3800
Published on জুন 10, 2019আসিফ কবীরঃ
সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের অব্যবহিত পর ইউরোপ সফররত তদানীন্তন পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. কামাল হোসেনের প্রত্যাশিত ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন সময়ের বক্তৃতায় প্রসঙ্গক্রমে স্মৃতিচারণায় বলেছেন ড. কামাল এ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে জার্মানীতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের বাসভবনে অনুষ্ঠিত প্রেসকনফারেন্সে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিশাবে হত্যাকাণ্ডের তীব্র প্রতিবাদ ও বিশ্ববাসীকে অবহিত করার মাধ্যমে জনমত গঠনের যথাযথ দায়িত্ব সেদিন পালন করেননি। অপরদিকে ড. কামাল ও তাঁর সুহৃদরা এ বিষয়টি নাকচ করে আসছেন। তবে ১৬ ও ১৭ আগস্ট ১৯৭৫-এর জার্মান সংবাদপত্র দি ফ্রাঙ্কফোর্টার আলগেমাইন জাইতুংগ-এর বিবরণী আমাদের বুঝতে সহায়তা করে যে, শেখ হাসিনার বক্তব্যই সর্বাংশে সঠিক। এ নিয়ে তৎকালীন জার্মানীতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীর জেষ্ঠ্যপুত্র নোমান রশীদ চৌধুরীর (একটি সংবাদপত্রে ২২.০৬.২০১৪-এ প্রেরিত কিন্তু অদ্যাবধি অপ্রকাশিত) প্রতিবাদলিপি এবং একই সময়ে আমাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে জানতে পারি:
“বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট, শুক্রবার, ঢাকা সময় ভোর ৪.৪৫ মিনিটে (জার্মান ও ইউগেস্লোভ সময় রাত ১২.৪৫ মিনিটে) হত্যা করা হয়। এই খবরটি বেশ কিছু সময় বিক্ষিপ্ত ছিল। হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী অভ্যূত্থানের খবর প্রথম পান জার্মান সময় রাত ৩.৩০ মিনিটে গিজেলা বন নামের ৬৫ বছর বয়সী একজন যুগন্বয়ী জার্মান সাংবাদিকের কাছ থেকে। পরবর্তী কয়েক ঘন্টার ইউরোপের বিভিন্ন দেশের বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে আসা টেলিফোন কল ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে। শেষ কলটি আসে ভোর ৬.০০ টায় বেলজিয়ামে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মরহুম সানাউল হকের কাছ থেকে। যার বাসায় তখন শেখ হাসিনা, তাঁর পরিবার ও শেখ রেহানা অতিথি হিসেবে ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর খবর শোনামাত্র তিনি তার অতিথিদেরকে চলে যেতে বলেন এবং তাঁদেরকে নিয়ে যাওয়ার জন্য হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীকে ফোনে অনুরোধ করেন। ক্ষণিক বিবেচনার পর হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী সম্মত হন এবং ব্রাসেলস থেকে থেকে তাঁদের আনার জন্য পরিবহণ প্রদান করতে সানাউল হককে অনুরোধ করেন। বন দূতাবাসের পরিবহণ পাঠানো সম্ভব হচ্ছিল না কারণ হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী তখন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন বেলগ্রেড থেকে তুরস্ক যাওয়ার পথে ট্রানজিটে ফ্রাঙ্কফুর্ট পৌঁছালে সেখান থেকে তাঁকে আনতে যান। কিন্তু সানাউল হক পরিবহণ প্রদানেও অসম্মতি প্রকাশ করেন। অবশেষে ঠিক করা হয় যে, শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবার ব্রাসেলস থেকে জার্মানি-বেলজিয়াম বর্ডারের আচেন আসবেন এবং হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারকে কোনিগ্সউইন্টারে (বনের খুব কাছে একটি গ্রাম) তাঁর নিজের বাড়ীতে নিয়ে আসার জন্য আচেনে দু’টো গাড়ি পাঠাবেন।
শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবার স্থানীয় সময় সকাল ১০.৩০ মিনিটে ব্রাসেলস ত্যাগ করে আচেনের পথে রাওয়ানা হন। তাঁদেরকে বেলা ১.০০ টার দিকে আচেন থেকে তুলে নেওয়া হয় এবং তাঁরা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট বিকেল ৪.৩০ মিনিটে কোনিগ্স্উইন্টার পৌছান। কাকতালীয়ভাবে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট বেলা ১২.০০ টার দিকে ড. কামাল হোসেন ও রাষ্ট্র্রদূত মরহুম রেজাউল করিম বনে আগমন করেন। ঢাকা ফিরে যাওয়ার আগে সিডিউল মোতাবেক বেলগ্রেড থেকে তুরস্কে একটি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার জন্য যাওয়ার পথে ট্রানজিটে বন আসেন। ড. কামাল বেলগ্রেড ত্যাগ করার আগেই অভ্যূত্থানের কথা শুনেছিলেন।
প্রকৃতপক্ষে ড. কামাল এবং শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবার উভয়েই আধা ঘন্টার ব্যবধানে কোনিগ্স্উইন্টার পৌছাঁন।
দুই কন্যাই তখন হত বিহবল ছিলেন এবং তাঁদেরকে সান্ত¡না দিতে হয়। গভীর শোকাচ্ছন্নতার মাঝেও বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার প্রতিবাদ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সোচ্চার করতে সংবাদ সম্মেলনের কথাটি ওঠে। হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী গিজেলা বনকে যোগাযোগ করেন। গিজেলা বলেন যে তিনি সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করবেন। ১৫ আগস্টের সন্ধ্যায় ডয়েসে ভ্যালে, জার্মান ব্রডকাস্টিং অথরিটি এবং ফ্রাঙ্কফোার্টার এলগেমানই জাইতুংগ-এর রিপোর্টার কোনিগ্স্উইন্টারের বাড়িতে আসেন, কিন্তু হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী ছাড়া কারও মন্তব্যই তারা নিতে পারেননি। প্রসঙ্গত: শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা অত্যন্ত শোকাভিভূত ছিলেন। পরিশেষে শেখ রেহানাকে নীচতলায় নেমে আসতে রাজি করানো হয় এবং তিনি গনমাধ্যমে যৎকিঞ্চিত কথা বলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট এই বক্তব্য পশ্চিম জার্মান রেডিওতে প্রচারিত হয় এবং পরদিন ১৬ আগষ্ট শানিবার এবং ১৮ আগষ্ট, সোমবার সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। উল্লেখ্য যে ১৬ আগষ্ট শনিবার ও ১৭ আগষ্ট রবিবার পশ্চিম জার্মানীতে সপ্তাহান্তে ছুটির দিন ছিল। নিশ্চিত করবার জন্য দি ফ্রাঙ্কফোর্টার বা ডয়েসে ভ্যালের ১৬ ও ১৮ আগষ্ট তারিখের প্রকাশনা আর্কাইভে খুঁজে দেখা যেতে পারে।
ড. কামাল ও রাষ্ট্রদূত রেজাউল করিম পরেরদিন সকালে (১৬ আগষ্ট) লন্ডন চলে যান। অন্যদিকে জার্মানীতে অবস্থানরত শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রশ্নটি ওঠে। স্পষ্টত: তাঁরা বাংলাদেশে ফিরে আসতে পারবেন না। অতএব কোথাও আশ্রয়ের (অ্যাসাইলাম) জরুরী প্রয়োজন ছিল। স্বাভাবিকভাবে পশ্চিম জার্মানী ও অস্ট্রিয়ার রাষ্ট্রদূত হিসেবে হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী পশ্চিম জার্মানী ও আস্ট্রিয়ার অ্যাসাইলামের জন্য চেষ্টা করেন। কিন্তু বেশীর ভাগ দেশেই অ্যাসাইলাম প্রক্রিয়া সময় সাপেক্ষ ব্যাপার।
