2814
Published on এপ্রিল 1, 2019শাহাব উদ্দিন মাহমুদঃ
একাত্তর পূর্ববর্তী প্রজন্ম বাঙালীর মুক্তি-সংগ্রামের দিনগুলোর জীবন্ত সাক্ষী। যারা মুক্তি-সংগ্রামের চূড়ান্ত পরিণতি বিজয়ের দিনটিতে বাংলাদেশের জন্ম হতে দেখেছে, সেই সময়ের তীব্র আনন্দটুকু পৃথিবীর খুব কম মানুষ অনুভব করেছে। তারা খুবই সৌভাগ্যবান একটি প্রজন্ম- যারা সেই অবিশ্বাস্য আনন্দটুকু অনুভব করার সুযোগ পেয়েছিল! বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, সেই দিনটিতে যখন একজনের সঙ্গে আরেকজনের দেখা হয়েছে, তখন প্রথম অনুভূতিটি ছিল এক ধরনের বিষাদময়। কারণ, সারাদেশে একজন মানুষও ছিল না, যার কোন না কোন আপনজন বা প্রিয়জন সেই যুদ্ধে মারা যায়নি। একাত্তর পরবর্তী বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম কল্পনাও করতে পারবে না, স্বাধীনতার জন্য দেশের মানুষ কত বড় আত্মত্যাগ করেছে। বাঙালীর সুমহান মুক্তি-সংগ্রামের ভয়াবহ দিনগুলোর ঘটনাপ্রবাহ ও মুক্তি-সংগ্রামীদের গৌরবগাথা ও পাক-হানাদারদের বীভৎস হত্যাযজ্ঞের ধারাবাহিক বিবরণ দৈনিক জনকণ্ঠ আজ থেকে প্রকাশ করছে। আজ একাত্তরের ১ এপ্রিল ‘প্রতিরোধযুদ্ধ বিষয়খালী’
১৯৭১ সালের ১ এপ্রিল দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। দিন যত এগোচ্ছিল যুদ্ধের তীব্রতা তত বাড়ছিল। পাক হানাদারদের অমানুষিক অত্যাচার-নির্যাতন, গুম-হত্যায় দেশের মানুষ কিছুটা বিচলিত হলেও মুক্তিযোদ্ধাদের কঠোর মনোবল ভাঙতে পারেনি। যুদ্ধকালীন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হতো- ‘বীর বাঙালী অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’। দেশব্যাপী যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। স্বাধীনতা সংগ্রামের এই দিনে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ ও পাহাড়ের ওপর অবস্থানকারী পাকিস্তানী বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর সংঘাত মারাত্মক আকার ধারণ করে। তীব্র আক্রমণের মুখে মুক্তি সেনাদের অবস্থান ছেড়ে দিতে হয় এবং রাতে মুক্তিসেনারা কালুরঘাটে চলে আসে। সন্ধ্যায় ইপিআরসহ মুক্তিবাহিনী টাঙ্গাইল থেকে নাটিয়াপাড়া গিয়ে ঘাঁটি স্থাপন করে। পাকিস্তানী বাহিনীর অত্যাচারের মুখে দলে দলে লোক নিজ মাতৃভূমি বাংলার সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের শরণার্থী শিবিরগুলোতে আশ্রয় নেয়। এ দিন সিনেটর এ্যাডওয়ার্ড কেনেডি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে পাকিস্তান কর্তৃক সামরিক সাহায্য চুক্তির শর্তাবলী লঙ্ঘনের কথা উল্লেখ করেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সরকার ও জাতিসংঘকে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও মানবিক সমস্যাগুলোর সমাধানকল্পে উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানান। চট্টগ্রাম রেলওয়ে বিল্ডিং এলাকায় পাকিস্তানী বাহিনীর সঙ্গে ইপিআর বাহিনীর সংঘর্ষ বাধে। নায়েব সুবেদার মোহাম্মদ আলী আকবরের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা বগুড়ার আড়িয়াল বাজারে অবস্থিত পাকিস্তানী বাহিনীর ‘এ্যামুনিশন ডাম্প’ আক্রমণ করে। এতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেনসহ ২৪ জন সৈন্য ও তাদের পরিবার আত্মসমর্পণ করে। রাতে ক্যাপ্টেন মতিয়ূর, সুবেদার ফরিদ, ইপিআর বাহিনীর ৬০ জনের মতো জওয়ান ও অন্যান্য সৈন্য নিয়ে ‘ডাঙ্গা’ নামক স্থানে ‘হাইড আউট’ বসিয়ে মর্টার দিয়ে রামপুরায় অবস্থানকারী পাকিস্তানী বাহিনীর ওপর গোলাবর্ষণ শুরু করে। কর্নেল ব্যানার্জি ঠাকুরগাঁও আসেন। সিরাজুল ইসলাম এমপিএসহ তিনি শিবগঞ্জ বিমান ঘাঁটি, ইপিআরদের অগ্রবর্তী ঘাঁটি পরিদর্শনসহ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে দিক নির্দেশনা দেন। বিদ্যুত বিভাগের প্রকৌশলী মি. রেজা নিজেই ১০ মাইলে স্থাপিত পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন স্টেশনের টাওয়ারে উঠে বিদ্যুতবাহী তার বিচ্ছিন্ন করে দেন। আবুল হাসনাত ভেলার নেতৃত্বে ঠাকুরগাঁও সুগারমিলের শ্রমিকদের সহায়তায় জনগণ শিবগঞ্জ বিমানবন্দরের রানওয়েতে বড় বড় গাছ কেটে ফেলে রাখেন।
