10436
Published on মার্চ 27, 2019ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরীঃ
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া নামক এক অজপাড়াগাঁয়ে যে শিশুটি জন্মগ্রহণ করেছিলেন, কালের পরিক্রমায় তিনি হয়ে উঠেছেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা; হাজার বছরের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ বাঙালি; স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের স্থপতি; বাঙালির একমাত্র মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই মহান ব্যক্তি এখন শুধু বাঙালির বঙ্গবন্ধু নন, বিশ্ব মানবতার প্রতীক, মুক্তিকামী-স্বাধীনতাকামী-নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষের শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে এক অবিনাশী আলোকবর্তিকা বিশ্ববন্ধু শেখ মুজিব। যে কারণে কিউবার ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন, আমি হিমালয় দেখিনি, আমি মুজিবকে দেখেছি। বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ, বাংলাদেশ মানেই বিশ্বমানচিত্রে সর্বোচ্চ সংখ্যক আত্মবিসর্জনের স্মারক- লাল-সবুজের পতাকা।
বিবিসি বাংলা বিভাগ কর্তৃক পরিচালিত বিশ্বব্যাপী বাংলা বিভাগের শ্রোতাদের জরিপে তিনি বিবেচিত হয়েছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। শ্রোতাদের মতামতের নির্যাস ছিল, 'তিনি ছিলেন বাঙালি জনগণের অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগের আলোর বাতিঘর। তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, বাঙালিদের স্বার্থের জন্য আপসহীনতা শুধু বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমার মধ্যে নয়, সারাবিশ্বের বাঙালিদের প্রথমবারের মতো ঐক্যবদ্ধ করে এবং তিনিই তাদের জাতীয়তা দিয়েছেন। সারা পৃথিবীর বাঙালি, যারা বাংলাদেশের নাগরিকত্ব লালন করেন, তারা এক ব্যক্তির নেতৃত্বের কাছে এই জাতীয়তার জন্য ঋণী এবং তিনি শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়া অন্য কেউ নন' (মিঞা রহমান :২০১৭)।
যে অসাধারণ অমিয় বাণীটি বঙ্গবন্ধুকে বিশ্বসভায় অত্যন্ত সুদৃঢ়ভাবে সুমহান মর্যাদায় আসীন করেছে তাহলো, তাঁর 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' গ্রন্থের স্বগতোক্তি, 'একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত, তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনৈতিক এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।' অতএব বলা যেতে পারে, বঙ্গবন্ধু হচ্ছেন অবিচল মানবধর্মের অন্যতম স্রষ্টা।
আমরা সবাই অবগত আছি যে, বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র রচয়িত হয়েছে চারটি প্রধান স্তম্ভের ওপর ভিত্তি করে। বাংলাদেশ গণপরিষদে ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর খসড়া শাসনতন্ত্র অনুমোদন উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু তাঁর অসাধারণ ও যুগান্তকারী ভাষণে বাংলাদেশের জনগণের প্রতিনিধিরা জনগণের ভোটের মারফতে গণপরিষদে এসে দেশের প্রথম শাসনতন্ত্র প্রদানের পটভূমি ব্যাখ্যা করেন। ভাষণে বঙ্গবন্ধু তদানীন্তন ভারতবর্ষে স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীরাই বেশি রক্তদান করেছেন বলে দাবি করেন। যুব বিদ্রোহ, সিপাহি বিদ্রোহ সব বাংলার মাটি থেকে শুরু হয়েছিল। যুদ্ধ করেছিলেন তিতুমীর, হাজী শরীয়ত উল্লাহ। বঙ্গবন্ধু তাঁদেরসহ ১৯৪৭ থেকে যারা এই দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য দীর্ঘ আন্দোলন, সংগ্রাম এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে জীবন বিসর্জন দিয়েছেন, শহীদ হয়েছেন, সল্ফ্ভ্রম হারিয়েছেন, পঙ্গু হয়েছেন সবার অবদানকে স্মরণ করে তাঁদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে বিশদ বক্তব্যের মাধ্যমে এসব পবিত্র স্তম্ভের যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলেন, 'ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মকর্ম করার অধিকার থাকবে। আমরা আইন করে ধর্মকে বন্ধ করতে চাই না এবং করব না। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রে কারও নেই। হিন্দুরা তাদের ধর্ম পালন করবে, কারও বাধা দেওয়ার ক্ষমতা নেই। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে, খ্রিষ্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদের কেউ বাধা দিতে পারবে না। আমাদের শুধু আপত্তি হলো এই যে, ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না। ২৫ বছর আমরা দেখেছি, ধর্মের নামে জুয়াচুরি, ধর্মের নামে শোষণ, ধর্মের নামে বেইমানি, ধর্মের নামে অত্যাচার, খুন, ব্যভিচার- এই বাংলাদেশের মাটিতে এসব চলেছে। ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না।' এর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু অসাম্প্রদায়িক ধর্মচিন্তার নতুন স্বরূপ উন্মোচন করেন।
হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কে টানাপড়েনের মাঝেই বঙ্গবন্ধু ধর্মভিত্তিক নয়, বরং ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের প্রজ্বলন ঘটিয়ে অন্ধকারের শক্তি সাম্প্রদায়িকতাকে নিধন করে সবার ঐক্যবদ্ধতায় বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সমাজতন্ত্র ও সাম্প্রদায়িকতাকে ঘিরে নানামুখী মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থে (পৃষ্ঠা ২৫৮) বলেছেন, 'জনগণকে ইসলাম ও মুসলমানের নামে স্লোগান দিয়ে ধোঁকা দেওয়া যায় না। ধর্মপ্রাণ বাঙালি মুসলমানরা তাদের ধর্মকে ভালোবাসে; কিন্তু ধর্মের নামে ধোঁকা দিয়ে রাজনৈতিক কার্যসিদ্ধি করতে তারা দেবে না- এ ধারণা অনেকেরই হয়েছিল। জনসাধারণ চায় শোষণহীন সমাজ এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি।' বঙ্গবন্ধু আরও বলেন, 'আওয়ামী লীগ ও তার কর্মীরা যে কোনো ধরনের সাম্প্রদায়িকতাকে ঘৃণা করে। আওয়ামী লীগের মধ্যে অনেক নেতাকর্মী আছেন, যারা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করেন এবং তারা জানেন, সমাজতন্ত্রের পথই একমাত্র জনগণের মুক্তির পথ। ধনতন্ত্রবাদের মাধ্যমে জনগণকে শোষণ করা চলে। যারা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করে, তারা কোনোদিন কোনো রকমের সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস করতে পারে না। তাদের কাছে মুসলমান, হিন্দু, বাঙালি, অবাঙালি সবাই সমান। শোষক শ্রেণিকে তারা পছন্দ করে না। পশ্চিম পাকিস্তানেও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে এ রকম অপপ্রচার করা হয়েছে।'
১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩ সুনামগঞ্জের সভায় বঙ্গবন্ধু অতি আবেগি ভাষণে বলেছেন, 'এ দেশের হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান আপনারা সুখে বাস করবেন। পাশাপাশি বাস করবেন। ভাই ভাই বাস করবেন। কোনোমতে যেন সাম্প্রদায়িকতা বাংলার মাটিতে আর না হয়। তাহলে আমি হার্টফেল করে মারা যাবো। কারণ জীবনভর আমি সংগ্রাম করেছি মানুষের মঙ্গলের জন্য। মুসলমান ভাইয়েরা, আল্লাহ কিন্তু রাব্বুল আল আমিন আল্লাহ, কিন্তু রাব্বুল মোত্তেকিন। সমস্ত মানুষের খোদা। কোনো সম্প্রদায়ের খোদা নয়। তাই আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, সাম্প্রদায়িকের বীজ যেন বাংলার মাটিতে বপন না করে। তাহলে ত্রিশ লক্ষ যে শহীদ হয়েছে ওদের আত্মা শান্তি পাবে না।' উল্লিখিত বিভিন্ন বক্তব্য থেকেই অতি সহজে অনুমেয় যে, বঙ্গবন্ধু যে সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছেন, তার স্বরূপ উন্মোচিত ও পরিপূর্ণতা পাবে, যেদিন বাংলাদেশ প্রকৃত অর্থেই একটি গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, ক্ষুধা-দারিদ্র্য-শোষণমুক্ত মানবিক সমাজের অবস্থানে পৌঁছে বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে।
লেখকঃ শিক্ষাবিদ ও উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
প্রকাশঃ দৈনিক সমকাল