বিকল্প চিন্তা হিসাবে ভারতে আশ্রয়ের বিষয়টি উত্থাপিত হয়। বনের একটি কূটনৈতিক অনুষ্ঠানের হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীর প্রস্তাবে পশ্চিম জার্মানীর ভারতীয় রাষ্ট্রদূত বর্ষীয়ান মি. পুরি বলেন যে তিনি খোঁজ নিয়ে দেখবেন।
পরের দিন তিনি হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীর সাথে তাঁর অফিসে সাক্ষাৎ করেন। মি. পুরি বলেন তাঁকে তাঁর নয়াদিল্লীর বৈদেশিক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে যেতে হবে এবং অ্যাসাইলাম প্রক্রিয়া দীর্ঘ হবে। এ অবস্থায় মি. চৌধুরী একটি উপায় বের করেন। স্বাধীনতার পূর্বে ও পরেও কয়েকমাস নয়াদিল্লীর বাংলাদেশ মিশনের প্রধান হিসেবে হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী নয়া দিল্লীতে অনেক সুনাম অর্জন করেন। প্রকৃতপক্ষে ১৯৭১ সালে এবং ১৯৭২’র প্রথম দিকে তিনি মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর সাথে বহুবার সাক্ষাৎ করেছেন, কিন্তু এরপর আর যোগাযোগ হয়নি।
১৮ আগষ্ট তিনি কোনিগ্স্উইন্টারের বাড়ি থেকে নয়াদিল্লীতে মিসেস গান্ধীর অফিসে ফোন করেন। তিনি অত্যন্ত বিস্মিত হন যখন মিসেস গান্ধী স্বয়ং টেলিফোন কলটি গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধুর কন্যাদের দুর্ভাগ্যপূর্ণ অবস্থার কথা তিনি তাঁকে জানান এবং তাৎক্ষনিকভাবে মিসেস গান্ধী ভারতে তাঁদের আশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারে সম্মত হন এবং যত দ্রুত সম্ভব প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন।
ফরাসী বর্ডারের অদূরে, জার্মানীর দক্ষিণে ছবির মত সুন্দর শহর কার্লস্রুর একটি অভিজাত গবেষণা ফ্যাকাল্টিতে তখন ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া ফেলোশিপ করছিলেন। অত:পর তাঁকে তাঁর সব কাজ গুটিয়ে ফেলতে হয়। তাঁদের কোনিগ্সউইন্টার ত্যাগ করার পরে নিরাপত্তার প্রসঙ্গ ওঠে। পুনরায় গিজেলা বনকে যোগাযোগ করা হলে পরদিন ২০ আগস্ট জার্মান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছ থেকে জার্মান ভূমিতে থাকাকালীন তাঁদের নিরাপত্তার আশ্বাসও মিলে যায়।
অবশেষে জার্মান পর্ব শেষে, শেখ হাসিনা, ড. ওয়াজেদ মিয়া, শেখ রেহানা, জয় (সজীব ওয়াজেদ) ও পুতুল (সায়মা হোসেন) ২১ আগষ্ট কোনিগ্স্উইন্টার ত্যাগ করেন এবং একদিনেরও কম সময়ে দিল্লী পৌঁছান।”
বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যদের বেলজিয়াম বর্ডার থেকে বহনকারী গাড়ীর চালক গভীর আবেগ ও যত্নে চার দশক আগের জার্মান সংবাদপত্রগুলি, যেখানে বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তী প্রেসমিটের সংবাদ ছাপা হয় সেগুলি সংরক্ষণ করেন। ২০১৪ সালের ২৪মে একটি মর্যাদাশীল বাংলাভাষার পত্রিকায় মিজানুর রহমান খান শেখ হাসিনার উত্থাপিত ড. কামাল হোসেনের বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে তাৎক্ষণিক যথাকরণীয় নিয়ে অনীহার পক্ষে সাফাইমূলক নিবন্ধ ছাপলে, সংবাদপত্রগুলি তাঁর (বর্তমানে জার্মান প্রবাসী) সংগ্রহ থেকে জেরক্স করিয়ে আনেন মি. নোমান। যেগুলি পাঠে তদানীন্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেনের প্রেসের সামনে অনভিপ্রেত নীরবতার নিদর্শন পাওয়া যায়।
লেখক: সাংবাদিক,গবেষক,রাজনৈতিক বিশ্লেষক।