কাল ভয়াল ২৫ মার্চ, জাতীয় গণহত্যা দিবস

7993

Published on মার্চ 24, 2019
  • Details Image

আগামীকাল ভয়াল ২৫ মার্চ, জাতীয় গণহত্যা দিবস। দিনটির স্মরণে জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এ উপলক্ষে আগামীকাল রাত ৯টা থেকে ৯ টা ১ মিনিট পর্যন্ত ১ মিনিটের জন্য জরুরি স্থাপনা ও চলমান যানবাহন ব্যতীত সারাদেশে প্রতিকী ব্ল্যাকআউট কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হবে।

স্কুল, কলেজ এবং মাদ্রাসাসহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কন্ঠে ২৫ মার্চ গণহত্যার স্মৃতিচারণ ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে গণহত্যার ওপর দুর্লভ আলোকচিত্র ও প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হবে।

এছাড়াও ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে নিহতদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে এদিন বাদ জোহর দেশের সকল মসজিদে বিশেষ মোনাজাত এবং অন্যান্য উপাসনালয়গুলোতে সুবিধাজনক সময়ে প্রার্থনার আয়োজন করা হয়েছে।

কেন্দ্রীয়ভাবে এবং সকল জেলা ও উপজেলায় ২৫ মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবস উপলক্ষে আলোচনা সভার আয়োজন করাসহ সারাদেশে গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গীতিনাট্য এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।

জাতীয় সংসদে ২০১৭ সালের ১১ মার্চ ২৫ মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবস পালনের প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হওয়ার পর থেকেই দিনটি জাতীয় গণহত্যা দিবস হিসাবে পালিত হয়ে আসছে।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে বাঙালী জাতির জীবনে এক বিভিষিকাময় রাত নেমে আসে। মধ্যরাতে বর্বর পাকিস্তানী হানানদার বাহিনী অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে কাপুরুষের মত তাদের পূর্ব পরিকল্পিত অপারেশন সার্চলাইটের নীলনকসা অনুযায়ী আন্দোলনরত বাঙালীদের কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়ার ঘৃণ্য লক্ষ্যে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে নিরস্ত্র বাঙালীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।

২৫ মার্চের গণহত্যা শুধু এক রাতের হত্যাকান্ডই ছিলনা, এটা ছিল মূলতঃ বিশ্ব সভ্যতার জন্য এক কলংকজনক জঘন্যতম গণহত্যার সূচনা মাত্র।

অস্ট্রেলিয়ার ‘সিডনি মর্নিং হেরাল্ড’ পত্রিকার ভাষ্য মতে শুধুমাত্র ২৫ মার্চ রাতেই বাংলাদেশে প্রায় ১ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল, যা গণহত্যার ইতিহাসে এক জঘন্যতম ভয়াবহ ঘটনা। পরবর্তী নয় মাসে একটি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার লক্ষ্যে ৩০ লক্ষ নিরপরাধ নারী-পুরুষ-শিশুকে হত্যার মধ্য দিয়ে বর্বর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা পূর্ণতা দিয়েছিল সেই ঘৃণ্য ইতিহাসকে।

তাদের সংঘটিত গণহত্যা, ধর্ষণ, লুন্ঠন, অগ্নিসংযোগ সবই ১৯৪৮ সালের ১১ ডিসেম্বর জাতিসংঘ গৃহীত ‘জেনোসাইড কনভেনশন’ শীর্ষক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তে বর্ণিত সংজ্ঞায় গণহত্যার চুড়ান্ত উদাহরণ।

মার্কিন সাংবাদিক রবার্ট পেইন ২৫ মাচর্ রাত সর্ম্পকে লিখেছেন, ‘সে রাতে ৭০০০ মানুষকে হত্যা করা হয়, গ্রেফতার হয় আরো ৩০০০ লোক। ঢাকায় ঘটনার শুরু মাত্র হয়েছিল। তৎকালীন সমস্ত পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে সৈন্যরা বাড়িয়ে চললো মৃতের সংখ্যা। জ্বালাতে শুরু করলো ঘর-বাড়ি, দোকান-পাট লুট। আর ধ্বংস তাদের নেশায় পরিণত হলো যেন। রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহগুলো কাক-শেয়ালের খাবারে পরিনত হলো। বাংলাদেশ হয়ে উঠলো শকুন তাড়িত শ্মশান ভূমি।”

বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষণে বলা হয়, ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জয়লাভ করা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের কাছে পাকিস্তানী জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর না করার ফলে সৃষ্ট রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনের প্রক্রিয়া চলাকালে পাকিস্তানী সেনারা কুখ্যাত ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নাম দিয়ে নিরীহ বাঙালী বেসামরিক লোকজনের ওপর গণহত্যা শুরু করে। তাদের এ অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগসহ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতা-কর্মীসহ সকল সচেতন নাগরিককে নির্বিচারে হত্যা করা।

এদিন সকালে পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে ৪৫ মিনিটি ধরে বৈঠক করেন।

রংপুর, সৈয়দপুর ও চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর গুলিতে ১১ জন নিহত হওয়ার সংবাদ পাওয়া যায়। সেনাবাহিনীর এ হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু ২৭ মার্চ সারা দেশে হরতাল আহ্বান করেন।

দুপুরের পর থেকেই ঢাকাসহ সরারদেশে থমথমে অবস্থা বিরাজ করতে থাকে। এদিন সকাল থেকেই সেনা কর্মকর্তাদের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মত। হেলিকপ্টার যোগে তারা দেশের বিভিন্ন সেনানিবাস পরিদর্শন করে বিকেলের মধ্যে ঢাকা সেনানিবাসে ফিরে আসে।

ঢাকার ইপিআর সদর দফতর পিলখানাতে অবস্থানরত ২২তম বালুচ রেজিমেন্টকে পিলখানার বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিতে দেখা যায়।

এদিন মধ্যরাতে পিলখানা, রাজারবাগ, নীলক্ষেত আক্রমণ করে পাকিস্তানি সেনারা। হানাদার বাহিনী ট্যাঙ্ক ও মর্টারের মাধ্যমে নীলক্ষেতসহ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা দখল নেয়। সেনাবাহিনীর মেশিনগানের গুলিতে, ট্যাঙ্ক-মর্টারের গোলায় ও আগুনের লেলিহান শিখায় নগরীর রাত হয়ে উঠে বিভীষিকাময়।

এদিন পাকিস্তানি হায়েনাদের কাছ থেকে রক্ষা পায়নি রোকেয়া হলের ছাত্রীরাও। ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব ও জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. মনিরুজ্জামানসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ৯ জন শিক্ষককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। ঢাবির জগন্নাথ হলে চলে নৃশংসতম হত্যার সবচেয়ে বড় ঘটনাটি। এখানে হত্যাযজ্ঞ চলে রাত থেকে সকাল পর্যন্ত।

বিশিষ্ট নজরুল গবেষক ও বাংলা একাডেমির সাবেক পরিচালক অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম থাকতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নীলক্ষেত আবাসনের ২৪নং বাড়িতে। ওই বাড়ির নিচে দু’পায়ে গুলিবিদ্ধ দুইমা তাদের শিশু সন্তানকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সিঁড়ি ভেসে যাচ্ছিল তাদের রক্তে। পাক হানাদাররা ভেবেছিল অন্য কোন দল হয়ত অপারেশন শেষ করে গেছে। তাই তারা আর ওই বাড়িতে ঢোকেনি। অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম তখন প্রাণে বেঁচে যান।

পরে এ নিয়ে স্মৃতিচারণ করে লিখেন অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, তাদের বাড়ির নিচে আর একজন অবাঙালী অধ্যাপক থাকলেও তিনি ২৫ মার্চের আগে কাউকে না জানিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যান। শুধু তাই নয়- বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকার সব অবাঙালী পরিবার তাই করেছিলেন। এ থেকেই ধারণা করা যায়-২৫ মার্চের এই হত্যাযজ্ঞের পূর্বাভাস অবাঙালীরা জানতো।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অপারেশন সার্চ লাইট পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সকল পদক্ষেপ চূড়ান্ত করে গোপনে ঢাকা ত্যাগ করে করাচি চলে যান।

সেনা অভিযানের শুরুতেই হানাদার বাহিনী বাঙালী জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের আগে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং শেষ শত্রু বিদায় না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাবার আহ্বান জানান।

বঙ্গবন্ধুর এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাঙালী জাতি পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং দীর্ঘ নয়মাস রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র লড়াই শেষে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পূর্ণ বিজয় অর্জন করে। বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের।

 

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত