্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাটি সন্নিবেশিত আছে-
‘This may be my last message, from today Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you might be and with whatever you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved.
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে ইপিআরের ট্রান্সমিটার, টেলিগ্রাম ও টেলিপ্রিন্টারের মাধ্যমে বাংলাদেশের সর্বত্র এই ঘোষণা প্রচারিত হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই স্বাধীনতা ঘোষণা বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক রিট পিটিশন নং-২৫৭৭/২০০৯ [ড. এম এ সালাম বনাম বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং অন্যান্য]-এ প্রদত্ত রায়ে স্বীকৃত (affirmed) ও সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সংবিধানে সন্নিবেশিত হওয়ার পর তাই এ নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোন অবকাশ নেই। এটি এখন একটি মীমাংসিত বিষয়। আরও মনে রাখা প্রয়োজন, জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে প্রকাশিত সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোন আইন যদি সংবিধানের সঙ্গে অসামঞ্জস্য হয়, সেক্ষেত্রে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হবে। অর্থাৎ, স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ব্যতিরেকে অন্য কোন দাবি করা সংবিধান লঙ্ঘনের অপরাধ হিসাবে বিবেচিত হতে পারে।
প্রোপাগান্ডা মেশিনের সেই ধারাবাহিকতায় ইদানীংকালে কিছু উল্টোস্রোতের মানুষ চরম অশ্রদ্ধা মিশিয়ে এও বলতে শুরু করেছে ‘শেখ মুজিব বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি ছিলেন না’। বলাবাহুল্য, যারা এদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ঘৃণা করে তারাই কেবল ‘জাতির পিতা’ এবং ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দগুলো স্বীকার করে না এবং ব্যবহার করে না। ‘জাতির পিতা’ এবং ‘বঙ্গবন্ধু’ ব্যবহার না করার পেছনেও রয়েছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে অবজ্ঞা ও অশ্রদ্ধা করার ঘৃণ্য অপপ্রয়াস।
বাংলাদেশের প্রথম সরকার (মুজিবনগর সরকার) গঠিত হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল তারিখে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায়। এই সরকার গঠিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীনই। আমাদের সংবিধানের ১৫০(২) অনুচ্ছেদের ৭ম তফসিলে এই সরকারের জারিকৃত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি সন্নিবেশিত আছে। সেখানে শেষ পৃষ্ঠায় বলা আছে ‘এতদ্বারা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতেছি যে, সংবিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি থাকিবেন এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রজাতন্ত্রের উপ-রাষ্ট্রপতি থাকিবেন এবং রাষ্ট্রপতি প্রজাতন্ত্রের সকল সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হইবেন’... ‘আমরা আরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতেছি যে, স্বাধীনতার এই ঘোষণাপত্র ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ তারিখে কার্যকর হইয়াছে বলিয়া গণ্য হইবে।’ অর্থাৎ, বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার তারিখ থেকেই বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র এবং সেদিন থেকে বঙ্গবন্ধুই ছিলেন এই স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের এত বছর পরেও এটি নিয়েও অপপ্রচার অত্যন্ত দুরভিসন্ধিমূলক। কিন্তু একটি কথা সব সময় মনে রাখতে হবে history cannot be deleted.