একাত্তরের এই দিন দুপুর সাড়ে বারোটায় হানাদার পাকিস্তানী বাহিনী ঝিনাইদহের বিষয়খালী আক্রমণ করল। মুক্তিবাহিনী প্রধান মাহবুব প্রতিরোধ বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হলেন বিষয়খালী অভিমুখে। উভয়পক্ষে সামনা-সামনি যুদ্ধ হলো। কামানের গোলা ব্যর্থ হয়ে গেল মুক্তিবাহিনীর অসীম সাহসের কাছে। হানাদার পাকিস্তানী বাহিনী বিষয়খালী নদী অতিক্রম করতে না পেরে ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেল যশোর ক্যান্টনমেন্টে। এটাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম সমর। বাংলাদেশের ইতিহাসে যুদ্ধ বিজয়ের গৌরবের প্রথম মাইলফলক স্থাপন করল এই বিষয়খালীর যুদ্ধে। এই যুদ্ধের কাহিনী প্রথম বিদেশী রেডিও বিবিসি, ফরাসী বার্তা সংস্থা এবং অস্ট্রেলীয় রেডিও এবিসিতে প্রচারিত হয়। কুড়িগ্রাম জেলায় স্থানীয় পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ, ছাত্রজনতা এবং ইপিআরদের নিয়ে একটি সম্মিলিত বাহিনী গড়ে তোলা হয়। এরপর শুরু হয় অস্ত্র সংগ্রহ এবং মুক্তিবাহিনী গঠন ও প্রশিক্ষণ। মহকুমার সকল সীমান্তের ইপিআর বাহিনীকে অস্ত্রসহ কন্ট্রোলরুমে ক্লোজ করে আনা হয়। অস্ত্র সংগ্রহ ও ইপিআর ক্লোজের প্রথম সূচনা করা হয় ভূরুঙ্গামারী থানার জয়মনিরহাট বিওপি ক্যাম্প থেকে। কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট শহরকে পাকবাহিনীর আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য ১ এপ্রিল তিস্তা ব্রিজের পূর্ব পাড়ে প্রতিরক্ষা ব্যুহ গড়ে তোলা হয়। ভারত সীমানার কাছাকাছি ঝিনাইগাতীর রাংটিয়া কুম্ভিপাতার ক্যাম্পে স্থাপন করা হয় প্রশিক্ষণ শিবির। এ শিবিরে প্রথম ব্যাচে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন শেরপুরের ১২ জন নির্ভীক যুবক। এই দিন ভারতীয় বিএসএফের পূর্বাঞ্চলীয় অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার ভিসি পান্ডের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ২য় ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়ক মেজর কেএম সফিউল্লাহ হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলাধীন তেলিয়াপাড়া চা-বাগানকে নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে টার্গেট করে ৪র্থ বেঙ্গলের সঙ্গে যৌথভাবে সদর দফতর স্থাপন করেন। বিকেলে ব্রিগেডিয়ার ভিসি পান্ডে তেলিয়াপাড়া হেড কোয়ার্টারে লেফটেন্যান্ট কর্নেল এসএম রেজা, মেজর কেএম সফিউল্লাহ, মেজর খালেদ মোশাররফ ও মেজর শাফায়াত জামিলের সঙ্গে দেখা করে কর্নেল ওসমানীর সীমান্ত অতিক্রম ও ৮ম ইস্ট বেঙ্গলের বিদ্রোহে নেতৃত্বদানকারী মেজর জিয়াউর রহমানের রামগড়ে অবস্থান নিয়ে সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম চালিয়ে যাবার সংবাদ দেন। রাত ১০টায় একটি মালবাহী পুরনো রাশান AN ১২ সামরিক বিমানে তাজউদ্দীন আহমদ, আইনজীবী আমীর-উল ইসলাম, গোলোক মজুমদার ও বিএসএফের নিরাপত্তা অফিসার শরদিন্দু চট্টোপাধ্যায় সঙ্গোপনে নয়াদিল্লীর পথে রওনা দেন। আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ভারতের জনগণ পূর্ব বাংলার পাশে সংসদে প্রস্তাব’ শিরোনামে এক সংবাদে বলা হয়, ‘ভারতের জনগণ পূর্ব-বাংলার পাশে আছে। ৩১ মার্চ বুধবার সংসদে সর্বসম্মত এক প্রস্তাবে বলা হয়েছে যে, ওদের সংগ্রাম, ওদের আত্মবিসর্জন ব্যর্থ হবে না ভারতের সর্বান্তকরণ সহানুভূতি এবং সাহায্য ওরা পাবেন। এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সংসদের উভয় কক্ষে তুমুল হর্ষধ্বনি ওঠে উল্লাস বয়ে যায়। দুই পৃষ্ঠাব্যাপী প্রস্তাব উত্থাপন করলেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী স্বয়ং। তাতে পূর্ব-বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানকে অভিনন্দিত করা তো হলোই, উপরন্তু অভিব্যক্ত হলো তাঁরা যে জয়যুক্ত হবেন এই দৃঢ় বিশ্বাস ও আশা।
প্রকাশঃ দৈনিক জনকণ্ঠ