কেন বঙ্গবন্ধুকেই প্রথম রাষ্ট্রপতি করা হলো এই ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে? এর উত্তর রয়েছে আরেকটু পেছনে। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানে যে সাধারণ নির্বাচন হয়েছিল সেই নির্বাচনে পাকিস্তানের জনগণ সরকার গঠনের ‘ম্যান্ডেট’ দিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগকে। পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী আমাদের মতো ‘আউটক্লাসড’দের কাছে রাষ্ট্রক্ষমতা দিতে চায়নি। যুদ্ধ যখন অনিবার্য হয়ে যায় এবং জনগণের ম্যান্ডেট যেহেতু আগে থেকেই ছিল, সেহেতু মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এই মুজিবনগর সরকার গঠন সহজ হয়ে যায় এবং সেই সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার আর কোন অবকাশ থাকে না। তারপরও একটি মামলা হয়। অষ্টম সংশোধনী মামলায় [আনোয়ার হোসেন চৌধুরী বনাম বাংলাদেশ ৪১ ডিএলআর, ১৯৮৯ (এডি) ১৬৫] মুজিবনগর সরকার কর্তৃক গৃহীত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট সংবিধানের মূল সূচনা (Genesis of the Constitution) হিসেবে আখ্যা দেয়।
জাতির পিতাকে সপরিবারে অতর্কিতে হত্যার ঘটনায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত থাকলেও সকল অপপ্রচারের বিরুদ্ধেই সমুচিত জবাব দেয়ার মতো মানুষ এই দেশে ছিল। কিন্তু তাদের পথ রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল খন্দকার মোশতাক কর্তৃক ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫-এ জারিকৃত ইনডেমনিটি এক্টের মাধ্যমে। অর্ডিন্যান্স নম্বর ৫০-এর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু খুনীদের বিচার করা যাবে না মর্মে রাষ্ট্রীয় বিধিনিষেধ জারি হলো। পৃথিবীর ইতিহাসে এর চেয়ে কলঙ্কজনক অধ্যায় বোধহয় আর একটিও খুঁজে পাওয়া যাবে না। পরবর্তী সময়ে ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের পার্লামেন্টে এই কালাকানুন আমাদের পবিত্র সংবিধানে ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে অন্তর্ভুক্ত হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার দীর্ঘ ২১ বছর পর তাঁর জ্যেষ্ঠ সন্তান শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আবার সরকার গঠন করতে সক্ষম হয় এবং ১৯৯৬ সালের ১৪ নবেম্বর তারিখে সংবিধান থেকে এই কালো আইন The Indemnity (Repeal) অপঃ, ১৯৯৬ নামে অকার্যকর, বাতিল ও অস্তিত্বহীন মর্মে ঘোষণা করে। এরপরই বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার কার্য শুরু হয়। ২৮ জানুয়ারি ২০১০ এ অর্থাৎ সেই নৃশংস নারকীয় হত্যাকাণ্ডের ৩৪ বছর পর মোট ১২ জন খুনীকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। এর মধ্যে ৬ জন পলাতক রয়েছে, ১ জন স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেছে এবং ৫ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে।
১৯৭৫ থেকে ৯৬ পর্যন্ত বেড়ে ওঠা প্রজন্ম তাই ইতিহাসের ‘ব্ল্যাকআউট প্রজন্ম’ হিসেবেই বেড়ে ওঠে। তাদের আজ আমাদের জানাতে হবে যে বঙ্গবন্ধুর মতো একজন অবিসংবাদিত নেতার হত্যাকাণ্ড কেবল সেনাবাহিনীর কিছু সদস্যের মাধ্যমে সংঘটিত করা কখনই সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন ছিল আন্তর্জাতিক আগ্রাসী শক্তি, দলের ভেতরের মীর জাফর এবং কিছু জল্লাদ খুনী। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ঘটানোর জন্য এই সবগুলো উপাদানের যোগান হয়েছিল অত্যন্ত দক্ষভাবে এবং পরিকল্পিতভাবে।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আলোচনা শেষ করা যায় না। কারণ, বঙ্গবন্ধু একটি পঙক্তি বা একটি অধ্যায় নন, তিনি একটি সমগ্র ইতিহাস। বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফর রহমান তাঁকে বলেছিলেন ‘বাবা রাজনীতি কর আপত্তি করব না, সংগ্রাম করছ এত সুখের কথা, তবে লেখাপড়া করতে ভুলিও না। লেখাপড়া না শিখলে মানুষ হতে পারবা না। আর একটা কথা মনে রেখো sincerity of purpose and honesty of purpose থাকলে জীবনে পরাজিত হবা না।’ পিতার আদর্শকে জীবনের শেষপর্যন্ত ধারণ করেছিলেন বলেই বঙ্গবন্ধু আজও পরাজিত হননি, রয়ে গেছেন মানুষের মনের মণিকোঠায়Ñ বিনম্র শ্রদ্ধায় আর অতল ভালবাসায়।
লেখক : সদস্য, বাংলাদেশ সরকারী কর্মকমিশন ও অধ্যাপক, বুয়েট